আমরা যখন সবেমাত্র চলচ্চিত্রাঙ্গনে পা দিয়েছি ততদিনে ওপার বাংলার এক বাঙালি চিত্রপরিচালক 'পথের পাচাঁলী' বানিয়ে সারা বিশ্বে সোরগোল ফেলে দিয়েছেন। সুতরাং ফিল্মি দুনিয়ায় আমরা শিশুবৎ; মাপকাঠি যাইহোক না কেন। কিন্তু চিরকাল শিশু থেকে গেলেতো চলবে না। আমাদের কৈশোর পার করতে হবে, হতে হবে যুবক এবং সবচেয়ে বড়কথা ধরে রাখতে হবে সেই যৌবন; চিরকালের মত। কখনো বুড়ো হওয়া যাবে না। তো, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা কী আমাদের সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে? নিশ্চিতই না। তাহলে এখন কি করা? চলচ্চিত্রে চিরস্থায়ী যৌবন ধরে রাখতে গেলে আমাদের কি কি করতে হবে? উত্তর বোদ্ধারা দেবেন। আমি আমার মত করে দিই।
চলচ্চিত্র একটি ব্যয়বহুল মাধ্যম। সুতরাং চলচ্চিত্র শিল্পকে ( আর্থিক এবং নন্দনতাত্তিক দুই অর্থেই এটাকে বোধহয় শিল্প বলা হয়) দাঁড় করাতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে টাকা। তাহলে বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র দেশের চলচ্চিত্রশিল্প দাড়াঁবার কি কোন কারণ আছে? তাছাড়া ভালোমানের চলচ্চিত্র গ্রহণ করার মত উপযুক্ত মানসিক প্রস্তুতিও কী আমাদের আছে? যেখানে জাতি হিসেবে প্রায় নিরক্ষর এবং পাঠ বিমুখ। আ্যস্থেটিক ভিউটাতো আর আসমান থেকে আসবে না। খামাখা তাহলে চলচ্চিত্র নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? আচ্ছা, আ্যস্থেটিক ভিউয়ের কথা বাদ। চলচ্চিত্রতো মূলত বিনোদন মাধ্যম। তাহলে এর মাধ্যমে আমরা বিনোদিত হতে চাই। তাই কী? নাকি বিনোদনের সাথে সাথে চাই আরো কিছু। কি সে চাওয়া? সেই চাওয়ার জায়গাটাও তো আমরা স্পষ্ট করতে পারিনি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যা চাই সেটা হল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ধনাত্মক ইমেজ। এক্ষেত্রে ইরানি মুভিগুলো হতে পারে আমাদের আদর্শ। তাহলে চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক দিকটাকে কি আমি উপেক্ষা করছি? মোটেই না।
এখনতো আকাশ-সংস্কৃতির যুগ। তাই হলিউড-বলিঊডের ঝাঁ চকচকে কমার্শিয়াল ফিল্ম দেখে আমাদের চোখের যে অবস্থা হয়েছে তাতে আমাদের এই ক্ষুদ্র বাজেট নির্ভর চলচ্চিত্রগুলোরতো কল্কে পাওয়ার কথা না।
শুনেছি ৭০-৮০'র দশকে নাকি পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে সিনেমা হলে যেত। এখন পুজিঁবাদ, বিশ্বায়ন বা যে কারণেই হোক না কেন সেই জোরালো ফ্যামিলি বন্ডেজটা আর নেই। সুতরাং সেই সামাজিক অবস্থাটাও আর কল্পনা করা যায় না। তাহলে কি সিদ্ধান্তে আসা গেল? 'পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মত ছবি' এই vague কথাকে পুজিঁ করে মুভি বানালে সেটি আর কল্কো পাবেনা। তাহলে কি করতে হবে?
