পুরুষ রচিত ধর্মে বিকলাঙ্গ নারী
নন্দিনী
ধর্মের স্রষ্টা পুরুষ। তাই দেখি ‘ঈশ্বর’ ভাবনাতেও পুরুষালী ছায়া। পুরুষের জন্য সব আরাম-আয়েশ স্ত্রী, দাসী, বাদী কতো কী। নারীর জন্য কিছুই নেই। জীবনে-মরণে একই পুরুষ । মরেও তার শান্তি নেই-বেহেস্তে গেলেও যেতে হবে, হাড়মাংস জ্বালানো সেই মিনষেটার সাথে! কিন্তু বেহেস্তে যাবেন কিভাবে? পবিত্র আল কোরানে ইসলামের জন্য জিহাদ (সংগ্রাম) করলে, মহান আল্লাহতায়ালা জান্নাতে (স্বর্গ) প্রবেশের নিশ্চয়তা দিয়েছেন (সুরা ইমরান, ৩:১৪২; সুরা মোহাম্মদ, ৪৭:৪-৬; সুরা ফাতাহ, ৪৮:৫); তা জান্নাতে গিয়ে জীবনবাজি রেখে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করা জিহাদিরা কী পাবেন? পাবেন-যতখুশি ফলমূল, সুরা ভর্তি পেয়ালা আর মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র পরিধানরত আনতনয়না-পরমাসুন্দরী চিরকুমারীদের (সুরা সোয়াদ, ৩৮:৫১-৫২; সুরা আদ দোখান, ৪৪:৫১-৫৭); যারা চিরকুমারী, প্রেমময়, যেন এক একটি ঢেকে রাখা মুক্তা (সুরা আল ওয়াক্বেয়া, ৫৬:১০-৪০); যাদের এর আগে কোন মানুষ বা জিন কখনো স্পর্শ করে নি (সুরা আর রহমান, ৫৫:৫৬); এ হুরেরদল (জার্মান ভাষায় ’হুর’ শব্দের অর্থ গণিকা!) জান্নাতের তাঁবুতে রয়েছে অপেক্ষমাণ অবস্থায় (সুরা আর রহমান, ৫৫:৭২)। কিন্তু এগুলো তো পুরুষদের জন্য, আর নারীর জন্য? কিছুই নয়। কেউ কেউ বলেন নারীর জন্য রয়েছে তার “পূন্যবান স্বামী”! ভালো করে বিভিন্ন ধর্মের কেতাব লক্ষ্য করলে দেখা যায়, জান্নাত বা স্বর্গ হচ্ছে এক একটি গণিকালয়, যেখানে মদ-নারীর ছড়াছড়ি। আর এই গণিকালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! দুঃখের কথা, এরপরও আমাদের এ সমাজের বেশিরভাগ নারীই এই ধরণের ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এবং বিপদের দিনে তাঁর কাছেই আশ্রয় খোঁজেন!
সোজা কথায় নারীর স্বার্থ কখনও পুরুষের ধর্ম দেখেনি; দেখার কথাও নয়। তাই প্রচলিত সবগুলো ধর্মগ্রন্থ আতিপাতি করে খুঁজেও পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে এমন একটা শব্দও পাওয়া যাবে না। আসলে পুরুষের চোখ নারীকে যেভাবে দেখে, দেখতে ভালোবাসে, যেমন করে নারীকে পেতে চায় ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঠিক সেভাবেই সাজানো হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক আল্লাহ/ঈশ্বর/গড ভয়ানক এক চোখা! ভয়ানক রকম পুরুষতান্ত্রিক নারীলোভী; আবার আর সেই পরিমাণ-ই নারী বিদ্বেষী! নিচের হাদিস দেখলে নারীর অবস্থান ধর্মের মগজে কোথায় কিছুটা ধারণা করা যায়:
হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত : নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘আমি যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তির সামনে সিজদা করার নির্দেশ দান করতাম তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।’’ (তিরমিযী)
সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার ইমাম গাজ্জালি (রঃ) বিখ্যাত ‘ইয়াহ্ইয়া উলুমেদ্দিন’ ( পৃ-২৩৫)গ্রন্থে লিখেছেন -
“স্ত্রীর উচিৎ স্বামীকে তার নিজ সত্ত্বার চেয়েও উপরে স্থান দেয়া, এমনকি তার সকল আত্মীয়স্বজনের উপরে স্থান দেয়া। সে স্বামীর জন্যে নিজকে সদা-সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে যেন স্বামী যখন ইচ্ছা তাকে ভোগ করতে পারে..।”
যেহেতু ধর্ম এনেছিল পুরুষ তাদের স্বার্থে - পুরুষের ধর্মে নারীর স্থান, তাই তাদেরই পদতলে হবে তাতে আর আশ্চর্য কী। নারী তার প্রয়োজন মেটাবে, খুব বেশি হলে সহচরী সেজে সময়ে সময়ে মিষ্টি দুটো কথা শুনে বর্তে যাবে - এই তো নারী। খ্রিস্টান ধর্মে আছে : এ্যাডাম-এর প্রয়োজন হয়েছিল বলেই ইভের সৃষ্টি। ক্রিস্টিয়ান লেখক-শিল্পীরাও তাদের কর্মে প্রচার করতে ভালোবাসেন, ‘Women are subordinate to men because they are created after men and from men and for men. (Drury, 1994, 34)’
তাছাড়া pope Jhon Paul-II এর দু-একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে : "...I permit no women to teach or to have authority over a man; she is to keep silent. For Adam was formed first, then Eve; and Adam was not deceived, but the women was deceived and became a transgressor. Yet she will be saved through childbearing, provided they continue in faith and love and holiness with modesty." (1 Timothy 2:8-15)
আরেক জায়গায় তিনি বলেন, "Indeed, man was not made from women, but women from man. Neither was man created for the sake of woman, but women for the sake of man." (1 Corinthians 11:3-10)
কি চমৎকার! তাহলে তো আর কোন কথাই থাকে না। ধর্মীয় মগজ থেকে উৎসারিত এই রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। এখানে ইসলাম ধর্মের আরও কিছু নারী সম্পর্কীত হাদিস নিচে উল্লেখ করা হল :
হযরত মোহাম্মদ বলেন ‘আমার অনুপস্থিতিতে আমি পুরুষের জন্য মেয়েদের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর ফিতনা ও বিপর্যয় রেখে যাইনি।’’ (বোখারি ও মুসলিম)
‘নারী (জাতির মূল অর্থাৎ সর্ব্বপ্রথম নারী, আদি মাতা হাওয়া) পাঁজরের (উর্দ্ধতম হাড় হইতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড় সমূহের মধ্যে উর্দ্ধতম হাড় খানাই সর্ব্বয়াধিক বাঁকা। তুমি যদি উহাকে পূর্ণ সোজা করিতে তৎপর হও যে, তুমি তোমার মন মত পূর্ণ সোজা না করিয়া ছাড়িবে না) তবে উহা ভাঙ্গিয়া যাইবে। আর যদি উহাকে তোমার মন মত পূর্ণ সোজা করায় তৎপর হও, তবে অবশ্য উহার মধ্যে একটু বক্রতা থাকিবে,কিন্তু ভাঙ্গিবে নাআস্ত থাকিবে, তুমি উহার দ্বারা সাহায্য, সহায়তা লাভ করিয়া নিজের অনেক কল্যাণ সাধন করিতে পারিবে।’’ (বোখারি শরিফ, ২০৫)
‘স্বামী তাহার স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় আসিবার জন্য ডাকিলে যদি স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় (এবং স্বামী তাহার প্রতি অসন্ত্তষ্ট হয়) তবে ভোর পর্য্যন্ত সারা রাত্র ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর প্রতি লানৎ ও অভিশাপ করিতে থাকেন।’’ (বোখারি ও মুসলিম)
আরেকটি হাদিস এরকম,
‘....নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন দোযখ পরিদর্শন-কালে আমি দোযখের দ্বারে দাঁড়াইলাম এবং জানিতে পারিলাম যে, দোযখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে।‘ (বোখারি শরিফ, ২১১)
আমরা জানি, নারীদের নির্দিষ্ট বয়সে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বকোষ বেরিয়ে ফ্যালোপিয়ন টিউবে এসে শুক্রকীটের জন্য অপেক্ষা করে, শুক্রকীট না পেলে ওই ডিম্বকোষের মৃত্যু ঘটে এবং ঋতুস্রাব হিসেব বেরিয়ে আসে। এই ঋতুস্রাবের মেয়াদ প্রত্যেক নারীরই নির্দির্ষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে চার-পাঁচ দিন স্থায়ী হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে - এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ব্যাপার, শুচি-অশূচির কোনো ব্যাপার নয়। তবে এই সময় নারীদের প্রয়োজন একটু বিশ্রামের । অথচ আল কোরানের দৃষ্টিতে রজঃস্বলা নারী অশূচি-দূষিত, তাই এ সময় স্ত্রীসঙ্গ বর্জনীয় (সূরা বাকারা, ২:২২২)। কিন্তু হাদিস থেকে জানা যায়, ‘রজস্বঃলা স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষ সংগত হলে তাকে এই কাজের জন্যে এক দিরহাম সদকা দিতে হবে। রক্তের রং কিছুটা হলদেটে হলে সদকার পরিমাণ হবে অর্ধ দিনার আর সম্পূর্ণ লাল হলে এক দিনার (মিশকাত : ৫৫৩, ৫৫৪)।’’- তাহলে দেখা যায়, কোরান যা বাতিল করেছে, হাদিস তা সামান্য সদকার বিনিময়ে হালাল করে দিয়েছে!
উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক নারী আসলে ধর্মের দৃষ্টিতে মনুষ্য পদবাচ্যই নয়! তাকে কিভাবে কোন কৌশল অবলম্বন করে দমিয়ে রাখা যাবে এবং তার থেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করা যাবে তার-ই যেন সব ফন্দি-ফিকির বের করা হয়েছে। ‘পবিত্র ধর্মে’র নামে নারীকে পুরুষতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পেষণ করা সহজ। যুগ যুগ ধরে এই ধুরন্ধর কৌশলেই নারীর ‘বাঁকা চলন’কে বশে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীও খুশী। ধর্ম বলে কথা। ’পবিত্র’ জ্ঞানে পিপড়ের সারির মত পিলপিল করে ধর্মের পিছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এছাড়া নারীর শিক্ষা-দীক্ষাও নারীর নিজস্ব নয়; পুরুষের-ই মনোনীত তথাকথিত শিক্ষা নিয়ে তার বড়জোর চাকুরি জুটে। তাতে হূদয়ের অর্গল খুললেও মগজের ভিতরে পাকানো জঁট আর খুলে না। নারীর ভিতর শতাব্দীর অন্ধকার দূর হওয়ার গতি, তাই বড় ধীর। যার জন্য আজও দেখি ধর্মের নামে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়ার রমরমা ব্যবসা চলে। নারী কি চাইবে, না-চাইবে, কিভাবে চাইবে, হাসবে, কাঁদবে, কিভাবে মরবে সব-ই বলে দেয় পুরুষ। হয়ত তাই দাবি দাওয়ার ছিটে ফোঁটা পেলেও বর্তে যায় নারী!
এবার একটা কেস স্টাডি দেখা যাক। তাতে আধুনিক নারীর প্রাত্যহিক জীবন যাপনের একটা খন্ডচিত্র পাওয়া যাবে। ফলে আমাদের ধারণা পেতে সুবিধা হব্ণেদুই হাজার আট সালের একজন মুসলিম বঙ্গনারীর জীবনে মধ্যযুগের আরবে রচিত ’ধর্ম গ্রন্থের’ আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা। নীলা (ছদ্মনাম) একজন প্রবাসী কর্মজীবী নারী। নিজ কথনেই শুনা যাক তার জীবন যাপনের প্রাত্যহিক চালচিত্র : ‘আমাকে সকাল সাতটায় কাজে দৌঁড়াতে হয়; তাই নাস্তাটুকুও সারার উপায় থাকে না বাসায়। ছেলেমেয়ে তখনও ঘুমিয়ে। ওদের স্কুল কিছুটা দেরিতে। নয়টার দিকে। বিকেল পাঁচটায় যখন কাজ শেষ হয়, তখন শরীর মন অনেকটা বিধস্ত। ফেরার পথে প্রায় দিনই টুকটাক বাজার সারতে হয়। তবে আজকাল বাজার-সদাই প্রায় সবই অনলাইনে করি, সময় বাঁচানোর জন্য। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়দিনই বিকেল ছয়টা। সন্তানদের সামন্য খোঁজ খবর নিয়েই দৌঁড়াতে হয় কিচেনে। নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে পাত্তা দেওয়ার অবসরটুকুও মেলে না। বিকেলের চা, রাতের খাবার, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়েদের হোমওয়ার্কের খোজখবর করা এর মধ্যেই আবার টুকটাক জরুরি ফোনগুলোও সেরে নিতে হয়। তারপর ঘরদোর গুছানোর পালা শেষ করে রাতের খাবার সেরে, শুরু করতে হয় পর দিনের প্রয়োজনীয় কাজ গুছিয়ে রাখার পালা। এতসব করতে করতে রাত এগারটা সারে এগারটা বেজে যায়। এরপর কিছুটা সময় নিজেকে দেই। যেমন কিছু পড়াশুনা করার চেষ্টা করি। বই আমার প্রাণ, চেষ্টা করি প্রতি রাতে অন্তত দুই পাতা হলেও পড়ার; তারপর বিভিন্ন নিউজ সাইটগুলো ঘেটে খবরাখবর গুলো জেনে নেই। ই-মেইল পড়ি, দরকার হলে দু’একটার উত্তর দেই। এ সব শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুইটা-আড়াইটা বেজে যায়। জন্মসূত্রে আমি যেহেতু একজন মুসলিম নারী, আজ দুই হাজার আট সালে দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় পরিপূর্ণ ইসলামিক রীতিনীতিগুলো মেনে জীবন যাপন করা। আমাকে যেভাবে উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াতে হয় সাত সকালে, সারাদিন প্রায় দৌঁড়ের উপর থাকতে হয়্ণসেখানে আমার পায়ের আঘাতে ‘মাটি কাঁপল’ কি-না তা দেখার সময় কোথায় আমার? ঘরের ভিতর নীরবে চলাফেরা করার-ই বা সুযোগ কোথায়? আর বেহেস্তে যাওয়ার জন্য স্বামীর সন্তুষ্টি আদায়ের নানা তরিকা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মত এত অলস সময়ও আমার হাতে নেই। দুজন মানুষ একসাথে থাকতে গেলে ঠুকাঠুকি কিছুটা লেগেই থাকবে। আমার জীবনযাপনের সাথে তাই মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোহীন, অন্ধকার গৃহকোণে পরে থাকা নারীর জীবনযাপনকে মিলাতে চাইলে কি সেটা বাস্তব-সম্মত হবে? তাছাড়া আমি মনে করি ভালো-মন্দের পার্থক্যটা ঠিক কোথায় তার শতভাগ পরিস্কার কোন সীমারেখা টানা না গেলেও আমার বিবেক, বুদ্ধি এবং শিক্ষা অনুযায়ী আমি নিজেকে চালিত করি। নীতিবোধ শেখার জন্য মধ্যযোগীয় ধর্মের কোন প্রয়োজন দেখি না। কারণ সেসময়কার নৈতিকতাবোধ আর আজকের নৈতিকতাবোধ এক নয়। মধ্যযুগে সামান্য চুরি করার জন্য হাত কেটে ফেলা হত। আজকের সভ্য দুনিয়ায় তা (অসভ্যদের কথা বাদ) কল্পনাই করা যায় না।‘
উপরে উল্লেখিত চিত্র শুধু এই একজন নীলার নয়, বরং প্রায় প্রতিটি ঘরে একই চিত্র। কী দেশে, কী প্রবাসে। তবে পার্থক্য এই, নীলা জানেন তিনি কি করছেন, তার অবস্থান পরিস্কার। অন্যেরা দুই নৌকায় চড়তে গিয়ে খাবি খাচ্ছেন। এবার চোখ ফেরানো যাক ’ঐশি’ গ্রন্থ কোরানের দিকে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখি সেখানে নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে কি বলা আছে। বিষয়টা সবচেয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে যে সূরাটির মাধ্যমে, তা হচ্ছে সুরা নিসা, ৩৪ নম্বর আয়াত।
(সুরা নিসা : ৩৪) পুরুষেরা নারীদের উপর কতৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে ও তারা হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্ক্ষা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।
এখানে আল কোরান নারী-পুরুষের প্রতি নিরপেক্ষতা দেখিয়ে স্ত্রীকে অধিকার বা অনুমতি দেয়নি অবাধ্য স্বামীকে প্রহার করার। কেন? হায়! নারীদের প্রহার করার ব্যাপারে পবিত্র কোরান শরিফের সাথে মিল পাওয়া যায় সনাতন হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৬/৪/৭, ১/৯/২/১৪) এবং শতপথ ব্রাক্ষ্মণের (৪/৪/২/১৩)।
একই সুরার অন্যান্য আয়াতে যা পাই তা হচ্ছে :- (সুরা নিসা, ৪:৩) ‘আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পুরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্ক্ষা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হয়ার অধিকার সম্ভাবনা ।‘মানে পুরুষেরা (যদি সকলের সাথে সমান ইনসাফ করতে পারে) সর্বোচ্চ চারজন নারীকে একসাথে বিবাহ করতে পারবে। কিন্তু নারী-পুরুষের প্রতি নিরপেক্ষতা দেখিয়ে কোরানে কোথাও নারীদের একসাথে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়া হয় নাই (বর্তমানে প্রচারিত কোনো ধর্মেই এরকম নির্দেশ বা অনুমতি পাওয়া যায় না, কেন? মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নেই বলে?); এছাড়া আল্লাহর বান্দারা যে তাদের স্ত্রীদের প্রতি এই ’সমান ইনসাফ’ করতে পারবে না, সেটি মহান আল্লাহতায়ালা মনে হয় আগেই জানতেন; তাই পরবর্তীতে এ বাধা তুলে দিয়েছেন (সূরা নিসা, ৪:১২৯)। তাহলে আর থাকলো কী? পুরুষেরা বিয়ে একসাথে চারটি স্ত্রী রাখতে পারবে, তবে উপপত্নী, দাসী সম্ভোগের সংখ্যা অনুল্লেখিত (সূরা আহযাব, ৩৩:৫০, ৫২)।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে, পুরুষের অবস্থান নারীদের কিছুটা উপরে (সুরা বাকারা, ২:২২৮), সাক্ষী হিসেবে একজন পুরুষ সমান দুজন নারী (সুরা বাকারা, ২:২৮২)। আমি সুরা বাকারা থেকে উদ্ধৃত করছি-
‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে; লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না| আল্লাহ্ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া এবং ঋন গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে| অত:পর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দূর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়, তবে তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখাবে। দুজন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্যে থেকে যদি দুজন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়...।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, সাক্ষী সাবুদের ক্ষেত্রে দুজন পুরুষ সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। যদি দুজন পুরুষ না পাওয়া যায় – তা হলে মহিলাদের দিয়ে কাজ চলতে পারে, তবে একজন পুরুষের বদলে দুজন নারীর সাক্ষ্য নেওয়া এক্যেতে পারে। শুধুমাত্র মহিলাদের সাক্ষী গ্রহনযোগ্য নয়। সাথে অন্ততঃ একজন পুরুষ থাকতেই হবে। যারা কোরানের মধ্যে সব সময় নারী-পুরুষের সাম্য খুঁজে পান, যারা বৈষম্যের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেন, তারা এর কি জবাব দেবেন? নারীরা চিন্তায় চেতনায় পুরুষদের থেকে হীন, তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল, তাদের বিচার বুদ্ধি কম, তারা ঠিকমত সাক্ষ্য দিতে পারবে না এই ভাবনা থেকেই মূলত – দুজন নারীর সাক্ষ্যকে একজন পুরুষের সমতুল্য করা হয়েছে।
নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও। সুরা নিসা অনুযায়ী উত্তরাধিকার সুত্রে বাবা-মার কাছ থেকে একজন পুরুষ সন্তান যা পাবে, মেয়ে সন্তান পাবে তার অর্ধেক। আল্লাহ বলেন, (৪:১১),
‘আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। অত:পর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে| যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অত:পর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যেেতর পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ।’
মুসলিম ‘স্কলার’রা বলতে চান, মেয়ে বড় হয়ে যেহেতু স্বামীর সম্পত্তি পায়, তাই পিতার সম্পত্তি তাকে কম দেওয়া হয়েছে। এগুলো আসলে ছেলে ভুলানো ছড়া। আধুনিক বিশ্বে বহু নারী উপার্যনক্ষম। অনেকেই স্বামীদের থেকেও বেশী রোজগার করেন, তাদের অনেককেই স্বামীর উপার্যনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয় না। মেয়েদের অনেকেই আজ বহুজাতিক কোম্পানির সিইও, এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতার-ও শীর্ষে ছিলেন, কিংবাএখনো আছেন। এদের কাছে ওই আয়াতগুলো বোকা বোকাই লাগবে। আর তা ছাড়া এমন অনেক নারীই আছেন যারা পরে বিয়েই করেননি, কিংবা করবেন না। মেয়েদের বড় হয়ে ‘স্বামী’ থাকতেই হবে – এটা কি ধ্রুব সত্য নাকি?
