আগের পর্ব : শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো : পর্ব ১
আমরা তখন “সঙ্গম” নিয়ে মেতে উঠলাম।প্রথম সংখ্যা বের করতে হবে। লেখা জোগাড় হচ্ছে। লেখা আসছে। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছি। দীনভাই কবিতা দিলেন। শেখভাই গল্প। পলাশ, ঋতো, জাহিদ, সুমন লিখলো। পলাশের একটা বড়োকবিতার খন্ডাংশ চারপাতাজুড়ে সেখানে গিয়েছিলো। পুরোকবিতাটা পরে তার বইয়ে এসেছিলো। সাদিক একটা প্রবন্ধ দিয়েছিলো। খুবই বাজে টাইপের কিছু একটা হয়েছিলো। আগামাথা নাই। একদম তারছেঁড়া টাইপের। কি নিয়ে লেখবো বলে শুরু করে কোথায় গিয়ে থেমেছিলো সে নিজেও বোধহয় আন্দাজ কারতে পারছিলো না। আমাদের টাইপের না হলেও, একদম ফালতু হয়নি বলে সেযাত্রায় ছাপিয়েছিলাম। কম্পোজের কাজটা করেছিলো সাদিকের ছোট ভাই। ছেলেটা ছিলো একটু মাথামোটা টাইপের। বেশীকথা বলতো। বানানে ন এবং ণ ঠিক করে বেরিয়ে এসে পরদিন গিয়ে দ্যাখি সবগুলোকে ন বানিয়ে বসে রয়েছে। আমরা অসম্ভব বিরক্তি আর রাগ নিয়ে কম্পোজটা শেষ করেছিলাম।
আজ “সঙ্গম” বেরুবে। আমাদের মাঝে একটা সাজ সাজ রব। আমি কোচিং-এ ক্লাস কেনসেল করলাম। সেই সময়টায় আমি পজিট্রন আর শুভেচ্ছাতে রসায়ন পড়াতাম। সপ্তাহে তিনদিন চুক্তিতে তিনটা টিউশানীও করতাম। তাও একসপ্তাহ কেনসেল করলাম। টেনসান হচ্ছিলো। শেষপর্যন্ত যদি কোনো বানান ভুল থাকে, তাইলেই সবর্নাশ হয়ে যাবে। ভুল বানানের লেখা দেখলে পালাশ জাহিদ ঋতো বলবে, এইগুলো গু হয়েছে। কি করেছেন এই সব? ঘাস খেয়েছিলেন? ইমদাদ টুকেরবাজার থেকে গত চারদিন ধরে আমাদের সাথে আছে। এমদাদের বাড়ি যাবার কথা ছিলো গতসপ্তাহে, মাস খরচের টাকা আনতে। যায়নি। লাইন বাই লাইন কয়েকবার করে পড়েছি।
আমি ইমদাদ আর এমদাদ প্রথমে গেলাম বইপত্রে। দীন ভাই এর সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। উনি ডালপুরী আর চা খাওয়ালেন। আনোয়ার কাজিম্যানশনের সামনের একটা দোকান থেকে সেই স্পেশাল ডালপুরী আর চা আনতো। এই ছেলেটি আমাদের অনেক চা-সিঙ্গড়া খাইয়েছে। ওঁর সাথে আমাদের অনেক সখ্যতা হয়েছিলো। অনেক বই পড়তো । বইপত্রে আমার একটা একস্ট্রা লোভ ছিলো ওঁর পঠিত বিদ্যার কিছুটা রস আহরণ করা। সেখান থেকে গেলাম প্রেস-এ। তর সইছিলোনা। কবে আতুঁড় কপিগুলো দ্যাখবো? প্রেসের লোকেরা বলল সবকাজ শেষ হতেহতে রাত ১১/১২ টা হবে। আপনাদের আগে আরেকটার সিরিয়াল আছে। আমরা আবার বইপত্রে গেলাম। দীন ভাই ততক্ষণে চলে গেছেন। আনোয়ার তখন দোকান বন্ধের পায়তারা করছিলো। আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
বললাম, চলো সুরমা দ্যাখে আসি। রাতের সুরমা। একাটা আলাদা হাহাকার আর সৌন্দর্য নিয়ে চলমান। পানিতে প্রতিবিম্বিত বিদ্যুতবাতির আলোর খেলা দ্যাখা আমরা প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। ঘাসিটুলার দিকে যেতে বললাম। এইদিকটায় সুরমা ভরাবর্ষায় অসম্ভব যুবতীরূপে থাকে। ভরা সুরমা। ভরাসৌন্দর্য। ইমদাদ যথারীতি গান করছে। শক্তিও আওড়াচ্ছিলো। তারপর অনেকক্ষণ নিরব। এমদাদ বলল শামিম ভাই, যদি আমাদের লেখাগুলো প্রতিষ্ঠিতদের ভালো না লাগে? কোনো উত্তর দিলাম না। কি দেবো? শুধু