আমরা কতটা আধুনিক হয়েছি আমি মনে হয় ৬ তারিখের আগে জানতাম না। এক বৃদ্ধ নিবাস আধুনিকতার সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। এতদিন শুনেছি বড়দের গড়ে দেয়া রাস্তায় আমরা চলি...বাবা-মা যেখান শেষ করেন সন্তান সেখান থেকে শুরু করে...একটু একটু করে বাবা-মা শিখান জীবনের কোন মুহুর্তে কি করতে হবে...বিপদে সবার আগে সন্তানের জন্য নিজেদের বিলিন করেন...অল্প অল্প করে নিজেদের সব সখ আল্লাদ বলি দেন। বিনিময়ে একটা বীমা করে আমরা বলি,দেখেছ বাবা আমাদের চিন্তাধারা কত্ত আধুনিক বৃদ্ধ হলেও তোমাদের মতো অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না। তারপরও তারা চুপ থাকেন...আমরা সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুর হয়ে যাই...ঘরের কোনেও বাবা-মার জায়গা হয় না...তারপরও শুধু নিষ্পাপ পলক পরে... প্রতিবাদ দানা বাঁধে না,মন অভিশাপ দেয় না। আমরা কতটা আধুনিক স্বার্থপর!
৬জুন সকাল ৮টায় যখন গাড়ি গাজীপুরের দিকে যাচ্ছিল তখনও আমরা ত্রিশজন পিকনিক পিকনিক ভাব নিয়ে হইচই করতে করতে হেরে গলায় গান করছিলাম। গাড়ীটা শালবন আর ছোট ছোট পাহাড় ছাড়িয়ে বশিপুক(বয়ষ্ক ও শিশু পুর্ণবাসন কেন্দ্র)-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গিভেন্সী গ্রুপের এলাকা দিয়ে গাড়ী যখন বশিপুক প্রবেশ করলো কেমন যেন আচমকা নিরবতা শুরু হয়ে গেল। সারি সারি গাছ...গাছের নিচে ফলকে লিখা কে,কবে গাছটি বপন করেছেন।এমনকি ১৯৯৫ সালে মাদার তেরেসার লাগানো একটি মেহগনি গাছও আছে সেখানে। বিশাল এলাকার শেষ দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে এখানকার মানুষগুলির দেখা মিলছে...কেউ পিট পিট করে তাকাচ্ছে,কেউ ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসি টানছে,কেউ বা দরজায় দাঁড়িয়ে আগন্তুক দেখার মতো অবাক হচ্ছে। দেখলেই কেমন মায়া লাগে...নিষ্পাপ শিশুর মতো চোখ দিয়ে সব কথা বলে ফেলতে চায়। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা আবিষ্কার করলাম,চারিদিকে আন্তরিকতার কোন অভাব নাই।
আমরা আসলে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির "মনন" নামক সাইকলোজি ক্লাবের কতগুলা আজাইরা মানুষ যারা বশিপুক এ প্রবেশ এবং সেখানকার মানুষের জন্য সামান্য আনন্দের আয়োজন করার অসাধ্যটুকু সাধন করে ফেলেছি। এবার বশিপুক নিয়ে কিছু বলি,এই পুর্নবাসন কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে গিভেন্সী গ্রুপ। এটি বিশাল এলাকা জুড়ে ব্যক্তিগত খরচে পরিচালিত হচ্ছে। কেন্দ্রে ১২২জন বৃদ্ধ ও ৯৮জন বৃদ্ধা রয়েছে। এসব বৃদ্ধদেরকে একটি সুন্দর দিন উপহার দেবার উদ্দেশ্যেই আমাদের সেখানে যাওয়া। ক্লাবের পক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া সামান্য উপহার ও খাবার তাঁদের মুখে যে হাসি ফুটিয়েছিলো,তারচেয়ে বেশী আনন্দের ছিল আমাদের সাথে মিশে যাওয়া। মনে হচ্ছিল আমাদের মাঝে কোন পরিচিত মুখ খুজে বেড়াচ্ছেন। দুপুরের পর আমরা তাদের জন্য আয়োজন করেছিলাম ছোট ছোট গেইম শো আর ছোট ছোট গিফট। তারা যে এই বয়সেও প্রাণচঞ্চল তার প্রমান আমরা পেয়েছি তাদের স্বতঃস্ফূত অংশগ্রহনে। এমনকি যাদের একহাত বা একপা নাড়াতে পারছিল না তারাও লাঠিতে ভর করে সেখানে অংশগ্রহন করেছিল। ফুটবলে পা লাগানোর স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিল কোন অভিজ্ঞ ফুটবলার কিক দিচ্ছে।
কেউ আবার মাঝে মাঝে চিটিং চিটিং খেলছে। বিজ্ঞের মতো একজন আরেক জনকে না পারার খোঁচা দিয়ে
