এ জার্নি বাই বাস

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৬/০২/২০০৯ - ৮:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট বেলায় বেশ জনপ্রিয় রচনাগুলোর মধ্যে ছিল জার্নি বাই বাস, জার্নি বাই ট্রেন এসব। তখন ছোট ছিলাম, খুব একটা ঘোরাঘুরি করতে পারতামনা। তাই এ জার্নি বাই বাস-ট্রেনের রচনার কাহীনিগুলো হতো গৎ বাধা।
যান্ত্রিক এই হল লাইফে প্রায় প্রতিদিন ই বাসে চড়তে হচ্ছে। এখন লিখতে দিলে পরীক্ষার খাতা নিত্য নতুন কাহীনি দিয়ে ভরে তোলা যেত। সেই দিন কি আর আছে? তাতে কি, সচলায়তনের পাঠকদের জন্য রইল এবার একটি ভিন্ন স্বাদের বাস ভ্রমনের খবর। দিনটা ছিল ১৪ ই ফেব্রুয়ারী ২০০৯, আই মিন ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবসে আমার বাঙ্গালী ভাইদের কাছ থেকে পাওয়া হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা কারো সাথে শেয়ার না করে একা একাই হজম করব অতটা স্বার্থপর আমি নই।
কক্সবাজার থেকে ফিরছি আমরা সাত জন- আমি, মাহাবুব, আরিফ, রাশেদ, আমিন, মনির ও ফখরুল। খুব ভাল বন্ধু আমরা। সফল একটা ভ্রমন মোটামুটি প্ল্যান’ড ওয়েতে শেষ করেছি। তাই মনটা খুব ভাল। ঈদ্গাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে টিকেট করলাম সাতটি। বাসে উঠলাম। সৌদিয়া প্রিন্স। এ দেশের মধ্যবিত্তদের জন্যে মোটামুটি ফেমাস বাস। সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি।
কিন্তু বাসে উঠে দেখি ঘটনা অন্য। অলরেডি আমাদের চারটে সিট ব্লক। ওগুলো লোহাগড়া পর্যন্ত আরো একবার বুক করা হয়েছে। ওদের ঘাড়ে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। শুরু হল ঝামেলা। ওই লোকগুলো কিছুতেই উঠছেনা। কন্ট্রাক্টরকে জানালে সে বলল ৫০ কিলোমিটার পর লোহাগড়া গেলে তারপর ওগুলো খালি হবে। ততক্ষণ একেবারে পেছনের সিটে বসে যেতে হবে।
এ রকম অযৌক্তিক অন্যায় আব্দারকে প্রশ্রয় দেবার কোন মানে হয়না। প্রতিবাদ শুরু করলাম সবাই মিলে। ঝামেলা বাড়তে শুরু করল। যতই কন্ট্রাক্টরকে বকাঝকা করছি সে ততই দাঁত কেলিয়ে হাসছে। কিছুই গায়ে মাখছেনা। বুঝলাম এর বিড়ালের চামড়া, বকাঝকা করে লাভ নেই। এই রকম হয়তো এর প্রতিদিন ই ঘটে। এর দরকার মাইর। মাইরের উপরে এ দেশে কোন ঔষধ নাই। কিন্তু তখনি মাইর দিলামনা। কারণ জানতে পারলাম বাসটা অলংকার যাচ্ছে। ওয়ার্লেস মোড়েই আমাদের ক্যাম্পাস। ওখানেই বাস আটকে রেখে কিছু একটা করতে হবে। কন্ট্রাক্টরকে এই বলে ভয়ও দেখালাম, কিন্তু সে হেসেই উড়িয়ে দিল। রাগটা বাড়ল কয়েক গুণ। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত ফাইনাল করলাম, ঐ শালারে মাইর দিবই দিব। ড্রাইভারকে বললাম আমাদের নামিয়ে দিতে। ঐ বেটা গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিল। বুঝলাম ঐ শালাকেও পাপে ধরেছে। মাইরের লিস্টে এবার তার নামও উঠল।

বাসের সব প্যাসেঞ্জার বেশ আগ্রহ নিয়েই আমাদের এই কান্ডকারখানা দেখছে। কেউ প্রতিবাদ করছেনা। বুঝলাম এ রকম ঘটনা দেখে দেখে এরা অভ্যস্ত। বরং এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে এরকম কিছু একটা না ঘটলে এরা খুব বোর ফিল করত। বিনে পয়সায় সিনেমা দেখার মজাই আলাদা।
কিন্তু ভুল ভাঙ্গল চশমা পড়া এক ভদ্রলোকের গলা শুনে। উনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মোটামুটি হুংকার ছেড়ে দিয়ে কন্ট্রাক্টরকে বললেন, “আরে এরা যাবে কি যাবেনা জিগ্যেস কর, না গেলে নামাইয়া দাও, যত্তসব”।
আমরা সবাই আকাশ থেকে পড়লাম, ভাবলাম এই বেটা বোধহয় ভুলে কথাটা বলে ফেলেছে। কিন্তু সিওর হলাম যখন তিনি কথাটা আবারো রিপিট করলেন। মেজাজ বিগড়ে গেল। আমাদের সাথে এত্ত বড় একটা অন্যায় হচ্ছে, তিনি তো প্রতিবাদ করছেন ই না বরং বলছেন আমাদের নামিয়ে দিতে! সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
এবার ঝগড়া শুরু করলাম ঐ ভদ্রলোকের সাথে। বেশি কিছু বলতে হলোনা। আমাদের দেশের চশমা পড়া এসব বলদ টাইপ ভদ্রলোকগুলো আবার অল্পতেই ভয় পান। দু একটা কড়া ধমক দিতেই সে চুপসে গেল। মেজাজ আরো হট হল। বাগে পেলে ঐ শালাকেও সাইজ করতে হবে এমন একটা চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগল।
অনেক বাক বিতন্ডার পর আমরা টায়ার্ড হয়ে গেলাম। মেনে নিলাম কন্ট্রাক্টরের মহামূল্যবান রায়। বসলাম একেবারে পেছনের সিটে। অথচ আমাদের লিগ্যাল সিটে বসে আছে অন্য মানুষ। মন থেকে ক্ষোভ একেবারেই গেলনা। বরং বাড়তেই লাগল। অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকলাম কখন ভার্সিটি গেটে পৌঁছাব। আমাদের কথা হেসেই উড়িয়ে দেয়া ঐ ছাগলদুটোকে বুঝাব যে কত ধানে কত চাল, হাউ মেনি পেডি হাউ মেনি রাইস।
অবশেষে এল সেই আমাদের ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। আমাদের কয়েকজন ফ্রেন্ডকে আগেই বলেছিলাম গেটে থাকার জন্য। ওরা বেশ আয়োজন করেই রাস্তা ব্লক করল। কন্ট্রাক্টর আর ড্রাইভারকে আচ্ছা মত ধোলাই দিলাম। রাইস আর পেডির হিসেবটা বুঝিয়ে দিলাম। বাস ভাংচুর করলামনা। কারণ আমরা বড় বড় ইউনিভার্সিটির (ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহী) স্টুডেন্টদের মত অতটা উদার নইযে, বিনা ছুতোয় রাজপথকে রণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলব। তবে মাইরটা হেভি ছিল। পেসেঞ্জারদের খুব বেশি অসুবিধায় না ফেলে যতটুকু ঝামেলা করা যায় ঠিক ততটুকু। কন্ট্রাক্টর মাফ চাইল, পরে দুটোকেই ছেড়ে দিলাম।
মনের ঝাল মিটেও মিটলোনা। কারণ আমাদেরকে নামিয়ে দিতে বলা ভদ্রলোককে পাওয়া গেলনা। সে আগের স্টেশনে নেমে গেছে। কন্ট্রাক্টর ড্রাইভার এরাতো মূর্খ। এরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এদের মাইর দেয়া আর না দেয়া সমান কথা। কিন্তু মনের ঝাল মিটানোর জন্য এটুকু করতেই হল। কিন্তু ঐ শিক্ষিত ভদ্রলোকটা কি করে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার মত এমন একটা অযৌক্তিক দাবি করল তা এখনো আমার মাথায় ঢুকছেনা। ওনাদের মত কিছু অসচেতন শিক্ষিত ভদ্রলোকের কারণে আমরা সাধারণ জনগণ সুষ্ঠু বিচার পাইনা, আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হই। ঐ বেটার আর দোষ কি? বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এ দেশের মানুষ, বিচিত্র আমি নিজেও। একজন কন্ট্রাক্টর আর ড্রাইভারকে মেরে বুক ফুলিয়ে বলি, দোস্ত হেভি মাইর দিছি। অথচ আমি নিজেও ভালো করে জানি, কাল আমার সামনে অন্য কেউ এমন বিপদে পড়লে আমিও দেখে না দেখার ভান করব। এনজয়েবল একটা দৃশ্য ভেবে দু একটা ছবিও হয়তো তুলে ফেলব। ইরেজার দিয়ে ঘষে মনটাকে পবিত্র করে হয়ত বলব, আরে ঝামেলা করলে নামাইয়া দাও, যত্তসব।
প্রতিদিন ই এরকম হাজারো ঘটনা ঘটছে, অথচ আমরা নির্বিকার। কোন বিচার কোথাও নেই। আমাদের মত সাধারণ পাবলিকের হাতে একমাত্র ট্রিটমেন্ট মাইর। এরকম মাইর ওরা প্রতিদিন ই খায়। পরদিন সব ভুলে আবারো নতুন করে বীজ বোনে নতুন কোন অন্যায়ের। এসব দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। মুখ ঘুরিয় কানে হেডফোন ঢুকিয়ে বসে থাকি আর ভাবি দুনিয়া জাহান্নামে যাক, আমিতো ভাল আছি। সকল অধঃপতনের মূলে যেখানে আমরা নিজেরা, সেখানে প্রশাসন ই বা কি করতে পারে। এই দেশ দুর্নিতিতে চ্যাম্পিয়ন হবেনাতো, হবেটা কে???


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

একমত না। ছাত্র জীবনেও সহপাঠিদের এমন মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছি, এখনো জানাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

নেগেটিভলি না দেখে ব্যাপারটাকে পজিটিভ ভাবা উচিৎ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা সম্পূর্ণ সফলতার পরিচয় বহন করে।

জি এম মাজহারুল
ডি ভি এম ৪র্থ বর্ষ, সিভাসু, চট্টগ্রাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।