দুনিয়ার হালচাল বুঝে যাবার পর অনেকের ভালো না লাগলেও শতভাগ বাংগালীরই শিক্ষাজীবন কিন্তু শুরু হয় কবিতা(ছড়া) দিয়ে; অ তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে ধরনের অনর্থবোধক( nonsense) ছড়া না পড়েই বিদ্বান হয়ে গেছি এ কথা কোন বংগসন্তান বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না; এই অযথা বকবক এর গন্ডি পেরিয়ে যখন হাট্টিমাটিমাটিমটিম পড়া শুরু হয় তখন বাবা-মা রা সন্তানের অনাগত ভবিষ্যত এর কথা ভেবে ভেবে রাত জাগতে কখনও বা দুচোখ বুজেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
আমিও এই একই পথের পথিক। পড়ার ফাঁকেফাঁকে “আমপাতা জোড়া জোড়া জ়ামপাতা কেন নয়?” “ভোদঁড় কী জাতীয় বস্তু?” এই টাইপের কিছু উচ্চমার্গীয় (!) প্রশ্ন আমাকেও চিন্তিত করত; তবে গুরুজনের ভ্রুকুঞ্চনে তা দূর্ভাবনার কারন হয়নি।যতদূর মনে পড়ে দিনভর ব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যাবেলা ঘুমঘুম চোখে “তালগাছ একপায়ে দাড়িঁয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উকি মারে আকাশে” বা “ও বগী তুই খাস কী, পান্তামাছ চাস কি” খুব একটা খারাপ লাগত না । তবে বিপদ হত পরীক্ষা এলে; অমুক কবিতার শেষ আট লাইন,তমুক কবিতার প্রথম দশ লাইন মুখস্থ লিখ- এ ধরনের প্রশ্নে হরহামেশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছি সে সময়। কবিতা আর ছড়ার পার্থক্যটাও বুঝতাম না- অনেক গবেষণা করে ঠিক করেছিলাম আট লাইনের বেশি লম্বা হলে তা কবিতা, নইলে ছড়া।পরীক্ষায় লেখা ছাড়াও কবিতার যে আরো কোন আবেদন আছে তা আমার প্রথম উপলব্ধ হয় চতুর্থ শ্রেনীতে পড়বার সময়, একটা কবিতায় কেমন যেন গল্পের গন্ধ পেলাম, পড়ার পর মনে হল এটা গল্পই শুধু মিল দিয়ে দিয়ে লেখা হয়েছে; আফসোস হতে লাগল আমার যদি এমন শোলক বলা একটা দিদি থাকত! কয়েকবার পড়ে কবিতাটা মুখস্ত করে ফেললাম। বাড়ী থেকে আমার স্কুল ছিল বেশ খানিকটা দূরে, আমি স্কুলের পথে হাঁটতে হাঁটতে আওরাতাম
“ভূঁই-চাঁপাতে ভরে গেছে শিউলী গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল |
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটা লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি যখন শুনবে এসে বলবি কি মা বল্ |”
বেশ লাগত।আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে, যৌথ পরিবারে। ঈদ বা পারিবারিক কোন উত্সবের আগের রাতগুলোতে সমবয়সী সবাই মিলে জোনাকী ধরা ছিল আমাদের খুব প্রিয় একটা খেলা, পুরাতন ঔষধের শিশি হাতে জোস্না রাতে জোনাকীর পেছনে ছুটতে গিয়ে কেন জানি হঠাত কাজলা দিদির কথা মনে হয়ে আমার দুচোখ ভিজে উঠত।
সেটাই ছিল প্রথম ভাল লাগা, তবে যতই বড় হতে লাগলাম কবিতার আরো নানান গুণ আমার সামনে প্রতিভাত হতে লাগল। শীতের সকালগুলোতে আম্মুর অত্যাচার হতে বাচঁতে কবিতা যে একটা ব্রহ্মাস্ত্র তা ততদিনে বুঝে গেছি; আম্মুর ঘর হতে আমার টেবিল দেখা যেত না, সুতরাং বাংলা বা ইংরেজি বইয়ের কবিতাগুলো মুখস্থ রাখতে পারলে লেপের নীচে শুয়ে শুয়েই পড়ার ঝড় তুলে দেয়া যায়, তাই যতই দিন যাচ্ছিল কবিতা আমার প্রিয় হয়ে উঠছিল।
ক্লাস এইটে উঠলাম; নতুন বই কিনেই কবিতা পড়া শুরু করেছি, একটা কবিতায় এসে আটকে গেলাম, চৌদ্দ লাইনের কবিতা; কবিতার নামটা অদ্ভুত, কবির নামও শুনিনি আগে কখনো।পুরো কবিতা জুড়ে নদী,পাখি,গাছ এসবের নাম; পড়ে মনে হল এ কবি আমাদের গ্রাম ঘুরেঘুরে কোথায় কি হচ্ছে দেখে দেখে কবিতাটি লিখেছেন। এতদিন পড়ে আসা কবিতা বা ছড়ার সাথে কোন মিল নেই। ভাল লাগল না, খারাপও না। সেদিন সেই বালককে কেউ বলে দেয়নি যার একেকটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় আমি সেই কবির কবিতা পড়ছি, পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও যার কবিতার উপাদান দিয়ে এই বাংলাকে পুনর্বার নির্মাণ করা যাবে আমি সেই কবির কবিতা পড়ছি; “রুপসী বাংলা”র ৬১টি হীরার একটিকে চোখের সামনে নিয়ে বসে আছি।
না লিখলেও বোধহয় চলে কবিতাটির নাম ছিল “আবার আসিব ফিরে”।
কবির নাম জীবনানন্দ দাশ।
রাফি
মন্তব্য
হুম...