আমার মনে হয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের জন্য আমাদের দুইটি স্তরে টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করতে হবে। একটা স্তরে থাকবে সমাজের তরুণ এবং তরুণতর অংশ বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা যাদের সংখ্যা আনুমানিক চা-পাচঁ লাখ। এখন তাদেরকে টার্গেট করে চলচ্চিত্র বানানো হলে আমার স্থির বিশ্বাস তা তাদের মনযোগ আকর্ষণে সক্ষম হবে যেমন ব্যাচেলর। আরেকটি স্তরে থাকবে সমাজের খেটে খাওয়া অংশ যেমন কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদির জন্য নির্মিত বিনোদন নির্ভর চলচ্চিত্র যেমন বেদেঁর মেয়ে জোছনা ( এই মুভিটির যে ক্রিটিসিজম ফরহাদ মজহার করেছেন তাতে এটিকে শুধু বিনোদন নির্ভর চলচিত্র বলতে সাহসে কুলোচ্ছে না। এবার আসা যাক আর্ট ফিল্ম, প্যারালাল ফিল্ম বা বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে। এইসব মুভি আমার মতে শুধু তৈরিই করতে হবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য। তার মানে এই নয় যে এইসব চলচিত্র বাংলাদেশে একদম প্রদর্শিত হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স হবে চলচ্চিত্র বোদ্ধা দর্শকেরা।
আর একটা ব্যাপার বলা যেতে পারে সেটা হল চলচ্চিত্রের দর্শক তৈরি। এই কাজটা করতে পারে বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি যাদের কার্যক্রম শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক। এটাকে ছড়িয়ে দিতে হবে মফস্বল অব্দি।
শেষে কিছু রুটিন কাজের কথাতো বলতেই হয় যেমন একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইন্সটিটিউট তৈরি করা, প্রয়োজনীয় সরকারী নীতিমালা তৈরি ও প্রয়োগ, পাইরেসি রোধ করা, সিনেমা হলগুলোর আধুনিকায়ন ইত্যাদি ইত্যাদি।
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
(মহসীন রেজা)
মন্তব্য
আপনি যদি থিয়েটারের মহসীন ভাই হন তাইলে সালাম নেন। বেলী আপা ভালো আছেন?
পোস্টের কথাগুলো আমার মনের কথা। ভালো লিখছেন। অনেক কমেন্ট পড়া উচিত লেখাটায়।
না ভাই, আমি থিয়েটারের মহসীন না। লেখাটা ভালো লেগেছে বলে আপনাকে ধন্যবাদ।
(মহসীন রেজা)
ইদানিং কিন্তু হলিউডেও স্রেফ টাকার জোরে ছবি হিট হচ্ছে না। ইন্ডি ঘরানার অনেক ছবি নতুনত্বের জন্য 'সারপ্রাইজ হিট' হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে প্রায়ই। মূলধারার ছবিও নিজের গুণেই স্থান করে নিচ্ছে।
আমাদের উচিত 'স্পাইডারম্যান' বা 'পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের' মত সিজিআই নির্ভর ছবির বদলে 'লিটল মিস সানশাইন' বা 'জুনো'র মত ছবিকে নিজেদের মডেল হিসেবে নেওয়া।
প্রচারণা সিনেমার একটি বড় ব্যাপার। এক্ষেত্রেও ক্লিন্ট ইস্টউডের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুসরণ করা যায়। তাঁর "ছবি যদি ভাল হয়, তাহলে তা নিজেই দর্শক টানবে" তত্ত্বের সার্থকতা প্রমাণ করেছে 'মিলিয়ন ডলার বেবি', 'লেটারস ফ্রম ইয়ো জিমা', ইত্যাদি। এই আত্মবিশ্বাসটুকুই নেই আমাদের। ভেবে দেখুন তো, 'শংখনীল কারাগার' তৈরি ও প্রচারে কত টাকা খরচ করতে হয়েছিল?