পবিত্র আল কোরানের দৃষ্টিতে বহুগামী পুরুষের কাছে নারী কী শুধুই সম্ভোগের বস্তু, সে জন্য দেখা যায় ইসলামী সৈনিকদের জন্য যুদ্ধবন্দি সধবা, বিধবা, বিবাহিত, অবিবাহিত সব নারীকে হালাল করা হয়েছে (৪: ২৪)। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের মহানবী থেকে শুরু করে হজরত আলী, হজরত ওসমান, হজরত ওমর সবাই যুদ্ধবন্দী নারী উপভোগ করেছেন, কখনোবা উপপত্নি বানিয়েছেন। কোরানে বলা আছে – ‘তোমাদের দক্ষিন হস্ত যাদের অধিকারী (দাস, দাসী এবং যুদ্ধবন্দিনী)- আলাহ তোমাদের জন্যে তাদেরকে বৈধ করেছেন” (৪:২৪)[*]! কোরানে মেয়েদের সংজ্ঞায়িতই করা হয়েছে শস্যক্ষেত্র হিসেবে -‘তোমাদের স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্যে (সন্তান উৎপাদনের) ফসলক্ষেত্র, তোমরা তোমাদের এই ফসলক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই গমন করো ...‘ (সূরা আল বাকারা, ২:২২৩)। এরপর কি আর কিছু বলার থাকতে পারে? যৌন কর্ষণের ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের সকল ক্ষমতা পুরুষের হাতে দিয়ে দিলেন মহান আল্লাহতালা!
উপরের একটি সুরায়ও নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া তো দূরে থাক, মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয়নি। এখন কথা হল, উপরে উল্লেখিত কোরানের নির্দেশ অনুসারে নারীরা পুরুষদের সমান ক্ষমতা দাবী করলে বিশাসীদের ’ধর্মীয় অনুভুতি’ আঘাত পাবেই! কারণ তারা দাবি করতেই পারে, তাদের আচরণ কোরান অনুযায়ী সঠিক-ই আছে! আমরা দেখেছি এ সরকারের আমলে ঘোষিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি’র বিরুদ্ধে মোল্লাদের বিক্ষোভ। দেখেছি কিভাবে উত্তরাধিকার আইনে নারীদের পুরুষদের সাথে সমতা দিতে গিয়ে সরকার কিভাবে মোল্লাদের কাছে মাথা নত করে পিছু হটে গেলো।
ইসলামি আইনে ‘জেনা’ হলো, ব্যভিচার, বিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলন, ধর্ষণ ও পতিতাবৃত্তি। অর্থাৎ পরস্পরের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নেই এমন দুজন নর-নারীর মধ্যে যৌনমিলন হলো জেনা। ইসলামি শরিয়তী আইনে জেনার জন্য চরম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তবে নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে শাস্তি দু’রকম। জেনার জন্য অবিবাহিত পুরুষের শাস্তি ১০০ ঘা বেত্রদ¨, বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে ৮০ ঘা বেত্র¨। কিন্তু নারীদের বেলায় প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদ¨। আর এই ’জেনা’ সংক্রান্ত অপরাধ প্রমাণ করতে চারজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন, কোনোভাবেই নারীর সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামি আইনের এই ধরনের কঠোর-ভয়ঙ্কর বিধান থেকে বিশ্ববাসীর মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কতিপয় ইসলাম-দরদীরা আল কোরানের (সুরা নিসা, ৪:১৬) এই আয়াতটি উল্লেখ করেন- ‘আর তোমাদের মধ্যে যে দুজন (নর-নারী) এ (ব্যভিচারের) কাজ করবে, তাদের দুজনকেই তোমরা শাস্তি দিবে, (হাঁ) তারা যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়, তাহলে তাদের (শাস্তি দেয়া) থেকে তোমরা সরে দাঁড়াও...‘। হঠাৎ করে এই আয়াত নজরে আসলে অনেকে ভাবতে পারেন, ব্যাভিচারে অভিযুক্ত দুজন নারী-পুরুষেরই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তাহলে অপরাধীদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সমান দৃষ্টিপাত করা হয়েছে, এরকম দাবিও করেন অনেকে। কিন্তু আসলেই কী তাই, সত্যি কী এখানে দুজন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হলে সমান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আয়াতে কিন্তু কখনোই ‘সমান শাস্তি’ কথাটি বলা হয়নি, ভালো করে লক্ষ্য করুন। পূর্বের আয়াতটি (সুরা নিসা, ৪:১৫) আগে দেখি, তাহলেই বুঝা যাবে-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অপরাধীদের জন্য কী আল্লাহতায়ালার সমান দৃষ্টিভঙ্গি- ‘তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা (ব্যভিচারের) দুষ্কর্ম নিয়ে আসবে, তাদের (বিচারের) ওপর তোমরা নিজেদের মধ্যে থেকে চারজন সাক্ষী যোগাড় করবে, অতপর সে চারজন লোক যদি ইতিবাচক সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে সে নারীদের তোমরা ঘরের ভেতর অবরুদ্ধ করে রাখবে, যতোদিন না, মৃত্যু এসে তাদের সমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়, অথবা আল্লাহতায়ালা তাদের জন্যে অন্য কোনো ব্যবস্থা না করেন।‘
পুরুষ ব্যভিচার করলে তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আটক রাখার বিধান কোরানের কোথাও দেয়া নেই, কোরান থেকে কেউ দেখাতেও পারবে না। কিন্তু নারীকে (নারী বলেই কী?) নিয়ে এমন কঠোর বৈষম্যপূর্ণ বিধান থাকার পরেও আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা যখন দাবি করেন, আল কোরান বা আল্লাহতায়ালার কাছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান, তখন আর বলার কিছু থাকে না!
বাস্তব ক্ষেত্রে জেনা এবং হুদুদ আইন যে ধর্ষনকারীদের ‘রক্ষা কবচ’ হিসবে ব্যবহৃত হয় তা আমরা পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব সহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে দেখেছি। ধর্ষন প্রমান করার জন্য ‘চারজন সাক্ষী’ প্রায় কোন ক্ষেত্রেই মেয়েটির পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব হয় না, ফলে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ধর্ষণকারীর ঘটে মুক্তি, আর মেয়েটা ‘জেনা’ করার দায়ে কপালে জুটে ‘শারিয়ার রজম’। অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েটির পরিবারই হতভাগ্য মেয়েটিকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয় পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষার জন্য। এর যে কত ‘ডকুমেন্টেড কেস’ আছে তার ইয়ত্তা নেই।
কোরানের দৃষ্টিতে পুরুষ চাইলেই তার স্ত্রীকে ‘তালাক’ দিতে পারে, শুধুমাত্র পরপর তিনবার অথবা আলাদা আলাদাভাবে শব্দটি উচ্চারণ করলেই হয়ে যায় (সূরা বাকারা, ২:২২৭-২২৯), কিন্তু এক্ষেত্রেও কোরান শরিফ নারীকে তালাক দেবার অধিকার দেয়নি (যদিও ১৯৬১ সালের তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার ’মুসলিম পারিবারিক আইন’-এ পবিত্র কোরানকে ডিঙিয়ে গিয়ে স্ত্রীদের তালাক দেয়ার অধিকার দিয়েছে, এ জন্য সেসময় মোল্লা-মৌলভীরা অনেক চিল্লা-ফাল্লা করেছিল; যা হোক, বর্তমানে বাংলাদেশে এ আইনই কার্যকর রয়েছে)। আরেকটি আয়াত দেখুন- ‘যদি সে (পুরুষ) তাকে তালাক দিয়েই দেয়, তাহলে তারপর (এ) স্ত্রী তার জন্যে (আর) বৈধ হবে না, (হ্যাঁ) যদি তাকে অপর কোনো স্বামী বিয়ে করে এবং (নিয়মমাফিক তাকে) তালাক দেয় এবং (পরবর্তী পর্যায়ে) তারা যদিই (সত্যিই) মনে করে, তারা (এখন স্বামী স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে) আল্লাহর সীমারেখা মেনে চলতে পারবে, তাহলে পুনরায় (বিয়ে বন্ধনে) ফিরে আসতে তাদের ওপর কোন দোষ নেই; এটা হচ্ছে আল্লাহর (বেঁধে দেয়া) সীমারেখা...।‘ (সুরা বাকারা, ২:২৩০)। এই আয়াত থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো পুরুষ যদি তালাক দেয় (ইসলামিতাত্ত্বিকদের মতে, ভুলক্রমে হলেও) এবং পরে তার স্ত্রীকে ফেরত চায়, তবে সহজভাবে ফেরত নেয়া যাবে না। নারীটিকে আবার বিয়ে দিতে হবে অন্য পুরুষের সাথে, যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এই দ্বিতীয় স্বামীর সাথে, এরপর এই দ্বিতীয় স্বামী নামক পরিত্রাতার ইচ্ছা হলে তাকে তালাক দিবে, তারপরই নারীটি যথাবিহিত ইদ্দত পালনের পর প্রথম স্বামীর কাছে যেতে পারবে, নচেৎ নয়। এই আয়াতে তালাক দিবে পুরুষ, অথচ এর ফল ভোগ (ধর্ষিত হতে হবে) করবে নারী। ভুল করবে একজন, শাস্তি পাবে অন্যজন; একেই কী বলে সমানাধিকার! (কোন কোন তফসিরকাররা বা ইসলামি চিন্তাবিদরা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলে থাকেন, ‘তালাককে নিরুৎসাহিত করার জন্যই এতো কঠিন বিধি করা হয়েছে।‘- ওনাদের এ যুক্তি শুনলে বড়ই খেলো মনে হয়! যে পুরুষ ভুল করে তাকে কিছু দিতে হয় না, হারাতে হয় না, শাস্তি পেতে হয় না; অথচ নিরাপরাধ নারীটিকে সব মূল্য দিতে হয়; উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে ইক্যুয়াল ডিস্ট্রিবিউশন!) ইসলামের পরিভাষায় এই দ্বিতীয় স্বামীকে বলা হয় ’মুহাল্লিল’। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলে গেছেন- ‘মুহাল্লিলের সাথে বিয়ে তখনই বৈধ হবে, যখন তাদের দুজনের মধ্যে যৌন-মিলন হবে।‘ (বোখারি হাদিস, ২০৭৮, ২০৭৯)
যাক, এসব সুরা এবং হাদিস নিয়ে মুসলিম ফেমিনিষ্ট এবং স্কলারদের বক্তব্য কী, এবার চোখ ফেরাই সেদিকে। আমেরিকান ফেমিনিষ্ট এবং মুসলিম স্কলার Amina Wadud Muhsin যিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং বর্তমান ইসলামিক স্কলারদের ইন্টারপ্রিটেশনগুলো অনুসন্ধান করে যে মতামত প্রকাশ করেছেন, সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াত এর ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল’-বাক্যটি আসলে সেই সময়কার প্রেক্ষিতে রচিত। ’প্রেক্ষাপট এবং সময়’ এই বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। তখনকার আর্থ-সামাজিক বিষয়টিই এই সুরার মাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। যেহেতু তখন পুরুষরাই ছিল পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমিনা মনে করেন বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই সূরাটির ব্যাপারে আরও উদার (লবিরোল) রিইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ আছে।
আরেক মুসলিম ফেমিনিস্ট মরোক্কান Fatema Mernissi এবং ইজিপশিয়ান আমেরিকান Leila Ahmed দুজনেই মোটামুটি তাদের বিভিন্ন লেখায় যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা হল, ইসলামে যে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে তা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে পরস্পরবিরোধী। নারীর উপর ধর্মের নামে নানা বিধি নিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে নারীর অবস্থা দিনে দিনে শোচনীয় হয়েছে। পুরূষের অধীনতা, বশ্যতা স্বীকার-ই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। Leila Ahmed আরও উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদের সময়ে, অর্থাৎ প্রথম যুগের মুসলমান সমাজ নারীর প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল। মূলতঃ আব্বাসীয় সময় থেকেই নারীর প্রতি চরম বৈষম্যমুলক ব্যবস্থা চালু হয় ধর্মের নামে। ইসলামের নামে না হলেও আব্বাসীয় যুগে-ই উপপত্নী গ্রহণকে আইনানুগ করা হয়। যা ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। যার ফল হয় নারীর জন্য ভয়াবহ। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফলে এদের মান-মর্যাদা বলতেও কিছু ছিল না; ছিল না কোন অধিকার। Leila Ahmed যে আইনকে উল্লেখ করেছেন, 'extreme androcentric bias' বলে। মুসলিম নৈতিকতার কন্ঠটি কিন্তু এক্ষেত্রে ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। উপপত্নী এবং দাসীদের ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকার পাওয়ার ফলে নারীদের অবস্থা দাঁড়াল ঘরের কোনে পরে থাকা ব্যবহার্য্য কোন বস্তুর চেয়েও করুন। অধিকার বিহীন। অন্ধকারে দিন-রাত্রি পার করা শুধু। সমাজের উপর তলার নারী সমাজের অবস্থাও সুখকর ছিল না। কারণ এরা ছিল একেবারেই প্রান্তিক- যে কারণে আসলে তাদের কোনো ’ভয়েস’-ই ছিল না।
Mrnissiও প্রায় একই কথা উল্লেখ করেছেন, তিনিও দাবি করেছেন তুলনামুলকভাবে মোহাম্মদের সময় নারী কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করত। যেমন ঘরের বাইরে তাদের উপস্থিতির প্রমান পাওয়া যায়। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে না হলেও তিনি লিখেছেন - “They were active in the early Islamic movement.” মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী। তাছাড়া মোহাম্মদের প্রিয় পত্নী আয়শা ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের অন্যতম প্রধান উৎস।
Mernissi ভাষায় -“... She was a major political actor in the civil war or strife (fitna) following the assassination of the third caliph 'Uthman in 656. Her role as a source of hadiths is so important that in one tradition the Prophet is supposed to have told the Muslims that they ' received half their religion from a woman.” এছাড়াও ইসলামে অনেক নারী বিদ্বেষী হাদিসের উৎস আবু হুরায়রার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন। যেমন, Fatema Mernissi সহ অনেকেই মনে করেন আয়েশার সাথে সাহাবী আবু হুরায়রার দ্বন্ধের কারণেই বহু নারী বিদ্বেষী হাদিস সৃষ্টির মূল কারণ।
যাই হোক। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে ’পবিত্র ধর্মে’র নামে পিতৃতান্ত্রিকতার ভয়াবহ মিশেল দিয়ে উদ্ভট এক খিচুড়ি পাকানো হয়েছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে জেনেসিসের মিথ সামান্য অদল-বদল করে নিজেদের বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে ইসলামে। তাই আদম হাওয়া আর গন্দম ফলের কথা পাওয়া যায় লোকমুখে। আদম এর প্রয়োজনে এখানেও দেখা যায় হাওয়ার জন্ম। অর্থাৎ ধর্মে নারী চরিত্রের সৃষ্টি পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। বেহেস্তে যেতে হলেও নারীর জন্য প্রয়োজন হয় পুরুষের সার্টিফিকেট। প্রভু-স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট হলেই কেবল তিনি বেহেস্তে যাওয়ার সার্টিফিকেট পান, নাহলে নয়। যেমন হাদিস আছে, যে পর্যন্ত স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট নয় সে বেহেস্তে যেতে পারিবে না...।
এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার। মুসলিম নারীবাদী এবং স্কলারদের দৃষ্টিতে সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে- কোরান অপরিবর্তনীয়-এই বদ্ধমূল বিশ্বাস। মুসলিমদের মধ্যে এই বিশ্বাসের ফলেই কোরানকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য সামান্য পরিবর্তন সাধন করাও এক কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে পুরুষতন্ত্র কোরানের আক্ষরিক অর্থ ধরে রাখায় অতি উৎসাহী। বিশেষ করে কোরানের যে সব আয়াতে জেন্ডার ইস্যু পরিস্কারভাবে উল্লেখিত আছে, সগুলো নিয়ে আসলে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে। বর্তমান সভ্যতায় ইসমিক রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার সাথে যা খাপ খায় না মোটেই। বরং ন্যায় এবং সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে মধ্যযুগের আইনকে ধর্মের নামে আঁকড়ে পরে থাকা মানে সমাজ-সভ্যতাকে উটের যুগে ফিরিয়ে নেওয়া। আজকের সমাজ-বাস্তবতার সাথে যার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। যেমন ইসলামিক ষ্টাডিজ এবং কম্পেরাটিভ রিলিজিয়ন-এর অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ, এবং ইসলামসহ বহু গ্রন্থের লেখক Malise Ruthven লেখায় কিছুটা ফুটে উঠছে। আমি Ruthven -এর ‘Islam’ থেকে সম্পূর্ণ লাইনগুলো এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি :
"The argument that a woman giving evidence on a business matter might need assistance from her friend might make sence under pre-modern conditions when most women were illiterate,but as the Quranic rules stand, the testimony of a woman with a higher degree in bussenes administration is only worth half that of an illiterate male.Beyond such textual sticking points, however, there are areas where masculine or androcentric interpretations are being contested, particularly in the field of hadith, where the questioning of surces belongs to a time honoured methodology and is less controversial than taking issue with the text of the Quran. The biggest obstacles facing Muslim feminists are cultural and historical: feminism is perceived as coming from a hostile source." (Malise Ruthven: Islam, 113)
অবশেষে বলার কথা একটাই- যদিও মুসলিম নারীবাদীরা মনে করেন, ‘ইসলাম’ নয়, প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতন্ত্রই ধর্মের নামে নারী পুরুষের বৈষম্য টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক একইভাবে খ্রিস্টান ধর্মেও দেখি খ্রিস্টান নারীবাদীরা যে উৎস থেকে গরলের উৎপত্তি, তাকে মাফ করে দেন আবলীলায়; খালি পুরুষতন্ত্রের উপর ঝাল ঝাড়েন। বিষয়টা কিছুটা হাস্যকরও। গোড়ায় গলদ রেখে মাথায় জল ঢেলে কি হবে? পুরুষ রচিত ধর্মে নারীর জন্য যৎসামান্য দয়া দাক্ষিণ্য আছে হয়ত, তাও তাদেরই স্বার্থে। নারীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যকে পূরুষের তুলনায় নিম্নশ্রেণীর আখ্যা দিয়ে তাকে `ধর্মের` প্রলেপ মিশিয়ে মহিমান্নিত করা হয়েছে, এই বলে যে, নারী বাঁক্ণাকারণ তার সৃষ্টিই বাঁকা হাঁড় থেকে। বিস্তারিত পরিসরে না গিয়েও হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, হিন্দুধর্মে ক্ষেত্রবিশেষে নারীর অবস্থা মুসলিম নারীর চেয়েও অনেক বেশি শোচনীয় ছিল। বিধবা বিবাহ ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। সতীদাহের মত জঘণ্য এক প্রথা চালু ছিল ধর্মের নামে। এই ধর্মে কয়েকজন যোগপুরুষের আবির্ভাবে আগের অবস্থার কিছুটা অবসান হলেও- এখনও নারী সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। নারী-শিশুদের তো এখনও সেখানে জন্মাতেই দেওয়া হচ্ছে না। সে আরেক ভয়াবহ চিত্র; অন্য প্রসঙ্গ।
মোদ্দা কথা হচ্ছে কোন ধর্মই যেহেতু নারীর প্রয়োজনে বা নারীর কল্যাণে সৃষ্টি হয়নি; নারীর ধর্ম-কাতরতা তাই দূর করা প্রয়োজন, তাদের নিজেদের-ই কল্যাণের জন্য। ধর্ম রচিত হয়েছে পুরুষদের দ্বারা, পুরুষদের জন্য, নারীর কল্যানের জন্য নয়। বেগম রোকেয়া এ প্রসঙ্গে দ্বিধাহীন কন্ঠে বলেন –
‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
ধর্মে থাকবেন, আবার পুরুষের সমান অধিকারও দাবি করবেন, এটা আসলে অনেকটা ‘সোনার পাথরবাটি’ যেমন, তেমনি। ধর্ম আকঁড়ে থাকতে গেলে এর চেয়ে বিপরীত চিত্র আশা করা যায় না। কারণ ধর্ম নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়নি। মোল্লা, পুরোহিতরা কোত্থেকে দেবে? খোদ ‘ধর্ম’ বিষয়টাই উপড়ে ফেলতে পারলে, মানব সভ্যতা রক্ষা পেলেও পেতে পারে।
তথ্যসূত্র :
Drury, C. (1994) 'Christianity' in J. Holm with J. Boker (eds) Women in Religion, London, Printer Publishers, 30.
Ruthven, M. (2000) Islam, 2nd edn, Oxford, Oxford University Press.
Wadud-Muhsin, A. (1999) Qur'an and Woman: Re-reading the Sacred Text from a Women's Perspective, Oxford, Oxford University Press (first published 1992).
Linda Woodhead, Christianity, Oxford University Press (2004)
Leila Ahmed, Women and Gender in Islam (1992)
--------------------------------------------------------------------------------
[*] Dictonary of Islam থেকে জানা যায়, দাসী যদি বিবাহিতাও হয়, তাকেও অধিকারে নেয়ার ক্ষমতা আছে মনিবের। সুরা ৪:২৪; “তোমাদের দক্ষিন হস্ত যাদের অধিকারী- আল্লাহ তোমাদের জন্যে তাদেরকে বৈধ করেছেন”। এই আয়াতের ব্যখ্যায় জালালান বলেন- “অর্থাৎ, যাদেরকে তারা যুদ্ধের ময়দানে আটক করেছে, তাদের সাথে সহবাস করা তাদের জন্যে বৈধ, যদি তাদের স্বামীগণ জীবিতও থাকে”
মন্তব্য
নন্দিনী আপা, ভালো লেখা। একটু আগে মুক্তমনায় আপনার বিকলাঙ্গ নারী শিরোনামের লেখা পড়ে এলাম। দারুণ হয়েছে !
কথাটাতে আমিও সহমত পোষণ করি।
ধন্যবাদ আপা, ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনাকেও ধন্যবাদ রণদীপম, লেখাটা কষ্ট করে পড়েছেন বলে।
নন্দিনী
অসাধারণ!!!
আপনার মেধা, অধ্যয়ন, সাহস এবং পরিশ্রমসাধ্য কাজকে স্যালুট।
কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত(!) বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষিকা যখন সেমিনার করে "প্রস্তাবিত নারীনীতির ইসলাম বিরোধিতায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে" এমন কথা বলেন, তখন এ ধরণের বিশ্লেষণ আশা জাগায়।
ধন্যবাদ নুশেরা আপনাকে। যত বেশী নারী এ নিয়ে কথা বলতে এগিয়ে আসবেন ততই মঙ্গল।
ভালো থাকুন আপনি।
নন্দিনী
ধন্যবাদ নন্দিনী, আপনার বিস্তৃত ও গভীর এবং সমালোচনামূলক লেখাটির জন্য। আরও ধন্যবাদ এ কারণে যে, আপনি প্রচলিত ইসলাম ব্যাশিং লেখামালার বাইরে এসে ফাতেমা মেরনিসি বা লায়লা আহমেদের যুক্তিগুলোর সঙ্গেও যুঝে দেখেছেন। এবং জোরের সঙ্গে আপনার মত প্রতিষ্ঠা কারতে চেয়েছেন।
কিন্তু বেশ কিছু কারণে আপনার অনেকগুলো যুক্তির সঙ্গে একমত হয়েও চিন্তার সারবস্তুর সঙ্গে একমত হতে পারছি না। আমার মত অনেকটা মেরনিসি কথিত আপনার বিবৃত এ মতের কাছাকাছি,
প্রতিটি বিপ্লবই তার মধ্যে প্রতিবিপ্লবকে ধারণ করে। ইসলামেও এই প্রতিবিপ্লব হয়েছে, নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ ও অধিকারভিত্তিক ধারাগুলো সেখানে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পরাজিত হলেও সেটা থাকে। কোনো ধর্মই একমাত্রিক ও একমূখী নয়। কিন্তু এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে কলামের খোপে তা পূরবে না। কোরানের আয়াত থেকে যে অনুবাদগুলো আপনি দিয়েছেন, তার অন্য অনুবাদগুলোও কিন্তু দেখা দরকার। সেখানে অর্থান্তর ঘটে। যেমন, যেখানে বলা হচ্ছে, নারীর সৃষ্টি পুরুষের পাঁজর থেকে নয়, আল্লাহর 'নফস' থেকে। আরবী ভাষায় নফস হচ্ছে আল্লার গুণাবলী সম্পর্কিত এবং এটি নারীবাচক গুণ। এবং এই নফস থেকে মানুষেরও জন্ম! এটি যদি মানেন তাহলে বলা যায়, সৃষ্টিকর্তা নিজেই নারীকে এরকম উচ্চতা দিয়েছেন। আবার ঠিক এর বিপরীত ভাষ্যও ভুরিভুরি পাওয়া যাবে। যেমন আপনিও দেখিয়েছেন, আমি তার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করি। ইসলামের প্রথম শহীদ কিন্তু একজন নারী, কোরানের প্রথম হেফাজতকারী একজন নারী_আয়েষা, প্রথম মুসলিম-খাদিজা ইত্যাদি দেখানো যায়। কোনানে সর্বোচ্চ সম্মানিতা নারী হলেন মরিয়ম। ঊনিশটি সুরা তাঁর নামে আছে। তাই মানতে পারছি না যে,
এখন অফিসে আমার হাতের কাছে বইগুলো বা কোরান নাই, তাই হুবুহ উদ্ধৃতি ইত্যাদি দিতে পারব না। আপাতত এটুকু বলতে চাই, ধর্মগুলো অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক এবং রোকেয়া যেমন বলেন, ধর্ম পুরুষের সৃষ্টি; তেমনই বলতে চাই। কিন্তু ধর্মে ধর্মে এবং কালে কালে ধর্মীয় ইতিহাসে নারীর অবস্থানের অদলবদল ছিল। দ্বিতীয়ত, খোদ ধর্মচিন্তা কীভাবে দিনে দিনে পুরুষদের রক্ষণশীল অংশের কব্জায় চলে গেল তারও সুলুকসন্ধান না করলে আজকে এর বিরুদ্ধে লড়াই ঠিকমতো করা কঠিন।
আমি একমত যে, আবু হুরায়রা, বোখারি ও মুসলিম এবং গাজ্জালির মতো ধর্মপুরুষদের নারী-বিদ্বেষ সুবিদিত। সেটাকে তারা ইসলামের ভেতরেও প্রবিষ্ট করতে পেরেছেন। এঁদের হাদিস ব্যাখ্যা কিংবা কোরানের অনুবাদ নির্ভরশীল না। যেমন সুরা নিসায় যেখানে বলা হচ্ছে, পুরুষ চাইলে একাধিক (একসঙ্গে চারটি পর্যন্ত) বিয়ে করতে পারে, সেখানেই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে, 'যদি তুমি মনে করে তুমি সকলের প্রতি সমান নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারবে'। আমরা জানি এটা সম্ভব নয়। এভাবেই পুরুষের বিশেষাধিকারগুলো অনেক জায়গায় এমনভাবে শর্তবদ্ধ করা হয়েছে যাতে পুরুষের দৌরাত্ম্য কমে। এর অর্থ আবার এই না যে, ইসলাম বা অন্য ধর্মগুলো পুরুষতন্ত্রমুক্ত। তবে ইসলামে কিছু ধারা আছে যা লিবার্টাইন অর্থাত অধিকারমুখী, দমনমুখী নয়। আপনি আমি চাইলেও যেহেতু ধর্ম উবে যাবে না, আর ধর্মকে নিছক সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়ে খারিজও করা যায় না, মানুষের ইতিহাসের দার্শনিক উত্তরণ না ঘটা পর্যন্ত যেহেতু এটা থাকবে, সেহেতু ভেতর-বাহির দুদিক থেকেই একে কীভাবে আরো মানবিক ও বৈষম্যবিরোধী করা যায়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
আশা করি, পরের কেনো মন্তব্যে কিছু উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারব।
আমাকে দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি বিশ্বাসী নই, আবার বিদ্বেষীও নই। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতেই হবে বলে বিশ্বাস করি। ধন্যবাদ।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
ফারুক,
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমার বলার কথা এখানে আসলে একটাই আর তা হচ্ছে একজন নারীর দৃষ্টিতে আমি ধর্মকে দেখাতে চেয়েছি - ধর্ম আমাকে কি দিয়েছে বা দিতে পারে । নারী কি আদৌ পুরুষের ‘ধর্ম’ থেকে উপকৃত হতে পারে? কথার মারপ্যাচে পুরুষ নারীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এতদিন চালিয়েছে। এখন মুসলিম নারীবাদী অথবা খীষ্টান নারীবাদীই হোন তাদের বোঝা দরকার ‘ধর্মগ্রন্থ’ গুলোর রি-ইন্টারপ্রিটেশন করে কোন লাভ আসলে হবে না। তাতে করে বরং ‘ধর্মের’ নিগড়ে নারীকে বেঁধে রাখতে চাওয়া পুরূষতন্ত্রেরই পরোক্ষে জ়য় হবে। তাঁরা হয়ত ছিটেফোটা ছাড় দেবে, কিন্তু ঘটনা যে কে সেই থেকে যাবে - মাঝখান থেকে রি-ইন্টারপ্রিটেষণের নামে ‘ধর্মগ্রন্থ’ গুলোকে নতুন করে গ্লোরিফাই করা হবে শুধু।
নন্দিনী
এখানে একটা লিংক রইল, আপনার পরিচিত মুক্তমনাতেই এই বিতর্কটা হয়েছিল। http://www.mukto-mona.com/Articles/taj_hashmi/slave_girl.htm
আর ফুটনোটে ব্যবহৃত মন্তব্যটির প্রাসঙ্গিক অংশটা সরাসরি পড়ার জন্য এখানেই তুলে দিলাম,
The oft-cited Quranic verse (ironically both by mullahs and Islam-bashers), Surah Al-Ahzaab (revealed in Medina), 33:50 actually means: “ We [God] have made lawful for you, O Prophet, wives to whom you have given their dowers, and God-given maids and captives you have MARRIED…. This is a privilege only for you [Prophet] and not the other believers.”
The problem with the above verse is that many translators and interpreters have wrongly assumed that the phrase, “Malakatu Aimanukum”, stand for “What your right hands possess” or slave girls. Actually the phrase stands for: “What your right hands have pledged or married”. As for example, Ayesha’s self-identification as a wife of the Prophet of Allah in Arabic was: “Malakani Rasul Allah” (The Prophet of Allah married me). One may get further clarifications from the following verse: “… And to those you have given your pledge in marriage give their share, for God is witness to everything” [ Surah Nissa, revealed in Medina, 4:33]. Here the expression “ Malakatu Aimanakum”, stands for “marriage”.
We also come across in Surah Nissa the following verse, which Mr Mirza has used to vilify Islam: “ Also forbidden are married women unless they are captives (of war), such is the decree of God. Lawful for you are women besides them if you seek them with your wealth for wedlock and not for debauchery.” [4:24]
Muslims just cannot have sex with POWs or slaves without marrying them first.
Contrary to the motivated translation/interpretation, the verses 23:1-7 [Surah Al-Muminun, revealed in Mecca] tell us the following: “ The true believers will be successful, who are humble in their service, who shun all frivolities, who strive for betterment, who guard their sex, except for their wives, and ‘women slaves of old’ [who had been in possession of their masters since the pre-Islamic days] are free from blame.” The verse 7 of Surah Al-Muminin only accepts the fait accompli – slave girls whose masters had been sleeping with them since the pre-Islamic period, were allowed to do so. It is just a case of allowing NOT promoting the pre-Islamic custom. We find the same injunction in Surah Al-Maarij (Meccan), verses 29-30: “And those who guard their sex except from their wives and women slaves of old, are free of blame.”
The Prophet, despite his intentions, could not abolish slavery and the pre-Islamic custom of grabbing POWs as booties—slaves and sex objects. After the Battle of Hunayen, Prophet’s attempt to release the female POWs was resisted by his companions. One Sahaba grabbed his robe and told the Prophet sternly: “You cannot deprive us from these female POWs, this is our age-old custom.” The Prophet without any police force, judiciary and regular army, could not enforce his desire.
Now, to turn to Mr Asghar’s comment, I agree with him that “Islam defenders” give the “information” to the Islam-bashers (Hadis, Fiqh and motivated interpretations of the Quran). Yes, this is the problem I have been pinpointing in my assertion against Shariah and Political Islam. Ibn Ishaque, Tabari and the Hadis literature and people like Ghazzali, who considered wives as slaves, created problems for the Muslims and Islam. We want to get rid of these Hadis-Fiqh based Islam.
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আমি ইংরেজী ফন্টে পড়তে পারছি না ঠিকঠাক তাই বরং না পড়েই একটা ব্যাপার বলি। একটা লাইনের পাঁচটা মানে থাকলে আর তার 'ভুল' ইন্টারপ্রিটেশনের কারণে সমাজে কুপ্রথার চল হলে দায়টা কার?
এখানে অনেকেই বলে থাকেন দায়টা মানুষের ঘাড়েই বর্তায় কারণ তারা ঠিকঠাক ইন্টারপ্রেট করতে পারে নি। কিন্তু বাস্তবে সমান দোষ ধর্মগ্রন্থের ঘাড়েও যায় বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না দেবার জন্য।
যদি ধরেই নিই ঐশী গ্রন্থের বিশ্বাস, আর এও মনে করে নিই ঈশ্বর মানুষকে ভালবাসেন, তাহলে এরকম পাঁচরকম মানেওয়ালা আয়াত লিখে মানুষকে পাঠানোর মানেটা কি? ঈশ্বর যদি মানুষের পরীক্ষাই নিতে চান তবে বই না পাঠিয়েই পরীক্ষা নিতে পারেন তো ...
এটা খুবই স্বাভাবিক যে যুগে যুগে শাসনকারীরা তাদের ইচ্ছামত ইন্টারপ্রিটেশনকে যথেচ্ছ কাজে লাগিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের সেই স্কোপ তৈরী করে দেবার জন্য ঈশ্বরও তো collaborator হিসাবে একই দোষে দুষ্ট।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দিগন্ত, খোদা ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, ইতিহাসই খোদাকে সৃষ্টি করেছে এবং যতদিন প্রয়োজন তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবে বলে মনে করি। তাই ঈশ্বরের দায় আমি নেব না, যতটা নেয়ার ইতিহাস নেবে। আমার বিশ্বাস যেহেতু মানুষে সেহেতু অবিশ্বাসটাও মানুষের ওপর। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো কোলাবরেশনের সম্ভাবনা তাই দেখি না।
একইভাবে টেক্সট মানুষকে চালায় না, মানুষই টেক্সট তৈরি করে ফেলে এবং সংশোধন করে। কোরান তো শত শত বছর ধরেই পড়া হচ্ছে, সবাই তা থেকে এক শিক্ষা নেয় নাই কেন? কেন দেশ-কাল ভেদে ধর্মের বিধি ও ব্যবহার পাল্টায়? কেন বিশেষ একটি সময়ে একটা বিশেষ ব্যাখ্যানই বেশি চালু হয়? কেন প্রতিষ্ঠান সমসময়ই ধর্মের রক্ষণশীল দিকগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে?
যাহোক, ওপরে দেয়া ইংরেজিটা এখানে বাংলা করে দিলাম এবং সঙ্গে আমার মন্তব্যও।
প্রায়শই উদ্ধৃত করা কোরানের এই আয়াতটি (পরিহাস এই যে, মোল্লা এবং ইসলাম-বিদ্বেষীরা উভয়েই এটা হরহামেশাই একে উদ্ধৃত করেন), সুরা আল আহজাব (মদিনায় নাজিল হওয়া), ৩৩:৫০ আসলে বলছে, ‘‘ও রাসুল, আমরা (আল্লাহ) তোমার স্ত্রীদের ন্যায়বতী করে গড়েছি। তুমিও তাদের যা প্রাপ্য (দেনমোহর) তা দিয়েছ, এবং খোদা-প্রদত্ত পরিচারিকা এবং যুদ্ধে বন্দিনীদের তুমি বিয়ে করেছ...এই বিশেষাধিকার কেবল তোমার (নবী) জন্য এবং আর কোনো বিশ্বাসী এর অধিকারি নয়’’
ওপরের এই আয়াতটি নিয়ে সমস্যা হলো, ভুরিভুরি অনুবাদক এবং ব্যাখ্যাকারিগণ ভুলভাবে এই বাক্যবন্ধটি, ‘মালাকাতু আইমানুকুম’-এর অর্থ করেছেন, ‘তোমার দণি হস্তগত যা’ অথবা দাসী। প্রকৃতভাবে এর অর্থ হচ্ছে, ‘তোমার দণি হস্ত যার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অথবা যাদের সঙ্গে বিবাহবদ্ধ’। একটা উদাহরণ, আল্লাহর নবীর স্ত্রী হিসাবে আয়েশার আÍস্বীকৃতিটি আরবিতে এমন ছিল: ’মালাকানি রাসুলাল্লাহ’ অর্থাত আল্লাহর নবী আমাকে বিয়ে করেছেন। আরো পরিষ্কার হওয়ার জন্য এই আয়াতটি দেখানো যায়: ‘...এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের জন্য প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হয়েছ, তোমরা তাদের অংশ তাদের দিয়ে দাও, কেননা আল্লাহ সবকিছুর সা।ি’’ (সুরা নিসা, মাদানি সুরা, ৪:৩৩) এখানেও ‘মালাকাতু আইমানুকুম’ এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ‘বিবাহ’।
সুরা নিসা থেকে অনেকে এও উল্লেখ করে থাকেন যে, ‘‘বিবাহিত নারীরাও নিশিদ্ধ যদি না তারা যুদ্ধবন্দি হয়, এই হলো আল্লাহর বিধান। এ ছাড়া নেই নারীরাও বৈধ যাদের সঙ্গে তোমরা সম্পত্তির বিনিময়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ, ব্যাভিচারের জন্য নয়।’’ (৪:২৪)
মুসলমানরা বিয়ে করা ছাড়া যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতে পারে না। সুরা আল মুমিনুন (মক্কায় নাজিল হওয়া) আমাদের জানাচ্ছে, ‘‘সত্যিকারের বিশ্বাসী তারা, যারা তাদের দায়িত্বে সত, যারা অন্যায় আচরণ করে না, যারা উন্নত হওয়ার জন্য সচেষ্ট, স্ত্রী এবং ‘আগের যুগের দাসী’ (প্রাক ইসলামি যুগ থেকে যারা প্রভুর অধীনে দাসত্ব করছে, তারা) ছাড়া আর সকলের প্রতি যাদের যৌনতা সংযত, তারাই কেবল অভিযোগমুক্ত।’’
সুরা আল-মুমিনুনের সপ্তম আয়াত কেবল অনিবার্য পরিস্থিতিকেই কিংবা পূর্বে সাধিত বিষয়কেই মেনে নিচ্ছে। অর্থাত যেসকল দাসমালিক প্রাক ইসলামী যুগ থেকেই দাসীদের তাদের সঙ্গে শুতে বাধ্য করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি। বিষয়টি নিছক প্রাক ইসলামি ঐতিহ্যকে অনুমোদন না দেওয়া অর্থাত এর পুনঃপ্রবর্তন রোধ করা। এই নিষেধাজ্ঞা আমরা পাই সুরা আল-মা’র্জি (মক্কি সুরা) আয়াত ২৯-৩০-এ : ‘‘যারা নিজ স্ত্রী এবং ‘আগের যুগের দাসী’ ছাড়া আর সকলের প্রতি তাদের যৌনতাকে সংযত রেখেছে, তারা অভিযোগমুক্ত।’’
দাসপ্রথা উচ্ছেদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এবং যুদ্ধে আয়ত্ত সম্পদ ও নারীদের ভোগ্য হিসাবে গ্রহণের ঐতিহ্যের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও নবীর পে এগুলোকে সীমিত করে আনা ছাড়া আর কিছু সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি ঈশ্বর ছিলেন না এবং অলৌকিক মতাসম্পন্নও ছিলেন না। হুনায়েনের যুদ্ধের পর তিনি চেষ্টা করেছিলেন নারী বন্দীদের মুক্ত করে দেয়ার জন্য। তখন এক সাহাবা তাঁর জোব্বা আঁকড়ে ধরে বলে, ‘‘আপনি আমাদের নারী যুদ্ধবন্দীদের থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। এটা শত-শত বছরের রীতি’’। সেসময় তাঁর হাতে কোনো পুলিশ বাহিনী বা নিয়মিত সেনাবাহিনী না থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে নিজের ইচ্ছা আরোপের কোনো মতা তাঁর ছিল না। সেটা তাঁর পদ্ধতিসঙ্গত হতো কি না সেটাও আরেক প্রশ্ন।
একই কথা তাঁর বহুবিবাহ নিয়েই বলা যায়, আয়েশা এবং সম্ভবত জয়নব ছাড়া তাঁর সকল স্ত্রীরই বয়স চল্লিশোর্ধ ছিল। সে আমলে গোত্রে গোত্রে মৈত্রীর জন্য বৈবাহিক আÍীয়তার প্রথা ছিল। আবার তাঁর কোনো সাহাবি শহীদ হলে বা স্ত্রী-কে তালাক দিলে সেই নারীরা নবীর কাছেই আশ্রয় চাইলে তিনি তাদের বিয়ে করতে নৈতিক ভাবে বাধ্য হন। এগুলো ছিল নিছক রাজনৈতিক বিবাহ। এমনও হয়েছে যে, এক দাসীকে মুক্ত করে তাঁর এক প্রিয় সাহাবার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পরে সেই নারী তাকে ত্যাগ করে আসে, কারণ বিয়েটিতে তার তেমন সায় ছিল না। নবীর নাতনী সখিনা মদিনার রাজনৈতিক বৃত্তে খুবই প্রভাবশালী ছিলেন, তিনি সভায় বক্তৃতা করতেন, মসজিদের নববীর পাশে মেয়েদের একটি তাঁবু ছিল যেখানে তারা হাসপাতাল খুলেছিল।
এবং সেকালে পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক ছিল না। মদিনার নৈরাজ্যিক পরিবেশে এবং নবীসহ নওমুসলিম নারীদের ওপর অন্যদের শারীরিক ও মানসিক আক্রমণ থেকে বাঁচতে মুসলিম নারীদের তারা যে মুসলিম সেরকম একটা প্রতীক ব্যবহার করতে বলা হয়। এবং নবীর পরিবারের নিরাপত্তাহীনতা এবং তার গৃহ সকলের জন্য অবারিত থাকায় স্ত্রীদের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা করতে বলা হয়। আবার এও দেখা যাবে যে, মক্কায় নাজিল হওয়া সুরাগুলোর থেকে মদিনার সুরাগুলো বেশি সংরণমূলক। মদিনার জটিল-সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রগঠনের প্রাক্কালে সেটাই স্বাভাবিক ছিল।
এবং বলাবাহুল্য এর বিপরীত দৃষ্ঠান্তও ভুরিভুরি পাওয়া যাবে। আমি কেবল যেকোনো ধর্মকেই তার তার বিশেষ সামাজিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতায় উদ্ভূত বলে দেখার প্রস্তাব পেশ করি। তা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের ভেতরে সংরণবাদী মনোভাবের থেকে অধিকারবাদী (লিবার্টাইন) প্রবণতাই ছিল বেশি। পুরুষরা যেখানে ছাড় পেয়েছে সেটাও কিন্তু সাবেক বিশেষাধিকারের অতি সামান্য অবশেষ মাত্র। সেটুকু উচ্ছেদ করা কোনো মানুষের পে সম্ভব নয় রাতারাতি। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় সেটা ’বহু শতাব্দীর অজস্র মনীষীর কাজ’।
সম্পত্তির প্রশ্নেও দেখা যাবে, আগে যেখানে নারীর সার্বজনীন অধিকার ছিল না সেখানে ইসলাম পুরুষকে বেশি দিচ্ছে কিন্তু পুরুষের মতা কমিয়েও দিচ্ছে। সেক্ষত্রেই পুরুষ নারীর ঊর্ধ্বতন যেখানে নারী তার নিরাপত্তা কিংবা ভরণপোষণের জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। (এ পর্যবেণের জন্য আমি ঋণী আমার সঙ্গিনীর কাছে, তিনি এটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন) আজ যদি নারীর অর্থনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক স্বনির্ভরতা অর্জন হয়ে থাকে তাহলে ঐ বিধান আর প্রযোজ্য হয় না।
একজন পুরুষের বিপরীতে দুজন নারীর সাক্ষিদানের বিধির ব্যাখ্যায়ও বলা হয় যে, স্বাধীন পুরুষের বিপরীতে অধীনস্থ নারীরা সাক্ষি দিতে ভীত হতে পারে, তাদের ভুল সাক্ষিদানে বাধ্যও করা হতে পারে। সেক্ষত্রে একজন নারী যদি ভুলও করে বা ভীতও হয়, দুজনের ভুল করা বা ভীত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিপরীতে যুক্তি উঠবে, একজন পুরুষ সাক্ষি কি ভুল করতে পারে না? পারে কিন্তু ভয়-ভীতি প্রশ্নে এবং স্বাধীন পুরুষদের পর্যবেণের সামনে তার সে সুযোগও কিন্তু কমে যায়। আমি এটাই বলতে চাইছি, গোড়ায় খ্রীষ্টধর্মের মতো ইসলামও অধিকারমুখী ও যুক্তিমুখী আন্দোলন ছিল। এটা কেবল একটা ধর্ম ছিল না, এটা আন্দোলনও ছিল এবং যেভাবে তা সর্বোচ্চ বিশ্বায়িত ধর্ম হতে পেরেছে, তা তার স্থিতিস্থাপকতা ও অধিকারমুখীনতারই নজির।
এককথায় এটা বলে শেষ করতে চাই যে, ইসলাম যেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পরে সেই সিরিয়া কিংবা ইরানে আগে থেকেই সামন্তবাদ প্রবল ছিল। এবং নারী-বিদ্বেষ সেখানকার শাসক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। ইসলাম রাজতান্ত্রিক কাঠামোর অধীনস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটো জিনিষ ঘটে। এক নারী বন্দি হয় এবং দুই. ইসলামে যাজকতন্ত্র দাঁড়িয়ে যায়। যাজকন্ত্র ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজতন্ত্র যাজকতন্ত্র ছাড়া চলতে পারে না।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ইওরোপ খুবই সীমিত অর্থে হলেও ধর্মকে যেভাবে সংস্কার করেছে, যেভাবে প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলন রিফর্মেশন ইত্যাদি হয়েছে সেরকম কোনো সামাজিক শ্রেণী মুসলমান সমাজে উপনিবেশিক যুগের পর আর দেখা যায় নাই। এর আগে সেই চেষ্টা অনেক হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, উপনিবেশিক আমলেই ইসলামী সমাজগুলো বৃহদাংশে বেশি রণশীল হয়েছে এবং উপনিবেশবাদও যাজকতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে।
ইংরেজ আসার আগে ভারতবর্ষে হিন্দু আইন বা মুসলিম আইন ছিল না। রাষ্ট্রীয় আইন ছিল এবং পারিবারিক বিষয়গুলো স্থানে স্থানে যার যার আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত ঐতিহ্যমাফিক সুরাহা করতো। ইংরেজরা এটা বুঝতে পারে নাই। তাই ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্ট আদলে তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র পারিবারিক আইন করে। আর আইন থাকলে তাকে কেন্দ্র করে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যাবে। মোল্লাতন্ত্র হলো সেই এক গোষ্টী।
ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্মবিরোধী অবিশ্বাস একটা পর্যায়ে পরস্পর পরস্পরকে নির্মাণ করে। হেগেলের মাস্টার-স্লেভ ডায়লেক্টিকের ধরনে অবিশ্বাসী বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে দাগিয়ে দেয় আবার বিশ্বাসী অবিশ্বাসীকে সংজ্ঞায়িত করে। এভাবে উভয়েই হয়ে ওঠে মেটাফিজিকাল ভাবধারায় পরিপূর্ণ। ইতিহাস, যুক্তি, কার্যকারণ এবং সর্বোপরি মানবিয়তা সেখানে সরলীকৃত হয়ে যায়। জগত হয়ে ওঠে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে জলঅচল এক পরিস্থিতি। ফলে কারো পে কাউকে বোঝা বা পাল্টানো আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।
যাহোক এখানেই ইতি টানা দরকার। ধর্ম কিংবা যেকোনো তন্ত্রকে আমি সে কী বলে তা দিয়ে না বুঝে কেন বলে, কখন বলে এবং কীভাবে বলে সেভাবে অর্থাত তার জাগতিক টানসমেত দেখতে চাই। অন্যভাবে বললে ধর্মচেতনা সেক্যুলারিস্ট নয়, কিন্তু ধর্ম নিজে জগতের সেক্যুলার উপাদান। অর্থাত তাকে মর্ত্যরে মাটিতে এবং মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা বিষয় হিসাবে বিচার করতে চাই। এবং তখন দেখতে পাই, আজকে ইসলামের ভেতরের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদী দুটো ঐতিহ্যই যে প্রবল হচ্ছে তার কারণও কিন্তু কোরান বা বিশ্বাস নয়-সময়ের অভিঘাত। তার সামনে হাজির হওয়া সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থতাই তাকে বিচলিত করছে। সেই বিচলন আমাদেরও-যারা মানবিক মুক্তিতে বিশ্বাসী-ব্যতিব্যস্ত এবং ভীত করছে আবার কাউকে কাউকে আশাবাদীও করছে। আমার ধারণা, এই উথাল-পাথাল শেষ হলে ইসলাম আর আগের ইসলাম থাকবে না, যেমন দুনিয়াও থাকবে না আর আগের দুনিয়া। ধন্যবাদ।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
অসংখ্য ধন্যবাদ ও খুব সুন্দর লেখা।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ভুল বোঝার অনেক পরিসর রেখে দিয়েছি তাড়াহুড়ার কারণে। তারপরও আপনি যে নিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আমি ভাবছিলাম এ নিয়ে অযথা আর বিতর্ক না বাড়াতে। কারণ এগুলোর জবাব দিতে হলে আমাকে ধর্মগ্রন্থ আর ইতিহাস থেকে খুব কঠিন কিছু সত্য উল্লেখ করতে হবে। আর সেটা করলে যা হয় - 'ইসলাম ব্যাশিং'-এর একটা লেভেল এঁটে দেওয়া হয়। যুক্তি তর্কের ক্ষেত্রে এই লেভেল আঁটা আঁটির ব্যাপারটা খুবই বোরিং আর বিরিক্তিকর।
যা হোক, আমার কিছুটা দ্বিমত আছে ফারুক ওয়াসিফের এই 'ইন্টারপ্রিটেশন' আর 'রিইন্টারপ্রিটেশনের' খেলায়। নন্দিনী একটি সহি হাদিস উল্লেখ করেছেন যাতে মহানবী নিজেই বলেছেন, নারীর জন্ম হয়েছে পাঁজরের বাঁকা হাড় হতে। আমি যে হাদিসের কথা জানি তা হল - ‘নারী পাঁজরের উর্দ্ধতম হাড় হতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড় সমূহের মধ্যে উর্দ্ধতম হাড়টাই সবচেয়ে বাঁকা। তুমি যদি তাকে আরো বাঁকাতে চাও, তবে এটি ভেঙ্গে যাবে। আর যদি কিছুই না কর তা হলে বাঁকতেই থাকবে।' (womankind was created from a rib, but the bent part of the rib, high up, if you try to straighten it you will break it; if you do nothing, she will continue to be bent.) । মহানবীর উত্তিতে কিন্তু জলের মত পরিস্কার কোথা থেকে নারীর জন্ম। এখন ফারুক সাহেব বলছেন, নারীর জন্ম নাকি পুরুষের পাঁজর থেকে নয়, আল্লাহর 'নফস' থেকে। ফারুকের কতথা সত্য হলে, এই সহি হাদিস গুলো মিথ্যা, নয়ত ফারুক সাহেব অযথা রিইন্টারপ্রেট করে জোর করে বাড়তি মহত্ত্ব আরোপ করছেন, যা ধর্মগ্রন্থসিদ্ধ নয়।
ফারুক সাহেব আরো বলেছেন, কোন ভাল মুসলমান নাকি যুদ্ধবন্দী নারী ভোগ করে না, কিংবা অত্যাচার করে না। ইতিহাস বিশ্লেষণে এটা কি ঠিক হল? ফারুক সাহেব ইসলামের ইতিহাস জানা পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, বানু কুরাইজা নামক ইহুদি গোত্রটির সমস্ত পুরুষ সদস্যদের হত্যা করার পর রায়হানাকে কি করা হয়েছিল। ফারুক সাহেব নিশ্চয় ইবনে ইসহাকের সিরাত রাসুলুল্লাহ পড়েছেন। তিনি নিশ্চয় জানেন বানু হাওয়াজিন গোত্রকে পরাজিত করার পর যখন প্রায় ৬ হাজার নারী ও শিশু বন্দী হইয়েছিল মুসলমানদের হাতে, তখন তাদের কি হয়েছিল।
আসলে ফারুক সাহেব যতই ভিন্নমত পোষন করুন না কেন, যুদ্ধবন্দী নারী ভাগবাঁটোয়ারা করা ছিল সে সময় যুদ্ধের রীতি। সবাই করেছেন। ভাল মুসলমানরা এগুলো করে না - তা আপ্তবাক্য। বহু হাদিসে আছে কিভাবে যুদ্ধবন্দিনীদের ভাগ বাটোয়ারা করতেন হযরত আলী এবং কিভাবে হযরত ওসমানকেও তিনি উদারভাবে মালে গনীমৎ বন্টন করেছেন। সেগুলো কি তাহলে মিথ্যা? যুদ্ধবন্দি নারীদের উপর কি হয় ২ লাখ বাঙ্গালী নারী দেখেছে - একাত্তরে পাক বাহিনীর কর্মকান্ডে। বহু ইসলামী আলেম ওলেমা সে সময় ব্যাপারগুলোকে বৈধতা দিয়েছেন এই বলে যে, ওই সমস্ত নারীরা পাকবাহিনীর জন্য হালাল - কারণ ওরা মালে গনিমৎ। ফারুক সাহেব হয়ত বলবেন, পাকবাহিনী ইসলামী বাহিনীর সত্যিকারের উদাহরন নয়। তা ঠিক আছে। কিন্তু 'মালে গিনিমত' কন্সেপ্টটা যে ইসলাম থেকেই উঠে এসেছে, এবং অনেকেই যে সুযোগ পেলে ইসলামের লেবাস পড়িয়ে তা ব্যবহার করতেও কসুর করেন না, তা তো ঠিক।
আমি আসলে ফারুক ওয়াসিফের সবগুলো রিইন্টারপ্রিটেশনেরই জবাব দিতে পারি। কিন্তু এতে দেখা যাবে তিক্ততা বাড়ছে। এ ধরণের বিতর্কের আসলে শেষ নেই। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ধর্মগ্রন্থের ভাল ভাল আয়াত গুলো নিয়ে ফারুক এবং অন্যান্যদের 'ইন্টারপ্রিটেশনের' দরকার পড়ছে না। বরং সে আয়াত গুলোকেই 'ইন্টারপ্রিটেশনের' দরকার পড়ছে, যেগুলো আজকের সভ্যতার চোখে অমানবিক এবং নারীবিদ্বেষি । ইন্টারপ্রিটেশনের দরকার পড়ছে সে সমস্ত আয়াতেরই যেখানে স্ত্রীকে 'প্রহার' করার কথা আছে, 'চারটা বিয়ে' করার কথা আছে, 'পাজরের হাড়' থেকে জন্মের কথা আছে, সাক্ষী এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারিদের বঞ্চনার কথা আছে। কথা হল, একটা খারাপ আয়াতকে ইন্টারপ্রেট করে যদি মহত্ত্বের খোলস পরানো যায়, তা হলে তাত্ত্বিকভাবে 'ভাল' আয়াতগুলোও ইন্টারপ্রেট করে খারাপ বানানো যাবে। সে ধরনের প্রচেষ্টা হাতে নিলে তা কেমন দেখাবে?
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
প্রিয় অভিজিত বাবু, আপনি এই ছত্রে যা বলেছেন,
তা নিয়ে কোনো কথা বলব না, কারণ ঐ অযথা শব্দটির জন্য।
এখানে কেবল আমি আমার দুঃখই প্রকাশ করব যে, আপনি আমার মন্তব্যগুলো ভাল করে পড়েননি। তাই আমার উত্থাপিত কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দরকারও মনে করেননি। আপনি সরাসরি আমাকে মূল্যায়ন করেছেন। এবং সেই মূল্যায়নে প্রচ্ছন্নভাবে আমাকে ইসলামের ডিফেন্ডার বলে দেখাতে চেয়েছেন। কী করা যাবে, সেটা আপনারই অভিরুচি!
আপনি দেখেছেন,
আর আমি দেখেছি ভুল এবং রক্ষণশীল অনুবাদ ও ব্যাখ্যান। সেটা অনেকটা এরকম।
নন্দিনীর লেখার শেষে ফুটনোট হিসাবে আছে:
আর আমি এর যে অনুবাদ পেয়েছি তা এই,
আবার সুরা আল আহজাবে বলা হচ্ছে (মদিনায় নাজিল হওয়া),
এরকম ভুল অনুবাদের বেশ কিছু ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি। নারী ও পুরুষ যে একই উতস, আল্লাহর নফস থেকে তৈরি এটার প্রমাণও দিয়েছি। এবং নবী যা-ই বলে থাকুন, কোরানই হাদিসের থেকে নির্ভরযোগ্য, এটাও ঐ নবী ও কোরানেরই রায়। এ রায় আপনি চাইলেই পাল্টাতে পারেন না। আমি আবারো আপনাকে অনুরোধ করি, আমার মন্তব্যগুলো খুঁটিয়ে পড়তে। ওটুকু সম্মান আমি আপনার কাছে দাবি করতেই পারি।
আমি ইসলামের ডিফেন্ডার কিংবা অ্যাপলজিস্ট নই। যেদেশে থাকি সেদেশে ইসলামওয়ালাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করে বাঁচতে হয়। যাহোক, আমি মনে করি না ইসলাম সেক্সিস্ট বা নারীকে দাসত্বে আটক করার প্রবণতাটাই তাত্ত্বিকভাবে প্রধান। কিন্তু অবশ্যই এর মধ্যে পুরুষতন্ত্র আছে, আছে এ যুগের নারীর জন্য অবমাননাকর শর্ত।
৩৩ নং সুরার ৩৫ নং আয়াত দেখুন, ওখানে বলঅ হচ্ছে ধর্ম নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই নাজিল হয়েছে। ইতিহাসে সেটাই প্রথম নারীর ধার্মিক স্বীকৃতি।
পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি হওয়া বা নারী বিদ্বেষী বেশিরভাগ হাদিসই যারা বলেছেন সেই আবু হুরায়রার বর্ণন বা বোখারির গ্রন্থন বা গাজ্জালির ব্যাখ্যান অনেক ক্ষেত্রেই কোরানের স্পিরিট বিরোধী এবং সরাসরি খণ্ডন। যেমন নারীর তালাক দেয়ার অধিকার কোরানেই দেয়া আছে, ২:২২৮। বলা হয়েছে নারী এবং পরস্পরের ওপর অধিকার রয়েছে। হাসান আল তুরাবি মনে করেন, হিজাব অ-ইসলামিক।
অন্যত্র বলা হচ্ছে,
'ও বিশ্বাসীরা, নারীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অধিকার করা হারাম। তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণও করা যাবে না। তাদের দেয় দেনমোহরের অংশ তোমরা ফেরত নিতে পার, যদি তারা সরাসরি নীতি লংঘন করে।''
অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত নারীরা ইমামও হতে পারতো। সেসময় পর্যন্ত মুসলিম নারীরা যে অধিকার ভোগ করেছে তা আজকের অনেক মুসলিম নারীরাও করতে পারে না। ইসলামের প্রথম দীক্ষিতরা কিন্তু নারী এবং দাসেরা। সেটাও প্রমাণ করে যে, গোড়ায় তার মধ্যে লিবার্টাইন ধারাই প্রধান ছিল। আপনি দেখছেন, আধিপত্যবাদী ধারাকে। এটা আমাদের কোনো একজনের দৃষ্টির সমস্যা। কেউ পায়ের জুতা দিয়ে মানুষ পরিমাপ করে, কেউ করে চোখের ভাষা দিয়ে। এটাও যার যার ঝোঁকের হদিস।
আপনি যে ঐতিহাসিক তথ্যাদি দিয়েছেন, সেগুলো প্রেক্ষিতহীন ভাবে আলোচনা করা যায় না। ওগুলো নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারাও বিহারিদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। কিন্তু এটা দিয়ে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধকে লেবেল এঁটে দেয়া যায় না।
আমি বুশ বা হান্টিংটন সাহেবদের মতো আধুনিকতার সঙ্গে বা পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সিভিলাইজেশনাল ক্ল্যাশ দেখতে পাই না। এটা হাল আমলের সৃষ্টি। কিংবা দেয়ার বা আওয়ার ওয়ে অব লাইফের মধ্যেও কোনো গুরুতর হিংসার বীজও দেখি না। একসময় ইহুদীদের বিষয়েও এমনটা বলা হতো। কিন্তু সেগুলো সত্যি ছিল না। তেমনি এগুলোও সত্যি নয়।
ইসলাম বা যে কোনো ধর্ম যেভাবে আছে সেভাবে থেকে যেতে পারে না। এবং সেভাবে থাকেও না। যেমন শরিয়া ও মাদ্রাসা অনেকটা কলোনিয়াল যুগের সৃষ্টি। আজ মুসলমানদেরই এর কুফজিলতের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে তালাল আসাদ ফর্মেশন অব সেক্যুলারিজম এবং জিনিয়লজি অব রিলিজিয়নে বিস্তর আলোচনা করেছেন। দেখতে পারেন। যাহোক, চিন্তা, সংষ্কৃতি এবং ঐতিহ্য হিসাবে আর সব জাগতিক উপাদান যেমন আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীবাদ, ভৌগলিকতা ইত্যাদি রকমের উপাদানগুলো বৃহত্তর পুনর্গঠনের মধ্যে ট্রানসেন্ড করতে হয়। ইওরোপীয় রেঁনেসাও কিন্তু সেটাই করেছিল। মুসলিম সমাজগুলোকে নিজের দায়েই সেটা করতে হবে। তার দু কাঁধে চেপে বসা সামন্তীয় ভুত আর উনিবেশিক আধুনিকতার দানোটাকে না সরাতে পারলে এ সমাজগুলোর মুক্তি নাই। এ কাজে সংঘাত হবে নিশ্চয়, কিন্তু ইতিহাস কিন্তু উল্লম্ফন সরাসরি দেয় না, সংস্কৃতির ভেতর রাতারাতি কিছু ঘটে না। সেখানে চলে ক্রমাগত অতীতের সারবস্তু গ্রহণ করে অসার জিনিষ ফেলে দিয়ে উত্তরণের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা। সেকারণেই আমি সচেতনভাবে transend কথাটা ব্যবহার করেছি।
যাহোক, আপনি এবং নন্দিনী যেসব হাদিসের উল্লেখ করেছেন এগুলো হুজুরেরা এবং এনজিওবাদী কিংবা তসলিমা নাসরীনের মতো লেখকেরা হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকে। একদল ধর্মের নামে আরেকদল প্রগতির নামে নারীর ওপর কিংবা রাজনীতির ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চায়। নারীর শরীর মন সত্তা হচ্ছে সেই সংঘাতপূর্ণ এলাকা, যার ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধটা হয়।
যাহোক, আমি এসেন্স নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম, আপনি বা নন্দিনী অ্যাপিয়ারেন্সের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করেছেন।
আমার আলোচনার আমি এখানেই ইতি টানলাম। এ পরিসরে আমার আর বিশেষ কিছূ বলার নাই। সম্ভব হলে স্বতন্ত্রভাবে কখনো আলোচনা হবে। সেখানে দাওয়াত দিয়ে রাখলাম। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
ঠিক আছে, আপনি যখন চাইছেন, আমিও তাহলে বিতর্কে ইস্তফা দিলাম এ যাত্রা। আপনার অবগতির জন্য আমি জানাই, আপনার মন্তব্য এবং লেখা সব কিছুই আমি পড়ি, এবং মন দিয়েই পড়ি। কিন্তু পড়লেই যে একমত হতে হবে তা কিন্তু নয়। আমি কোরানের আয়াতগুলো নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা পড়েছি, এবং আমার মতামতও জানিয়েছি। শুধু তাই নয়, হাদিস পর্যালোচনা করে কিংবা মহানবী এবং অন্যান্যদের জীবনী থেকে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে দেখিয়েছি যুদ্ধবন্দীর প্রতি কি করা হয়েছে, এবং কেন মৌলানারা 'মালে গনিমত'কে ইস্যু করার সুযোগ পান কিংবা কেন ' পাঁজরের বাঁকা হাড়' থেকে নারী জন্মের কথা বলা হয়, ইত্যাদি।
আপনাকে আমি কখনোই ইসলামের এপোলোজিস্ট বলি নি। আসলে তর্ক বিতর্কের সময় আমি বিশেষন ব্যবহারের ঘোর বিরোধি আমি। আমি জানি আপনি মোল্লাদের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করছেন। আপনি আপনার মত করছেন, নন্দিনী হয়ত করেছে তার মত। ধর্ম বৈষম্যের কারণে নারীর যে ক্ষোভ এবং তার চিরন্তন প্রকাশটুকুও আমাদের বুঝতে হবে। এটাও আপনার বুঝতে হবে যে ধর্মগ্রন্থে ঐ সমত আয়াত ওভাবে উল্লেক করা না হলে, নন্দিনীদের সোকল্ড 'অ্যাপিয়ারেন্সের মধ্যেই থাকার'ও দরকার পড়তো না, কিংবা আপনার 'লিবারাল ইন্টারপ্রিটেশনের'ও কোন প্রয়োজন থাকতো না।
আপনার এবং নন্দিনীর- এ দুজনের জন্যই আমার শ্রদ্ধা থাকলো।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
নন্দিনী - বিশ্লেষণধর্মী লেখা অতিথি লিখিয়েদের কাছ থেকে আসলে সত্যিই বেশী ভালো লাগে! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সেজন্য
কিন্তু, আমার দু'একটা কথা বলার আছে। আপনার দেয়া যুক্তির প্রেক্ষিতে এই লেখার প্রধান মতটিকে যদি এক লাইনে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে খুব সম্ভবত এরকম কিছু একটা দাঁড়ায় যে - নিজের স্বার্থে, নিজেকে মানুষ এবং নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা নির্যাতন/বৈষম্য ইত্যাদি দূর করতে, মেয়েদের ধর্ম জিনিষটাকে বাদ দিতে হবে।
এবং সেই হিসেবে মুস্লিম নারীবাদীদের অবস্থান ঠিক গ্রহনযোগ্য নয়, কারণ তারা ধর্মের কাঠামোর ভেতরে থেকেই 'নারী'র অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে চান - ধর্মকে 'চ্যালেঞ্জ' না করে, বরন ধর্মকে 'রি-ইন্টারপ্রিট' করে। তাই তো?
আমি এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করি। ধর্ম, যাকে কিনা আসলে - বাতাসে মিশে থাকা অক্সিজেনই বলুন (বিশ্বাসীদের জন্য) অথবা কার্বন-ডাই-অক্সাইড ই বলুন (অবিশ্বাসীদের জন্য) বাতাস থেকে যেমন আলাদা করা যায় না - তেমনি ধর্মকেও সমাজ থেকে, এই মূহুর্তে, আলাদা করা অসম্ভব বললেও কম বলা হয়। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি মুস্লিম নারীবাদীদের অবদান আরেকটু অন্যভাবে দেখা যেতে পারে।
প্রথমতঃ তাদের প্রধান প্রশংসণীয় অবদান হলো নারীবাদকে 'পশ্চিমা নারীবাদ'এর একচেটিয়া আধিপত্য থেকে ধাক্কিয়ে বের করে - হোক তা 'মুস্লিম' নারীবাদ - অন্য আরেকটা ক্যাটেগরীতে পৃথিবীতে উপস্থাপিত করা।
দ্বিতীয়তঃ ইসলাম, বা যে কোন ধর্মই, আমাদের 'আইডেনটিটি'র অনেকাংশ নির্ধারিত করে। মুস্লিম নারীবাদীরা মুস্লিম নারীদের সেই 'আইডেনটিটি' বজায় রেখেই পুরুষতন্ত্রকে প্রশ্ন বা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহায্য করে। যদি প্রশ্ন করেন - সেই তো ধর্মের মত পুরুষতান্ত্রিক স্ট্রাকচারকে বজায়ই রাখলো তাহলে আর লাভ কি হলো? উত্তরে বলতে হয়, নারীবাদ যাদের জন্য - অর্থাৎ নারী - যদি চায় সে ধর্মের কাঠামোর মধ্যে থেকেই তার প্রতিবাদের শুরু টা বা সুচনা টা করবে, তাহলে সেটা তার 'স্বাধীনতা', তার 'মত', বা তার 'এজেন্সী'।
আর ধর্ম যদি বাদ দিতে হয় - তা দিতে হবে যে কোন 'মানুষ'কেই - তা সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তা নাহলে বৈষম্য কিভাবে দূর হবে? আজকে যদি কোন কারণে নারীরা 'ক্ষমতায়' যায় তাহলে শুরু হয়ে যাবে পুরুষ নির্যাতন - ধর্মের ভিত্তিতে। শুধু সেক্ষেত্রে সমস্যা হবে একটাই - আবা আ আ র ধর্মের বইগুলোকে নতুন করে লিখতে হবে।
বাপ্রে !! শুধু সেজন্যই তো উচিৎ ধর্ম ব্যাপারটাকেই ভুলে যাওয়া ....
সাধারণভাবে যারা রি-ইন্টারপ্রেট করে ধর্ম-সংষ্কার করেন তারা আদপে ধর্মের চেয়ে মানবিকতার ওপর বেশী জোর দেন। কিন্তু একটা বাস্তবসম্মত মধ্যপন্থা গ্রহণ করে যতটা সম্ভব ততটা করার চেষ্টা করেন। রাজা রামমোহন সেটাই চেষ্টা করেছিলেন। আবার একই সময়ে ডিরোজিও অনুপ্রাণিত ইয়ং বেঙ্গল কিন্তু ধর্মের বর্জনের মাধ্যমে সমাজ-বিপ্লব আনতে চেয়েছিল। তারা সফল হয় নি।
কালের ফেরে আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে তো ইয়ং বেঙ্গলের বাণীই আমরা গ্রহণ করেছি। আজকে সতীদাহ থামাতে বেদের নতুন করে মানে খুঁজে বের করার দরকার পরে না। কিন্তু পরিবর্তনটা এসেছিল রামমোহনের হাত ধরেই। মানুষ হয়ত মধ্যপন্থাই বেশী পছন্দ করে।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দিগন্ত - কথাটা সেটাই। ক্ষেত্র প্রস্তুত না হলে কোন লাভই শেষ পর্য্যন্ত হয় না, আর ক্ষেত্র প্রস্তুতের সুচনা হতে পারে যে কোনখান থেকেই। মুস্লিম নারীবাদের মত আরেকটা নতুন ধারা হচ্ছে 'তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদ' - আমি মনে করি খুবই দরকারী একটা মতবাদ, এখনকার অস্থির সময়কে বোঝার জন্য।
সাধারণত মানুষ মধ্যপন্থায় বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তো বটেই।
স্নিগ্ধার উক্তি একটু বিশ্লেষনের দাবী রাখে। ধর্ম জিনিসটা যদি সমাজ থেকে আলাদা করা নাই যায়, কিংবা এত প্রয়োজনীয়ই হয়, তাহলে স্নিগ্ধা কিংবা নন্দিনীর মত যারা- তারা ধর্ম ছাড়া কিভাবে চলতে পারছেন সে প্রশ্ন এসে যায়। আসলে আমি মনে করি বিভিন্ন বিপরীতমুখী মতের 'সঙ্ঘাত আর সংঘর্ষ' থেকেই পরবর্তীতে 'নির্মান' হতে পারে প্রগতিশীল সমাজ। আমরা বহু কুসংস্কার কিন্তু দূর করতে পেরেছি অব্যাহত সঙ্ঘাত থেকে শিক্ষা নিয়েই। ইতিহাস তার সাক্ষী। আতীতে বহু মনিষীকেই 'র্যাডিকাল' আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো, তারা প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে কুসংস্কার দূর করতে চেয়েছিলেন বলে। চার্বাক থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর , কিংবা বেকন, হবস, বার্ট্রান্ড রাসেল, আহমেদ শরীফ, আরজ আলী মাতুব্বর, হুমায়ুন আজাদ... অনেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি, বরং সমাজে জমে থাকা কুসংস্কারের আবর্জনা দূর করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এদের অনেকেই তখন সমাজ বিচ্যুত হয়েছিলেন, হয়েছিলেন একাকী। কিন্তু আজ আমরা জানি, তারা সে সময় 'সঙ্ঘাত আর সংঘর্ষ' শুরু না করলে আজ আমরা অনেকে ভাল কিছু থেকেই বঞ্চিত হতাম। আমরা পেতাম না আজকের এই আধুনিক সমাজ। এদের অনেককেই আমরা আজ স্বীকার করে নিয়েছি 'জীবনের নমস্য' হিসেবে।
আসলে বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বকে নিরুৎসাহিত করা উচিৎ নয়। বরং চলতে দেওয়া উচিৎ এই অব্যাহত দ্বন্দ্ব। এ থেকেই বেরিয়ে আসবে একটা নতুন সুন্দর কিছু।
মানুষ জাগবে তবেই কাটবে...
অন্ধকারের ভোর!
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
অভি - নারীবাদ বা যে কোন মতবাদ, সেভাবে দেখতে গেলে, সমাজের বেশীরভাগ মানুষের জন্য চিন্তা করা হয়। আমি বা নন্দিনী ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবন থেকে বাদ দিয়ে চলতে শুধু পারি না, দরকার হলে সেই বাদ দেয়ার পক্ষে দু'কথা প্রতিপক্ষকে শোনাতেও পারি (এই যেমন এখন তোমাকে )। কিন্তু, যারা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরই বল, আর পারিবারিক কি সামাজিক প্রেক্ষাপটই বল, থেকে আসে বা জীবন যাপন করে তাদের জন্য আমাদের মত সমাজের মূলধারার বিপরীতে যাওয়াটা কি এত সোজা ? সবাই তো আমাদের মত 'সুবিধাজনক' শ্রেনীতে জন্মায় না ?
দ্বন্দের দরকার বা উপকারীতা থাকতে পারে, সংঘাত থেকে আরো ভালো কোন নতুন কিছুর সুচনা হতে পারে - এবং অবশ্যই হয়ও, কিন্তু আমাকে যদি এখন বাংলাদেশের কোন গ্রামে গিয়ে নারীবাদ প্রচার করতে বলা হয়, আমি অবশ্যই শুরু করবো 'ধর্ম' কে প্রথমেই আঘাত না করে। যাদের জন্য নারীবাদ - অর্থাৎ নারী - তারা যখন চাইবে এবং প্রস্তুত হবে, ধর্মকে একটানে ছূঁড়ে ফেলা যাবে নাহয়, তার আগে পর্যন্ত আমি সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ায় বিশ্বাসী - এবং এটা একেবারেই আমার একটা ব্যক্তিগত অবস্থান বা মত।
ঠিক আছে। তুমি হয়ত গ্রামে গিয়ে ধর্মকে আঘাত না করেই শুরু করবে। অথচ দেখো আরজ আলী মাতুব্বররের মত মানুষ কিন্তু একেবারে এঁদো গ্রাম থেকেই উঠে এসেছিলেন। গ্রামে থাকলে যে অন্যরকম ভাবে কিছু করা যাবে না তা তো নয়।
আসলে ধর্ম ব্যাপারটাকে অনেক সময় 'মাথার উপরে' উঠিয়ে রাখা হয়। জগতের সব কিছুর সমালোচনা করা যায়, শুধু ধর্মের নয়। ধর্মানুভুতি ব্যাপারটা এতটাই প্রবল যে, ধর্ম যারা মানে না, তারাও ব্যাপারটাকে মনে করে 'ধ্রুব সত্য'। এ নিয়ে ডকিন্স খুব ভাল আলোচনা করেছেন তার 'গড ডিলুশন' বইয়ে।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
'মাথার ওপর' আসলে শুধু ধর্ম কেন, আমি বেশ কিছু বিষয়কেই তুলে রাখি - আরজ আলি মাতব্বর গ্রাম থেকে আসুক, তিনি অবশ্যই নমস্য ব্যক্তি, কিন্তু আমি 'আমার' বিবেচনা, যুক্তি, এবং সর্বোপরি বুদ্ধি অনুযায়ী মনে করি যে আমি গ্রামে গেলে ওপরে যা বলেছি তাই করবো।
কারণ দেখ বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে শুধু ধর্ম নয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতি বা সমাজব্যবস্থাকেও কিন্তু ব্যবহার করা হয়। আমি সেগুলোকেও 'বাবা বাছা' করে চলবো - ততক্ষণ, যতক্ষণ আমি মনে না করবো যে সেগুলোকে ধাক্কা দেয়ার 'সময়' হয়েছে বলে। আর সেই সময় হওয়াটা নির্ধারিত হবে যাদের জন্য এই 'বাদ' নিয়ে বাদানুবাদ - তারা রাজী কিনা, তৈরী কিনা, সেটা দিয়ে।
(অন্য প্রসঙ্গঃ তুমি না সপ্তাহ দুই পরে আমার বাসায় আসছো? উত্তর দিও খুব খিয়াল কৈরা কিন্তু, খাবার দাবার না পেলে পরে দোষ দিও না যে আমি যথাসময়ে সাবধান করি নি !!)
'আঘাত দেওয়ার সঠিক সময়ের' আশায় বসে থাকলে সময় আর আসবে না কখনোই। কাউকে না কাউকে দায়িত্ব তুলে নিতে হবে সমাজের প্রয়োজনেই। এভাবেই সভ্যতা এগোয়।
আর সঠিক সময়ের আশায় বসে থাকলে, সাত মন ঘিও আর পুড়বে না, রাধাও নাঁচবে না
ধর্মানুভুতি নিয়ে ডগলাস এডাম এর মজার একটা উক্তি মনে পড়ল -
"Religion ... has certain ideas at the heart of it which we call sacred or holy or whatever. That's an idea we're so familiar with, whether we subscribe to it or not, that it's kind of odd to think what it actually means, because really what it means is 'Here is an idea or a notion that you're not allowed to say anything bad about; you're just not. Why not? - because you're not!' If somebody votes for a party that you don't agree with, you're free to argue about it as much as you like; everybody will have an argument but nobody feels aggrieved by it. If somebody thinks taxes should go up or down you are free to have an argument about it, but on the other hand if somebody says 'I mustn't move a light switch on a Saturday', you say, 'Fine, I respect that'. ...
Why should it be that it's perfectly legitimate to support the Labour party or the Conservative party, Republicans or Democrats, this model of economics versus that, Macintosh instead of Windows, but to have an opinion about how the Universe began, about who created the Universe, no, that's holy? What does that mean? Why do we ring-fence that for any other reason other than that we've just got used to doing so? There's no other reason at all, it's just one of those things that crept into being and once that loop gets going it's very, very powerful. So, we are used to not challenging religious ideas but it's very interesting how much of a furore Richard creates when he does it! Everybody gets absolutely frantic about it because you're not allowed to say these things. Yet when you look at it rationally there is no reason why those ideas shouldn't be as open to debate as any other, except that we have agreed somehow between us that they shouldn't be."
যাই আজ। তোমার বাসায় আইতাছি। কপালে যে কি আছে কে জানে। খাওন পাওয়া তো পরের কথা, মাইর ধোর না খাইলেই খুশি!
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
অভিজিত (এখানে খণ্ড ত নেয় না, তাই অভিজিতই লিখছি) আপনার সুন্দর ও যুক্তিশীল এবং পরিবর্তনবাদী মতের জন্য ধন্যবাদ। কথাগুলো ভাবিয়েছে। এবং ভাবনায় একটা প্রতিক্রিয়াও দানা বেধেছে। সেটাই এখানে শেয়ার করতে চাই। ধর্মের প্রভাব খর্ব করা বিষয়ে আপনার মোদ্দা কথাটা যদি বুঝে থাকি, তাহলে সেটা এরকম,
আপনি আঘাতের পথে বদলাতে চেয়েছেন। আমি ব্যক্তি মনীষিদের কথা বলছি না, ইতিহাসে ধর্মের বিরুদ্ধে বড় বড় বিদ্রোহগুলো হয়েছিল কিন্তু ধর্মের ভেতর থেকেই। রাজতান্ত্রিক ইসলামের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেন-হাসানের বেদঈন ইসলাম। কিংবা সুন্নি শরিয়তি ধর্মের বিরুদ্ধে শিয়া ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে সুফি পন্থার বিদ্রোহ। সনাতনী বর্ণবাদের বিপরীতে বৈষ্ণব-কবীর-নানকের পন্থা। আবার ক্যাথলিক শরিয়তীদের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট্যান্ট বিদ্রোহ (মার্টিন লুথার ও জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহ), অন্যদিকে চার্চের কাঠিন্যের বিরুদ্ধে ইতালি ও স্পেনের ফ্র্যান্সিসকান আন্দোলন। এরকম উদহরণ অজস্রই আছে। এসব নজির বলে যে, ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্মই বেশি কাজের হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে, এসব আন্দোলনগুলো সমাজের ভেতর পেকে ওঠা কোনো না কোনো দ্বন্দ্ব বা শক্তির সমর্থন ছাড়া হাজির হতে পারতো না। উদীয়মান পুঁজিবাদ রিফর্মেশনকে সম্ভব করেছিল। কৃষক চৈতন্যের সমর্থনে সামন্তীয় যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফ্র্যান্সিসকান কিংবা সুফী ধারা এবং লালন, কবীর হাজির হয়েছিলেন। ইসলামের প্রভাব এবং শাসনক্ষমতায় মুসলমানদের উপস্থিতি চৈতন্যকে অক্ষত রেখেছিল। ইংরেজদের সমর্থন নিয়েই কিন্তু রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর লড়াই চালাতে পেরেছিলেন।
এগুলোর কোনোটাই কিন্তু 'আঘাত ও সংঘর্ষের' পথে হয় নাই। অন্যদিকে সমাজে যখন আধুনিক 'ধর্ম' হিসাবে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ দাঁড়িয়েছে শিল্পবিপ্লব ইত্যাদির মাধ্যমে নতুন শ্রেণী ও সমাজ ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে তখনই কিন্তু চার্চ পিছু হঠেছে। এসব কথার ইঙ্গিত একটাই যে, নতুন মতাদর্শ নিয়ে নতুন জীবনব্যবস্থা কায়েমের শক্তি ও দাবি সমাজে জোরদার হলেই বদল আসে। ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ করে নয়। ভেতরের সংস্কার অবশ্যম্ভাবী হয় যখন বাইরের সমাজটা খোলনলচে সহ বদলে যায়। সেরকম বদলের জন্য আমরা কী করছি?
