আপন ভূবন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৪/০৫/২০০৮ - ৬:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একজন পুরুষ কিংবা নারী কেন আকস্মাৎ ছেড়ে যায় তার আপন হাতে গড়া আর হৃদয়ের মমতা দিয়ে আগলে রাখা সুদীর্ঘ কালের অধ্যবসায়ে যে সংসার, যেখানে সে নিজেই তার অধিপতি,
একজন পুরুষ কিংবা নারী কেন অকস্মাৎ ছেড়ে যায় তার আপন হাতে গড়া আর হৃদয়ের মমতা দিয়ে আগলে রাখা সুদীর্ঘ কালের অধ্যবসায়ে যে সংসার, যেখানে সে নিজেই তার অধিপতি, একচ্ছত্র সম্রাট অথবা সম্রাজ্ঞী? কেন লহমায় তার কাছে মনে হয় এ অন্ত:সার শূন্য, অর্থহীন এক মায়াজাল; নিজ হাতে তৈরী করা কঠিন ফাঁস? আজ এমন অনেক কেনরই উত্তর জানা নেই নাজুর।
সুদীর্ঘ বিশ বছরের টানা সাধনায় গড়ে তোলা তার আপন ভূবন কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কূটচালে হাতছাড়া হতে বসেছে। কী তার অযোগ্যতা? নাকি সে ফুরিয়ে গেছে, স্বামীর কাছে শূন্য হয়ে গেছে তার আবেদন? হতে পারে, এ আর বিচিত্র কি? কিন্তু তার স্বামী খোকন পাটোয়ারী কী এমন যোগ্যতার বলে মধ্য ত্রিশের একজন নারীর চোখে আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে?
নাজু নিজে কি পারবে কোনো মধ্যত্রিশের বা চল্লিশোর্ধ কোনো পুরুষের চোখে নিজকে আকর্ষনীয় করে তুলতে পারবেন? পারবেন কি কোনোভাবে কোনো যুবকের মনোযোগ আকর্ষন করতে? কী করে? তা ছাড়া একজন বিগত যৌবনা নারী কোন কৌশলে, কোন মায়াজালে বহিমূখি স্বামীকে ধরে রাখতে পারবেন? তেমন কোনো রহস্যের সন্ধান তার জানা নেই। জানা নেই, কী করে একজন ষাটোর্ধ পুরুষ নিজকে তারুণ্যে ভরপুর রাখতে পারে!
যৌবনে খোকন পাটোয়ারীর সাথে যখন নাজুর বিয়ে হয়, তখন সে বাইশ বছরের টগবগে তরুণী। খোকন পাটোয়ারীর বয়স কত হবে? বড় জোর আঠাশ-ত্রিশ! এর বেশি ভাবতে মন সায় দেয় না কিছুতেই। বিয়ের পরপরই স্বামীর মা-বাবা ভাই বোনের বিশাল একটা পরিবারের সাথে যুক্ত হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিরো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। যেখানে হাসা-কাঁদা, খাওয়া-শোওয়ার কোনো স্বাধীনতা ছিলো না। ছিলো না এককভাবে কিছু ভোগ বা উপভোগ করার। সারাদিন পর রাত এগারোটার আগে স্বামীকে কখনো কাছে পায়নি। নব বিবাহিতা এক তরুণী, যে সারাক্ষন মননে কাটে স্বপ্নের আঁকিবুকি আর সাজায় হাজারো কথার বর্নিল ফুলঝুড়ি; সে যদি চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বরণ করতে হয় স্বামীকে আর তা যদি চলতে থাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, সেখানে আর যাই হোক সজীব প্রাণের অস্তিত্ব বিলিীন হতে খুব একটা সময় লাগে না। তার মা একদিন বললেন, ‘তুই আলাদা না থাকতে পারলে এ রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে পারবি না।’
