এক মায়ের ব্যবসা কিংবা নৈতিকতা

নিবিড় এর ছবি
লিখেছেন নিবিড় (তারিখ: সোম, ২২/০৯/২০০৮ - ৭:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক মায়ের ব্যবসা কিংবা নৈতিকতা

আমি তখন ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার, মনে অনেক জোশ । সারা দিন মনে হয় কিছু করি । এমন কিছু যাতে সবার তাক লেগে যায় । ডিবেট থেকে আবৃিও কিছুই বাদ দিই নাই । আর মাথার ভিতর তো দেশ ও জাতি পরিবর্তনের নানা আইডিয়াতো আছেই । এই যখন অবস্থা তখন এক পেপারে একটা ছোট খাট কাজ পেয়ে গেলাম ।এরপর ক্রিয়েটিভ কিছু করব এই ভাবের ঠ্যালায় গলা দিয়েও সহজে কিছু বের হতে চায় না ।

অফিসে প্রথম দিন কাজের ফিরিস্তি শুনেতো বেলুন চুপসায় গেলো । প্রতি সাপ্তাহে একজন ছিন্নমূল মানুষের ইন্টারভিউ , এইখানে ক্রিয়েটিভ কি করব ? ধূর শালা । তাও প্রতি সাপ্তাহে যাই একটা ইন্টারভিউ নিই কোন একখান থেকে । প্রথম প্রথম এইসব মানুষের কাহিনী শুনলে চোখে পানি আসত বুকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলত । অফিসে সোহেল ভাই সব শুনে খালি হাসত আর বলত প্রথম প্রথম এমন একটু হবেই ।আমি আরো ক্ষেপে গিয়ে বলি সোহেল ভাই সব মানুষ একরকম না ।কিন্তু সময় এর সাথে সাথে আমার আবেগ যেন থিথিয়ে আসতে থাকে।এই সময় একদিন এক বিকেল বেলা আমার সাথে দেখা হল হাসানের মায়ের ।

হাসান এমন কোন বিখ্যাত কেও না যে তার মা কে আমাদের চিনতে হবে , তাই আমিও চিনতাম না ।তবে প্রতিদিনের মত ঐ দিনেও আমি আমার আস্যাইন্টমেন্টের জন্য সাবজেক্ট খুজছি । এমন সময় আজিজ মার্কেটের একটু দূর দিয়ে পরীবাগের দিকে যে গলি গিয়েছে তার পাশে দেখি এক মহিলা এক বাচ্চা নিয়ে বসে বসে ভিক্ষা করছে । বাচ্চাটার পা টা অস্বাভাবিক, কেমন জানি বাঁকানো আর মহিলা টা বাচ্চাটার পা টা দেখিয়ে ভিক্ষা চাইছে । খুবই পরিচিত দৃশ্য কিন্তু কি মনে করে যেন আমি ঠিক করলাম এরাই হবে আজকে আমার সাবজেক্ট । প্রতিবারের মত শুরুতে আলাপ জামানোর জন্য কায়দা করলাম, দিয়ে দিলাম দশ টাকা । রুটিন মাফিক প্রশ্ন করলাম, কি নাম তোমার ছেলের?
- জ্বি স্যার হাসান
- কি হইছে তোমার ছেলের?
- স্যার পোলিও
- কে বলছে তোমাকে?
- ডাক্তার
- কি বলেছে ?
- স্যার বলছে আর হাটতে পারবে না আর কিছু ঔষুধ দিছে
- খাওয়াও ঔষুধ ?
- না স্যার এত টাকা খরচ কইরা কি হইব ? পোলা তো আর হাটতে পারবো না ।

শেষ কথাটা শুনে ২১ বছরের আমার দেখা সমস্ত বাস্তবতা দুলে উঠে ।হাটতে পারবে না দেখে এক মা তার সন্তান কে ঔষুধ খাওয়াবে না এই কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না ।আমার থিথিয়ে যাওয়া আবেগ যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল । আবেগ আর বাস্তবতার ধাক্কায় বেসামাল আমি, এই মা কে আমার সমস্ত যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করলাম।যুক্তি দিয়ে এই মা কে বিধস্ত করতে পারলে যেন এই বাস্তবতা থেকে আমি মুক্তি পাই। আমি বললাম,
- কেমন মা তুমি ? নিজের ছেলেরে নিয়ে ব্যবসা কর । লজ্জা করে না ।
- কেন স্যার ? পুলারে লইয়া ভিক্ষা করি এইতে সরমের কি আছে ?
- ছেলের অসুখ কে পুঁজি করে ব্যবসা কর খারাপ লাগে না ?

আমার কথার ফুলঝড়িতে যেন প্রথম বারের মত এই মা যেন বুঝতে পারে কিছু একটা গোলমাল এই কাজটায় আছে । সেই ব্যাপারাটা বুঝি খুজে বের করার জন্য একবার ছেলের পায়ের দিকে আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকায় । মনকে শান্ত করার জন্য একটা জুতসই উওর এর অপেক্ষায় আমিও হাসানের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ।হয়ত ছেলে কে ব্যবহার করে ব্যবসার লজ্জা বুঝতে পেরে কিংবা ঢাকার শেষ বিকেলের গরমে হাসানের মা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । দীর্ঘশ্বাসটার মানে না বুঝলেও একটা উওর এর জন্য আমি অপেক্ষা করি ।শেষ পর্যন্ত উওর দেয় হাসানের মা, বলে-

