আমার জন্য যার ভালোবাসা রাত্রিদিন তড়পায় বুকের নিভৃত খাঁচায়। যার অক্ষিগোলক নিরবচ্ছিন্ন ঘুরপাক খায় আমাকে কেন্দ্র করেই। আমি বুঝি তার অনুরাগ। প্রণয়ের আহ্বান। কিন্তু বুঝলেই বা হবে কি? এই যে সামাজিক, পারিবারিক আর সম্পর্কের জটিল বন্ধন। তা থেকে যে মুক্ত হতে পারি না। দাম্পত্য জীবনে বিশ্বস্ত থাকার কথা পরস্পর। তবু সেই বিশ্বস্ততার ফাঁক গলিয়ে আমিও যে তাকে ভালবাসি। কিন্তু তার যেমন মুখ ফোটে না, আমারও তেমনি। কিন্তু ভালবাসি তাকেও। তবে তার ভালোবাসা খুবই গোপন। কিন্তু পারিবারিক আবহে ম্লান।
বর্ষা এলেই আমি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি। হয়ে যাই ভিন্ন কোনো মানুষ। তুমুল বৃষ্টির দিনে নিজকে হারিয়ে ফেলি আরেক জগতে। যখন রাস্তায়, ফুটপাতে বা দর-দালানের কার্নিশে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ে চারদিকে ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমার øায়ু সমূহে যেন বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। সে মুহূর্তে একা থাকলে ভীষন হতাশায় মুষড়ে পড়ি। প্রবল আকর্ষণে ঘর আমাকে টানতে থাকে। প্রিয় নারীর বুকের ওম আমাকে হাতছানি দেয় বারবার। খুব করে পেতে ইচ্ছে করে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে। সে যেমনি হোক। কারণ প্রতিটি নারীরই থাকে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ও রুচি বোধ। সে কারণেই কোনো নারীকে হুট করে অসুন্দরী বলাটা নির্ঘাত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। সাধারণের চোখে অসুন্দর নারীটিরও এমন কোনো একটি শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য আছে, যা কেবল তার প্রতি বিমুগ্ধ হতে পারলেই দৃষ্টি গোচর হয়। না হলে, রবীন্দ্রনাথের মত এত বড় মাপের একজন কবি কালো মেয়েকে নিয়ে কবিতা লেখার মত এমন অর্থহীন কাজটুকু করতেন না।
ভাইজান তাঁর ত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গিনী, নাজু বেগমকে রেখেই প্রথম বিয়ে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ আর পরাস্ত নারী এবং রূপের তুল্যমূল্যে সাধারণের কাছে অস্বস্তিকর; সেই সুইটি নামের অপরূপার প্রেমে ঘোল খেলেন একযুগ। কেন? তা কি এমনি এমনিই? শুধু কি তাই? গোপনে বিয়ে করে সুখের সংসার সাজিয়ে বসে আছেন খিলগাঁর কোনো এক ভাড়া বাড়িতে। কেন? এর নামই মোহ। ভালবাসা। আকর্ষণ!