মনে মনে বললাম, দূর মিয়া রাখ তোর প্রতিষ্ঠিতওয়ালা। ইশটাবলিশমেন্টে আঘাত বাঙালী সইতে পারে না। ভয় পায়। কোনপ্রকার রিস্কে তারা নেই। তাই বলে আমরা কি নতুন কিছু করবো না? ইমদাদ বলল, আমাদের অনেক অনেক ভালোবাসার ফসলগুলো কেউই সহজে ফালতু বলতে পারবে না। সামনাসামনি ভালো না বললেও মনে মনে ঠিকই বলবে ঐ ছেলেগুলো তো ভালোই করতেছে। সাহস করে শুরু করতে হবে বেটা, এতো মিনমিনে স্বভাব কেন তোর? কে কি বলল তাতে আমাদের কি আসে যায়? আমরা জানি আমরা কি করছি, সেটা জানাই আমাদের দরকার, তুই জানিসতো তুই কি করতেছিস? এমদাদ হতাশা মেশানো কন্ঠে নিম্নস্বরে বললো জানি রে দুস্ত, জানি।
সুরমার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে রইলাম। পূর্ণযৌবনা সুরমা। দূর থেকে আসা অসংখ্য বণিক আর নৌকা-শ্রমিকদের ভীড়। বাণিজ্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকে। নৌকাবাসী। নৌকায় খায়। নৌকায় ঘুমায়। সুরমায় হাগে। ঘাসিটুলার পশ্চিমদিকটায় জলবাসী সাপুড়েদের সারিসারি নৌকা। তাদের ভাসমান সংসার। সেখানে কেমন জানি রবরব ভাব। নৌকার ছইয়ের বাইরে হারিকেনবাতির চারপাশে সংসারের সব জিনিশপত্র। বাচ্চারা হামাগুড়ি দিচ্ছে। রমণীরা রাধঁছে। কেউ গাইছে। আমরাও গাইলাম। যৌথভাবে অঞ্জনের কাঞ্চনজঞ্জা হলো। সামিনার কবিতা পড়ার প্রহরও হলো।
পাশেই একটা খেয়াঘাট। প্রতিপারে ১ টাকা। তাছাড়া ছোট ছোট অনেক নৌকাও কর্মক্লান্ত মানুষ নিয়ে এপার-ওপার করছে। তাদের ভাড়াও ১টাকা। মানুষ হাপাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। হয়তো বউ দাওয়ায় বসে আছে পথচেয়ে। শিশুরা হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় মা ভাত দাও মা ভাত দাও বলে বলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ি যাবে, রান্না-বান্না হবে। তারপর অর্ধঘুমন্ত শিশুদের খাওয়ানো হবে। পরদিন ভোরের আলো হবার আগেই হয়তো ঝোলা হাতে আবার খেয়াপার হতে হবে।
ইমদাদ কদিন পরপর প্রেমে পড়তো। ইশ, শামিম ভাই যা সুন্দর ! দ্যাখামাত্র আমার শিরা উপশিরা থেমে গ্যাছিলো। এই জাতীয় উত্তেজক বাক্য আমরা প্রতি ৪/৫ মাস অন্তর অন্তর নতুন করে নতুনরূপে শুনতাম। ক্যাম্পাসে নতুন একটা ব্যাচ এসেছে, কোথাও বিয়ে খেতে গিয়েছে,ঈদে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে অথবা লন্ডন থেকে কেউ বেড়াতে এসেছে ইমদাদের সেই শিরা উপশিরা থেমে যাওরার কাহিনীর সংখ্যাও বেড়েছে। সুরমার পানিতে পা ডুবিয়ে ইমদাদ আমাদের তেমন এক শিরা উপশিরা থেমে যাওরার নতুন কাহিনী শোনালো। ওঁর বলারভঙ্গিতে অতি সাধারণ চেহারা আর মেধার মেয়েও গ্রীক পুরাণের অতিমানবী কেউ হয়ে উঠতো। রূপের আর মেধার অলৌকিক দ্যূতিতে ঝলমল করতো। আমি অনেকবার বলেছিলাম তুই কবিতা ছেড়ে গল্প লেখ। তখন বলত আমি গল্প লেখলে আপনাদের বেইল থাকবে না। তো সেদিনও সে আমাদেরকে তার নতুন অতিমানবীর কথা বলেছিলো স্বাভাবিক ছন্দেই। বলল, একদিন আপনাদের কুলাউড়ায় নিয়ে যাবো। সেই অতিমানবী তখন কুলাউড়াবাসী। আমরা ওঁর এই নতুন প্রেমের বাহবা দিলাম আর অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তী নতুন কাহিনী শোনার।
