‘বৃত্তের বাইরে’ নাম দিয়ে একটা সিরিজ শুরু করলাম । এই সিরিজে কি লিখব তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই – একটা লেখা থেকে আরেকটা লেখা সম্পুর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে হবে । পড়ে যার যেমন খুশী লেখাগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণ করতে পারেন, তাতে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই
নন্দিনী
বেশ কিছু চেয়ার টেবিলের দখল নিয়ে নিয়েছে এতক্ষণে কর্মজীবি মানুষেরা । কোন এক অদ্ভুত কারণে নারীদের সংখ্যাই এখানে বেশী । সাথে কিছু শিশুও অবশ্য । হয়ত কাছে পিঠে তাদের শ্রমে ঘামে একাকার হয়ে নির্মিত হচ্ছে সমাজ – সভ্যতা, যেমন হয়ে আসছে চিরকাল । বাচ্চাগুলো হাই চেয়ারে ব্যল্ট বাঁধা হয়ে বসেছে মায়েদের সঙ্গে । অবশ্য, ওসব দিকে আমার আর মন নেই তেমন । মাথাটা বার বার-ই ঘুরে যাচ্ছে কোণের দিকটায় । যেখানে ছোট্ট টেবিল ঘেষে বেশ বড়সড় একটা টবে চাইনিজ ব্যাম্বুর ঝাড় । একা দাঁড়িয়ে .....
এ নিয়ে পর পর ছয়টি সোমবার কোণের টেবিলটা ফাঁকা । সাথে চেয়ারটাও । দুই বছর ধরে দেখছি এমনটা কখনও হয়নি আগে । প্রতি সোমবার সকাল ন’টায় একই চেয়ার-টেবিলে বসে পা দোলাত লোকটা, যেন বাপের জমিদারী দেখাশুনায় বসেছে ! আর প্রজারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে তাঁর সামনে .....
চোখ তুললেই দেখতাম এদিকেই তাকিয়ে আছে । পিত্তি জ্বলে যেত !
খর চোখে তাকাতাম মাঝে মাঝে। দু’ এক পলক মাত্র । লোকটার চেহারায় অদ্ভুত আলো এসে পরত কিনা জানিনা – মনে হত যেন আমার রাগ রাগ ভাব দেখে বেশ মজা পেয়ে হাসছে .....
অন্যকেউ ও চেয়ারটায় ভুলেও পা বাড়াত না – কেন জানি !
............................................................................................
নারীদের ভীরে জমজমাট ক্যাফে
ইতস্তত ছড়িয়ে বসা ক’জন পুরূষ
কাষ্টমার সামলাতে হিমশিম খায় ওপাশের লোকগুলো
আমি ‘স্ক্রাম্বলড এ্যগ এন্ড টোষ্ট’ কফি সহ এই মাত্র
শেষ করে ঘন ঘন দরজা দেখি
কোণের ফাঁকা চেয়ারটায়
আলতো চোখ ঘুরিয়ে আনি
নাহ, কোত্থাও নেই , নেই–ই
......................................................................................................
আমার সামনের বাড়িটার ব্যালকনি একলা পরেছিল অনেককাল – সাথে
ছোট্ট বাগান টাও । ‘স্পেনীশ যুগলে’র ঘর গেরস্থালীর ঘ্রাণ নিতাম দূর থেকে – তাদের অগোচরে ।
বুড়োর হুইল চেয়ার টেনে টেনে বুড়ি সকাল-সন্ধা ব্যলকনি ঘর, ঘর ব্যলকনি । মাঝে মাঝে ‘কাউন্সিলের’ দুই তাগরা জোয়ান সাদা - সবুজে মেশানো গাড়িটায় তুলে নিয়ে যেত বুড়োকে - সাথে বুড়িও কলবল করে গাড়িতে উঠে বসত স্বাস্থসেবার জন্য । এ টুকুই বাইরের পৃথিবী তাদের
বুড়ির চোখে-মুখে সেসব দিন গুলোতে
বালিকার কিচির মিচির ছড়িয়ে পরতে দেখতাম ।
লোকগুলো যান্ত্রিক মমতায় দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবার দৃশ্য
আমি কতদিন বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথা নিয়ে
দেখেছি । অথচ পাশাপাশি বাস করেও আমাদের কথা হয়নি
তেমন । কখন ও সখন ও শুধু হাই হ্যালো
অথবা খানিকটা যান্ত্রিক হাসি ফুটিয়ে
ব্যস্ত হয়েছি নিজের কাজে ।
কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়া আমার ভয়াবহ অপছন্দ
রক্তে মাংসে হাড়ে মজ্জায় বহুবছরের নিঃসংঙ্গতা মিশে আমাকে অদ্ভুত যন্ত্র মানুষে পরিণত
করেছে.......