নিঃসঙ্গতার আবহে বর্ষাকে উপভোগ করতে চাওয়ার মানে নির্বাসনে পড়ে থাকার মত যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে ছটফট করা ছাড়া আর কিছু নয়। কাজেই বৃষ্টির অঝোর বর্ষণের যে মুগ্ধতা, তা উপভোগ্য করে তুলতে নারীসঙ্গ খুবই প্রয়োজন। নারীকে তাই প্রয়োজন তার সঙ্গে উপলব্ধির বিনিময় করবার প্রয়োজনে। তার প্রগাঢ় চুম্বনে নিজকে সিক্ত করে তুলতে না পারলে, তার উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজকে আড়াল করতে না পারলে, বর্ষার আনন্দটা বোধ হয় বৃষ্টির জলেরই মত পানসে। আর সে অর্থে মেয়েদের তুলনা চলে বর্ষার সঙ্গেই। তাদের মনও বুঝি বর্ষাকালের বৃষ্টির মতই। নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর যাদের মানসিকতা। যাদের মন কখনো কখনো হয়ে ওঠে বর্ষার কদমফুলেরই মত। তাই বর্ষাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বৃষ্টিকে। কারণ, এই বৃষ্টিই একদিন মাসিতাকে ঠেলে দিয়েছিল আমার কাছে। যদিও দীর্ঘকাল তার দিকে দু’হাত প্রসারিত করে রেখেছিলাম নিবিড় আলিঙ্গনে তাকে অভিষিক্ত করবো বলে। কিন্তু স্বেচ্ছায় সে কখনোই এগিয়ে আসেনি, ধরা দেয়নি দু’বাহুর বেষ্টনীতে। এমন একটি দুরূহ ব্যাপারকে সহজ করে দিতে মধ্যস্থতা করেছিল বর্ষা ঋতুটিই। যার অপার বিস্ময়ের আরেক দিক হচ্ছে অবিরাম বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টির অবিরল ধারায় ধ্বসে পড়েছিল তার যাবতীয় কপট গাম্ভীর্যের মাটির দেয়াল। বৃষ্টির তোড়ে উম্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল আমার প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণকে প্রতিহত করে রাখবার নানামূখী অর্গল। আমি ঋদ্ধ হয়েছিলাম বর্ষার কাছেই।
প্রথম যৌবনে যখন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন সে ক্লাস এইট পড়–য়া একজন উচ্ছ্বল কিশোরী মাত্র। তার দেহমনে তখনো যৌবন হানা দেয়নি। চোখের পাতায় ঠাঁই নেয়নি নারীসূলভ গাঢ়তর লজ্জার মদির কাজল। কিন্তু মদনের পঞ্চশর তাকে কৈশোরের কোনো এক ফাঁকে ছুঁয়ে গিয়ে থাকলেও হয়তো সে খেয়াল করেনি। কিন্তু তবুও কোনো এক মুগ্ধতার কাছে নিজকে সমর্পন করেছিল সে। যে মুগ্ধতার উপলক্ষ্য ছিলাম আমিই। যা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল এগার বছর। শুধু এগার বছরই বা বলি কী করে, বোধ করি ইহজীবনেও তা আমার সামনে তার রহস্যের নেকাব উম্মোচন করতো না, যদি না সেদিন আমরা দুজন জাতীয় জাদুঘরের আর্ট এগ্জিবিশানে যেতাম। যদি না তুমুল বৃষ্টির উল্লসিত প্রতিবন্ধকতায় আমাদের বেরিয়ে আসবার পথ রুদ্ধ হতো। হয়তো সেদিন আগেকার মতোই হুডখোলা রিক্সায় কমলাপুর স্টেশনে এসে অতি সাধাসিধে ভাবে আমরা যে যার পথে ফিরে যেতাম। পরস্পরের দিকে হাত উঁচু করে নাড়তাম পরবর্তী কোনো এক সময় পুনরায় সাক্ষাতের প্রত্যাশায়। আর এভাবেই একটি অতি সাধারণ দিন আমাদের কাছে অসাধারণ আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বর্ষার বদান্যতায়; তুমুল বৃষ্টির নূপুর নিক্কণে।
শুরুটা অবশ্য সেই করেছিল। আমি কেবল তার সাথে সাথে তাল বা ঠেকা দিয়ে গেছি। প্রধান ভূমিকা নিয়ে অবতীর্ণ হতে পারিনি একবারের জন্যেও। পরিচয়ের প্রাথমিক পর্বে একবার সে খুব করে ধরলো যে, তাকে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানা দেখাতে হবে। যেহেতু ঢাকার বাইরের এক মফস্বলের মেয়ে হলেও আগে কখনো সে চিড়িয়াখানা দেখেনি, তাই সেখানে যাবার আগ্রহ বা কৌতুহল থাকা তার জন্যে স্বাভাবিক। তো একদিন সকালের দিকেই তাকে নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম। তখন ছিলো শীতকাল। সেখানকার জলাশয়ে ছিলো পরিযায়ী পাখিদের উল্লাস। আমাদের চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। বিশেষ করে মাসিতার মাঝে আরেকটা ব্যাপার কাজ করছিলো, যার নাম বিস্ময়। এত সুন্দর সুন্দর পাখি দেখে সে প্রথমে হতবাক। তারপর একটা একটা পাখি দেখে আর বিমুগ্ধ বিস্ময়ে মুখে, গালে হাত নাচের মুদ্রায় চাপা দিয়ে বিচিত্র ধ্বনিতে তার মনোভাব ব্যক্ত করে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমরা ময়ূরের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াই। নীল রঙের পেখম মেলবার ক্ষমতা সম্পন্ন ময়ূরটি যে পুরুষ, সে কথা দিন কয়েক আগেই পত্রিকার পাতায় পাখি বিষয়ক এক প্রবন্ধ পড়ে জেনেছিলাম। তাই সেদিনের কিশোরী সঙ্গিনীর কাছে নিজের পান্ডিত্য ফলাতে বলি, ‘জানিস, আগে ভাবতাম সুন্দর ময়ূরটি নারী। আসলে কদাকার হাঁসের মত দেখতে যেটি, সেটিই হচ্ছে নারী। পুরুষ ময়ূরটি কী সুন্দর দেখেছিস?’
সে বিস্ময় প্রকাশ না করে কন্ঠে মুগ্ধতার মাধুরি ঝরিয়ে বলেছিলো, ‘পুরুষই তো সুন্দর!’
অথচ আমরা যে কোনো পুরুষই মেয়েদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাই। কিন্তু দৃষ্টির সে মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েরা সব পুরুষের দিকে তাকাতে পারে না। মেয়েদের মুগ্ধতা কেবল তাদের পছন্দের পুরুষের জন্যে আর নারী মাত্রেই পুরুষের দৃষ্টির খোরাক হয়। পুরুষ মুগ্ধ হয়। নাকি সে মুগ্ধতায় থাকে শুধুই কামনা অথবা শুধুই লোভ? পুরুষ ময়ূর সম্পর্কে মাসিতার মন্তব্য শুনে আমি সেদিন বুঝতে পারিনি যে, তার মুগ্ধতা যাবতীয় পুরুষদের জন্যেই, নাকি বিশেষ কোনো একজনের জন্যে! পরবর্তী দিনগুলোতে সময় আর মননের নিষ্পেষণে আমার বোধোদয় হলেও পেছন ফিরে যাবার কিংবা প্রায়শ্চিত্ত করবার সময়-সুযোগ কোনোটাই ছিলো না। তাই দীর্ঘদিন পর দুজনে একত্রিত হলে, অভ্যাস বশে অথবা নিরাপত্তার জন্যে শাহবাগ চলে আসি। শাহবাগ মোড় থেকে সেই দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পথটুকুই আমাদের ভরসা। অন্য কোথাও সহজ হতে পারি না। মনের ভেতর ভয় সিরসির করে; এই বুঝি পরিচিত কেউ পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাচ্ছে, “সাথে এটি কে?”
আমাদের শহরবাসী সিংহভাগ মানুষই গ্রাম্যতা মুক্ত হতে পারেনি আজো। তাদের অযাচিত কৌতুহল অন্যের বেডরুম পর্যন্ত চষে বেড়ায়।
পাঁচ ছ’জন তরুণ শিল্পী তাদের চিত্রকর্ম নিয়ে জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে। আমি এসব না বুঝলেও বিচিত্র রঙের কারিশমায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না। প্রদর্শনীতে অনেকগুলোই চমৎকার প্রতিকী চিত্র ছিল। সেগুলোর মাঝে আমার দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল একটি চিত্রকর্মে। যেখানে দিগম্বর এক যুবকের গলার উপরিভাগে মানুষের মাথার বদলে আঁকা হয়েছিলো শিংঅলা ছাগলের মাথা। গলায় গাঁদা ফুলের মালা। যে ‘কোরবানী’ বা ‘কতল’ কিংবা ‘বলি’ হবার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। পাশে চকচকে শাণিত ছুরি হাতে লম্বা কোর্তা পরিহিত, গায়ে জড়ানো আরবি রুমাল, শম্রু ও টুপি আবৃত ধারালো দাঁতের ক’জন মানুষ ক্রূর হাসিমুখে চকচকে দৃষ্টিতে তাকে অবলোকন করছে।
চিত্রকর্ম দেখা শেষ হলে মাসিতাকে বলি, ‘চল, বেরিয়ে পড়ি। রাত বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে ফিরতে দেরি হলে অন্যরা তোর জন্যে দুশ্চিন্তা করবে।’
মাসিতা ঘড়িতে সময় দেখে আৎকে ওঠে। ‘সর্বনাশ, সাড়ে আটটা!’ বলে, প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও গেটের কাছে সে থমকে যায়।
গেটের সামনে এক টুকরো বারান্দায় প্রচুর মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কেমন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। আমি কাছাকাছি আসতেই ও বললো, ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। লোকজন সব আটকা পড়েছে মনে হয়।’
উঁকি দিয়ে দেখি, সত্যিই তাই। ‘এখন উপায়?’