আমি আমাদের সীমিত সম্পদকে সুযোগ হিসেবেই দেখি। বেশি টাকা থাকলে সিনেমা শিল্পের বদলে ব্যবসা হয়ে যায়।
আপনি উল্লেখ্য করেছেন তরুণদের সংখ্যা চার-পাঁচ লাখ বলে। সাম্প্রতিক ভোটের সময় আমরা দেখলাম, বিশেষ করে জীবনে প্রথম ভোট দেয়া ভোটারের সংখ্যা এক কোটির ওপরে। আপনি কী ভিত্তিতে চর-পাঁচ লাখ বেছে নিলেন বুঝলাম না!
আর সিনেমা বানাতে টাকা বড়ো ফ্যাক্টর মানলাম। তবে সবচেয়ে বড়ো যেটি, সেটা হলো মেধা। মেধাবি চলচ্চিত্রকার পেলে, তাদের তৈরিকৃত সিনেমা দর্শক ঠিকই লুফে নেবে। আমার ধারণা, আমাদের দেশে দর্শকের অভাব নাই। অভাব ভালো সিনেমার। এদেশের দর্শক একসময় হলমুখী ছিল। ভালো সিনেমা হলে আবার হলে ফিরে যাবে এতে সন্দেহ নাই।
এখনতো মেধাও ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়। আর আমি তরুণদের সংখ্যা হিসেব করেছি ইউনিভার্সিটি কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ের সংখ্যা হিসেব করে। অন্যকিছু না। ধন্যবাদ।
(মহসীন রেজা)
বিষয়টা ভালো। তবে, স্যরি টু সে- কেমন যেন বেশি খণ্ড খণ্ড আর ভাসা ভাসা মনে হ'লো লেখাটি। তবে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট বটে।
-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
স্যরি হওয়ার কিছু নাই। আমারও মনে হয় এটি খন্ড খন্ড এবং ভাসা ভাসা। ধন্যবাদ আপনাকে।
(মহসীন রেজা)
আমার তো মনে হয এখানে মেধাবী চলচ্চিত্রকার, ইচ্ছা ও রুচির বিষয়টাই গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এ জিনিসগুলোর অভাবটাই তো বোধ করছি আমরা..! টাকা এখানে মনে হয় না যে বড় কোন ফ্যাক্টর। এফডিসি-তে এখনও টাকার বন্যায় কোন ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। ঘাটতি কেবর রুচি ও মেধার...
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সিনেমাশিল্পের উন্নতির দায়িত্ব বোধহয় আমাদের সবার।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দর্শকদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী
শুধুমাত্র প্রযোজক কিংবা পরিচালকের না।
আমরা বাংলা সিনেমা দেখা অথবা সিনেমার প্রশংসা করাকে
স্মার্টনেসের অন্তরায় মনে করি।
ভারতের দর্শকেরা কিন্তু এই ভুল করেননি।
তারা সবসময় তাদের সিনেমার পাশে থেকেছেন।
যেমনই হোক না কেন নিজেদের সিনেমা দেখেছেন।
ভারতীয় হিরোদেরই তাদের হিরো বানিয়েছেন।
ভারতের সিনেমা সারা পৃথিবীনন্দিত হওয়ার আরো বহু কারণ আছে।
তবু তাদের দর্শকদের এই শর্তবিহীন সমর্থন এর ভুমিকা তাতে অনেক।
বাংলা সিনেমার গানের প্রতি আমাদের অনুভুতি নিয়ে
চমতকার একটা লেখা আছে। পড়ুন। ভালো লাগবে
আমি যদি আজ একটা সিনেমা দেখি
সিনেমা খারাপ হলে আমার ক্ষতি হবে বোধহয় ৩০ টাকা।
কিন্তূ আমার মতো সবাই সিনেমা দেখা বন্ধ করলে সংশ্লিষ্ঠ সবাই পথে বসবেন।
দর্শক তৈরী করা সিনেমা ইনস্টিটিউট এসবের পাশাপাশি
চলুন না সবাই কিছু বাংলা সিনেমা দেখি।
এতো গাজাখুরি হিন্দি ফিল্ম দেখি।
বাংলা সিনেমা একটু দেখতে সমস্যা কোথায়?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন