রাত দশটার মতো বাজে। হৃদয় তার ল্যাবে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। মাত্র ছয় মাস আগে সে এই ইউনিভর্সিটির পিএইডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। তার সুপারভাইসারের সাথে মিলে প্রাথমিকভাবে ফাউলিংয়ের উপর একটা মডেল দাঁড় করাতে চাচ্ছে। গত সপ্তাহে মডেলের একটা খসরা সুপারভইসারকে পড়তে দিয়েছিল। আজ সকালে প্রফেসর নিজের রুমে ডেকে মডেলটার উচ্চসিত প্রশংসা করেছে। বলেছে, মডেলটা রিসার্চ আর্টিকেল হিসাবে পাবলিশ হবার জন্য প্রায় রেডী। সমস্যা শুধু একটাই। মডেলে কন্টিনজেন্সীর সংখ্যা বেশ কম। হৃদয় শুধু থিকনেসটাকেই ফাউলিংয়ের লিমিটেশন হিসাবে দেখিয়েছে। যদি আরেকটা কন্টিনজেন্সী মডেলে যোগ করা যায় তাহলেই পেপারটা পাবলিকেশনের জন্য পাঠিয়ে দেয়া যাবে।
ল্যাবে বসে মডেলের উপরই হৃদয় ইন্টারনেটে আর্টিকেল সার্চ করছিল। এমন সময় সে শুনতে পেল কে যেন দরজায় নক করছে। এত রাতে আবার ল্যাবে কে এল রে বাবা? হৃদয় যখন দরজাটা খুলবে কি খুলবে না এমন দোনামোনায় ভুগছে তখন আবারো দরজায় টোকার আওয়াজ পড়ল। ধুত্তুরী, রাতের বেলায়ও কাজ করে শান্তি নেই, দরজায় যে টোকা দিচ্ছে তার চোদ্দগুস্টি উদ্ধার করতে করতে হৃদয় দরজাটা খুলল। একজন ৭০-৭৫ বছরের বুড়ো সবুজ রংয়ের একটা জ্যাকেট গায়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাকেটের বুকের কাছাকাছি ইংরেজীতে M লেখা। বুড়োকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বৃস্টিতে ভিজে এসেছে। বুড়োই প্রথমে তার পরিচয় দিল। আমার নাম মর্গান, ডক্টর মর্গান। দেখ, আমার নামের প্রথম অক্ষর আমার জ্যাকেটের গায়ে লেখা আছে, বলেই সে M অক্ষরের দিকে আংগুল তুলে দেখাল। আমি এই ডিপর্টমেন্টেরই প্রফেসর। কৈফিয়তের সুরে সে বলতে লাগল সরি এত রাতে তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতাও সংগে আনিনি। তোমার ল্যাবে বাতি জ্বালানো দেখলাম, তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলে সময়টা পার করি।
এত রাতে বুড়োকে এ অবস্হায় দেখে হৃদয় যার পর নাই অবাক হল। হৃদয়কে কিংকর্তব্যবিমুরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ো নিজে থেকেই বলল, আমি কি ভিতরে আসতে পারি? হৃদয় এবার লজ্জা পেয়ে বলল অবশ্যই, অবশ্যই। শত হোক ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসরকে কি আর এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। হৃদয় নিজেই মর্গানের দিকে একটা খালি চেয়ার এগিয়ে দিল। ডক্টর মর্গান নিজের কোর্টটা খুলে চেয়ারের হাতলে রাখতে রাখতে বলল বৃষ্টিটা একটু কমলেই বের হব। গাড়ীটা পার্ক করেছি বেশ দূরে। এখানকার আবোহাওয়ার এই এক সমস্যা, বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতে চায় না। বাই দ্য ওয়ে তোমার নামটাই তো জানা হলো না।
-আমার নাম হৃদয়।
-কি দয়?
আমেরিকানদের নিয়ে এই এক সমস্যা, দাঁত ভেঙে গেলেও কেউ হৃদয় উচ্চারণ করতে পারে না। হৃদয় বলল, আমার নামের একসেন্ট খুব কঠিন, তার চেয়ে তুমি বরং আমাকে হি বলে ডাক।
-দ্যাটস গুড। হি নামটা বেশ সোজা। তা তুমি ডিপার্টমেন্টে নতুন এসেছ বুঝি?
-হ্যা, মাত্র ছয় মাস আগে, গত সেমিস্টারেই আসলাম।
-এর জন্যই তোমার সাথে আমার দেখা হয় নি। আমি তো সিক লিভে ছিলাম এতদিন।
- কেন কি হয়েছে তোমার?
-বয়স হয়েছে। বয়স হলে যা যা হবার সবই হয়েছে। প্রায় তিন বছর যাবৎ ভুগছি। বছরখানেক আগে ক্যান্সার ধরা পড়ল, ডাক্তারেরা বলল, অপারেশন করাতে হবে, সেজন্যেই ছুটিতে আছি। আজকেও এদিকে আসতাম না, কিছু জরুরি কাগজ আমার ড্রয়ারে ছিল সেগুলো নিতেই এসেছি। দিনেই আসব ভেবেছিলাম, কিন্তু আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। বুড়ো মানুষ তো, যে কোন কাজ করতে প্রচুর সময় লাগে। যাক আমার কথা বাদ দাও, তুমি এত রাতে ল্যাবে বসে কি করছ?
- একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছি, ওটার রেজাল্ট নিতে এসেছি।
-গুড। তা কি নিয়ে রিসার্চ করছ?
- আমি মেমব্রেন ফিল্ট্রেশনের সময় অরগানিক মলিকিউলের ফাউলিংয়ের উপর কাজ করছি।
-গুড। কলোয়ডাল ফাউলিংয়ের উপর আমারও কিছু কাজ আছে। একদিন সময় পেলে আমার পেপারগুলো তোমাকে দেখাব।
হৃদয় বলল, অবশ্যই।
মর্গানের সামনে বসে হৃদয় ভাবছে, এত রাতে বুড়োটা আর কাউকে পেল না, এসেছে আমার সাথে গল্প করতে। কি গল্প করব এই আমেরিকান বুড়োর সাথে? হৃদয়কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ডক্টর মর্গানই আগ বাড়িয়ে বলল, চলো দেখি তোমার এক্সপেরিমেন্টাল এ্যাপারেটাস কেমন ডিজাইন করেছ? অসুখে পড়ার পর ডিপার্টমেন্টে তেমন আর আসাও হয় না, নতুন নতুন কাজের খবরও রাখা হয় না। ডক্টর মর্গানের উৎসাহ দেখে হৃদয় একটু চিন্তাতেই পড়ে গেল, সে কিছুদিন আগে মাত্র কাজ শুরু করেছে, এখনো সব গুছিয়ে উঠতে পারে নি, এর মধ্যে এত বয়স্ক একজন প্রফেসরকে সে কি বলতে কি বলে ফেলে, তারপর মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি। হৃদয়কে চিন্তিত দেখে ডক্টর মর্গান হেসে ফেলল, বলল, ইয়াং ম্যান, এত সংকোচ করছ কেন? নিজের রিসার্চের কাজ দশজনকে দেখাবে, তাদের মতামত নেবে তবেই না তোমার জ্ঞান বাড়বে।
কি আর করা, এত উৎসাহী মানুষকে তো আর নিবৃত করা যায় না। অগত্যা হৃদয় ডক্টর মর্গানকে এ্যাপারেটাসের সামনে নিয়ে এতদিন সে কি কি এক্সপেরিমেন্ট করেছে তার একটা ফিরিস্তি দিতে লাগল, ডক্টর মর্গানও বেশ উৎসাহ নিয়ে হৃদয়ের কথা শুনছে। হৃদয়ের কথা শেষ হতে ডক্টর মর্গান বলল, 'গুড, ইয়াং ম্যান ভলোই কাজ করছ তুমি।' আমরা বুড়ো হয়ে গেছি, বিজ্ঞানকে দেবার মতো আর কিছুই নেই আমাদের। এখন তোমাদের সময়। তোমরাই এখন বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বুড়োর এত উৎসাহ দেখে হৃদয় ভাবল, আচ্ছা মডেলের কন্টিনজেন্সীর ব্যাপারে তো এই বুড়োকেও প্রশ্ন করা যায়। বুড়োটা যখন বলছে সে কলয়ডাল ফাউলিংয়ের উপর কিছু কাজ করেছে, এই ব্যাপারে তার নিশ্চয় কিছু ধারনা আছে।। হৃদয় ডক্টর মর্গানকে বলল, 'ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?' মর্গান বলল অবশ্যই, নির্দ্বিধায়। হৃদয় বলল, আচ্ছা, মেমব্রেনের উপর স্কেল ফরমেশনের সময় ফাউলিংয়ের লেয়ারের থিকনেস ছাড়া আর কোন লিমিটিং ফ্যাক্টার থাকতে পারে বলে কি তোমার মনে হয়?' কথাটা শুনে ডক্টর মর্গানকে একটু চিন্তিত মনে হল, উত্তরটা খুঁজতে একটু সময় নিল যেন তারপরই সে বলে উঠল, কমপাক্টনেসের কথা কি চিন্তা করেছ কখনো? উত্তরটা শুনে হৃদয় প্রচন্ড ধাক্কা খেল, তাইতো এদিকটায় তো চিন্তা করা হয় নি। কম্প্যাক্টনেস তো অবশ্যই একটা লিমিটিং ফ্যাক্টর হতে পারে। উত্তরটা শুনে হৃদয় খুবই খুশী। আগামীকালই সে তার প্রফেসরকে বলতে পারবে তাদের মডেলে আরো একটা কন্টিনজেন্সী যোগ করা যায়। মর্গান যে হৃদয়ের কত বড় উপকার করল সে নিজেও বোধ হয় তা জানে না। কি বলে ডক্টর মর্গানকে ধন্যবাদ দেয়া যায় তাই ভাবছে হৃদয়। ডক্টর মর্গান যেন হৃদয়ের মনের কথা টের পেয়েছে, সে বলল, এত উত্তেজিত হবার কিছু নেই হি, তার চেয়ে চল, তুমি বরং আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াও। কফি মেশিন আছে তোমাদের ল্যাবে?