‘উপায় একটা তো হবেই! তার আগে দেখ বোরোতে পারি কিনা।’
আমরা বের হয়ে এলেও বাইরে বেরিয়ে আসতে পারি না। যে-সে বৃষ্টি নয়। মুষলধারে বৃষ্টি যাকে বলে। মাঝে মাঝে দু’একটা শিলও রাস্তায় পড়ে লাফিয়ে উঠে গড়িয়ে যাচ্ছে টেনিস বলের ভঙিতে।
মাসিতা আমার বাহু ধরে টেনে বলল, ‘এখন বাইরে বেরোনো ঠিক হবে না। দাঁড়াও।’
কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। লোকজনের ভিড়ে প্রচন্ড গরম লাগছিলো। শরীর ঘামছে। মাসিতা আঁচলে ঘাড় মুখ মুছে বলল,‘ এখান থেকে নেমে চলো দেয়ালের পাশে দাঁড়াই। কিছুটা খোলা বাতাস পাওয়া যাবে।’
সেখানেও মানুষ সার বেঁধে দাঁড়ানো। কারো কারো গায়ের ঘাম অথবা ভেজা পোশাকের বিশ্রী দুর্গন্ধে পেট ঘুলিয়ে উঠছিলো। নাকে মুখে হাত চাপা দিয়ে সরে যাই আরো নিরাপদ দূরত্বে।
আমরা দেয়ালের সাথে সরু করে বাঁধানো পাকা অংশটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। বৃষ্টির ঠান্ডা-শীতল-ছাঁট এসে লাগছিলো আমাদের চোখে মুখে। তবুও আমরা দাঁড়িয়েছিলাম দীর্ঘ রাজপথে মানব বন্ধনের ভঙ্গিমায়। ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। সবার সাথে একাত্ম হবার মত। দাঁড়িয়েছিলাম বৃষ্টি থামবার প্রতীক্ষায়।
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল বৃষ্টির উন্মাদনার সাথে নিজেদের শরিক করে নেই। বৃষ্টিধারায় ধূয়ে নেই আমাদের শরীরে জমে থাকা যাবতীয় শ্রান্তি আর ক্লেদ। বৃষ্টির ভেতর দিয়েই ভিজতে ভিজতে পরস্পর হাত ধরে হেঁটে যাই উম্মুক্ত রাজপথে; হেঁটে যাই আমার প্রথম যৌবনের কাব্যময় মুহূর্তগুলোতে। যেখানে মাসিতার শাণিত উপস্থিতি আমাকে অভিষিক্ত করবে নিত্য নতুন প্রণোদনায়। সে প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠবে মুক্ত বিহঙ্গেরই মত।
কিন্তু আমার পৌরুষোচিত যে সাহস, একজন আবেগ বিহ্বলা পরিপূর্ণ নারীর কাছে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের যে শৈল্পিক উপস্থাপনা, বাহারি শব্দের মাধুর্য ও নান্দনিকতার প্রয়োজন, তার কোনোটিই নিজের ভেতর আবিষ্কার করতে পারিনি কখনো। আর পারিনি বলেই আমার প্রিয় নায়িকারা তাদের আবেগঘন মুহূর্তগুলোতে আমাকে পরিচালিত করে তাদের ইপ্সিত পথে। আমি তখন বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে নিজকে তাদের হাতের ক্রীড়নক করে তুলতে পছন্দ করি। ওরাও হয়তো এমনটিই চায়। পিতার সংসার হয়ে স্বামীর সংসার অবধি অন্যের হাতে পরিচালিত হতে হতে তার মননে বাসা বাঁধে অন্য কাউকে পরিচালনার বাসনা। আর এভাবেই অবদমিত চাওয়া-পাওয়ার আড়ালে নারী নিজেরই অজান্তে আসীন হয়ে যায় সঞ্চালকের আসনে।
মাসিতা অধৈর্য হয়ে বলে, ‘আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো?’