আমাদের রিকশাওয়ালা ততক্ষণ খেয়াপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। চারজন মিলে আবার জম্পেস একটা চা-সিগারেট পর্ব হলো। রাত গভীর হতে থাকলো, প্রেসে যেতে হবে। সারাক্ষণ আমরা কথা বলছিলাম নিজের লেখা ছাপা অবস্থায় দ্যাখে পড়ে কার কেমন লাগবে। যতই জিন্দাবাজারের কাছাকাছি আসছিলাম নিজের মাঝে ততই কেমন জানি একটা পরিবর্তন ঠের পাচ্ছিলাম। অনবরত সিগারেট চলছিলো। প্রেসে গেলাম। আমরা একটা একটা করে সঙ্গম হাতে নিলাম। অবশেষে সঙ্গম বেরোলো। দীন ভাইয়ের পরিচিত ছিলাম বলে কয়েকশ টাকা কম রেখেছিলেন প্রেসের মালিক। আমরা রিকশা ছেড়ে হাটা ধরলাম। ছুটলাম আমাদের বাগবাড়ির মেসে। আমাদের আর তর সইছিলো না। সোডিয়াম আলোর ফ্যাকাসে আলোতে আমরা তিন বন্ধু হাটছি, আমাদের মাথায় সঙ্গম-এর বোঝা। মনে আনন্দের বন্যা। ফ্যাকাসে আলোতে নিজেদের লেখা দেখছি। আমারা আলোকিত হলাম নিজের আনন্দে। তিনজন অনেক হইহই রইরই করলাম। বাসায় ফিরেই আবার ছুটলাম দীন ভাইয়ের দরগামহল্লা বাসায়। তখনো ঘুমাননি। তাঁকে একটা কপি দিলাম। সেখানেই প্রথম লক্ষ্য করলাম একটা বানান ভুল ভাবে ছাপা হয়েছে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকলাম। সারা কাগজে ৪ টি বানান ভুল পেলাম। আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে হলো। আমাদের মন ভীষণ খারাপ হলো। মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সালামকে আসলো শেষরাতের দিকে। ছটাকখানেক গাঁজা আর অনেক গুলো সস্তার সিগারেট নিয়ে। সঙ্গম দ্যাখলো। বলল, হয়ছে ভালো হয়েছে। যা হবার হয়ে গ্যাছে, এখনতো মুখ ত্যাবড়া করে বসে থাকার কোনো মানে নেই। শামিমভাই কই আপনার সেই বিখ্যাত খিচুড়ি? খিচুড়ি রাঁধেন। আমি গাঁজা সাপ্লাই দেবো, যে যে খাবেন চিল্লানি দিয়েন। উঁচুভলিউমে গান হবে, কোনো নিষেধ নেই আজ। গান হলো। পলাশের দীর্ঘকবিতাটা ইমদাদ পড়লো। হাসান আজিজুল হকের “আত্মজা ও একটি করবি গাছ” পড়লো এমদাদ। আমরা বাকিটা রাত উৎসব করলাম। খেলাম, আনন্দ করলাম। সালাম সারাক্ষণ ভুল এবং অশ্লীল বাঙলায় বিড়বিড় করে যাচ্ছিলো। মনে হয় ডোজটা একটু বেশী হয়েছিলো। বুদ হয়ে পড়ে রইলাম, পরদিন সকাল পর্যন্ত।
ঢাকায় কিছু কপি পাঠানো হলো। পরিচিত সাহিত্যজনে ১০ টাকার বিনিময়ে দিচ্ছি। কেউ কেউ বাকীও নিয়ে যায়। জানি বাকীর পয়সা কখনোই পাবো না, এর পরেও দিয়ে দেই। কারণ সাথে এটাও জানি যে, লোকটি কবিতা-গল্পের ভালোই সমঝদার। কদিন পর পলাশ ঢাকা থেকে আসলো। সঙ্গম দ্যাখলো পড়লো। বলল জাহিদের কবিতা এমদাদের গল্প অসম্ভব ভালো লেগেছে । জাহিদ, ঋতো, সুমন ছিলো। সঙ্গম উপলক্ষ্যে চা-স্টলে ম্যারাথন আড্ডা বসলো। ৪ ঘন্টা চুটিয়ে আড্ডা মারলাম। আমাদের সাহিত্যপ্রেম বাড়তে থাকলো। এমদাদ আস্তে আস্তে গল্পকার হতে থাকলো। ইমদাদ তারো আগে কবি হয়ে উঠেছিলো। আমরা সঙ্গমের পরবর্তি সংখ্যার পথ খুঁজতে থাকলাম।
শামিম২৭শে নভেম্বর ২০০৮
মনাশ ইউনি, মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া
(পরবর্তী পর্ব : শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো : পর্ব ৩)
নিবন্ধন নাম: Shamim
ইমেইল:
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন