প্রিয় টগর,
তোমাকে লিখব বলে অনেক কথা জমিয়ে রেখেছি। তোমার ঠিকানা পেয়ে আজ লিখতে বসলাম। প্রথমে বাসার কথা বলি,জান-শেফালিবু'কে ছেলেপক্ষ থেকে দেখতে এসেছিল। ছেলে জাহাজে চাকরি করে- আনেক টাকা বেতন। ওদের নাকি বুবুকে খুব পছন্দ হয়েছে। আব্বার কলিগ শামছু সাহেব সম্মন্ধ এনেছে। ভাইয়ারও ছেলে পছন্দ, কিন্তু আব্বা তেমন একটা গা করছে না। বলে-ছেলে জাহাজে থাকবে-সাগরে সাগরে ঘুরবে, কতদিন পর পর দেশে আসবে তার নাই ঠিক। আছ্ছা তুমিই বল, এখন কি আর আগের যুগের মত ব্যাপার-স্যাপার আছে? এখন সব কিছু কত আধুনিক হয়ে গেছে না? আমার বান্ধবী বিন্তি'র মামাওতো বিদেশি জাহাজের ইন্জিনিয়ার-মিলি বলেছে, যেকোন সময় চাইলেই নাকি যোগাযোগ করা যায়। তবে দেশে আসতে নাকি এক-দেড় মাস দেরি হয়। আব্বা যখন সোনাইমুড়ি কলেজে চাকরি করতেন, তখনতো তিনিও এরকম মাসে একবার বাসায় আসতেন। তাহলে ঐ ছেলে দোষ করল কী? আর আম্মার কথা বইলনা, সারা জীবন আব্বা যা বলেছে, তার বাইরেতো কোন কথা বলেওনি আর বলবেও না।
জান, ছেলেটার একটা ছবি দিয়েছে-সাদা সার্ট সাদা প্যান্ট পড়ে জাহাজের ডেকে দাড়িয়ে আছে- ঠিক যেন স্কুলের ইউনিফর্ম । মাথায় একটা ক্যাপ-নৌবাহিনী'র লোকদের মত। আছ্ছা জাহাজে যারা কাজ করে-তারা কি নৌবাহিনীরই অংশ?
ছবিটা নিয়ে আমি আর আম্মা বুবুকে দেখাতে গিয়েছি আর সে-তো কিছুতেই দেখতে চায়না-লজ্জায় একেবারে লাল। কিন্তু রাতের বেলা একা একা দেখতে গিয়ে আমার কাছে ধরা পড়েছে। আমাকে প্রমিজ করতে হয়েছে-আমি কাউকে বলবনা। এই যাহ, তোমাকে বলে দিয়েছি-তুমি আবার তাকে বলে দিওনা। এখন আবার দেখি তার মন খারাপ। কার কাছ থেকে নাকি শুনেছে, জাহাজে যারা চাকরি করে তাদের চুল উঠে যায়, সেজন্য মাথায় ক্যাপ পরা ছবি দিয়েছে। শুনে আমি আর আম্মা হেসেই বাঁচিনা-এখনো বিয়েরই নাই ঠিক-আর বুবু আছে চুল নিয়ে।
শোন, দুর্গা পুজা হয়ে গেলো-তোমায়তো বলা হয়নি, এবার মহামুনি'র ওদিকে নদীতে কিছুটা পানি ছিল-তাই সেখানেই প্রতীমা বিসর্জন হয়েছে। অনু, বিন্তি ওদের সাথে আমিও গিয়েছিলাম। আমাদের প্রিয় "চালনী" নদীটা দেখে কি যে কস্ট লাগল, তোমাকে বোঝাতে পারবনা। বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত চর উঠেছে, তারপর সামান্য জায়গা জুড়ে পানি-তবে মনে হলো বেশ গভীর। অথচ দেখ বাজারের এদিকটায় নদীর পাড় ভাংগতে ভাংগতে শাবুদ্দিন মেম্বারের স'মিল ছুঁই ছুঁই। এখন শুকনো মৌসুমে তো এদিকে পানি নেই বললেই চলে- তাই দুই দেশেরই প্রতীমা বিসর্জন হয়েছে মহামুনি'র ওদিকে। যথারীতি বিডিআর-বিএসএফ বর্ডার খুলে দিয়েছে আর হাজারে হাজার মানুষ সব ছুটে এসেছে নদীর পাড়ে। সুশীল কাকুর মেয়ে আর জামাইকে দেখলাম ওপার থেকে দেখা করার জন্য চলে এসেছে। মনে আছে, তুমি একদিন কাকুকে জিগ্গেস করেছিলে- কেন আরেক দেশের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন? উনি বললেন- "বাবারে দেশ যারা ভাগ করছিল তারাতো সীমানা দিয়াই খালাশ, কিন্তু বাপ-দাদার সাত পুরুষের ভিটারে আমি ভাগ করুম ক্যামনে? বাপে এইখানে একটা ঘর তুলছিল বইলা আমি রইয়া গেলাম এই দেশে-আর আমার ভাই-বোন সব হইল পরদেশি-এইটা কোন বিচার হইল। এইযে দেখ জগাই-যার লগে আমার মাইয়ার বিয়া দিছি, হ্যায় আমর খুড়ার পুলা। এক পুলা আর এক মাইয়ারে বিয়া দিয়া আত্মাগুলারে শক্ত কইরা বান দিছি "। উনারা নাকি পালা পর্বনে চুপে চুপে যাওয়া আসা করেন। বিডিআর-বিএসএফ এর জোয়ানরা কিছু টাকা দিলে তেমন একটা কিছু বলেনা।
সন্ধ্যার কুয়াশা গাঢ় হবার আগেই আমরা ফেরত এসেছিলাম। আসার পথে আমাদের স্কুল সামনে এসে ওরা সবাই চলে গেল যার যার বাসার দিকে-আমি একা হয়ে গেলাম। আমায় হঠাত কেমন যেন বিষন্নতায় পেয়ে বসল। দুরে ঢাক বেজে চলেছে এক মনে-আরও দুরে কালাডেবার গ্রামগুলো কুয়াশারা চাদরে ঢাকা পড়ছে-আর আমি বসে আছি ডেবার পাড়ে, শান বাধানো ঘাটে। আমার মনে হল আমি যেন সত্যি অপার হয়ে বসে আছি, যে সত্য এতদিন মনে মনে পুষে রেখেছিলাম, তোমার জন্য আমার অপেক্ষা একদিন শেষ হবে-তা বুঝি আর সত্য নয়। তোমার আর আমার মাঝে বিধাতা এক অদৃশ্য সীমানা টেনে দিয়েছেন-পার হবার সাধ্য আমাদের নেই।
ভাল থেক।
ইতি
মনি
(চলবে)
(বাউলিয়ানা)
মন্তব্য
অতিথির লেখা ভালো হয়েছে। প্যারা করলে পাঠকরা আরাম করে পড়তে পারবে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ধন্যবাদ।
প্যারা করেছিলামতো..কোথায় যে হারিয়ে গেলো..
):
ভালো লাগছে আপনার লেখা।
লিখতে থাকুন।
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
নতুন মন্তব্য করুন