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
হু.......ম.......
রাফি
দুর্ভাগ্য ভুল সময়ে জীবনানন্দ জন্মেছিলেন। ১৯৫০ সালের আগের মানুষগুলোর জন্য আমার খুব আফসোস হয়।
কবি! মন্তব্য এর জন্য ধন্যবাদ।
মনে করিয়ে দিলেন এই ছোট ছোট ছড়াগুলো বলে আমি আমার ছোট ভাইকে মাঝে মাঝে ঘুম পারাতাম,
আর শেষের ৮ লাইন, প্রথম ৮ লাইন ক্লাস ৪-৫এ কত লিখতে হয়েছে আপনি সুন্দর লিখেছেন।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
হয়ত জেনেটিক কারনেই ঘুমাবার সময় সবার একটু ছন্দাপেক্ষী হতে হয়। অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানের জননী কথাটা এ কারনেই বিশ্বাস হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে।
কোনো ভালো মানুষ কবিতা পড়েও না লিখেও না
আর কবিতা নিয়ে লেখার তো প্রশ্নই উঠে না
মুহাহাহাহা
আইজকা আপনারে আমি পাইছি
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
আইজকা আমিও আপনারে পাইছি।
@ মাহবুব লীলেন
ইস!
যদি আপনার মত খারাপ মানুষ হতে পারতাম!
লেখাটা বেশ চমৎকার লাগলো। বেশ গোছানো আপনার লেখার ভঙ্গি। খুব সম্ভবত আজকেই প্রথম আপনার কোন লেখা পড়লাম ( জানি না, আপনি এর আগেও সচলায়তনে লিখেছেন কিনা, লিখে থাকলেও হয়ত ব্যস্ততার কারণে চোখ এড়িয়ে গিয়েছে )।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্যটাও বেশ পছন্দ হলোঃ
আপনার আরো লেখা পড়ার আশায় থাকলাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
সচলায়তনে আমি মুলত পাঠক, এর আগে আর একটামাত্র লেখা দিয়েছিলাম।
আপনার ভালো লেগেছে বলে প্রীত হলাম।
ধন্যবাদ।
লেখাটা কেমন যেন- মজার, আবার মন খারাপ করিয়ে দেয়ার মতও। শহরে চারদেয়ালে বন্দিজীবন কাটিয়ে এখন মাঝে মাঝে আফ্সোস হয় – নাহ্ গ্রামে শৈশবটা কাটাতে পারলে বেশ হত। এইসব অনুভূতিগুলো শতভাগ বুঝতে পারতাম! মাঝখানে কবিতাকে জোর করে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলাম...কিন্তু সফল হইনি। তাই এই অঙ্গনে জ্ঞান শূন্যের কোঠায়...তারপরও কোন কোন বিশেষ কবিতার বিশেষ লাইনে চোখ আটকে যায় আর মাথায় ঘুরতে থাকে...
শেষ অনুচ্ছেদে জীবনানন্দের কথাটা সুন্দর করে লিখেছিস, আশা করি জীবনানন্দ বিষয়ে তোর জ্ঞানভান্ডারের কিয়দংশ সচলায়তনের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবি...
রিজভী
--------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
কষ্ট করে কবিতাবিষয়ক বকবক পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।
তুই হঠাত ঝিম মেরে গেলি কেন?
thesis নিয়েই একটা ব্লগ লিখে ফেল। সবাই পড়ুক।
হম্ অনেকদিন ধরে খরা যাচ্ছে...আসলে ৩৬০ তে লিখতে লিখতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে...এখন আর গণ-লেখা লিখতে পারিনা...লিখতে গেলেই ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো উঠে আসে...সমস্যা।
আর থিসিস্? ভালো বলেছিস...ভাবছি থিসিস্ শেষে সুপারভাইজার ফারুক স্যারকে নিয়েই একটা ব্লগ ফেঁদে বসব
সেভেন থেকে ঢুকেছিলো পোকাটা মানে খারাপ মানুষ হওয়ার চেষ্টা।সমস্যা হয়েগিয়েছিলো ভাব সম্প্রসারন আর কবিতার ব্যাখ্যা লিখতে।নিজের মতো করে লিখতাম কিন্তু টিচাররা মার্ক দিতে কিপ্টামি করতেন।
---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
পরিপূর্ন শ্রদ্ধা রেখেই লিখছি, স্কুলের স্যারদের এ ব্যাপারে মনোভাবের পরিবর্তন দরকার। কেতাবী ধরনের ভাবে ভাবসম্প্রসারন লিখতে হবে, আকার হবে এক পৃষ্ঠা আর এক কবিতা সবার কাছে একই রকম লাগবে আমার মতে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরোমাত্রায় স্বৈরাচারী।
দুর্দান্ত লিখেছেন রাফি ! নিয়মিত লিখুন ....
বড় শরমিন্দা হলাম, জনাব।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
জীবনানন্দ আমারো প্রিয় কবি। রূপসী বাংলা আমি আমার কবরেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
ধন্যবাদ রাফি আপনাকে সুন্দর এ লেখার জন্য।
--------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ভাই, ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন! অসংখ্য ধন্যবাদ।
~ ফেরারী ফেরদৌস
আপনিতো চমতকার লেখেন রাফি।
আরো অনেক লিখুন।
কাজলা দিদির জন্য এখনো কষ্ট পাই।
সারাজীবন পাবো।
একটা ভাই আর বোন আমাদের সবাইকে আজীবন
কাঁদাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আরেকটা কথা।
আপনিই কি বাংলাদেশে রিসার্চের সমস্যা নিয়ে
একটা জরুরি লিখা দিয়েছিলেন?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
@কীর্তিনাশা
জীবনানন্দের দুর্ভাগ্য যে তিনি আমাদের ভালবাসা দেখে যেতে পারেন নি; তারঁ সময়ের মানুষগুলো তাকে শুধু ব্যথাই দিয়েছে।
@ফেরারী ফেরদৌস
যতক্ষন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ততক্ষন ই আমার খুব কষ্ট হয়।
" আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে?"
@রানা মেহের
লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম। সচলে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা , তবে আগের লেখাটি বাংলাদেশে রিসার্চের সমস্যা নিয়ে ছিল না; সে লেখাটি হয়ত অন্য কোন ব্লগার দিয়েছিলেন। লেখাটি চমতকার ছিল শুনে খুজেঁ বের করার চেষ্টা করছি।
আপনাদের সবাইকেই মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
লেখাপড়া না করা স্বভাব আমার আশৈশব... ক্লাসে পড়া ধরার আগ মূহুর্তে একবার শুধু চোখ বোলানোই আমার কাজ ছিলো... আর পড়া ধরলে বানায়ে বানায়ে ইনায়ে ইনায়ে যা খুশি তাই বলতাম... পরীক্ষাতে লেখতামও এভাবেই।
এক পর্যায়ে স্কুলে আমারে পড়া ধরা বন্ধ হয়া গেলো... স্যার বলে এইটারে ধইরা লাভ নাই... বোঝাই যায় পড়ে নাই কিছু... কিন্তু বানায়া বানায়া এমনভাবে কয় যে ভুল ধরার উপায় নাই... (দেঁতোহাসি)। আমার এই বানায়া বানায়া বলার প্রতিভাতে আমার স্যারেরা আমার প্রতি মুগ্ধই ছিলেন... খালি তাদের আফসোস... লেখাপড়াটা যদি ঠিকঠাক করতি তাইলে অনেক বড় হইতে পারতি... সেই অভাবে আমার আর বড় হওয়া হইলো না। (দুঃখু)
জীবনানন্দ নিয়া লেইখা দিলেন তো ভ্যাজাল কইরা... এখন আবার আমার হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষটা পড়তে ইচ্ছা করতেছে... (চিন্তা)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
"জোস্না রাতে জোনাকীর পেছনে ছুটতে গিয়ে কেন জানি হঠাত কাজলা দিদির কথা মনে হয়ে আমার দুচোখ ভিজে উঠত।"
আমারও।এখনও। তবে আমার সত্যিই একটা দিদি ছিল।
তার কাছেই প্রথম ছড়াটা শুনেছিলাম। কিন্তু সে ই যে আমার কাজলা দিদি তখন বুঝিনি।একেবারে চলে যায়নি,বিয়ে হয়ে গিয়েছে।আর দেখা হয়নি।আর দেখা হবে কিনা জানিনা।
.........বস্ হইছে বস্। চালিয়ে যাও।
.........দেবু।
নতুন মন্তব্য করুন