একদিনই শুধু বুড়ি নিজে থেকে বলেছিল
অপূর্ব সুন্দর দন্তহীন হাসি ছড়িয়ে চেহারায়
‘জানো ! আমার একটাই ছেলে, থাকে স্পেনে
ব্যবসা নিয়ে অনেক ব্যস্ত সে - সময় পায়না মোটেই
তারপরও মাঝে মাঝেই এসে আমাদের দেখে যায়
বুড়ির গর্বিত উচ্চারণে আমি মজা পাই মনে মনে
বলি না কিছুই,
জিজ্ঞেসও করতে ইচ্ছা করেনা - কই ছেলে আসে? দেখিনি তো কখনও !
কৌতুহল দেখাতে অস্বস্তি হয় খুব । একদিন দেখি
বুড়ি শুধু ঘরবার করে, চিলতে বাগানে ‘সানফ্লাওয়ার ফোটায়’ আগের মতই
শুধু ব্যালকনিটা দিনভর একাকী ধু ধু
হুইল চেয়রে বসে ঢুলু ঢুলু চোখে সংগীনির নিপূণ হাতের কাজ আর দেখেনা বুড়ো
‘সানফ্লাওয়ার’ গুলো আলোহীন, তেজহীন হয়ে পরে ক্রমে
অতঃপর ব্যালকনিতে বুড়ির উপস্থিতি চোখে পরেনা আর – বাগান বুড়ো হয় অযত্নে অবহেলায় । খোলা জানলা দিয়ে সামারের লম্বা বিকেলগুলোতে কখনওবা চোখে পরে যেত বুড়ির শীর্ণ অবয়ব
অনেক দিন হল,
রাত – বিরাতে জানলার ফাঁক গলিয়ে আলোর রেখা দেখি না আর ।
চিলতে বাগান আর ব্যালকনিটায় এখন অন্য মানুষেরা হা হা হি হি করে ......
..................................................................................................
মানুষজন যাচ্ছে আসছে – কোণের টেবিলটা খালিই পরে থাকে
প্রতিটি সকাল একই রকম আছে, একই রকম নারীরা লিপষ্টিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়
তেমনি চলে কফির মগে গুলতানি - ধোঁয়া উড়ে উড়ে বেড়ায় সারাঘরময়
একই রকম – আমি চেয়ে চেয়ে দেখি ঐ চেয়ার টেবিল আর ব্যাম্বুর টবটা
আগাগোড়া তেমনি আছে
নাম না জানা এক কষ্ট নিয়ে দেখি
অন্য মানুষের দখলে এখন সোমবারের সকাল ন’টা ......
৫ জুলাই ২০০৮
মন্তব্য
দারুণ লেখা... চলুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হ চলুক চলুক পুরা দৌড়াইয়া চলুক।
-------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
বাহ
দারুণ
চমত্কার সিরিজ চলছে, ভালো লাগছে। চলুক আরও.........
ধন্যবাদ সবাইকে । আশা করছি সিরিজটা চালানোর - দেখি কি হয় ঃ-)
নন্দিনী
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
চাপা আবেগের ধার বেশি। সেই ধারের আস্বাদান হলো।
চলুক।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
নতুন মন্তব্য করুন