কেউ নেই আধাঁরে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৮/১১/২০০৮ - ১০:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুর্যটা বাড়ি যাব যাব করছে। সন্ধেটা এত তাড়াতাড়ি চলে আসলো কেমন করে বুঝতেই পারেনা অণু। একটু আগেই তো বিকেল ছিল। এখনো যে কেন আসছে না রিক্তা। অণু একটা দৈনিক পত্রিকায় কাজ করে। আজ রিক্তার সাথে তার appointment আছে।অণুর কারো জন্য অপেক্ষা করতে ভাল লাগেনা।কিন্তু আজ সে বেশ আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করে। নারী দিবসের বিশেষ সংখ্যায় রিক্তার story টা ছাপানো হবে। সম্পাদক কালকের মধেই report করতে বলেছেন।
“সরি। দেরি হয়ে গেল। একটা কাজে আটকা পরেছিলাম।“মাথার চুলটা ঠিক করতে করতে বলল রিক্তা।
“বসুন। কি খাবেন? চা খেলে খাওয়াতে পারি। কফি নাই।“ বলল অণু। “কিছু খাওয়াতে হবে না। এক গ্লাস পানি খাওয়ালে চলবে।“ হেসে বলল রিক্তা।
পিওনকে পানি আর নাস্তা আনতে বলে শুরু করল অণু।
“কেমন আছেন?”
“কেমন আর থাকব বলুন। এত খারাপের মাঝেও ভাল থাকার চেষ্টা করি।“ নির্লিপ্ত ভংগিতে বলল রিক্তা।
“তাহলে শুরু করা যাক। বলুন কেমন করে এই পথে আসলেন?“
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করল রিক্তা............
“আমি তখন খুব ছোট যখন আমার বাবা সব জমি বিক্রি করে দিয়ে শহরে চলে আসে। আশা ছিলো একটুখানি ভালোভাবে বেঁচে থাকা। কিন্তু বাবা যা মনে করেছিলো তার কিছুই হলো না। ঢাকায় একটা বস্তিতে পলিথিনের ছাউনি দেয়া ঘরে আমরা থাকতাম। বাবা রিকশা চালিয়ে যা পেতেন তা দিয়ে কোনরকমে দিন চলে যেত। আমরা ছিলাম তিন বোন। আমি সবচেয়ে বড় ছিলাম। আমাকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। আমি একবার রেজাল্ট ভাল করলে বাবা আমাকে বলেছিলেন,” তুই কি চাস মা। নতুন জামা নিবি?” আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম,”আমার কিচ্ছু দরকার নাই। চল আমরা গ্রামে ফিরে যাই। এখানে আমার ভাল লাগেনা। দম বন্ধ হয়ে আসে। এই শহরের মানুষগুলান জানি কেমন!” একবার হরতালে বাবার রিকশাটা হরতলাকারিরা ভেঙ্গে দিল। মহাজনের কাছে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হলো। আমাদের বস্তিটা উচ্ছেদ হলো। বাবা আবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু গ্রামে আমাদের কোন বাড়িঘর-জমি কিছু ছিলনা। তবুও আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। কতদিন শেফালিকে দেখিনা। ও আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। মনে আছে যেদিন আমরা ঢাকা চলে আসছিলাম সেদিন দুজনে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। আবার গ্রামে যাচ্ছি এই উত্তেজনায় আমি রাতভর ঘুমোতে পারিনি। সকালে উঠে সবাইকে ডেকে তুললাম। বাবা আমাদের তৈরী হতে বলে বাইরে গেল। বলে গেল কিছু কাজ করে ঘন্টাখানিকের মাঝে ফিরে আসবে। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসলোনা। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা ট্রাক......” বলতে বলতে গলাটা জড়িয়ে আসে রিক্তার। “রিকশা-শ্রমিক সমিতির সভাপতি আমার মা আর দুই বোনকে গ্রামে একটা টিনের বাড়ি করে দিতে চাইলো আর মাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিতে চাইলো। কিন্তু বিনিময়ে সে আমাকে বিয়ে করতে চাইলো। মা রাজি হতে চাচ্ছিলেন না কিন্তু আমি জোর করে মাকে রাজি করালাম। মা আর আমার দুই বোন গ্রামে ফিরে গেল। আমার আর গ্রামে ফেরা হোলনা। বিয়ের পর জানতে পারলাম আমার স্বামী আগেও তিনবার বিয়ে করেছে। সবাই জানে সে আমার স্বামী কিন্তু আমি জানি সে একটা পশু। তার উপরের দরবারের কোন কাজ করতে হলে সে আমাকে ব্যবহার করত। তখন নানা জনের সাথে আমাকে রাত কাটাতে হত।