সায়রা বানু চুল বেঁধে বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন।বেডসুইচটা নষ্ট,তাই বাতি নিভিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বিছানায় যেতে হয়।বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন আশরাফ আকন্দ।কি আশ্চর্য,মানুষটা এই বয়সেও কেমন বাচ্চাদের মত কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়।সায়রা বাতি নিভিয়ে দিলেন।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় সায়রার,ভেন্টিলেটার দিয়ে মৃদু আলো এসে পড়ছে ঘরে।তাকিয়ে দেখেন আশরাফের শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে।ঘুমের মাঝেই কাঁদছেন তিনি।প্রায়ই এরকম হয়।তিনি জানেন একটু পরেই ঘুম ভেঙে যাবে আশরাফ সাহেবের,পানি খেতে চাইবেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়বেন আবার।দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামীর গায়ে একটা হাত রাখেন তিনি।
খুব ছোটবেলায় আশরাফকে তার মা বাবা আদর করে ডাকতেন,মন্টু।তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নবীনগরে,থাকতেন ঢাকায়,বাবা রফিক সাহেব ব্যাংকার।বাড়িতে যাওয়া হত খুব কম।আশরাফ তখন খুব ছোট,আট কি ন বছর বয়স।বড় বোন জেসমিনের সাথে রামপুরার অলিতে গলিতে চমৎকার কাটছিলো দুরন্ত শৈশব।
হঠাৎ শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।ব্যাপারটা মন্টু ঠিক বুঝতে পারতনা,দেখতো আব্বা সবসময় খুব গম্ভীর হয়ে থাকেন।বরং হঠাৎ যখন স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো তখন মনে হলো যুদ্ধ ব্যাপারটা একেবারে খারাপ না।শুধু যখন আম্মা দুপুরবেলা খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন তখন খুব খারাপ লেগেছিলো।প্রায় রাতেই দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসত,আব্বা তখন সবাইকে নিয়ে বড় খাটে জেগে বসে থাকতেন।এর মাঝেই একদিন মন্টুরা সবাই গ্রামের বাড়ি চলে গেলো,নবীনগর কুমিল্লা।
দেখতে দেখতে গ্রামে তিনমাস কেটে গেলো,প্রথম দিকে বেশ লাগলেও এখন আর এখানে মন্টুর একটুও ভালো লাগেনা,সময় কাটেনা একদম।ওদিকে রফিক সাহেবের হাত একেবারে খালি হয়ে এসেছে,ঢাকায় যাওয়া প্রয়োজন।ভাবলেন ছেলেকে সাথে নিয়ে একবার রামপুরার বাসায় যাবেন।মন্টুকে বলতেই সে একপায়ে খাড়া।স্ত্রী কন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেকে নিয়ে নৌকায় চেপে বসলেন তিনি।দিনটা ছিলো ১১ই সেপ্টেম্বর,১৯৭১।
রামপুরার বাসাটা যেমন ছিলো তেমনই আছে।আব্বা সারাদিন বাসায় থাকলেও সন্ধ্যার পর পাশের বাড়িতে ক্যারম খেলতে যান।একলা বাড়িতে সময়টা তখন খুব ভালো কাটে মন্টুর,শুধু রাতে মাকে ছাড়া ঘুমাতে কষ্ট হতো তার,আব্বা যাতে শুনতে না পান তাই বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতো তখন।প্রায় এক সপ্তাহ থাকার পর আব্বা আবার রওনা দিলেন গ্রামে।
মেঘনা নদীর ওপর মাঝদুপুরের কড়া রোদ।আব্বা ছইয়ের ভেতর ঘুমাচ্ছেন।পা টিপেটিপে ছই থেকে বেরিয়ে এলো মন্টু,পানিতে পা ডুবিয়ে বসবে।একবার পেছন ফিরে দেখে নিলো মাঝি দেখতে পাচ্ছে কিনা।হঠাৎ বহুদুর থেকে একটা নৌকাকে আসতে দেখলো মন্টু।ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেটা,নৌকাটার সামনে কে যেন বসে আছে।একসময় নৌকাটা তাদের নৌকার পাশাপাশি আসলো।যদিও তখনও নৌকাটা বেশ খানিকটা দুর দিয়েই যাচ্ছে।হঠাৎ নৌকার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারলো মন্টু,জলিল কাকা,তাদের পাশের বাড়িতেই থাকেন।সে দুহাত মুখের কাছে এনে চিৎকার করে ডাকলো,''জলিল কাকা,ও জলিল কাকা।''আশ্চর্য তিনি যেন শুনতেই পেলেন না।বেশ কবার ডাকার পর তিনি ধীরে ধীরে মুখ ফেরালেন।তার চোখের দৃষ্টিতে আশ্চর্য শুন্যতা,মনে হলোনা তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন।একটু যেন থমকে গেলো মন্টু।সে আবার ডাকলো,''কাকা,কই যান?''কাকা কোন জবাব দিলেন না।হঠাৎ কেন যেন বুকটা ধ্বক করে উঠলো মন্টুর।''মা কেমুন আছে কাকা?জেসমিন?''কাকা কিছুই বললেননা।নৌকা দুটো দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।আবার জিগেস করলো মন্টু।কাকা তখন শুধু হাতটা তুলে কবার এদিক ওদিক নাড়লেন,তারপরই ভেঙে পড়লেন কান্নায়।মন্টুর সমস্ত পৃথিবী মূহুর্তে অন্ধকার হয়ে এলো.....
বহুদূরে খুব আবছাভাবে একটি নৌকা দেখা যাচ্ছে,খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।নৌকার সামনে একটা মানুষ উবু হয়ে বসে আছে।প্রায় চলে এসেছে নৌকাটা,আর একটু পরেই পাশ কাটিয়ে যাবে।আরেকটু এগিয়ে এলো....
.....ঘুমের মাঝেই কাঁদতে শুরু করলেন আশরাফ আকন্দ সাহেব।
মন্তব্য
পড়ে ভাল লাগলো। নামটা জানালেন না যে, অতিথি?
ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে। নামটা জানালে আমিও কৃতার্থ হইতাম।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
আশরাফ, মন্টু, জেসমিন চরিত্রের নামগুলো পরিচিত লাগছে...আমি কি অতিথি লেখককে চিনতে পেরেছি?
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন
একান্ত
নতুন মন্তব্য করুন