হৃদয় বলল, হ্যা আছে, কি কফি খাবে ব্ল্যাক, না উইথ কফি মেট?
-ব্ল্যাক, বৃষ্টির দিনে জমবে ভাল।
কফি খেয়ে মর্গান হৃদয়ের বেশ তারিফ করতে লাগল। সে নাকি এমন কফি অনেক দিন খায় নি। কফি খাওয়ার পর কিছুক্ষন এ কথা সে কথা বলে ডক্টর মর্গান হৃদয়কে বলল, ইয়াং ম্যান এবার আমাকে উঠতে হবে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, আর বৃষ্টিও বোধ হয় থেমে গিয়েছে। তা তোমার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ। কীপ আপ ইওর গুড ওয়ার্ক। আবারো হয়তো আমাদের দেখা হবে।
উত্তরে হৃদয় বলল, হ্যা আমিও কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠব। আশা করি তুমি দ্রুত সুস্হ হয়ে উঠবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বুড়োটি বলল এ অসুখ আর সারবার নয়, এটা নিয়েই মনে হয় আমাকে কবরে যেতে হবে। আমাদের তো দিন শেষ। এখন তোমার মতো ইয়াং ম্যানদের দিন। তোমরাই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বুড়োটি চলে যাবার পর হৃদয়েরও আর ল্যাবে মন টিকল না। প্রফেসারকে আগামীকালই কম্প্যাক্টনেসের কথাটা বলতে হবে। রিসার্চের কাগজ পত্র গুছিয়ে নিয়ে সেও বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
পরদিন সকাল ঠিক নয়টায় হৃদয় তার প্রফেসারের দরজায় নক করল।
- কাম ইন প্লিজ, দরজা খোলাই আছে।
রুমে ঢুকে হৃদয় দেখল তার সুপারভাইসার গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছে । প্রফেসারকে ব্যস্ত দেখে হৃদয় চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময়, আর্টিকেল থেকে চোখ না সরিয়েই প্রফেসার বলে উঠল, যা বলতে এসেছিলে বলে ফেল। আমি তোমার কথা শুনছি। হৃদয় বলা শুরু করল, ডক্টর, তোমার দেওয়া সমস্যা নিয়ে আমি গতকাল চিন্তা করেছি, শুধু থিকনেসই নয়, কম্প্যাক্টনেসও একটা লিমিটিং ফ্যাক্টর হতে পারে। হৃদয়ের কথা শুনে সুপারভাইসার চোখ তুলে হৃদয়ের দিকে তাকাল, বাহ চমৎকার আইডিয়া। ভালো সমাধানই বের করেছ তুমি। হৃদয় ভাবল এ ব্যাপারে পুরো কৃতিত্বটা তার একার নেয়াটা উচিৎ হবে না। সে বলল, আসলে এটা আমার মৌলিক চিন্তা নয়, এটায় ডক্টর মর্গানও সাহায্য করেছেন। কথাটা শুনে সুপারভাইসার জিজ্ঞেস করল, কোন মর্গান, আমাদের ডিপার্টমেন্টের মর্গান?
-হ্যা
-তুমি তার কোন পেপার থেকে আইডিয়াটা পেয়েছ?
-তার পেপপার নয় --, হৃ দয় আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রফেসার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-ভালই হোল তুমি মর্গানের প্রসঙ্গটা তুলেছ, তুমি জান তো আগামী মাসে আমরা তার নামে ডিপার্টমেন্টে একটা মেমরিয়াল স্কলারশিপ খুলতে যাচ্ছি। হৃদয় ভাবল সে বোধ হয় ভুল শুনেছে, তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল, মেমোরিয়াল স্কলারশিপ?
-হ্যা, মর্গান তো আট মাস আগে ক্যানসারে মারা গেছে। খুব ভালো প্রফেসর ছিল, তাই আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার নামে একটা মেমরিয়াল স্কলারশিপ খুলছি।
প্রফেসারের কথাগুলো শুনে হৃদয়ের শিঁরদাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এল। নিজের কানকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজেকে কোনভাবে সামলে নিয়ে সে ল্যাবে ফিরে এল। নিজের চেয়ারে বসতেই হৃদয় দেখতে পেল তার সামনের চেয়ারের হাতলে মর্গানের সবুজ জ্যাকেটটা ঝুলছে। জ্যাকেটের বুকের কাছাকাছি ইংরেজীতে লেখা M জ্বল জ্বল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-sahoshi6
মন্তব্য
অসাধারন হয়েছে !
আফসোস, আমার সাথে এরকম কেউ দেখা করতে আসে না ...
- এনকিদু
রহস্য গল্প! ভাল হয়েছে
নতুন মন্তব্য করুন