বৃষ্টি ততক্ষণে অনেকটা ধরে এসেছে। মাথায় রুমাল দিয়ে দু’একজন করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও বৃষ্টি একেবারে থেমে যায়নি। এখান থেকে বেরিয়ে রিকশাস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে যেতেই ভিজে জবজবা হয়ে যেতে হবে। বললাম, ‘বৃষ্টি না থামলে তো বেরোনো যাবে না।’
‘এখন রাত বাজে দশটা। আর কতক্ষণ?’
তারপর সে আবার বলে, ‘আমার ব্যাগে একটা ছোট ছাতা আছে।’
‘লেডিজ ছাতায় কি আমাদের দুজনের হবে?’
‘বেশ হবে! মাথাটা না ভিজলেই হলো!’
ছোট্ট ছাতা মাথায় আমরা দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে এলোমেলো পদক্ষেপে ছুটে যাই গেটের দিকে। কিন্তু তালাবদ্ধ দেখে হতাশ হয়ে ঠিক একই গতিতে আমাদের ফিরে আসতে হয়। ফিরে এসে শরীক হতে বাধ্য হই পূর্বেকার মানববন্ধনে।
আমাদের নিষ্ফল চেষ্টা সবাই দেখেছে। হয়তো মনেমনে হেসেছেও কেউকেউ। কিন্তু এক কৌতুহলী যুবক যখন বলল, ‘আঙ্কেল, মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায় রাত আটটার সময়। তখন বেরুতে হয় দক্ষিন পাশের সরু গেটটা দিয়ে।’
একরাশ লজ্জা বোধ আমাকে ছুঁয়ে যায় হিমশীতল ঝাঁপটার মতই। আমি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাই। কুঁকড়ে যাই এই ভেবে যে, আমার সঙ্গের তরুণীটি আমার স্ত্রী নয় তা যদি সে আন্দাজ করতে পারে, তাহলে আমাকে বা মাসিতাকে এমনকি দুজনকেই মনেমনে টিটকারি দেবে। এই বয়সে তরুণী প্রেমিকা নিয়ে যাদুঘরে আর্ট একজিবিশান দেখতে এসেছি।
অবশ্য আমি মনে করি এটা তেমন কোনো গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচ্য নয়। আচ্ছা, আটত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়স কি একজন পুরুষের জন্যে খুবই বেশি? এ নিয়ে আমার মনে তেমন কোনো অপরাধ বোধ কাজ করছিল না। প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি যে কোনো বয়সেরই হতে পারে। একজন ছাব্বিশ-সাতাশের আদিবাসী তরুণী যদি একজন আটত্রিশ-চল্লিশের পুরুষকে তার সঙ্গী বা প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তাতে কারো আপত্তি থাকলেও তা খুব একটা জোরালো হবার কথা নয়। আমাদের সমাজ এখনও আড়ালে বলতেই পছন্দ করে। অন্যের অগোচরে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ঘোঁট পাকায়। কাল্পনিক সম্পর্ক বানিয়ে রসালাপে মত্ত হয়। কিন্তু সামনা সামনি বলার মত ততটা দুর্ণিবার হয়নি এখনো।
বৃষ্টি থামলে ভেজা ছাতা হাতে মাসিতা আমার বাহু টেনে বলে, ‘চলো, লোকজন বেরোচ্ছে।’
দেখলাম আলো-আঁধারিতে সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দক্ষিনের ছোট্ট গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মৌণ মিছিলের মত। আমরাও পাশাপাশি হেঁটে যাই ঘনিষ্ঠ হয়ে। অন্যান্য দিনগুলোর চাইতে আজ আরো বেশ খানিকটা আমার দিকে ঝুঁকে আছে সে। এটা কি বর্ষার তারল্যের জন্যে? নাকি দীর্ঘদিনের অসাক্ষাতের ফল? বুঝতে পারি না। গত বছর ভ্যালেন্টাইন দিবসে অফিস থেকে বেরোতে দেরি করেছিলাম বলে সে অভিমান করে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো, ‘যাও, চলে যাও! তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই!’
চলে আসবার সময় এক ঝলক তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। হায়, চোখের কাজল গলে নেমে এসেছে গালে। কপালের টিপ সরে গেছে ডান পাশের ভ্রƒর দিকে। ঠোঁটের লিপস্টিকের রঙ থেবড়ে গেছে। কৃষ্ণ কি রাধার মান ভাঙাতে সচেষ্ট হয়েছিলো?
মনে পড়ে না। আমিও তার মান ভাঙাতে সচেষ্ট হই নি। কারণ সেদিন ছিলো হরতাল। তার অভিমান করবার আগে একবার ভাবা উচিত ছিলো যে, আমি কতটুকু কষ্ট আর ঝুঁকি নিয়ে সেই উত্তরা থেকে বাসাবো এসেছিলাম। তার একবার জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিলো। মানবিক কারণেই সেটা অত্যাবশকীয় ছিলো। আমি সেদিন তার কথায় চলে আসি। ফিরে যাইনি। যোগাযোগ করিনি। তারপর এই-ই প্রথম সাক্ষাৎ।
রাস্তায় উঠে এসেই পথ চলতি গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পাই মাসিতার মুখে বৃষ্টির বিন্দুবিন্দু কণা লেগে আছে শিশিরের মত। চাপা নাক, মোটা ঠোঁট, ফোলাফোলা চোখ-গালের মাসিতাকে এ অবস্থায় নতুন করে আবিষ্কার করি। পাহাড়ী এলাকার কোনো কুটিরের রাত্রিকালীন প্রদীপের মিটিমিটি আলোয় তার সত্যিকার রূপ বাঙময় হয়ে উঠতো সন্দেহ নেই।। কিংবা বনদেবী কখনো লোকালয়ে এলে, এমন বিস্ময়েই বুঝি অবলোকন করতেন মানুষের অসহায়ত্ব। তবে এও সত্যি যে, বনদেবীকে লোকালয়ে দেখতে পেলে কোনো যুবক তাকে প্রেম নিবেদনের সাহস পেতো না। মাঝেমাঝে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, তার অবয়বের কাঠিন্য তাকে অনেক দূরের মানুষ করে রাখে। তাই একবার বলেছিলাম, ‘তোর যেমন বাঘিনীর মত চেহারা, তাতে কোনো সাধারণ ছেলে তোকে প্রোপোজ করতে সাহস পাবে না!’
মাসিতা হেসেছিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলেছিল, ‘প্রোপোজ করবে কি? বরং হেঁটে যাবার সময় পথ থেকে সরে দাঁড়ায়!’