যাচ্ছে। হায়রে হাজার টাকার আনন্দ সেদিন বশিপুকে ছিল! শেষ বিকেলে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য একেক জন ফিটফাট। মনে হচ্ছিল বিয়ে বাড়ির আনন্দ!তাঁদের আনন্দ শুধু আনন্দ রইল না আগ্রহে বদলে গেল। আমরা আধুনিক গান গাইলে তারা মঞ্চে উঠে ভাটিয়ালি টান দেন। হাসন রাজার গান ওদের মনে দাগ কেটে যায় আর পাঞ্জাবীওয়ালা গানে মনে হতে থাকে যৌবনে ফিরে গেছেন। তাঁদের সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনা দেখে আমাদের এত ভাল লেগেছিল যে আমাদের আনাড়ি মন আর মঞ্চে উঠতে চাইছিল না।
কারও মন সেই দিনের শেষ দেখতে চাইছিল না। আমাদের সবারই মনে হয়েছিল, কি অমূল্য সম্পদ আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছি! তাঁদের কাছ থেকে এখনও অনেক কিছু শেখার আছে। অনেক বেশী শিক্ষিত হয়ে গেছি আমরা। এত শিক্ষিত না হয়ে তাঁদের কাছ থেকে মাটির কিছু শিখে নিলেই পারতাম। শিক্ষিত হয়ে শিক্ষিতের মতোই আচরণ করছি আমরা! বশিপুকের বাসিন্দাদের কোন অভাব নেই,নেই অভিযোগ। শুধু অপলক চোখগুলো আপনজনদের ছায়া খুঁজে। নির্বাক মুখগুলো কিসের যেন আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়। আমরা সবাই যখন ঢাকায় ফিরব বলে বাসে উঠছি,একজন বৃদ্ধ এখানে ওখানে ঘুরঘুর করছে আর গার্ড তার উপর কড়া নজর রাখছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে গার্ড বলে,আপনাদের দেখে উনার নাতি-নাতনির কথা মনে পড়ে গেছে তাই পালানোর চেষ্টা করছে। সাথে সাথে দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল।
দাদাভাই আমাকে অনেক আদর করতেন। কিন্তু আমার সামনে দাদাভাই ক্যান্সারে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেলেন। সেদিন আমরা ত্রিশজন একসাথে বলেছিলাম হে আল্লাহ, কেউ যেন এমন একাকীত্ব জীবন না পায় আর আমরা যেন ষাট বছরের মধ্যে দুনিয়া ছাড়তে পারি।
সবার মধ্যে আমাদের অনুভূতির প্রতিফলনের জন্য প্রতি সেমিষ্টারে ব্র্যাকের ১০-১২জন যেন বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখতে পারে এরকম একটা আবেদন আমরা গিভেন্সী গ্রুপের কাছে করে আসি।
ব্র্যাক এর চার বছরে মানুষ একটা জিনিস পায়-TARCএর তিন থেকে চার মাসের রেসিডেন্সিয়াল সেমিষ্টার। বিশ তলা ভবনে ক্লাশ না থাকলে ল্যাবে বসে থাকা আর প্রাঙ্গনে চা খাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তবে আমি আরও বেশী কিছু পেয়েছি "মনন" থেকে। নানান রকমের মানুষ দেখার সুযোগ হয়ত মনন না থাকলে পেতাম না। মননের মানুষগুলো আপন করে নেওয়ার মন্ত্র জানে। সাইকোলজি ক্লাব বলে এই ক্লাবের প্রতি প্রথমদিকে কারও তেমন আগ্রহ ছিল না। এখন মননের কোন প্রোগ্রমে রীতিমতো বাছাই কার্য চালাতে হয়। এগিয়ে যাও মনন,মননেই যেন মন ছুটে যায়। মন দিয়ে আজ মনকে ছোঁয়ার প্রত্যয় রাখো।
নিরিবিলি
মন্তব্য
শুভ উদ্যোগ।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
শুক্রিয়া...
-নিরিবিলি
কোন দেশ কতটা আধুনিক তার নিদর্শনের মধ্যে অনেকগুলোই নেতিবাচক। এখানে খুব ভাল একটা নিদর্শন পেলাম। এটাই প্রামাণ করে, আধুনিকতা মানবতাকে শ্রদ্ধা করছে না। আশা করি এই ঝোঁক থেকে আধুনিকতা বেরিয়ে আসবে। আমরা আবার মানুষ হব।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
অবশ্যই আমাদের মানুষ হতেই হবে। মানবতাকে ভুলে মানুষ কিসে আধুনিক হয়...শেষ দেখার বড় ইচ্ছা।
-নিরিবিলি
সত্যি, কত ভালো সব নতুন জিনিষই না হচ্ছে এখন দেশে !
মননের কথা জেনে খুবই ভালো লাগলো - সারাজীবন ইচ্ছে ছিলো সাইকোলজি পড়বো, পড়া হয় নি। আপনাদের এমন আরো উদ্যোগ সফল হোক।
সহমত। আমারো ইচ্ছে ছিল খুব। এখন রাস্তা থেকে সাইকোলজির বই টোকাই। পড়ার সময় হয়ে ওঠে না পুরোটা।
সাইকোলজি জিনিসটাই মজার...সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে মানুষগুলোকে কাছে থেকে দেখতে যারা আমাদের মতো স্বাভাবিক জীবনের বাসিন্দা না।
-নিরিবিলি
বৃদ্ধ নিবাসে কারা আসেন? নিঃসন্তানরা? নাকি দুষ্টু বাবা-মায়েরা? নাকি সন্তানকে জন্ম দিয়ে, বেশি আদর-যত্ন দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে কবিরা গুনাহ করেছেন যাঁরা?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা যান তাদের হয়ত ছেলে মেয়ে সবাই বেঁচে আছে, কেউ আসে অসুস্থ হয়ে যাঁদের দায় ভার ছেলে মেয়ে নিতে পারে না। আমি একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকে দেখেছিলাম যাঁর বয়স মাত্র ৫৫। আর অবাক করার কথা হল-মানুষগুলো বেশিরভাগই শিক্ষিত।
-নিরিবিলি
- যাক পশ্চিমের এই ধারাটাও তাহলে গেলো অবশেষে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মনে হয় এখনও পুরোপরি যায় নাই...
-নিরিবিলি
যাক! জাতে উঠলাম তাহলে!!!!! বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে!!!
বিদেশের দেখাদেখি আজকাল আমরাও বুড়োবুড়িদের ফেলে দিয়ে আসি বৃদ্ধাশ্রমে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
- কয়দিন আগে পর্যন্তও গলা উঁচা কইরা কৈতাম, আমাগো কালচার তোমাগো মতো হার্মাইদ্যা না। আমরা বেবাকে একলগে খাই, শুটকী পান্তা যা-ই খাই। আমরা বয়ষ্কদের দূরের কোনো আশ্রমে ফালাইয়া দিয়া আসি না।
হাজার নেতিবাচক দিকের মাঝেও গলা উচাঁ কইরা এখন আর ঐভাবে কওন যাইবো না। কষ্টটা ঐখানেই।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মানুষ এখন "একা একা খেতে চাও দরজা বন্ধ করে খাও" তে বিশ্বাসী
তা পান্তা হোক আর পোলাও...বৃদ্ধ মানুষগুলো ভাগ্যকে কি সুন্দর মেনে নেয়!!
-নিরিবিলি
এখন মানুষ "একা একা খেতে চাও দরজা বন্ধ করে খাও"তে বিশ্বাসী তা পান্তা হোক আর পোলাও... আধুনিক যুগের মানুষ ঝামেলা পছন্দ করে না।
-নিরিবিলি
কি যে বলেন আধুনিক হতে হবে না? আইন করা উচিত যাদের ছেলে মেয়ে বা দেখাশোনার কেউ থাকবে না তারাই কেবল বৃদ্ধাশ্রমে যাবে। ছেলে মেয়ে থাকা অবস্থায় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে শাস্তির বিধান থাকলে ভাল হতো
-নিরিবিলি
খুব ভালো লিখেছেন। বৃদ্ধাশ্রম আমার কাছে খুব বেদনার মনেহয়। মনেহয় যাই এদের কাছে, শুনি এদের প্রত্যেকের গল্পগুলো। কী ভুল করেছিলেন তারা, কী ঘটে গেলো তাদের জীবনে - যার প্রায়শ্চিত্ত করতে আজকে তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে এসে থাকতে হচ্ছে।
আমরা এই শর্তে মেনেই বশিপুক গিয়েছিলাম যে আমরা কেউ তাঁদের অতীত নিয়ে কোন প্রশ্ন করবো না। তাঁরা অনেক আবেগ প্রবন মাথায় হাত রেখেই কাঁদতে থাকেন। তা না হলে আমিও জানতে চাই কি তাঁদের অপরাধ বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো?
-নিরিবিলি
অবশ্যই এটা একটা মহতি উদ্যোগ, কিন্তু আমি বুঝিনা কিভাবে একজন তার বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে রেখে আসে ঐসব আশ্রমে ??? তাদের মন কি একটুও বিচলিত হয়না এসব কাজ করতে গিয়ে ?? যারা এসব কাজ করেন উনারা হয়তো ভেবে দেখেননি যে তাদেরকেও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে তখন যদি তাদের ছেলেমেয়ে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে দিয়ে আসে তখন ??!!!??
মানুষ বর্তমান নিয়ে ভাবে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার সময় নাই...
-নিরিবিলি
যাদের ছাড়া আমাদের এই জগতে আসা হত না, তাদের বাদ দিয়ে কিভাবে আমাদের ভবিষ্যত হয় তা আমার জানা নাই। যাদের দোয়া ও যত্নে আমরা বড় হয়েছি, তাদের ছাড়া আমরা কিভাবে আমাদের ভবিষ্যত গড়ব?
----অক্ষর
ভালো লিখছো ... আগেই দেখছিলাম, কিন্তু আইলসামি কইরা কমেন্ট করে হয় নাই
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...
আইলসামি কইরা হোক কমেন্ট তো করছেন...শুক্রিয়া ভাইয়া।
-নিরিবিলি
এটা খুবই সুন্দর একটি উদ্যোগ এবং মানবতারসবার খাতিরে সবার এধরনের উদ্যোগে সবার সহযোগিতা কাম্য।
-নাবিলা
নতুন মন্তব্য করুন