ধর্ম যে জগতের মায়াবি প্রতিফলন, ধর্মের শেকড় যে বাস্তবতার বৈষম্য-নিপীড়ন ও অর্ধচেতন বোধের মধ্যে, আমি মনে করি, হাত দিতে হবে সেখানেই। আর্কিমিডিস বলেছিলেন, আমাকে মহাশূণ্যে লিভার ফেলবার একটা পাটাতন দাও আমি পৃথিবীকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেব। শূণ্যে কোনো কিছুর ওপর ভর দেয়া যায় না। তাই আর্কিমিডিসও পৃথিবীকে কক্ষপথ থেকে সরাতে পারেন নাই, আমরাও মানবজাতিকে ধর্মের কক্ষপথ থেকে সরাতে পারব না। মানুষের চেতনা-মস্তিষ্ক কোনো কম্পিউটার নয় যে, ধর্মের ভাইরাসকে আমরা নাস্তিকতার অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে সরাতে পারব।
এই যদি হয়, তাহলে ঐ 'আঘাত ও সংঘর্ষের' ফল হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। এই অভিজিত (এখানে খণ্ড ত নেয় না, তাই অভিজিতই লিখছি) আপনার সুন্দর ও যুক্তিশীল এবং পরিবর্তনবাদী মতের জন্য ধন্যবাদ। কথাগুলো ভাবিয়েছে। এবং ভাবনায় একটা প্রতিক্রিয়াও দানা বেধেছে। সেটাই এখানে শেয়ার করতে চাই। ধর্মের প্রভাব খর্ব করা বিষয়ে আপনার মোদ্দা কথাটা যদি বুঝে থাকি, তাহলে সেটা এরকম,
আপনি আঘাতের পথে বদলাতে চেয়েছেন। আমি ব্যক্তি মনীষিদের কথা বলছি না, ইতিহাসে ধর্মের বিরুদ্ধে বড় বড় বিদ্রোহগুলো হয়েছিল কিন্তু ধর্মের ভেতর থেকেই। রাজতান্ত্রিক ইসলামের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেন-হাসানের বেদঈন ইসলাম। কিংবা সুন্নি শরিয়তি ধর্মের বিরুদ্ধে শিয়া ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে সুফি পন্থার বিদ্রোহ। সনাতনী বর্ণবাদের বিপরীতে বৈষ্ণব-কবীর-নানকের পন্থা। আবার ক্যাথলিক শরিয়তীদের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট্যান্ট বিদ্রোহ (মার্টিন লুথার ও জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহ), অন্যদিকে চার্চের কাঠিন্যের বিরুদ্ধে ইতালি ও স্পেনের ফ্র্যান্সিসকান আন্দোলন। এরকম উদহরণ অজস্রই আছে। এসব নজির বলে যে, ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্মই বেশি কাজের হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে, এসব আন্দোলনগুলো সমাজের ভেতর পেকে ওঠা কোনো না কোনো দ্বন্দ্ব বা শক্তির সমর্থন ছাড়া হাজির হতে পারতো না। উদীয়মান পুঁজিবাদ রিফর্মেশনকে সম্ভব করেছিল। কৃষক চৈতন্যের সমর্থনে সামন্তীয় যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফ্র্যান্সিসকান কিংবা সুফী ধারা এবং লালন, কবীর হাজির হয়েছিলেন। ইসলামের প্রভাব এবং শাসনক্ষমতায় মুসলমানদের উপস্থিতি চৈতন্যকে অক্ষত রেখেছিল। ইংরেজদের সমর্থন নিয়েই কিন্তু রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর লড়াই চালাতে পেরেছিলেন।
এগুলোর কোনোটাই কিন্তু 'আঘাত ও সংঘর্ষের' পথে হয় নাই। অন্যদিকে সমাজে যখন আধুনিক 'ধর্ম' হিসাবে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ দাঁড়িয়েছে শিল্পবিপ্লব ইত্যাদির মাধ্যমে নতুন শ্রেণী ও সমাজ ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে তখনই কিন্তু চার্চ পিছু হঠেছে। এসব কথার ইঙ্গিত একটাই যে, নতুন মতাদর্শ নিয়ে নতুন জীবনব্যবস্থা কায়েমের শক্তি ও দাবি সমাজে জোরদার হলেই বদল আসে। ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ করে নয়। ভেতরের সংস্কার অবশ্যম্ভাবী হয় যখন বাইরের সমাজটা খোলনলচে সহ বদলে যায়। সেরকম বদলের জন্য আমরা কী করছি?
ধর্ম যে জগতের মায়াবি প্রতিফলন, ধর্মের শেকড় যে বাস্তবতার বৈষম্য-নিপীড়ন ও অর্ধচেতন বোধের মধ্যে, আমি মনে করি, হাত দিতে হবে সেখানেই। আর্কিমিডিস বলেছিলেন, আমাকে মহাশূণ্যে লিভার ফেলবার একটা পাটাতন দাও আমি পৃথিবীকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেব। শূণ্যে কোনো কিছুর ওপর ভর দেয়া যায় না। তাই আর্কিমিডিসও পৃথিবীকে কক্ষপথ থেকে সরাতে পারেন নাই, আমরাও মানবজাতিকে ধর্মের কক্ষপথ থেকে সরাতে পারব না। মানুষের চেতনা-মস্তিষ্ক কোনো কম্পিউটার নয় যে, ধর্মের ভাইরাসকে আমরা নাস্তিকতার অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে সরাতে পারব।
এই যদি হয়, তাহলে ঐ 'আঘাত ও সংঘর্ষ' তত্ত্বকে কারো কারো কিন্তু
আমেরিকার ওয়ার অন টেররের 'শক অ্যান্ড অ' এর সঙ্গে মেলানো বলে মনে হতে পারে! এবং ঐ শক অ্যান্ড অ যেভাবে প্রায় সেক্যুলার ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবাননকে আবার ধর্মীয় আবরণে লড়াইয়ের যুগে ফেরত পাঠিয়েছে, তাতে এ নিয়ে আমারো ভয় বেশি। বাংলাদেশে তসলিমা নাসরীনদের ভুল ভাষা ও নিয়তের নিট ফল হলো তার আগে যেভাবে কথা বলা যেত, এখন সেভাবে যায় না।
ধর্ম মানুষের বুদ্ধিবিভ্রাট থেকে জন্মায় নাই, তা ইতিহাসের বিশেষ কালপর্বে মানব অগ্রগতির বাহন হিসাবেই এসেছে। ইতিহাসকে যদি আমরা ততদূর অগ্রসর করতে পারি, তাহলে মানুষ এ আবরণ ছেড়ে আসবে। শাসকরা যদিও তখন ধর্মের ব্যবহার করে যাবে, তাতে জনমানুষের বিশেষ সায় থাকবে না। আর এ কাজটা নিছক বুদ্ধিজীবী বা বিজ্ঞানীর কাজ নয়। সামাজিক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একগুচ্ছ পদক্ষেপ সেখানে দরকার হবে।
ধর্মানুভূতির অসহিষ্ণুতা নিয়ে ডগলাস এডামের যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, সেখানে একটি জিনিষ ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা নাই। উনি লিবেরাল পরিসরে বিতর্কের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করছেন। লিবেরাল পরিসরে যে বিতর্কের উদাহরণ উনি দিয়েছেন সেগুলো পরিমাণগত: যেমন দল, সরকারের কর্মসূচি, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ ইত্যাদি। ওখানে পরস্পরের একটা সাধারণ পাটাতনে থেকে আলোচনার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। নাস্তিক্যবাদীরা ধর্মের সঙ্গে যে বাহাস করেন, সেটা কিন্তু ওরকম টুকিটাকি বিষয়ের বিতর্ক নয়, ধর্মের দাবির অস্তিত্ব নিয়ে। লিবেরাল সংস্কৃতিতেও অসহষ্ণুতার উদাহরণ কিন্তু ধর্মের অসহিষ্ণুতার থেকে বেশি। নইলে উপনিবেশগুলোতে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করা হতো না, দুটি বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মরতো না। কেবল আমেরিকার পথে এবং পশ্চিমা মডেলে চলতে চায়নি বলেই, ইরাক-আফগানিস্তানে আগ্রাসন চাপিয়ে দেয়া হতো না। পশ্চিমা নারীবাদ আর প্রগতিবাদ কতটা ধ্বংসাত্মক ও ফ্যাসিস্ট হতে পারে তার প্রমাণ মধ্যপ্রাচ্যের আজকের হাল এবং ইউরো-আমেরিকায় ইসলাম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা। এই নারীবাদ আফগানিস্তানে আগ্রাসনের কাজে বৈধতা দিয়েছে, পশ্চিমা মানবাধিকার ডিসকোর্স ইরাকে আক্রমণকে আইনী না হলেও নৈতিক বৈধতা দিয়েছে। এখানেই আমি স্নিগ্ধার মূল প্রত্যয়ের সঙ্গে একমত যে, তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব নারীবাদের প্রয়োজন রয়েছে। একে আরেকটু প্রসারিত করে বলতে চাই, আমাদের মুক্তির পথ আমাদেরই রচনা করতে হবে। আর তা আসবে আমাদের সমাজের দ্বন্দ্ব ও সম্ভাবনার নিজস্ব ব্যকরণ মেনে। কোনো ইউনিভার্সাল যুক্তিবাদ আর তার আখেরি নবী পশ্চিমা মানবতাবাদের মুরিদ হলে সর্বনাশ। দুশ বছরের উপনিবেশিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর সাম্প্রতিক বিশ্ব দেখে এ কথা বলার হক আমাদের জন্মেছে। আপনাকে আবারো অভিনন্দন।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
এইক্ষেত্রে আমার জিজ্ঞাস্য হইল যাহারা ইতোমধ্যেই অবিশ্বাসী তাহারাও কিন্তু বিভিন্ন ধরণের social being. ইত্যবসরে তাহারা কি কিংকর্তব্য অবস্থানে বিমূঢ় গাঁথিয়া যাইতে বাধ্য থাকিবেন? তাহা কি প্রয়োগসিদ্ধ ক্রিয়া? বিগত দেড়শত বৎসরে বাকিদের সহিত তাহাদেরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়াছে। পূর্বাপর এবং উপনিবেশসমূহের তাবৎ মধ্যশ্রেণীর মধ্যস্তর হইতে ছাপোষা দঙ্গল (প্রচলিত অর্থে) কার্যত: অবিশ্বাসী। প্রাত্যাহিক জীবনে তাহারা অবিশ্বাসের অনুশীলন করেন। আপনার দাবী মোতাবেক ধর্মের মতো নির্ধারিত প্রশ্বাস মাত্রেই উহারা বিলুপ্ত হইবেন না। দ্বন্দ্বের বিপরীতে যদি ঘুঘু সাহেবরাই অবস্থান করেন সেক্ষেত্রে এই গলদঘর্ম কেরানীর দঙ্গলও পাকে চক্রে কামলাদিগের কাতারে পড়িবেন। তাহাদিগের সহিত আসিবেন প্রকৃত কামলাগণের বুভুক্ষু প্রতিনিধিগণ। ক্বচিৎ স্থিত প্রকৃতিবাসীগণ অভিজ্ঞতার ফাঁদে পতিত মানিতেছি। কিন্তু ওহাবী হউক বা সুফী কে, কোন বরাহ প্রপঞ্চ তাহাদিগের পশ্চাদ্দেশ না ফুরিয়া প্রতিষ্ঠাণের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত সাংস্কৃতিক বিনির্মানের দূরূহ কর্মসম্পাদন করিতেছে তাহার বস্তুগত প্রত্যক্ষ উদাহরণ (যাহা কোন অবস্খাতেই আরব জাতীয়তাবাদের প্রেত নহে...আরব জাতীয়তাবাদী যুদ্ধসমূহ সনাতন-আধুণিক উভয় সংজ্ঞার্থে স্বাধীনতা সংগ্রাম) পাইলে কৃতার্থ হইতাম। এইরূপ জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য অতিবিদগ্ধ কতিপয় বামাচারীকে আজিকালি ঠিক এই প্রসঙ্গে অতীব ধূম্রাচ্ছন্ন বয়ান চালিতে দেখা যায়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে বিগত বছর কুড়ি ফতোয়া বিষয়ক যতরকম গোল দেখা দিতেছে তাহার সকল নির্ধারক acterই গণঅভিজ্ঞতার আধ্যাত্মবোধের প্রাতিষ্ঠাণিক চালবাজীর প্রতিনিধিত্ব করেন। যাহারা বিশ্বাস করেন তাহারা সরাসরি প্রতাড়িত হন। যাহারা বিশ্বাস লইয়া খেলেন তাহারা সকলেই প্রফিট মেকানিজমের ব্যতিক্রমহীন দালাল। সুতরাং ফতোয়াবাজী ও ফতোয়াবাজ উভয় প্রপঞ্চ ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় আদিম বা তথাকথিত বা কল্পিত সনাতন ক্ষমতা কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করেন যাহা কিনা বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোর নিয়ন্ত্রকগণের বিপরীতে অবস্থান করে তাহাও প্রমাণ করিতে হইবেক।
বিশেষত বছর কুড়ি পূর্বে একবিশ্ব ব্যবস্খার পথ পরিস্কার হইবার সাথে সাথে বাংলাদেশ প্রমূখ প্রান্তিক অঞ্চলে সেবাসংঘের আদলে পূর্বোল্লিখিত মধ্যশ্রেণীর পাকস্থলীর দায়ভিত্তিক অংশগ্রহণে যে নবধারার প্রভুভক্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তাহারাই, প্রাতিষ্ঠাণিক অলৌকিক বিশ্বাসের বলিগণকে বাঁচাইবার সোল এজেন্সি গ্রহণ করিয়া বসেন, যাহা হয়তো ঐতিহাসিক কিম্বা আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী সাপেক্ষে এক বিশ্বব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিপক্ষের নেতৃত্বাধীন হওয়াই ইতিহাসের বিচারে সঠিক হইতো। এখন এই হইতোর অভিমানে আসলে আমি বা আপনি বা আপনারা বা সেই তাহারা কেউই কিন্তু আসলে রিভার্স অবস্থানে যাইতে পারি না। গেলে কার্যত মহাজনের কোঁচড়ে কড়ির যোগানই দেওয়া হবে। বিশ্বজগতে এমন কোন ধর্মের এমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক গুরু নাই যিনি মহাজনের পদলেহী সারমেয় নন। পুন: পুন: আঞ্চলিক অলৌকিক বিশ্বাসব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক বাটপারীর ডাক কিম্বা তাহাকে শ্রেণী সংগ্রামের প্রতিভূ বানাইবার অপচেষ্টাসমূহ ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠাণকেই শক্তিশালী করিতেছে না, তাহা দুয়ে দুয়ে চার যুক্তি কাঠামোর আওতায় জানাইতে বুঝাইতে আজ্ঞা হোক।
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
প্রিয় সুমন, আমার প্রতিক্রিয়া কিন্তু ক্রিয়া নির্ধারিত। সেই ক্রিয়ার মধ্যে ধর্মের জেনেসিস ছিল এবং ছিল তার ভেতরকার পুরুষতান্ত্রিকতার সমালোচনা। সেই সমালোচনার সঙ্গে মোটা দাগে একাত্ম হয়ে আমি দেখাতে চেয়েছি স্বতন্ত্র জেনেসিস এবং পুরুষতান্ত্রিকতার ছাউনি পাকাপোক্ত হওয়ার ইতিহাস আবার সেই ছাউনির তলায় মুক্তির লড়াইয়ের আকুতি। সেই আকুতিও ধর্মেরই আকুতি।
আমরা মেনিস্টোকে উধ্বৃত করে বলি না যে, এ যাবতকালের ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামেরই ইতিহাস। তার মানে ধর্মের ভেতরে ও বাহিরে যে ইতিহাস তার মধ্যেও কিন্তু শ্রেণীসংগ্রাম থাকতে পারে। আর প্রাচ্যে (এঙ্গেলস বলছেন) যেহেতু শ্রেণী পরিগঠন ইউরোপের মত করে হয়নি সেহেতু একানকার ইতিহাস ধর্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে একটা যুগ পর্যন্ত। এবং আজো তার রেশ রয়ে গেছে। তাহলে ধর্ম মানে কোনো একাট্টা বিশ্বাসের জগত বা বিধির মার্শাল ল নয়। তার ভেতরেও স্ববিরোধ যেমন আছে তেমনি আছে নারী বা শ্রেণীর তরফে অধিকারনামার স্বাক্ষর। আমি কেবল একে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিকভাবেই পাঠ করার আগ্রহ জানিয়েছি।
এ পর্যন্ত যদি মানি, তাহলে আজকেও ধর্মের নামে যা হচ্ছে, তা নিছক ধর্ম নয়। পুঁজি এবং তার জাত অনুন্নয়ন এখানে সাম্রাজ্যের রূপেও ফেরত আসছে আবার ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীলতাকেও জাগাচ্ছে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, এদেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং কোরানের অনুসরণ যখন পুঁজির নতুন মূল্যবোধের কারণে পিছু হঠছে, ঠিক তখনই ধর্মের ছাল গায়ে নিয়ে ক্ষমতার নতুন শরিকরা পুঁজির ছত্রছায়াতেই এগিয়ে আসছে। এখন আমি এর বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধী জেহাদ করবো না, ছায়া ফেলে কায়াকে কাবু করার চেষ্টা করবো। আমি মনে করি, আজকে প্রধান শত্রু মৌলবাদ নয়, আগের যে যে ধর্মবোধ মরে যাচ্ছে সে নয়, প্রধান শত্রু সাম্রাজ্যবাদ। একে ধরলেই ওর অবস্থা কাহিল হবে। মার্কস যে অর্থে স্বর্গের সমালোচনাকে বাস্তবের সমালোচনায় পরিণত করার কথা বলেছিলেন, সেই অর্থেই। তবুও জিজ্ঞাসাটা রইল।
এটুকু না বলে না নিলে এখানে আসতে পারতাম না। এরপরে এসেছে,
নাস্তিক্যবাদ প্রচার করে কোনো লাভ হয় বলে আমার জানা নাই। যাহারা ইতোমধ্যে নাস্তিক হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু হয়েছেন বৈষয়িক অবস্থার একটা বিকাশে পৌঁছে। গরিব ধার্মিকদের জন্য সেই বৈষয়িক অবস্থাটা এনে দেয়া হোক, অবস্থা বদলে যাবে। এর অর্থ নিরেট অর্থনীতিবাদী কর্মসূচির কথা আমি বলছি না। বলছি যে, এ কাজে শর্টকাট কোনো পথ নাই। ধর্ম তো পশ্চিমেও অন্য রূপে ফিরে আসছে। নাস্তিক্যবাদ কি তার প্রকোপ কমাতে পারছে?
দ্বিতীয়ত, নাস্তিক্যবাদ একধরনের ব্যক্তিবাদী প্রক্রিয়া। আস্ত সমাজ কখনো এ পথ অনুসরণ করে না। কিন্তু এ পথের পথিকদের অনেকেই যে সভ্যতার বিকাশে ভূমিকা রাখেন নাই, তা বলা যাবে না। একই কথা বিশ্বাসীদের প্রসঙ্গেও বলা চলে।
তবে তাঁরা কিন্তু বিমূঢ় কিংকর্তব্য দশায় নাই। একদল জনতাকে সঙ্গি করে মুক্তির পথে চলছেন। আরেকদল ওয়ার অন টেরর আর স্যাম চাচার বিশ্ববিজয়ে সামিলও হচ্ছেন। সেকারণেই নাস্তিক্যবাদী বলে কোনো বর্গ করার বিপক্ষে আমি। কারো সামাজিক অবস্থান ও ততসংলগ্ন বিশ্বদৃষ্টিকেই এক্ষেত্রে আমলে নিতে হবে।
তবে ধর্মের নামেই হোক আর শয়তানের নামেই হোক, অধিকাংশ মানুষের পক্ষে যে কোনো ততপরতাকেই আলিঙ্গন করতে হবে। সে হিজবুল্লাহ না মাওবাদী সেটা প্রধান আলোচ্য নয়। তার সামাজিক রাজনৈতিক কর্মসূচিটাই আলোচ্য। নইলে এঙ্গেলস জার্মানির কৃষকযুদ্ধে সর্বস্ব বাজি রাখতেন না, আর টলস্টয়কে লেনিন রূশ বিপ্লবের দর্পণ বলতেন না।
একই কথা আজকেও। ধর্মের নামে জুলমবাজদের হাতে নাচার দলকে দিয়ে ধর্মে আধা-পূর্ণ-মেকি বা আচরণসর্বস্ব কিন্তু প্র্যাক্সিসে বিকাশমুখী বা প্রতিরোধী এমন জনগোষ্ঠীকেও কেবল টুপি বা দাড়ি থাকার জন্যই ইতিহাসের কারিগরের ভূমিকা থেকে বাতিল করে দেব না। নতুন দর্শন আসার আগে ধর্মীয় নৈরাজ্যবাদ বা প্রগতিবাদী নৈরাজ্যবাদ আসে। লক্ষণ দিয়েই এদের মূল্যায়ণ করতে হবে, নাম দিয়ে নয়।
হ্যাঁ, আজকে মুসলমানদের মধ্যে একদল লিবারেশন থিওলজিস্ট দেখা যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার বঙ্গদেশে এই ধারার সেনাপতি। কিন্তু এনারা যদি ডান বিচ্যুতি ঘটিয়ে থাকেন তবে উমর ভাইরা ঘটাচ্ছেন বাম বিচ্যুতি (তোমার ভাষায় বললাম)।
তাঁরা ইতিহাসকে অস্বীকার করে, ধর্মের ভেতরের শরিয়া নামক বানোয়াট ও আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা না করে, জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ভুলভাবে ধর্মীয় সংগ্রাম বলে এবং পশ্চিমা নারীবাদের সমস্যার অজুহাতে ইসলামকে আনক্রিটিকালি মহিমান্বিত করার নামে যা করছেন, তা রীতিমতো আত্মঘাতী। সেই খেতা বহু আগেই পুড়াইয়া আসিয়াছি। আমাকে নিয়া সেই ভয়ে মাতিও না।
কিন্তু আবারও বলি, ধর্মতন্ত্র আর ধর্মভাব এক নয়। আমাদের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৌশলী এবং দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম করতেই হবে। কিন্তু ধর্মভাব মানুষের চিরন্তন মজ্জাগত মেটাফিজিক্স। অপরের জন্য অধরার জন্য, নিজের সত্তাস্বরূপের জন্য মানুষের চেতন যতদিন বেদনভরা থাকবে, ততদিন এও থাকবে। আমার ধারণা চিরকালই। তবে তার আদল পাল্টাবে। গতকাল চে'র পোস্টে চে-কে নিয়া প্রার্থনা করা কিংবা রাশিয়ায় লেনিন বা চীনে মাও পূজাও কি অধিবিদ্যার ফল নয়? কিঞ্চিত মেটাফিজিক্স না থাকলে বিজ্ঞানও হয় না, শিল্পও হয় না, আর প্রেম তো নৈব নৈব চ!
আর বামপন্থিগণ যতদিন বুর্জোয়া জড়বাদের খপ্পরে থাকবেন, যতদিন পুস্তকের আঁধারে জীবন্ত মানুষের নড়াচড়ার কুহক ধরার ব্যর্থ কোশেশ করবেন, ততদিন মেকি লোকেরা তো রাজত্ব করবেই। তোমার কি মনে হয় না, আজকের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা ও বদলানোর তাকদ তাদের (আমাদের/আমার মতো) মরচে ধরা, অর্ধচেতন তাত্ত্বিকতার সাধ্য নয়। সাবেক সমাজতন্ত্রী এবং উপনিবেশিত দেশগুলোতেই আজ কেন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান বেশি দেখা যাচ্ছে। ধর্ম প্রশ্ন যদি আমরা মীমাংসা করে ফেলেছি মনে করি, তাহলে ইতিহাসকে আমাদের জন্য এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অথবা ইতিহাসের ট্রেন আমাদের ছাড়াই চলে যাবে আর আমরা ভাবব, নয়টার ট্রেন কয়টায় আসবে যেন?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
কথাটা একই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি যা বললেন তা আমি জানি। আমাদের সর্বশেষ সাক্ষাতেও জানতাম। আমার প্রশ্ন ছিল ধর্ম থেকে শুধু অভিজ্ঞতা বিশ্লেষনের কারণে মানুষ ইতোমধ্যে যতটা সরে এসেছে সেই প্রসঙ্গে। এই সরে আসা শুধু এনলাইটেনমেন্ট প্রভাবিত মধ্যশ্রেণী না প্রান্তিক সমাজেও ঘটেছে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে যা চর্চা করেন সেটা তো আর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষন বহির্ভূত না। কোরানে বর্ণিত ইসলাম, বাইবেলে বর্ণিত খ্রীষ্ট ধর্ম বা ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদী ধর্মের মতোই বাস্তব জীবনে অনুসরণের অযোগ্য। ইতিহাসে এই অনুসরণের কোন বাস্তব উদাহরণ নেই। এই ঐতিহাসিক তথ্যের সুচতুর অনুল্লেখ কি কার্যত শায়খ রহমান-বাংলা ভাইদেরই শক্তিশালী করে না?
পুঁজিবাদী সমাজে নারী মুক্ত না। এই কথা একশতবার সত্য। কিন্তু তার চাইতেও অনেক বড় সত্য পুঁজিবাদী সমাজে(পশ্চিম ইউরোপ গলা পর্যন্ত পুঁতে পাথর ছোঁড়া হয়না, আগুনে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করা হয় না। এই অগ্রসর অবস্থান কোত্থেকে এলো? সেই ইতিহাস আপনি আপনার প্রথম মন্তব্যে বলেছেন। আমার বিরোধ কিন্তু সেখানে ছিলো না। আমার প্রশ্ন ছিলো আমরা কি নতুন করে প্রত্যাখ্যাত পথে হাঁটবো?
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
এই ঐতিহাসিক তথ্যের সরাসরি উল্লেখ আমার ওপরের মন্তব্যগুলোতে আছে। তথ্য আকারে নয়, পর্যবেক্ষণ আকারে। ধর্ম বর্ণিত আচরণবিধি বা শরিয়া যে অনুসরণের অযোগ্য, তা বলার জন্য বিশেষ জ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। অভিজ্ঞতাই তা বলে দেয়, এটা আমরা উভয়েই মানি ও জানি। তাই আলোচনাটা এখানে ঘুরপাক খাওয়ানোর দরকার নাই। যা অনুসরণের অযোগ্য এবং যার প্রবক্তারাও সেটা যখন অনুসরণ করে না, তখন যুক্তির স্বত:সিদ্ধি রায় হচ্ছে, তার মানে সে যা করছে সেটা ধর্মনির্দেশিত নয়, জাগতিক স্বার্থ ও শ্রেণীগত বা গোষ্ঠীগত আকাঙ্ক্ষা নির্ধারিত। এটা নতুন, অতীতের পুনরূত্থান নয় এবং তা নিয়ত পরিবর্তনশীল। তা যদি হয়, তাহলে 'মৌলবাদ' বলে স্থির-অচল বলে কোনো জিনিষ থাকা সম্ভব নয়। কারণ, সেই কথাটাই যে, মৌলবাদ অনুসরণযোগ্য নয় বলেই পসিবলও নয় এবং তা বলেই এরকম কোনো জিনিষের অস্তিত্বই নাই। এ সত্য উদঘাটন ছাড়া 'মৌলবাদ' বিরোধী সংগ্রাম আসলে হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজার কসরত ছাড়া আর কিছু নয় এবং কোথাও তা সফল হয় নাই। এটা হলো পয়লা নম্বর প্রশ্ন।
আমার ২য় প্রশ্ন এই যে, যাকে আমরা ধর্মের প্রত্যাবর্তন দেখছি (এখানেও বিভিন্ন জনের মন্তব্যে এর ছায়াপাত আছে এবং ফরহাদ মজহারের মোকাবেলার মূল প্রপঞ্চই এটি), তা আসলে রিলিজিওসিটি নয়, রিলিজিয়ন তো নয়ই_তা বাস্তবত ইহজাগতিক স্বার্থ ও আন্দোলনের ধর্মীয় রূপ। রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী এটা করে তখনই যখন সে, তার দাবিকে জাগতিক বৈধ দাবি হিসাবে আনতে অক্ষম। কারণ তার রাজনীতি তখনও অপরিপক্ক। এটা তার অবিকাশের ফল। তারপরও সেটা রাজনীতিই, একে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। অর্থাত নির্দিষ্ট সমস্যার নির্দিষ্ট বিশ্লেষণজাত নির্দিষ্ট করণীয় ঠিক করতে হবে। তা করতে গেলে দেখা যাবে, বহুলাংশে বিশ্বায়নের চাপে পুরাতন সমাজ ও মূল্যবোধের ধস, পঁজির অবাধ ঢলে ফেঁপে ওঠা নিম্ন মধ্যবিত্তর রাজনৈতিক স্পৃহা, দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থের মদদ ইত্যাদির মাধ্যমেই পলিটিকাল ইসলাম বঙ্গদেশে মাথা তুলেছে। এটা ধর্মজাত নয়, আধুনিকতা ও পুঁজিবাদের সংকটজাত। এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানদের কথা এসেছে। এটা এখানকার ইসলামী আন্দোলনের বহিস্থ উপাদান। অনেকাংশে গোয়েন্দা সংস্থা ও একটি দূতাবাস এবং সরকারের একাংশের মদদে একে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এখনও এ জাতীয় জিনিষের চাষবাস হচ্ছে রাষ্ট্রের মদদেই। ল্যাটিন আমেরিকার মত কৌশলে এদের দিয়ে বামপন্থিদের দমন এবং এদের প্রকোপ বৃদ্ধির অজুহাতে বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বলা এবং এর রিমেডি হিসাবে রাষ্ট্রকে আরো সশস্ত্র ও মার্কিনিদের উপাঙ্গে পরিণত করাই ছিল উদ্দেশ্য। এ নিয়ে আমি গত কয়েকবছর ধরে খোঁজ রেখেছি। এখন একে দেখেই যদি মনে করি বাংলাদেশ তালেবান বা আলকায়েদার হাতে যাচ্ছে সেটা অতি মারাত্মক ভুল হবে। বাংলা ভাইদের মতো এজেন্টদের অতি বড় করে দেখা কার হাত শক্তিশালী করে তোলে, সেটা ভেবে দেখার অনুরোধ করি।
এদেশে ধর্মীয় স্ট্যাবলিস্টমেন্টের থেকে পুঁজিবাদী স্ট্যাবলিস্টমেন্ট ও ইহজাগতিকতার সংস্কৃতি অনেক প্রবল হয়েছে গত দুই যুগে। প্রধান ইসলামী দল জামাত পুরোদস্তর মার্কিনাশ্রিত এবং পুঁজিবাদী দল। রিচার্ড বাউচার বাংলাদেশ বয়ে এসে সেই স্বীকৃতিও দিয়ে গেছে। তাদের নিয়ে ভীতি ইসলামের দিক থেকে নয়, সাম্রাজ্যবাদের ও কায়েমি শক্তির ঠ্যাঙারে বাহিনী হিসাবেই তাদের ভয়। পুঁজিবাদকে এরা যতটা সার্ভ করতে পারে ও পারছে বাংলাদেশে আর কোনো বুর্জোয়া দল তা পারে না।
প্রতিটি মুসলিম দেশেই ইসলাম ভার্সাস সেক্যুলারিজমের কৃত্রিম গৃহবিবাদ লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্র তৈরি করাই এই ডিজাইনের উদ্দেশ্য। এতে করে জনগনের একাংশে ঠেলে জনবিচ্ছিন্ন ইসলামওয়ালাদের দিকে নেয়া এবং আরেক অংশকে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ও তাদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষপুটে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইরাকে যা হচ্ছে, এখানেও অন্য কৌশলে তা-ই হচ্ছে। ইহজাগতিক রাজনৈতিক সংগ্রামকে জোর করে ইসলামী লেবাস দেয়া গেলে তাকে কতল করতে ও ব্যর্থ করতে সুবিধা। তাতে মার্কিন অনুপ্রবেশেরও সুবিধা হয়। আইএসআই-সিআইএ-তালেবান ত্রয়ীর ইতিহাস স্মর্তব্য।
হ্যাঁ, তবে আমি ঘুরপাক খেয়ে হলেও আবারো জোর দিয়ে বলতে চাই, কোনো মৌলিক দ্বন্দ্ব যখন সমাজকে পীড়িত করে, তখন চেতনার সকল দেশে তার প্রভাব পড়ে। এ প্রভাবে আজকে যেমন রাজনৈতিক ইসলামের একটা ধারা সাম্রাজ্যবাদের হাতে কিংবা তাদের অঙ্গীভূত সেনাবাহিনী ও বুর্জোয়াদের হাতের পুতুল হচ্ছে (আল কায়েদা ও তালেবান এর উদাহরণ), তেমনি ধর্মের অচলায়তন ডিঙিয়ে জাতীয়তাবাদী ও আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামেও ধর্মাশ্রিতরা সামিল হচ্ছে (হিজবুল্লাহ ও হামাস এর উদাহরণ) বাংলাদেশে এই দ্বিতীয় ধারাটির তেমন উপস্থিতি নেই। প্রথম পক্ষরাই এখানে রাজত্ব করছে। তাই আমি একমত যে, এদের মহিমান্বিত করা বা ডিফেন্ড করা চাতুরি ও আত্মঘাতী। উপরূন্তু শরিয়ার দাবি ত্যাগ না করে কোনো ইসলামপন্থির পক্ষেই জনগণের স্বার্থে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই আমি নতুন করে প্রত্যাখ্যাত পথে হাঁটার দাওয়াত নিয়ে এসেছি, এ মনে করলে আমার দুঃখিত ও ব্যর্ধ বোধ করা ছাড়া আর কি করার আছে? এই লেখাটা দেখার অনুরোধ করি, http://www.somewhereinblog.net/blog/farukwasifblog/28787179
নাস্তিক্যবাদ প্রসঙ্গে যে কথাটা এসেছে যে, এরা তবে কী করবে? আমি বরং উল্টোভাবে প্রশ্নটা করি, এঁরা যেভাবে একটানে ধর্মকে সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করছেন, সেই পথে কি এদেশের বা কোনো দেশের মধ্যশ্রেণীর বড় অংশ কিংবা সেক্যুলার স্পেসে সক্রিয় প্রান্তিক শ্রেণীগুলো যাবে? তাতে তাদের কী লাভ? ধর্মের বিরুদ্ধে যদি কোনো লড়াই থেকেই থাকে সেটা ধর্মের জমিনে ঢুগে উল্টা ওয়াজ করে হবে না, ধর্মীয় ইস্যুকে জাগতিক ইস্যুতে পরিণত করে ধর্মকেই বরং সেক্যুলার স্পেসে নিয়ে আসতে বাধ্য করতে হবে। রুটি-রুজি এবং মান-পরিচয় রক্ষার লড়াইয়ে তার যোগ্যতা কতটা সেই পরীক্ষায় তাদের ফেলতে হবে। হিজবুল্লাহরা এ কাজে যত এগুচ্ছে ততই কিন্তু সে সেক্যুলার স্পেসে ঢুকে সেক্যুলার দাবি (স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ইত্যাদি) নিয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। ইরানের সরকারও ধর্ম থেকে শুরু করলেও ভেতরে ভেতরে আসলে জাতীয়তাবাদী। এখানেই তার প্রাসঙ্গিকতা দেশের ভেতরে বা আমাদের কাছে। শ্যাভেজ যতই সমাজতন্ত্রের ওয়াজ করুন, তাঁকেও কিন্তু মতাদর্শের মাঠে নয় আর্থ-রাজনৈতিক মঞ্চেই লড়তে হয় এবং হচ্ছে।
অন্যদিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে এই কথাগুলো_
কতটা যৌক্তিক। বাংলাদেশে কয়জন নারী যৌতুক, ফতোয়া কিংবা ইসলামীদের হাতে নিপীড়িত হয়েছে? এদের সংখ্যা হাতে গোণা। (আমি এখানে ধর্মীয় পুরুষতন্ত্র আর পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্রের মধ্যে তুলনা করে মন্দের ভাল নির্বাচন করছি না। কারণ দুটি ভিন্ন পরিসরে দুটিই অনিবার্যতা আকারে এসেছিল) আর কত হাজার জন নারী পাচারকারীদের হাতে, এসিডে, ধর্ষণে, খুনে নিঃশেষ হচ্ছে? ইওরোপ-মার্কিন নিজে দেশে যতটাই সভ্য অন্যদেশে ততটাই অসভ্য। ততটাই খুনে, ধর্ষক এবং নারী মাংসের ব্যাপারী। এ দুই মাত্রাকে আলাদা করে দেখা সম্ভব কীভাবে? বরং দুই প্রকৃতির শত্রুর প্রতি দুই ধরনের অ্যাপ্রোচ থাকাই সমীচিন।
দুঃখিত ব্যাখ্যা দিতে দিতে করণীয়র আলোচনা স্বতন্ত্রভাবে করা গেল না। মধ্যে মধ্যে পুরে দেয়া গেল কিছুটা। তবে বাকিটার জন্য স্বতন্ত্র আলোচনা প্রয়োজন। আমাদের প্রেমিজ নিয়েই আমি চিন্তিত বেশি। কেননা, এখনও আমার মনে হয়, আমাদের সর্বশেষ সাক্ষাতের পর এখন দুনিয়া আরো উন্মোচিত হচ্ছে, আমাদেরও ঝোঁকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনা হাজির হয়েছে। http://www.somewhereinblog.net/blog/farukwasifblog/28798605
দীর্ঘ আলোচনার জন্য দুঃখিত, এটা বোধহয় মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমাসুন্দর হবার অনুরোধ জানিয়ে রাখছি।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
এইবার ঠিকাছে
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
জ্বি স্যার। চলেন, হুজুরে পাকের দরবারে সিন্নি দিই...
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
সিন্নি শুইনা মনে পড়লো একবার কোন এক মাজারে জিকির পরবর্তী খিচুড়ি আর গরুর গোস্ত খাইছিলাম জিকিরে অংশ না নিয়াই
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
মাত্র একবার, নাকি আরো আছে?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
পোস্টটা কমেন্টের ভারে নুব্জ, আপনি আরেকটা আলাদা পোস্ট দেন এই টপিকে। আপনার মত আমার থেকে আলাদা, তবে শুনতে ভালই লাগছে। একটু গুছিয়ে একটা আলদা পোস্ট দেন না ...