আমি কোনো মন্তব্য করিনি। ভেতরে ভেতরে এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলাম যে, সে কিনা নিরুপায় হয়ে বেছে নিয়েছে আমাকে। যার বয়স এখন জীবনের মধ্য গগণে।
খালি রিকশার আশায় রাস্তার ওপর ধাবমান যানগুলোর ওপর দৃষ্টি বিছিয়ে রাখি। এরই মাঝে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বর্ষাকাল বলে, বৃষ্টির কোনো সময় অসময় নেই। হঠাৎ করেই তার ঝিরিঝিরি অবস্থা ঝমঝমে পরিণত হতে পারে। কাজেই আমাদের কাছে একটি রিকশায় উঠে হুড তুলে দিয়ে বসা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। সে অবস্থায় একটা খালি রিকশা পেয়েও যাই। সুযোগ ফস্কে যেতে পারে ভেবে দরদাম না করেই উঠে পড়ি।
মাসিতা আগের চেয়ে খানিকটা মুটিয়েছে। আমিও। রিকশার সিটে পাশাপাশি বসতে এখন আর তেমন জুত পাই না। রিকশাঅলা তার হ্যান্ডেলের পাশ থেকে একটা ভাঁজ করা পলিথিনের শিট বের করে এগিয়ে দেয়। ‘ইডা দিয়া ঢাইক্যা বইয়েন।’
চার হাতে পলিথিনের ভাঁজ খুলে আমরা নিজেদের আড়াল করে ফেলি। আড়াল করে ফেলি বৃষ্টির তোড় থেকে। এমন কি লোকচক্ষু থেকেও। কিন্তু আমার সাবধানতা যায় না। এক ধরনের ঋজুতা আমার শরীরকে আড়ষ্ট করে রাখে। কারণ, হাত সঞ্চালনের সময় আমার কনুই তার শরীরের কোথাও লাগলেই তার মনে বিরূপ ধারণার জন্ম হতে পারে। ভাবতে পারে ইচ্ছে করে সুযোগ নিচ্ছি। ফলে, চিড় ধরতে পারে এযাবৎকালের স্থির বিশ্বাসে। তবুও অনেকদিন এভাবে আমার মনে সংগোপনে ইচ্ছে জেগেছে তার কাঁধে হাত রাখতে। বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা ক্রিসেন্ট লেকের পাশ দিয়ে হাঁটবার সময় ইচ্ছে হয়েছে একহাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরার। একটু আড়ালে সুযোগমত তার ঠোঁটের উষ্ণতার পরশ নিতে। কিন্তু কোনোবারই সাহসে কুলোয়নি। যদিও বা সাহসী হয়ে উঠতে কখনো চেষ্টা করেছি, তার প্রতিরোধের মুখে ভেস্তে গেছে সব।
একবার তার মাথায় একটা পাকা চুল দেখে তুলবার জন্যে যেই হাত বাড়িয়েছি, অমনি ঝাঁপটা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিয়েছিলো। সেই থেকে মেয়েদের সামনে নিজকে কখনোই দুর্নিবার বা দুর্বিনীত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি। কেমন যেন রুচিতে বাধে। কিছুটা ভয়ও মাকড়সার আঁশের মত জড়িয়ে থাকে মনের দেয়ালে। আমার সম্পর্কে কোনো নারী তার মনে কোনো ধরনের হীন ধারণা পোষণ করুক তা কখনোই কাম্য নয়।
বৃষ্টির বেগ বাড়বার সাথে সাথে আমরা পর্দার ভেতরে থেকেও নিজেদের শুকনো রাখতে না পেরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছিলাম। বৃষ্টি আমাদের চারপাশেই হানা দেয়; হুডের দু‘পাশের ফাঁক দিয়ে, পর্দার উপর ও নিচ দিয়ে। নানা ভাবে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিলো আমাদের গায়। আমার জুতো আর প্যান্টের হাঁটুর নিচের অংশ, মাসিতার পা সমেত শাড়ির পাড়।
অজস্র মিহি বৃষ্টিকণা পর্দার উপর দিয়ে আমাদের দুজনকে বারংবার উঁকি দিয়ে দেখবার ফলে আমার চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আমার দৃষ্টিও লুকোচুরি খেলে। কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। একবার দৃষ্টি ফেরাই মাসিতার দিকে। আর তখনি রাস্তার স্পিডব্রেকার পেরোবার সময় রিকশা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খায়। সেই সঙ্গে আন্দোলিত হয়ে সে হেলে পড়ে আমার দিকে। আর তখনই আমার ঠোঁট স্পর্শ করে তার বৃষ্টি-স্নাত গাল।