অভাবগ্রস্ত আর জটিল মানসিকতা পূর্ণ একান্নবর্তী পরিবার থেকে স্বামীকে আলাদা করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। খাওয়ার পাতে বসে কিছুটা চোখের পানি খরচ করতে হয়েছিলো শুধু। তারপর থেকে আক সপ্তাহও কাটেনি, কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারে সাবলেট ঘর নিয়ে সে শুরু করেছিলো নিজের একক সাম্রাজ্যে বাস। কিন্তু সেখানেও বর্গীদের মত শ্বশুর আর পঙ্গপালের মত দেবরদের সময় অসময়োচিত উৎপাত। সে থেকে অবশ্য এত সহজে তার মুক্তি ঘটেনি। যে জন্যে তাকে ব্যায়ও দিতে হয়েছে অনেক। সময়ে কঠোরও হতে হয়েছে। স্বামীকে চোখে চোখে রাখতে যেয়ে কখনো বাপের বাড়ি গিয়ে একরাত থাকা হয়নি। এক ঘেয়েমি কাটাতে কখনো যেতে পারেনি দূরে কোথাও।
ছোট ছোট দেবর-ননদগুলো বড় হয়ে যার যেমন জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সে কিছুটা দম ফেলবার সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু বিধাতা তার এ সুখ হয়তো পছন্দ করেন নি। সে কারনেই হয়তো তার স্বামী-সন্তান নিয়ে একাকী থাকার বাসনা তাকে আজ নিঃস্ব করতে চলেছে। শেষ জীবনে একাকী একটা ঘরে মরে পড়ে থাকতে হবে, কেউ জানবে না, দেখবে না।কিছুদিন পর লাশে পচন ধরলে পড়শীরা টের পাবে। তারপর সৎকার হবে লাশের। তাও হয়তো যারা বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করে তাদের হাতেই পড়তে হবে। অবস্থা-দৃষ্টে তার এ কথাই মনে হচ্ছে। আর এ কথা যখন মনে হয়, তখনই ভয়ে তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে।
একবার শুভকে কোনো এক কারনে কথা কাটাকাটির কোনো পর্যায়ে বলেছিলো যে, বিধাতা যেন কখনোই তার স্বামীকে তাদের কাছে কখনো হাত পাতার কাজ না লাগান। সে কথা শুনে ভিভে কামড় দিয়েছিলো শূভ। সেটা সে কেন করেছিলো, তা আগে কখনো অনুমান করতে পারেন নি নাজু। কিন্তু এখন সর্বস্বান্ত হবার আগে এসে তার মনে হচ্ছে সেদিনের আস্ফালন আর আজকের এ ব্যর্থতার কথা ভেবেই হয়তো শুভ সেদিন এমন করেছিলো। কিন্তু অনেক বছর হয়ে গেলো শুভ এদিকে আসে না। হয়তো নাজুর বর্তমান পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা সে জানে না। জানলে হয়তো বলতে পারতো যে, সেদিন কাকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলে? সে কি তোমার আছে?
একথা বলার মনের জোর বা সাহস আজকাল কোনোটাই পান না তিনি। বিশেষ করে মনেরই কোনো নাগাল পান না। আজকাল নষ্টালজিয়া তাকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
বাড়িতে তিনি সারাক্ষনই একা। দু ছেলে-মেয়ের মধ্যে মেয়েটা আমেরিকা পড়তে আর এমুখো হয়নি। ছেলেটা দেশে থাকলেও চাকরি আর অফিসের ছুতোয় বাইরে বাইরেই সময় কাটায়। পিতার কার্যকলাপে সে যারপর নাই ক্ষুব্ধ। বিয়ের কথা শুনলে জ্বলে উঠে তেলে বেগুনে। বলে, ‘বাবাকেই আরেকটা করাও!’
আত্মজের মুখে এমন কথা-বার্তা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে হয় নাজুর। এ মুখ কাউকে দেখাবার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেন। তিনি ভেবে পান না যে, কী দোষে, কোন ভুলের মাসুল হিসেবে তার সাজানো সংসার এমন ভাবে তছনছ হতে চলেছে? এর সদুত্তর খুঁজতে অনেক ভেবেছেন নাজু। কিন্তু প্রত্যাশিত ফলাফলের চাইতে ব্যাপরটা জটিলের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। একদিন কথায় কথায় মেয়ের কাছে অসাবধানে স্বামীর বহিমূখি হবার ঘটনা বলে ফেলেছিলেন, তারপরই একদিন বাপ বেটিতে ফোনে কথাকাটাকাটি। এক পর্যায়ে পিতার সংলাপ, ‘তুই আমার সাথে আর কোনোদিনও কথা বলবি না!’ সেই থেকেই বলতে গেলে সংসার থেকে অন্তর্হিত স্বামী খোকন পাটোয়ারী।
কিন্তু মানুষ যেখানেই আত্মগোপন করে থাকুক না কেন, দেওয়াল চুইয়ে কিছু না কিছু খবর বাইরে বেরিয়ে আসবেই। আর সেভাবেই নাজুর কানে এসেছে যে, বিধবা অথবা স্বামী-পরিত্যাক্তা এক কলিগকে নিয়ে নতুন সংসার পেতেছে তার স্বামী। তার সত্যমিথ্যা নিয়ে হিসেব কষতে মন চায় না তার। বিশ বছরের সংসার জীবনে স্বামী পথভ্রষ্ট হবে বা তারই অগোচরে কাজের মেয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে, সে ভয়ে রাতে কখনো দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি তিনি। দিনে রাতে একা ঘরে স্বামীকে দিয়ে যেতে কখনো ভরসা পান নি। এত সতর্কতা আর সাবধানতায় কী লাভ হয়েছে তার? মাঝখান দিয়ে জীবনের কতগুলো দামী সময় অপচয় হয়ে গেল। তার স্বামী যদি তার অলক্ষ্যে নষ্ট বা বেপথু হয়ে যেতো, তাতে কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? এই যে এখন বুড়ো বয়সে এসে লোকটা চুলে, গোঁফে মাঞ্জা লাগিয়ে,কেডস-জিন্স আর টি-সার্টে নিজকে শাণিত করে চলাফেরা করে, তাতে কেউ তো তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে না যে, তোমাকে এসবে মোটেও মানাচ্ছে না! তার উপযুক্ত পোশাক ও প্রসাধন এমন হওয়া উচিত নয়! বরং সবাই তার দিকেই আঙুল উঁচিয়ে বলবে, ‘দেখ, মহিলার স্বামী নিয়মিত ঘরে থাকে না। মহিলা নিজে ব্যর্থ হয়েছে নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে।’
শুভর নামে কানাঘুষা শোনা যায় যে, ঘর সংসার সামলিয়েও তার প্রেমিকাদের সময় দিতে পারে সে। এ নিয়ে তার স্ত্রী রায়নার কোনো অনুযোগ নেই। তার মনের ভাব, গোয়াল থেকে গরু বেরিয়ে গেলে এর ওর ক্ষেতে মুখ দেবেই। আর গেরস্থের লাঠি খেলে ফের গোয়ালে ফিরে আসবে ঠিকই! রায়না কেমন মেয়ে? তার তো কোনো কমতি হচ্ছে না? নাকি বেশির ভাগ মেয়েরাই এমন, স্বামীদের স্বেচ্ছ্বাচার মেনে নিয়েই আত্মমর্যাদাহীন ইতরপ্রাণীর মত সংসার করে যায়। কিন্তু নাজু নিজে কেন এমন হতে পারলেন না! নাকি তেমন হতে হলে বুকের বল ও ভরসা দুটোই থাকতে হয়? অথবা বিপুল ভালোবাসার আসুরিক শক্তিতে হারানোর ভয়কেও অবজ্ঞা করা যায়! এর কোনোটাই এতকাল খতিয়ে দেখেন নি নাজু। তিনি নিজে কেমন আর অন্য মেয়েরা কেমন? এর তুলনা অথবা পার্থক্য বের করতে যেয়ে প্রতিবারই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সাফল্য আসেনি কোনোবারই। বরং প্রতারিত হয়েছেন হাস্যকর ভাবে।
শুভ যখন এখানে থেকে লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন চাকরি করেছে। তখন পুরোনো কাজের বুয়া পাপিয়া, যে বিয়ে করাকে ঘৃণা করে। ঘৃণা করে পুরুষদের। তবুও তাকে অনেকবার সাবধান করেছিলো শুভ সম্পর্কে। পুরুষ মানুষ কখন কি করে বসে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ শুভ বেসামাল না হলেও পাপিয়া নিজকে তার কাছে সমর্পণে ব্যার্থ হয়ে অভিযোগ করে বলেছিলো, ‘আপনের দেবর হিজড়া নাকি?’
এ থেকেই নাজু শুভ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখেছিলেন। শুভ কাজের বুয়ার কথায় নির্ভর করতে পারেনি বা তার রুচিতে বেধেছিলো। কোনো কোনো পুরুষ আছে, যারা নারী দেখলেই হামলে পড়ে না বা যে কোনো নারী লোভ দেখালেই আধ হাত জিভ বের করে লালা ঝরাতে থাকে না। শুভ হয়তো সে শ্রেনীর পুরুষ। নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তা না পেলে দুর্গম পথের যাত্রী হতে চায় না। এ ধরনের লোকেরা কলঙ্ককে ভীষন ভয় পায়।
বেলা কখন গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত হয়ে গেছে বলতে পারবেন না নাজু। এই ব্যর্থতায় ক্লান্ত শরীর আর বেদনা বিধ্বস্ত মন নিয়ে তার বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় জগতের যাবতীয় ভর এসে তার শরীরে চেপে বসেছে। ছেলেটা অফিস থেকে ফিরলো কিনা সেটাও একবার দেখা প্রয়োজন। কিন্তু তার সে ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই হয় না। মনে মনে ভাবেন যে, তাকে দেখলে হয়তো ছেলের মনে ঘৃণার জন্ম হতে পারে। ছেলে ভাবতে পারে, যে নারী তার সন্তানের জন্মদাতাকে মায়ার জালে আবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়, ঘরকে নিরাপদ আর বিস্বস্ত আশ্রয় বানাতে ব্যর্থ হয়, সে নারী মা হিসেবে কতটুকু সাফল্যের দাবী করতে পারে?
এ ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হতেই নাজুর চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। আঁচল দিয়ে দুচোখ চেপে ধরেন। ছেলেকে দেখার জন্য বিছানা থেকে নামার কোনো আগ্রহ বোধ করেন না। (সমাপ্ত)

-জুলিয়ান সিদ্দিকী


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

জুলিয়ান সিদ্দিকীঃ
গল্পটি ভালো লেগেছে। আশা করছি আগামীতে আরো লিখবেন। একটু অনুরোধ করি, পড়তে গিয়ে বারবার চোখে লাগলো - প্যারাগুলো একটার কাঁধে আরেকটা জাঁকিয়ে বসেছে। খানিক সময় নিয়ে স্পেসিং - বানান ঠিক করে নিলে পাঠক হিসেবে আর তৃপ্ত হতাম।
ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তনের সিস্টেমটা জানতেই সময় পেরিয়ে গেল। তা ছাড়া প্রাথমিক ভাবে একটু দেখার ব্যাপারও ছিলো। পোস্ট করার পর ব্যাপারটা ধরা পড়েছে। কিন্তু অতিথি বলে সম্পাদনার সুযোগ নেই। সচল হওয়ার পর দেখি, সম্পাদনার সুযোগটা পাই কি না। ধন্যবাদ।

তীরন্দাজ এর ছবি

ভাল লাগলো আপনার গল্পটি। প্রথম মন্তব্যের প্রতি আমারও সহমত!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

আগামীতে সচেষ্ট হবো। অতিথি বলে কিছুটা সমস্যায় আছি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।