- কি আর কমু স্যার, বাড়িত আরও দু’গা পোলা আছে। এইহানে হাসানরে লইয়া ভিক্ষা করলে ভাল ইনকাম হয় । পোলাপাইন গুলারে একটু ভাল খাওইতাম পারি । হাসানতো এমনেও হাটতে পারে না কিন্তু অর পাটা দেখাইলে ভাল ইনকাম হয় স্যার । আপনেই কন কোনডা ঠিক স্যার, হাসানের পা দেখাইয়া ভিক্ষা করা না পোলাপাইন তিনডা রে ঠিকমত খাইতে দিতে না পারা । ভিক্ষা কি আর সাধে করি স্যার ।

বিভিন্ন নীতিকথা শুনানোর জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম কিন্তু প্রস্তুত ছিলাম না এই উওর এর জন্য । আর তাই ভিক্ষার থালায় ১০০ টাকা রেখে আমি এইখান থেকে যেন পালাতে চাইলাম । সন্ধ্যার ঢাকার ব্যাস্ত ফুটপাথ এর ভিতর দিয়ে যেন আমি ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলতে চাইলাম এই নতুন দেখা বাস্তবতা কে । কিন্তু হারাতে পারলাম না এই প্রশ্ন
টা কে,
কোনটা ঠিক হাসানের মায়ের এই ব্যবসা না আমার নৈ্তিকতা ?

নিবিড়


মন্তব্য

জয়িতা এর ছবি

কোনটা ঠিক হাসানের মায়ের এই ব্যবসা না আমার নৈ্তিকতা ......................... কঠিন প্রশ্ন ।
জয়িতা

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হুমম।

অতিথি লেখক এর ছবি

কোনটা ঠিক এখানে সেটা বলা কঠিন।আপনি বাস্তবতাকে এড়াতে পারবেন না আবার নৈতিকতা ও ছাড়তে পারবেন না। তবে অবশ্যই এই সমস্যার সমাধান হবে এই আশা করি।আপনি ভালো লিখেছেন।ধন্যবাদ

(জয়িতা)

অতিথি লেখক এর ছবি

বাস্তবতা মাঝে মাঝে এমন ধাঁধা লাগিয়ে দেয় যা আসলে এড়ানো কঠিন । আপনার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ ।
নিবিড়

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আপনেই কন কোনডা ঠিক স্যার, হাসানের পা দেখাইয়া ভিক্ষা করা না পোলাপাইন তিনডা রে ঠিকমত খাইতে দিতে না পারা । ভিক্ষা কি আর সাধে করি স্যার ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। এভাবেই অনেক সময় বাস্তবতার কাছে নৈতিকতা পরাজিত হয়।

আলমগীর এর ছবি

পেপার আর এনজিওঅলারা যে আবার তাদের কাহিনী বেচে সেইটা কী হবে?

অমিত আহমেদ এর ছবি

বাস্তবতার কাছে নৈতিকতার কোনো মূল্য নাই...
"পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"

ভালো লিখেছেন।

এই ঘটনার সাথে সম্পর্ক নেই। তবে দেখেছি কিছু ক্ষেত্রে ভিক্ষা একটা ইজি ওয়ে আউট হয়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিছু ভিক্ষুককে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে ফল পাই নাই। ভিক্ষায় নাকি কম কষ্টে বেশি ইনকাম। ভিক্ষা যে ভালো কাজ নয়, এই বোধটাই তাদের নাই।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

এক্জন এর ছবি

অফ টপিক্ঃআগে ভিক্ষুকদের সাথে অনেক কথা বল্তাম। একবার এক মাঝ বয়সি ভিক্ষুককে তুমি করে বলায় হেভি ঝারি খাইলাম --"বাড়িত বাপ মায় কি শ্যাখায়? আদব লেহায জাননা, মুরুব্বই মাইনসেরে তুমি কইরা কও! " এরপর থেকে আর কথা বাড়াই না। হয় মট্কা মেরে থাকি নাইলে দুই টাকা দিয়ে মাফ চেয়ে নেই।

অতিথি লেখক এর ছবি

এরকম লোকের পাল্লায় পড়লে মাফ না চেয়ে কি উপায় ? তবে কথা বলা বন্ধ করে ভুল করছেন , এদের কাছে এমন সব খবর পাবেন যা আপনি হয়ত কল্পনাও করেন নি । তাই কথা বলা চালিয়ে যান ।
নিবিড়

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে ম ন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । আপনার কথার উওর সম্ভবত একটাই - সবাই শর্ট কাট উপায় খুঁজে ।
নিবিড়

তানবীরা এর ছবি

পয়সা দিয়া ভাইব্বেন না কেউ, ভিক্ষা কইরা খাই।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হুমম, সব প্রশ্নের কি আর জবাব মেলে!
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

কুচ্ছিত হাঁসের ছানা এর ছবি

আমাদের এলাকায় একটা ভিক্ষুক ছিল আজকাল আর দেখি না অবশ্য। ব্যাটা নাকি ভিক্ষা করে ২ তলা বাড়ি করছে... আসুন আমরা সবাই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে এই শর্টকাট ব্যবসায় নেমে পড়ি।

এই সব লোকদের দেখে দেখে সত্যিকারের অভাবী লোকদের আর সাহায্য করা হয় না।

*******************************
আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে, অভিমানের নদীর তীরে
শুধু তোমায় বলতে ভালবাসি, আমি বারেবার আসব ফিরে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।