আমি শিহরিত হই। বোধ করি সেও। কারণ, আমার পিঠে একহাত রেখে তার গাল পেতে দেয় কাঁধের ওপর। আমার ডানগাল গাল ছুঁয়ে থাকে তার মাথার একাংশ। তার ললাটের পাশের দু চারটি দুরন্ত চুলের গোছা উড়ে এসে আমার নাকে মুখে আশ্রয় খুঁজছিলো বারবার। বৃষ্টির সুসিক্ত স্নিগ্ধ ঘ্রাণ উপেক্ষা করে আমার নিঃশ্বাসে ঠাঁই নেয় তার চুলে মাখা গন্ধরাজ তেলের সুবাস। ধীরে ধীরে আমার কাঁধে তার শরীরের চাপ বাড়ে। আমার অনুভূতি বলে যে, যাবতীয় মেয়েলী বাধা এখন অপসৃত। তাই এই প্রথম সাহসে ভর করে একহাতে তার কোমর বেষ্টন করি। ব্লাউজ আর শাড়ির মধ্যবর্তী উম্মুক্ত অংশের মসৃন পেটের ওপর হাতের তালু রেখে নাভির ওপর আঙুল ছোঁয়াই। কিন্তু নারীর সহজাত প্রতিরোধের সম্মুখীন হই না। তার আকস্মিক প্রশ্রয়ে অভিষিক্ত হই বলে একটি সাহসী ভাবনার শিকড় আমার বিশ্বাসের জমিতে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায় দ্রুত। আমি বুঝতে পারি, এখন ইচ্ছে করলে অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে তাকে হাজারটা চুমুও খেতে পারি। এমনকি তার মাথা আকর্ষণ করে বুকের বাঁ দিকে চেপে ধরে শোনাতে পারি আমার সাহসী হৃদপিন্ডের অনাবিল উচ্ছ্বাস। ভালোবাসার ধা-তিন-তাক! (সমাপ্ত)
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
মন্তব্য
wow ... এত্তভালো লিখেছেন কিছু বলার সাহস পাচ্ছিনা আপনাকে (বিপ্লব)
-------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
আগে একটু মন খারাপ করে নেই। কারণ এটা কোনো পত্রিকার সাময়িকীর পাতা নয় যে, এখানে বললে সম্পাদক কন্ঠরোধ করতে পারেন।
সচলায়তনের মানে বুঝি অবিরাম বলতে পারার প্রাঙ্গন। মন খুলে বলার জন্যেই তো এখানে। না কি?
যাই হোক, বলতে দ্বিধা নেই। দ্বিধা বোধ করতেও নেই। সচলায়তনের যে কোনো পাঠক বা ব্লগার আমার লেখা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন। সামর্থ থাকলে যুক্তি খন্ডনের জন্য চেষ্টা করবো নয়তো চুপটি করে নতুন লেখায় মন দেবো। তেড়ে ফুড়ে উঠবো না। লেখা পড়ে কেউ যদি ভালো বলে, তাহলেই লেখকের শ্রম সার্থক। আপনাকে ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
হু... এই তাইলে ঘটনা?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বুঝলাম না! তবে গল্পটা পইড়া থাকলে ধন্যবাদ। নাকি ঈর্ষান্বিত হইলেন? গল্পটা কিন্তু যতবার পড়ি ততবারই আমি মুগ্ধ হই। নিজেরেই ঈর্ষা করি।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
রাতে এসে পড়বো...
ভালোবাসা মানে তোমায় না পাওয়া...
আমি কিন্তু ভাবসিলাম এইটা স্মৃতিচারণ। পড়া শেষে ক্যাটেগরির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখি গল্প।
অনেক ভালো লাগসে...
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
আমারও ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
মানবমনের জটিল কিছু অনুভূতি খুব সুন্দর করে ফুটিয়েছেন। বেশ ভালো লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
পড়া শেষ। সেইরকম একটা গল্প।
---------------------------------
আপনি খুশি তো? আপনার খুশিই আমার খুশি। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
নতুন মন্তব্য করুন