এখানে এখন শীতের শুরু। সবাই অপেক্ষা করছে প্রথম তুষারপাতের জন্য। ক'দিন শূন্যের নিচে নাচানাচি চলেছে। এখন দিনে আবার ১০-১৫ পর্যন্ত উঠছে।
তবে, এ দেখে প্রকৃতির উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই। আজ নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখে যারা (আমার মত) দুটো টি-শার্ট (একটার উপর আরেকটা) পড়ে বের হয়েছে, তারাই আজ বিভ্রান্ত। সেদিন সকালের মাইনাস চার এর থেকে সুখকর ছিল।
দেশি মসলার সন্ধানে ছিল আমার এই অভিযান। ৫০ ব্লক দক্ষিণে কয়েকটি সারি সারি বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানির দোকান আছে। এই শহরে দেশি রসদের দোকান বলতে সর্বসাকুল্যে এটুকুই।
কেনাকাটা শেষ হয়ে গেছে বেশ তাড়াতাড়ি, বাস আসতে প্রায় আধ ঘন্টা বাকি। বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। তখন আরো দু'জন বাঙালি ছাত্রের দেখা।
তাদের একজন সিলেটি ভাষায় অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বোঝাল,কিভাবে এই শহরে তাপমাত্রা হরহামেশাই -৩৫ এ নেমে আসে। বোঝাল, কিভাবে তখন বাসস্ট্যান্ডে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কিভাবে তুষারপাতের সময় বাসগুলো যখনতখন সময়সূচি পাল্ট ফেলে এবং কিভাবে অনেকক্ষণ এমন তাপমাত্রায় থেকে হঠাৎ কোন বিল্ডিং এ ঢুকলে নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে।
আমি কল্পনা করতে থাকলাম সেই আসন্ন ঘটনাগুলো। -৩৫। হাতের আঙুল অবশ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখে ঠাণ্ডা লাগছে। কাছের বিল্ডিংটার দিকে দৌড়ে যাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু দৌড়নো যাবে না। পিছলে হাত-পা ভাঙতে পারি। কিছু আদিবাসী আমার দিকে তাকিয়ে নিজেরা হাসাহাসি করছে। তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। বোধহয় না। এদেশের সরকার তার সুদূর উত্তরপ্রান্তের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য কয়েক দশক আগে কিছু আদিবাসী পরিবারকে জোরপূর্বক সেপ্রান্তে পাঠিয়েছিল বসবাসের জন্য। সেখানে বসবাস স্বয়ং সেই ইগলুবাসীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। আজ তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে এ সরকার।
এটি সুদূর উত্তর না। তবে শীত এখানে নির্মম। যাহোক, আমার -৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কল্পনা এখনো চলছে। আমি কোনমতে একটি ভবনে ঢুকেছি। আর আমার নাক দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে পড়ছে রক্ত।
"এ অবস্থায় আমাকে কি এখন মেঝে থেকে এই রক্ত মুছে দিতে হবে?" কল্পনা ভেঙে ফিরে এসে জানতে চাইলাম সিলেটি ভাইকে।
"আমি মুছে দিয়েছিলাম রক্তগুলো। আমার কাছে টিস্যু ছিল।" নিতান্ত ঠাট্টার ছলে জানতে চেয়েছিলাম, এই উত্তর শুনবো আশা করিনি।
যাহোক, মনটা খারাপ হয়ে গেল।স্নাতক ডিগ্রির জন্য এই জায়গাকে বেছে নেয়ার যথেষ্ট শক্ত কারণ সবগুলো শীত আসার সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে ম্যাগপাইগুলোর মত।
এমন অবস্থায় দেখতে পেলাম একটি বাঙালি পরিবার বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে আসছে। স্বামী-স্ত্রী আর ছোট ছোট দু'টো বাচ্চা। এরা তবে এখানে কি করছে?
সিলেটি ভাই যথারীতি তার শীতাক্রমণ শুরু করে দিল নতুন আগন্তুকের প্রতি। এবং সহসাই আমরা জানতে পারলাম, তারা চারমাস হল বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছেন।
এদেশে প্রতিবছর প্রচুর বাঙালি অভিবাসী হিসেবে আসছে, তবে তা এই শহরে নয়। বাঙালিদের অভিবাসনের জন্য অতীব জনপ্রিয় একটি শহর আছে এই দেশে। তা ছেড়ে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই পরিবার।
-৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করার মানুষ বাড়ছে। স্বয়ং শীতবাহক সিলেটি ভাইটির চোখ দুটিও জ্বলজ্বল করছে আশার আলোয়।
মন্তব্য
হায়!
অতিথিরা নাম লিখেন না কেনো?
লেখক ধারাভাষ্য
নতুন মন্তব্য করুন