আমাদের বাংলাদেশের মানুষ ভ্যালেন্টাইন ডে-তে আনন্দ করা এবং প্রিয়জনের সঙ্গে দিনটির আনন্দ বা তাৎপর্য ভাগাভাগি করার ব্যাপারটা শিখেছে খুব বেশি দিন হয়নি। তা ছাড়া পত্রিকার পাতায় ঠোটখাট নিউজ আকারে অমুক দিবস তমুক দিবস সম্পর্কে লেখা হতো। তবে বিভিন্ন দিবস সম্পর্কে আমার যদ্দুর মনে হয় প্রথম আলোর বন্ধুসভাই অগ্রনী ভূমিকাটা পালন করেছে। ওরা বিভিন্ন দিবসের উপর বন্ধু সভার পাতায় লেখালেখি করে আসছে। তা ছাড়া নতুন নতুন টিভি চ্যানেলের কল্যাণেও বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠান দেখে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি দিনটির প্রতি। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা যেটার প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তা খুব সহজেই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যায়। আর এ দিনে বলতে গেলে ওরা তাদের প্রিয়জনদের নিয়ে বিভিন্ন পার্কে, রেস্তোরায়, পাবলিক প্লেসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলা যায় এ দিনটিতে তাদের ভালোবাসা উথলে উঠতে থাকে।
তো মাসিতার সাথে অনেক আগে থেকেই একটি সু-সম্পর্ক বজায় ছিলো। যা আমার বিয়ের পরও কেমন করে যেন অটুট থেকে যায়। সেই সুবাদে এখনো বছরে দুবছরে তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তবে সে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হয়ে গেলে আমার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হতো কিনা বা আমার সাথে সে যোগাযোগ রক্ষা করতো কি না জানি না। যেহেতু এখনো সে কারো পুরোপুরি অধিকারে চলে যায়নি, সেহেতু আমার সাথে তার যোগাযোগ রক্ষায় তেমন কোনো অসুবিধা হয়তো হয় না। মাঝখানে অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে তার সাথে আমার কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎ ফেব্র“য়ারির প্রথম সপ্তাহে সে আমাকে ফোনে জানালো যে পরের সপ্তাহেই সে ঢাকা আসছে। আমার সাথে ভ্যালেন্টাইন যেটা শেয়ার করবে বলে। কিছু না ভেবেই আমি বলে ফেলি, ঠিক আছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ও প্রান্তে রিসিভার রাখার খটাস শব্দে চমকে উঠে ভাবি, ভ্যালেন্টাইন ডে যেন কবে? দিন-তারিখের ব্যাপারগুলো আমার মাথায় কিছুতেই থাকতে চায় না। সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, দিনটা চৌদ্দই ফেব্র“য়ারি। সেদিন কি সরকারি ছুটির দিন? ওরা আমার কথা শুনে গলা ফাটিয়ে হাসে। আরে মিয়া, আপনে কোন দুনিয়ায় বাস করেন?
আরো লজ্জা পেতে হবে ভেবে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। দিনটার কথা ভুলে যেতে পারি ভেবে নোট বুকে লিখে রাখি ভি.ডি চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি। ওই দিনটিতে দীর্ঘদিন পর মাসিতার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। সেই দিনটিতে আমার আমিকে ভুলে গিয়ে ভিন্ন এক মানুষ হয়ে উঠবো। মুক্ত থাকবো স্ত্রী-সন্তান-সংসার নামক মায়াজাল থেকে। প্রাত্যহিক একঘেয়েমী থেকে বের হয়ে শ্বাস টেনে নেবো বুক ভরে। কন্ঠ ছেড়ে গান গেয়ে উঠতে পারবো যে কোনো মুহূর্তে। ইচ্ছে হলে পার্কের সবুজ ঘাসের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চোখ রেখে হারিয়ে যেতে পারবো আপন ভূবনে। সন্দেহ মাখা দৃষ্টি নিয়ে আমার স্ত্রী রায়না থাকবে না পাশে। কিংবা আমার খুঁতগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করবার জন্য শকূনের দৃষ্টি মেলে অপলক তাকিয়ে থাকবে না আমার দিকে। রায়নার বিশ্রী ইচ্ছেগুলোর কাছে নতজানু আমার রুদ্ধশ্বাস জীবনে মাসিতা যেন ছোট্ট একটি খোলা উঠোন। অথবা বলা যায় চৈত্রের খরাদহে একখন্ড মেঘ। যেভাবেই বলি না কেন, সে যখনই আমার কাছে আসে, সাথে করে নিয়ে আসে আনন্দ; কিছুটা মুক্তিও। কাজেই তার সঙ্গ কোনো কিছুর বিনিময়েও হারাতে চাই না। স্ত্রী বিনা ভিন্ন নারীর সঙ্গ যদি পাপ হয় আর সেই নারীটি হয় মাসিতা, তাহলে সেই পাপেই আমার অপার আনন্দ। যে আনন্দে কোনো ক্লান্তি নেই, দায় নেই। মুদিঅলার মত খেরো খাতা খুলে নাক-মুখ গুঁজে হিসেব-নিকেশের বালাই নেই। যেহেতু আমি বিত্তবান কেউ নই, সেই হেতু আমার আনন্দের ব্যাপারগুলোও খরচের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না কখনো। সে জন্য আমাকে অতটা শঙ্কিতও হতে হয় না।
তেরই ফেব্রুয়ারি মাসিতা আবার ফোন করে জানালো, সে তার বোন অজন্তার বাসায় উঠেছে। সম্ভব হলে অফিস ফেরত যেন তার সাথে দেখা করি। বিকেল পাঁচটার পর কমলাপুর রেল স্টেশন ছাড়িয়ে বাসাবোর দিকে যাই। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে সময় কাটাই। অজন্তার বাসার দরজায় টোকা দেই। সাথে সাথেই এক ঝলক মুক্ত হাওয়ার মত মাসিতা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমি ফের প্রাণ চাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠি।
তারপর আমাদের সময় কাটে নিরন্তর কলগুঞ্জনে। আগামী কালের পরিকল্পনায়। কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় তার একটি হিসেবি ছক কাটি। সব যদি ঠিক মত চলে তাহলে আগামী দিনটি আমার জীবনে আরেকটি আনন্দঘন দিন হিসেবে সঞ্চয় হয়ে থাকবে। ফিরে আসবার সময় মাসিতা আমাকে বাস স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসে। আমার ইচ্ছে হয় না তার সঙ্গ ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে। তবুও ফিরে আসি। আর অনেকদিন পর খুব ভালো একটা ঘুম হয়। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখি।
এমনিতেও বছরের দু একটা রাত হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভূত কোনো স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্নবৃত্তান্ত ভুলে যাই। কিন্তু এবার কিছুই ভুলে যাবার মত নয়। একটি সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে জাগার পর অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হই ধীরে-সুস্থে। আমার এই সামান্য পরিবর্তনও রায়নার দৃষ্টি এড়ায় না। বলে, ব্যাপারটা কি?
আমি অবাক হয়ে তাকাই।
সরু চোখে তাকিয়ে রায়না বলে, অন্যান্য দিনের চাইতে কিছুটা যেন ব্রাইট মনে হচ্ছে?
মনেমনে বলি, আমার অন্ধকার বুকের ভেতর একটি ছোট্ট পিদীম জ্বলছে! কিন্তু মুখে বলি, ঘুমটা ভালো হয়েছে।
প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় রায়না দুপুরের খাবার ব্যাগে দিয়ে দেয়। আজ বলি, ব্যাগ আজ আর নেবো না।
রায়না বিস্মিত হয়ে বলে, কাল বললে না কেন?
মনে ছিলো না।
ঝাড়া হাত পা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনো বাস আসতে দেখি না। আস্তে-আস্তে লোকজনের ভীড় বাড়ে। আমি অসহিষ্ণু হয়ে পাশের এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করি, কি ভাই, গাড়ি-টাড়ি কইমা গেল নাকি?
ভদ্রলোক বললেন, এগারো দল আজ হরতাল ডেকেছে। আপনি জানেন না?
তখন আমার চেহারা নিশ্চয়ই বাংলা পাঁচের মত দেখাচ্ছিলো। ভদ্রলোক কেমন গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি মুখ ব্যাদান করে ঠোঁট উল্টাই। আর তখনই পেট ঠাসা যাত্রী নিয়ে একটি মিনিবাস এসে থামে। লোকজনের হুটোপুটিতে আমি একদিকে ছিটকে পড়ি। বেশ কয়েকটা বাস চলে যায়। আমি স্টেশনেই দাঁড়িয়ে থাকি।
বেলা সাড়ে দশটার দিকে লোকজনের ভীড় পাতলা হয়ে এলে আমি বাসে উঠতে পারি। কিন্তু মতিঝিল এসে বাসটার চালক জানায় বাস আর যাবে না। ফের আরেক বাসে মহাখালী। সেখান থেকে উত্তরা। তিনবার বাস বদল করে শেষ পর্যন্ত অফিসে পৌঁছুতে পারি। হরতালের দিন বলে দেরিতে অফিসে এলেও কারো ঝাড়ি শুনতে হয় না। রিসিপশনিষ্ট শান্তা জানালো যে, দশটার দিকে আমার একটা ফোন এসেছিলো।
জিজ্ঞেস করি, মেল না ফিমেল?
ফিমেল।
শান্তার নি®প্রাণ কণ্ঠস্বর আমার উৎসাহ নষ্ট করে দেয়। আমার টেবিলে এসে বলতে গেলে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকি। কাজ কাম তেমন নেই। একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও আমার সময় কাটে না। খুবই গদাই লস্করী চালে কাজ করেও তিনটার আগেই শেষ হয়ে যায়। হাতে কোনো কাজ না থাকাতে ভেতরের ছটফটানি আরো বাড়ে। শেষটায় চারটার দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি।
অফিসে আসবার সময় যত না কষ্ট করতে হয়েছে, এখন ফিরতে আরো দ্বিগুণ কষ্ট করতে হবে। কারণ এখনকার গন্তব্য ভিন্ন। কিছুটা পথ হেঁটে, কিছুটা বাসে-ভ্যানে আর রিক্সায় করে যখন বাসাবো গিয়ে পৌঁছোই, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
আমার সঙ্গে ঘুরতে বের হবে বলে, মাসিতা অজন্তার লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরেছিলো। সেজেছিলো যত্নে। খোঁপায় জড়ানো বেল ফুলের মালা ম্লান হয়ে গেছে। কপালের লাল টিপ এক পাশে ধেবড়ে গেছে। কাজলটানা চোখের অবস্থাও তথৈবচ। হয়তো কান্নাকাটি করেছে।
আমি কাঁচুমাচু মুখে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াই। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। গারো সম্প্রদায়ের মেয়ে বলে তার নাক চেপ্টা, মোটা ঠোঁট, ফোলা ফোলা গাল-চোখ। এমনিতেই ভালো লাগে। কিন্তু সাজ নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তাকে দেখাচ্ছিলো কিম্ভূত। কিন্তু রাগলে যে তাকে এতটা বিচ্ছিরি দেখায় তা আগে কখনো দেখবার সুযোগ হয়নি। তার সাথে দেখা করতে এলে সব সময় পকেটে করে চকলেট বা চুইংগাম জাতীয় কিছু নিয়ে আসি। আজ তার চেহারা দেখে ওসবের কিছু বের করতে উৎসাহ পাই না। সে আমার দিকে রক্তাভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর তখনই হঠাৎ বলে উঠে, এখন কেন আসছো? আসবার আর দরকার কি ছিলো?
হরতালের দিন রাস্তায়...
আমি কৈফিয়তের সুরে বক্তব্য শুরু করলেও শেষ করতে পারি না। কথার মাঝ পথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বললো, তোমার সাথে আমার কোনো কথা নাই! যাও!
তারপরই সে আমার মুখের উপর খটাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।
আমার কষ্ট হয় এই ভেবে যে, কতটা কষ্ট আর ঝুঁকির পর আমি এখানে এসেছি, সে সম্পর্কে কিছু জানতে না চেয়ে সে তার বস্তাপচা অভিমান নিয়েই বসে আছে। একবার তার জানতে ইচ্ছে হলো না যে, হরতালের দিন উত্তরা থেকে বাসাবো কিভাবে এলাম?
আমার অভিমান আর রাগ দুটোই ফেনিয়ে উঠলেও আহত কুকুরের মত রাস্তায় নেমে আসি লেজ গুটিয়ে। পুনরায় দরজায় করাঘাত করতে আগ্রহ বোধ করি না। সন্তাপিত হৃদয়ে ভাবি, আমার স্ত্রী রায়না হলে কি এমনটি করতে পারতো? (সমাপ্ত)
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
মন্তব্য
হা হা হা
না রে ভাই !
বউ হইলে পারতো না। বউ আবার অনেক কিছু করতে পারে, যা আবার তিনি করতে পারবেন না।
স্ত্রীদের থাকে অনেক অনেক রাগ, কিন্তু এইটার আছর মনে হয় কম। আর প্রেমিকাদের অভিমান, এইটার প্রভাব-প্রতিপত্তির কোন সীমা পরিসীমা নাই...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আপনি কেমন বউ ?
আপনি হলে কি করতেন ?
হা হা হা
ঘরের কথা পরে জানলে চলবো ক্যামনে?
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
@সুলতানা পারভীন শিমুল ।
ভালো বলেছেন। তবে সব ক্ষেত্রেই দেখেছি কোনো এক অদৃশ্য মায়া বলে স্ত্রীরাই কিছুটা নমনীয়। সেই সঙ্গে নির্ভরযোগ্যতো বটেই। তাদের রাগের ওজন আছে। প্রেমিকার রাগের মত অর্থহীন নয়। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
মানব সভ্যতার একটা বিরাট ব্যাপার হলো সবাই যার যার বোহেমিয়ানী শেষ করে আবার নীড়ে ফিরে আসে। চেনা সেই গন্ডীতে চেনা বৃত্তে। সেই জন্যই বোধ হয় সংসারগুলো টিকে যায়।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
খাঁটি কথা। সংসার যে একটি নিরাপদ আশ্রয়, বেশির ভাগ স্ত্রীরাই যে সর্বংসহা- কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। আর তাই জুলিয়ানের মত দুষ্টু স্বামীরা যাই করে বেড়াক না কেন, হেথা-হোথা ঠোক্কর খেয়ে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় ও নির্ভরতা খোঁজে রায়নার মত স্ত্রীদের কাছেই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
নতুন মন্তব্য করুন