এসব করতে গিয়ে আমি তিনবার গর্ভবতী হই।প্রতিবার আমাকে গর্ভপাত করতে বাধ্য করা হয়। এইসব করতে রাজি না হলে সে আমাকে খুন করে ফেলার হুমকি দিত। একবছর আগে সে আরেকটা বিয়ে করে। আর আমাকে একটা পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও আমি সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে পারিনি। কারণ আমার যাওয়ার কোন পথ ছিলনা।“
“কেন? আপনি আপনার গ্রামে ফিরে যেতে পারতেন।“, এতক্ষন অবাক হয়ে শুনতে থাকা অণু জিজ্ঞেস করল।
“ফিরে গিয়ে মাকে আমি কি বলতাম? বলতাম যে এতদিন আমি কিছু নরপশুর সাথে জীবনযাপন করেছি? নিজের মায়ের কাছে এই গল্প বলার চেয়ে দেহব্যবসা অনেক ভাল। গ্রামে কেউ জেনে গেলে আমি কি করে মুখ দেখাতাম? এর চেয়ে এই অন্ধকার জগতই ভাল। আর এখন আমার অনেক সুনাম। আমি এই নগরীর এক জনপ্রিয় নিশিকন্যা।“,বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল রিক্তা। হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেলল সে। ছোট্টশিশুর মতো হাউমাউ কান্না। দুচোখ দিয়ে বুকের কষ্টগুলো পানি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।
শেষ কথাঃ এই story টি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর একটা বেসরকারী সংস্থা রিকশা-শ্রমিক সভাপতির বিরুদ্ধে মামলা করে। নারী নির্যাতন আইনে তার ১০ বছরের জেল হয়। সংস্থাটি রিক্তাকে একটা গার্মেন্টসে চাকরী যোগার করে দেয়। is it a happy ending? এই রকম কত রিক্তা আমাদের চারপাশে আছে। কেউ যখন এইসব নিশিকন্যার সাথে রাত কাটায় তখন তার লোলুপ দৃষ্টি থাকে মেয়েটির শরীরের দিকে। কেউ কি কখনো ভেবে দেখে একজন মা হওয়ার লোভ ছেড়ে সে এই পথে কেন এসেছে? এই রকম কত মা হারিয়ে যায় অজানা আঁধারে।তাদের চোখের জল জানিয়ে দেয় কেউ নেই আঁধারে।


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

লিখতে থাকুন নিয়মিত।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম...... গল্পের শেষে আপনার নাম টা দিলে ভাল হত । যাই হোক দেখা হবে আপনার অন্য কোন লেখায় ।
নিবিড়

ধুসর গোধূলি এর ছবি
মাহবুব লীলেন এর ছবি

লেখের নামটা যে জানা দরকার

০২

লেখাটা ভালো

খেকশিয়াল এর ছবি

দারুন লিখেছেন, আরো চাই ।

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

কুচ্ছিত হাঁসের ছানা এর ছবি

সাব্বাস মুবি। শুরুটা বেশ ভাল। চালায়া যাইতে থাক। আইইউটি দেখি সচল জ্বরে বেশ আক্রান্ত।

*******************************
আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে, অভিমানের নদীর তীরে
শুধু তোমায় বলতে ভালবাসি, আমি বারেবার আসব ফিরে

মেঘবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

লেখকের নাম মেঘবাড়ি।

রাফি এর ছবি

সচলে শুরুটা ভালোই করছেন।
*****

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

রায়হান আবীর এর ছবি

ভালোইছে।

=============================

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভাল হইছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।