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
বারো ভাতারি কাজ করি, সময় মেলাতে পারি না। তবে এ নিয়ে কয়েক কিস্তি লেখার ইচ্ছা আছে। নিজের বুঝটা একটু পরখ করা দরকার। অন্য কারণে নয়, কারণ এ বিষয়ে আমার চিন্তাটা একটা ট্রানজিশন পার করছে। এটা থিতু হলে কেমন হয় সেটা দেখার জন্যই।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
স্নিগ্ধা,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য, এবং অবশ্যই মন্তব্য করবার জন্যও। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই ‘ধর্ম’ বিষয়টাই আজকের পৃথিবীতে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বাহুল্য মনে করি। তা নারী-পুরূষ সবার জন্যই কথাটা খাটে। তবে ঘটনা হল, পুরূষ প্রজাতির ধর্মের প্রতি বিরাগ থাকার খুব একটা কারণ দেখিনা, তাদের তো মাশআল্লাহ লাভের কোন সীমা পরিসীমা নেই ঃ-)। তাই নারীদের কথাই বলতে হচ্ছে, তারাও যেন নিজের ভালোটা বোঝে, এই আর কি ঃ-)!বেহেস্তের লোভে পরে আম-ছালা দুটোই যেন না হারাতে হয় । হা হা হা
ভালো থাকুন।
নন্দিনী
স্নিগ্ধা,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য, এবং অবশ্যই মন্তব্য করবার জন্যও। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই ‘ধর্ম’ বিষয়টাই আজকের পৃথিবীতে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বাহুল্য মনে করি। তা নারী-পুরূষ সবার জন্যই কথাটা খাটে। তবে ঘটনা হল, পুরূষ প্রজাতির ধর্মের প্রতি বিরাগ থাকার খুব একটা কারণ দেখিনা, তাদের তো মাশআল্লাহ লাভের কোন সীমা পরিসীমা নেই ঃ-)। তাই নারীদের কথাই বলতে হচ্ছে, তারাও যেন নিজের ভালোটা বোঝে, এই আর কি ঃ-)!বেহেস্তের লোভে পরে আম-ছালা দুটোই যেন না হারাতে হয় । হা হা হা
ভালো থাকুন।
নন্দিনী
..................।।
আমার এই জবাব নীচে চলে গেলো কি করে বোঝলাম না ।।
আমি বিশ্বাসী এবং ইসলামে বিশ্বাসী। আপনার কথায় ভালো যুক্তি আছে। তবে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কোরানকে আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। কিন্তু তাকে পরিবর্তনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করছি। যেহেতু বিশ্বাস করি কোরন ঐশি গ্রন্থ। আপনার উল্লেখিত মুসলিম ফেমিনিস্টদের মতোই আমিও 'নারীর পূর্ণ অধিকার তাদের পেতে হবে' বিশ্বাস করি। আমার মা, আমার বোন, আমার স্ত্রী, আমার কন্যা সবাই নারী যাদের আমি ভালোবাসি। সেই অবস্থান থেকেই আমি মনে করি নারীর অধিকার কোথাও খর্ব হলে সেখানে কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার অধিকার শেষ পর্যন্ত ক্ষুন্ন হচ্ছে। ফারুক ওয়াসিফ যেমন বলেছেন ভিন্ন ব্যাখ্যার কথা আমারও সেমত। আমি নিজে আরবি ভাষা জানিনা বলে কারো অনুবাদে বা বিশ্লেষণে ততটা ভরসা করি না। আরবি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের মাধ্যমে কোরানকে ব্যাখ্যা করার সুযোগটা কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। যদি কোরনের পরিবর্তন হয় তাহলে আপনি কিন্তু মূল বক্তব্য থেকে ধীরে ধীরে সরে যাবেন। তবে কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময়টা সম্পূর্ণ আলাদা পরিপ্রেক্ষিত ছিল বলেই ইসলামে ইজমা কিয়াসের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্লেষণে ইসলামকে যুগোপযোগী করার সুযোগ সেখানে রাখা হয়েছে। তবে কোরানের মূল টেক্সট্ কে পরিবর্তন করায় বিভ্রান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করি। আর যদি কোনদিন মানব সভ্যতা ধর্মবিবর্জিত হয় তাহলে সেটা অন্য কথা। তখন পরিবর্তন, পরিমার্জনের প্রশ্নই উঠবে না। তবে এখন আমি মনে করি যার যার ধর্মবিশ্বাস নিয়েই সমাজের মানুষের হাজার হাজার বছরের মানসিকতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতার মুক্তি সম্ভব। নারীকে বাদ দিয়ে বা নারীকে আলাদা অবস্থানে রেখে সম্ভব নয়।
জিজ্ঞাসু
নন্দিনী দি,
চমৎকার লাগল বিশ্লষণ ধমী লেখাটি। মূল সমস্যা হচ্ছে ধর্ম নামের এই ফালতু বিষয়টাই। আপনার আরো লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ধন্যবাদ মাহবুব মুর্শেদ।
নন্দিনী
আপনাকে পাঁচতারার ওপরে আর কিছু দেয়া যায়না কেন????!!!!!
===================================
জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা
ওরে বাব্বা ! ঃ) এই চাওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
নন্দিনী
ওরে বাব্বা ! ঃ) এই চাওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
নন্দিনী
লেখিকা সহ আরও অনেকেই ধর্ম ও নারী পুরুষ দ্বন্দ, এই দুটো অত্যন্ত জটিল বিষয়কেই সাদা-কালোয় বিশ্লেশন করতে চান। তাদের জন্য দুটো ধাঁধাঃ
১। যে পৃথীবিতে ঈশ্বর আদম হাওয়াকে পরিপূর্ণ মানুয হিসাবে তৈরী করে পাঠিয়েছেন আসলে সেখানে ধর্মের কোন প্রয়োজন নাই। কিন্তু যেখানে জীব বিবর্তনের মাধ্যমে পশুরা মানুষ হয়েছে সেখানে ধর্মের কোন বিকল্প নাই পশুকে মানুষ করতে- আপনি কোন পৃথীবির বাসিন্দা?
২। (বায়োলজিক্যালি) আমি জোর করে আমার স্ত্রিকে (এখনও খুঁজে পাই নি!) তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভবতী করতে পারি কিন্তু কোন নারী কোন পুরুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সন্তান গ্রহণ করতে পারে না, তাকে ঐ পুরুষের মন জয় করতে হয় । প্রকৃতির এই দায় সম্পূর্ণ ধর্মের ঘাড়ে ফেলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?
- অপ্রিয় (আমি কিন্তু নাস্তিক)
প্রিয় অপ্রিয় - আমি আপনার কথা ঠিকমত বুঝেছি কিনা বুঝতে পারছি না। আপনার প্রথম যুক্তিটা কি এরকম যে মানুষের ভেতরের পশুত্ব (যেহেতু তারা এসেছেই পশু থেকে বিবর্তিত হয়ে) কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মের দরকার আছে?
আপনার দ্বিতীয় যুক্তিটার মানে দাঁড়াচ্ছে যে যেহেতু প্রকৃতির প্রধান উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি, এবং সেই বংশবৃদ্ধির জন্য নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয় - অতএব নারী এবং পুরুষ 'প্রকৃতিগত' ভাবেই বিষম, আপনি কি সেটাই বোঝাতে চাচ্ছিলেন?
প্রিয় স্নিগ্ধা, মোটামুটি ঠিকই ধরেছেন তবে মানুষের ভেতরের পশুত্ব নয়, একজন সফল কৃষক যেমন প্রতি বছরই বেছে ভাল বীজগুলোকে বপনে প্রধান্য দেয় ধর্ম তেমনই প্রতি প্রজন্মেই সুস্থির মনের মানুষদের (Sane minds) এমপাওয়ার্ড করেছে। গত ১০ মিলিয়ন বছরের মানুষের ইতিহাস তাই বলে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন ব্যাপক ধর্মহীন সমাজ নগ্নভাবে ক্ষমতা, লালসা ও রিপু দ্বারা পরিচালিত। তবে ধর্মের অতিপ্রয়োগ ও রাজনৈতিক ব্যবহারও অবশ্য বর্জনীয়।
হাঁ, নারী এবং পুরুষ 'প্রকৃতিগত' ভাবেই বিষম, তাদের হরমোন আলাদা এবং তাদের আবেগও আলাদা। পশ্চিমা কর্পোরেট আধুনিকতা যে জীবন উপহার দেয় নারীই সেখানে সবচেয়ে বড় লুজার, বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে গিয়ে সে তার অর্ন্তজগত হরায়। নারী এবং পুরুষ উভয়কেই এমন জীবনযাপন উদ্ভাবন করতে হবে যেখানে কোন পক্ষেরই মৌলিক আবেগ না হারাতে হয়।
ধর্ম জীবনযাপনের একটি গাইডলাইন, একে ১০০ ভাগ মানতে হবে একথা তো কোথাও নেই, তাহলে তওবার বিধান থাকতো না। কিন্তু ধর্মকে পুরোপুরি বিলোপের প্রচেষ্টা আর এক বিপজ্জনক রাজনীতি এবং চরম নির্বুদ্ধিতা।
- অপ্রিয়
যখন ধর্মের পক্ষে শুনি, তখন মনে হয় আর উপাসনালয় থেকে বের হবো না। আবার ধর্মের বিপক্ষে যখন শুনি তখন মনে হয় উপসনাগুলো অনাহূত জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু আমি বলি- বিতর্কের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিতর্ক হচ্ছে ধর্মীয় বিতর্ক।
এখানে পক্ষে-বিপক্ষে অনন্তকাল বিতর্ক চলতে থাকবে- কোনো সমাধান আসবে না। পক্ষে বিপক্ষে অনেক ওয়েব সাইট আছে। উৎসাহীরা সেগুলো দেখতে পারেন।
যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি- তখন পড়েছি "আমি জমিনকে পানির উপর বিছিয়ে দিয়েছি।" (সুরার কথা মনে নেই।) তারপর থেকে আমি সেই আয়াতটি খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না।
আমার মনে হয় খুব সূক্ষ্নভাবে হলেও কোরআনের অনুবাদে পরিবর্তন আসছে। যা হুট করে পাঠকের চোখে পড়ে না।
তবে সবার ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই আর তা হচ্ছে - ধর্মীয় বিতর্কে জড়িত হলে সচলায়তন বোধ করি অচল হবে শিঘ্রীই।
ধর্মীয় বিতর্ক ১. পরিবেশ নষ্ট করে। ২. সম্পর্কের অবনতি অর্থাৎ সামাজিক ভারসাম্য ও সম্প্রীতি নষ্ট করে। ৩. মানসিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।
কাজেই আমরা সচেতন ভাবে এমন বিষয়টিকে পরিহার করতে পারি।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
যে কোন স্পর্শকাতর বিষয়ের বেলাতেই ওপরের কথাগুলো খাটে, আর স্পর্শকাতরতা খুবই আপেক্ষিক, কাজেই সেভাবে দেখতে গেলে কোন বিষয় নিয়েই কোন বিতর্ক করা যাবে না। ভদ্রভাবে বিতর্ক করলে কেন সচলায়তনের পরিবেশ নষ্ট হবে বুঝলাম না।
@স্নিগ্ধা
ধর্ম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে সবাই কমবেশি মন্তব্য করতে পারে। বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে ভদ্র বিতর্ক চলে না। একসময় সেটি আশপাশকেও উত্তপ্ত করে।
ভদ্র বিতর্ক হচ্ছে- ১. ডিম আগে না মুরগি আগে?
২. আমার মা বাবাকে বলেছেন- 'আমি দেইখ্যা তোমার সংসার কইরা গ্যালাম! আর কোনো মাইয়া মানুষ হইলে কবেই যাইতোগা!'
কথাটি নানি নানাকে বলেছেন, তার আগে তার মা তার মা তার মা..... যে কথার শেষ নেই। এমনকি মটুও আমাকে বলেছে কথাটা। আমার ছেলেকেও একই কথা শুনতে হবে তার স্ত্রীর কাছ থেকে।
কাজেই বিতর্ক করলেই বাড়ে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
এ ব্যাপারে আমি স্নিগ্ধার জবাবের সাথে একমত।
নন্দিনী
লেখার জন্য নন্দিনীকে শুভেচ্ছা। অনেকদিন পর একটা ভালো ননফিকশন পড়লাম সচলে। ধর্মের আগাছা যেভাবে মানুষকে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে আছে এটা ছাড়ানো অনেক সময়ের ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় আমরা সেদিকেই যাচ্ছি ধীরে ধীরে...
আরও লেখা চাই এমন...
অতিথি লেখক আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে কোরান কোন কিছু কে বাতিল করলে সকল হাদীস ও তাকে হালাল করতে পারবে না।
অনেক গুলি হাদীস এর বাংলা তরজমা সম্পূর্ন হয় নাই, আশা করি ভাল তরজমা (@ তরজমার সুত্র সহ দিলে ভালো হয়।)
আরো অনেক কথা বলার ছিল । কিন্তু ভাবি বলে কি লাভ??
আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু হাদিসের রেফারেন্স ও তর্জমা সঠিক ধরলে মহানবী কুরানের উলটো কথা কেনো বললেন সেটাও রহস্য। যা বলার আছে বলে ফেলেন। আর বলবেনই না যখন তখন অযথা "বলে কি লাভ" টাইপের কথার দরকার কি?
কিন্তু ভাই, ইসলাম বললেই আপনাদের কেন নারীর ওপর চড়াও হওয়ার কথা মনে হয়, আর ইতিহাস বলেলেই কেন চলে আসে তরবারির ঝিলিক? এই গুমর একটা ফাঁস করবেন কি?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
যে কোনো ধর্ম বললেই আমার মনে হয় নারীর ওপর চড়াও হবার কথা। ইসলাম ধর্ম তুলনামূলকভাবে কম চড়াও হয়েছে, তাই ইসলাম নারীদের মৃত্যুর ঘটনা নেই। হিন্দুধর্মের সতীদাহ আর খ্রীষ্টানদের উইচক্রাফট আরো ভয়ানক কিছু ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ...
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আমি বিষয়টাকে আরো সোজাভাবে বলি
তা হলো
নারীকে যারা মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করতে চান তাদেরকে ধর্মের বইগুলো পৌরাণিক বইয়ের সাথে তাকে তুলে রাখতে হবে
কারণ ধর্মগুলোর যখন সৃষ্টি হয়েছে তখন নারীকে মানুষ ভাবার কনসেপ্টই ছিল না
নারীকে কোনোভাবেই মানুষ ভাবা হতো না তখন
নারীকে দাস-দাসী- গবাদি পশু এবং অন্যান্য সম্পত্তির মতো একটা জীবন্ত সম্পত্তি হিসেবেই দেখা হতো
ফলে আজকের নারী মর্যাদা এবং ধর্ম একসাথে চলতে পারে না কোনোভাবেই
একটাকে সরিয়ে রেখে অন্যটা নিয়ে ভাবতে হবে
যিনি নারীকে মানুষ মনে করেন তাকে ছাড়তে হবে ধর্ম
আর যিনি ধর্মকে ধরে রাখতে চান তাকে ছাড়তে হবে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি
(অনেকে দুটোকে একসাথে মিলাতে গিয়ে এক উদ্ভট তত্ত্বের দাঁড় করান)
০২
বর্তমানে প্রচলিত বড়ো বড়ে সবগুলো ধর্মের চেহারাই এক
যীশু খ্রিস্টকে সারা বাইবেলের কোথাও নিজের মাকে মা বলে ডাকতে শুনেছেন কেউ?
'হে আমার নারীগণ' এর ভেতরে মেরীকেও ঢুকিয়ে দিয়েছ্নে তিনি
হিন্দু ধর্মে একেবারে হস্তান্তরযোগ্য পণ্য হলো নারী
(শুধু যুধিষ্টির রাজা হওয়ার আগে পর্যন্ত এক কুন্তীকে আমরা মানুষ হিসেবে পাই। কিন্তু যুধিষ্টির রাজা হবার পরে তিনিও হয়ে যান সাধারণ নারী। যদিও মহাভারতের সাথে হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু কেউ কেউ মহাভারতের মিথগুলোকে হিন্দুধর্মের মিথ হিসেবে দাবি করেন)
পৃথিবীর সবচে লিবারেল ধর্মের জনক গৌতম সারা জীবন নারীদের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে মরার আগে বললেন- অদর্শন
মানে নারীদের দেখাও পাপ
০৩
নন্দিনীর লেখাটা দুর্দান্ত
ধর্ম এবং ঈশ্বর পুরুষদেরই বানানো
লীলেনদা, একটা বিষয় আমাকে খালি ভাবিয়ে তুলে, ব্যাপারটা নিয়ে ভালভাবে পড়া হয়নি, সেটা হল পুরুষরা কিভাবে কবে থেকে নারীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, নারীদের দুর্বল বলে মেনে নিতে আমার ভয়াবহ আপত্তি আছে ।
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
পুরুষরা কিভাবে কবে থেকে নারীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হ।... এ ব্যাপারটা নিয়ে আমার কিছু ধারনা লিখেছিলাম আমার হাইপেশিয়া প্রবন্ধে, হয়ত এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ---
আজ তবে নারী বিজ্ঞানী, গবেষক, গণিতবিদ আর প্রযুক্তিবিদদের এত অপ্রতুলতা কেন পুরুষদের তুলনায়? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। পুরুষের পাশাপাশি একদিন যে নারী পত্তন করেছিলো, বিস্তার ঘটিয়েছিলো প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতার, আজ সে নারীর অধিকাংশই প্রযুক্তি আর সভ্যতা থেকে যোজন মাইল দূরে; পর্দা, প্রথা, বিশ্বাস-অপবিশ্বাস আর হাজারো পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের ঘোরটপে বন্দি। এ তো নারী জাতির এক পরাজয়ই বটে। কখন তাহলে ঘটেছিলো নারী জাতির এই ‘ঐতিহাসিক পরাজয়’? অনেক গবেষকই আজ দায়ী করেন কৃষিব্যবস্থাকে ২০। তারা মনে করেন হোর্টিকালচার থেকে কৃষিব্যবস্থার উত্তোরণে সভ্যতা এগিয়েছে অনেক, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে দু’দুটি প্রগতিশীল মানবিক সত্ত্বাকে। কৃষিকাজের উদ্ভবের পর থেকেই নারীরা বন্দি হয়েছে গৃহে; মূলতঃ নিয়োযিত হয়েছে গৃহস্থালির পরিচর্যায় আর সন্তান লালন-পালনে, আর কৃষিব্যবস্থার ফলেই নিখুঁতভাবে তৈরী হয়েছে শ্রমবিভাজনের, পরবর্তীতে ব্যক্তিগত মালিকানার। আর এ ব্যবস্থার ক্রমোত্তরনেই নারী ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয় খাদ্যোৎপাদনের তথা প্রযুক্তির মূলস্রোতধারা থেকে। এঙ্গেলস তার 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্টরের উৎপত্তি' (১৮৮৪) নামের কালোত্তীর্ণ বইটিতে দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সাথে সাথে একসময় সম্পদ বাড়তে থাকে, আর সেই সম্পদই শেষ পর্যন্ত শত্রু হয়ে দেখা দেয় নারীর। অরণ্যপর্ব থেকে মানুষ যখন পৌঁছোয় কৃষিপর্বে, তখন সম্পদশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন গোত্র। একসময় ওই সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্রপতিদের; তারা হয়ে ওঠে সম্পদশালী, উদ্ভাবন ঘটে ব্যক্তিগত মালিকানার। সম্পদ যত বাড়তে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে গুরুত্ব বাড়তে থাকে পুরুষদের, পুরুষ মাতৃধারার প্রথা ভেঙে সৃষ্টি করে পিতৃতন্ত্রের প্রথা, নারী পরিনত হয় পুরুষের সম্পত্তিতে। ...।
পুরো প্রবন্ধটা এখানে রাখা আছে।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
ধন্যবাদ অভিজিৎ, পড়ছি
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
নন্দিনী, লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ, আপনাকে লাল সালাম !
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
মূল লেখা এবং অধিকাংশ মন্তব্য পড়ে খুব তৃপ্তি পেলাম। নন্দিনীকে বিশাল অভিনন্দন অতি চমত্কার এই লেখাটির জন্য।
যাবতীয় ধর্মই যে কিছু মানুষের দুর্বল মস্তিষ্কপ্রসূত, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের অবকাশ রাখেনি ধর্মগ্রন্থগুলোয় উল্লেখিত অজস্র অসঙ্গতি, দুর্বলতা, রূপকথাতূল্য কল্পকাহিনীগুলো। আর সেই লেখকগণ যে পুরুষ জাতির প্রতিনিধি ছিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন জাগে না ধর্মগুলোয় নারীদের অসম্মানিত অবস্থানের কারণে।
আর বেশি কিছু লিখবো না। এমনিতেই ইসলাম-বিরোধী লেবেলটি, মনে হয়, আমার কপালে শোভা পেতে শুরু করবে অচিরেই। দিন কয়েক আগে এক অতিথি লেখক লিখলেন, ইসলাম বিষয়ে আমার মন্তব্য নাকি "বিরক্তিকররকম পূর্বানুমেয়"। ইসলামের অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং তার বিশ্লেষণ দাবী করাটা যদি ইসলাম-বিরোধিতা হয়, তবে আমি অবশ্যই ইসলাম-বিরোধী।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল
মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
কি মাঝি? ডরাইলা?
খোদারে আমরাই তো বানাইছি, আর খোদা আমাদের এইসব মেহেরবানী দিব না মানে?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আবার জিগায়!!!!
দ্রাক্ষারস খাবো আর হুরের সাথে সুডোকু খেলবো!! দেখি কোন শালায় কী করে!!!!
কি মাঝি? ডরাইলা?
@ writer
Corrections:
The quotes from the bible is from St. Paul not Pope John paul II.
@ writer
Corrections:
The quotes from the bible is from St. Paul not Pope John paul II.
updated version er jonno ei linkta dekhte paren পুরূষ রচিত ধর্মে বিকলাংগ নারী
নন্দিনী
ভাবায়। পুরো লেখাটা পড়তে পারিনি, অনেক বড়। কিছু মন্তব্যও পড়লাম। ফারুক ওয়াসিফের মন্তব্যগুলো চমৎকার।
ধর্ম নিয়ে আমার ধারণা দিনে দিনে পাল্টে যাচ্ছে, আগে বিশ্বাসী ছিলাম(সম্ভবত এখনও), তবে যতই গভীরে প্রবেশ করছি, ভিন্ন একটা দিক ক্রমশই উন্মোচিত হচ্ছে।
'খোদারে আমরাই তো বানাইছি, আর খোদা আমাদের এইসব মেহেরবানী দিব না মানে?'
--বানাইছি যারে, সে কেমনে মেহেরবাণী দেয়? বানাইয়া দেখতেছি হাজারো বিপদ। মানুষে-মানুষে ঘৃণার সৃষ্টি করে, বিবাদের পথ দেখায়, হিংসার উসকানি দেয়, এইভাবে লাখ লাখ মানুষ মরছে হের লাইগ্যা। মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ হইছে। খোদারে বানাইছি, এইবার ভাঙ্গুম।
নতুন মন্তব্য করুন