এতিম
জুলফিকার কবিরাজ
এস.এস.সি রেজাল্ট বের হতে হতে পদ্মার দু’কুল ভাসায়ে বন্যা এসে গেল। রেজাল্ট নিয়ে আলাউদ্দিন যখন দ্বীপচর কদম তলা মোড়ে এসে দাঁড়াল,তখন মাঠ-ঘাট ভরাট হয়ে গৃহস্থের বারবাড়ি, ভিতরবাড়ি, কলতলা, কূয়োতলা, কোনাকাঞ্চিতে পানি অনধিকার প্্রবেশ করে চর আশিতোষপুর, সদিরাজপুর, কমরপুরের ফাক গলায়ে ওপারের কুষ্টিয়ার কালুখালি, শিলেদা পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত এক পদ্মা মনে হচ্ছে।
পদ্মার এই উত্তাল উপনিবেশ গাড়ার ঘটনা হাইস্কুলে আসা-যাওয়ার পথে প্রতি বছরের বর্ষাতে আলাউদ্দিনের কাছে চোখ সওয়া ঘটনা।
ফসল রক্ষার জন্য আলের দু’পাশের জমির সীমানা ঘেসে মাঝে মাঝে কাঁটা সমেত খেজুরের ডাগুর পোতা। কাঁটা কোথাও মাথা তুলে জেগে আছে, কোথাও ঘাতক হয়ে ডুবে আছে। সদা সজাগ বেজির মত বার বার ডান বামে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে খুব আস্তে আস্তে পা টেনে টেনে কাঁটার ঘা বাঁচায়ে আলাউদ্দিন উজান ঠেলা হাটা হাটছে।
পদ্মার চর এলাকার এবং আশপাশের প্রধান ফসল আউশ ধান। দু’একটা জমিতে কয়দিন ধরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এরই মাঝে আগাম বণ্যা এসে পানিতে ডুবায়ে কাঁচা-পাকা ধানের দর এক করে দিল। নদীর ঢালে এবং চরের বুকে যে ধান ক্ষেত ছিল সেখানে এখন গহীন গাং। নদীর বাইরের অংশে যেখানে পানি একটু কম সেখানে গলা পর্যন্ত ডুবায়ে ধান কাটছে। পানি যেখানে আরো বেশী সেখানে ডুব দিয়ে দিয়ে ধানের বাইল কাটছে। খরের আশায় কেহ কেহ অগত্যা কাঁচা ধানই কেটে নিচ্ছে। ধান রাখার জন্য জায়গায় জায়গায় নৌকা এবং কলা গাছের ভেলা নোঙ্গর করা। দেওয়ান ও মোল্লা বাড়ির কর্তারা নৌকায় চড়ে ধান কাটার তদারকি করছেন।
রাজশাহী বোর্ডে এবার পাসের হার ৩২%, আলাউদ্দিনের স্কুলের ৯০ জনের মধ্যে ৬৭ জন ফেল মেরেছে। মাত্র ৩ জন ফাষ্ট ডিভিশন পেয়েছে। পাশের এই আকালের বছর আলাউদ্দিন ২টি লেটার সহ ফাষ্ট ডিভিশন পেয়েছে। তবু কী যেন এক অব্যক্ত কষ্টে তার মন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে।
দিগন্ত ছোঁয়া পানির মধ্যে দাঁড়ায়ে কৃষকদের অন্নের জন্য পদ্মার সাথে হাঁসের মত এই ডুব সাঁতার খেলা দেখে আলাউদ্দিনের মনের কষ্ট আরো ঘনীভূত হয়ে এল।
এই এলাকায় বছরে একবারই ধানের চাষ হয়। পদ্মার গ্রাসাচ্ছাদনের পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই এদের সারা বছরের অন্ন সংস্থান করতে হয়। আর যাদের ধান পুরটাই পদ্মা খাজনা হিসাবে আদায় করে তাদের পেটে পাথর বাঁধতে হয়। এত কিছুর পরেও কৃষকরা নতুন উদ্যোমে ধানের বেছন ছিটায় -কৃষকদের এই হার না মানা-তেজ দেখে আলাউদ্দিন ভেতরে ভেতরে প্রাণিত হয়।
মাছখেকো পাখীরা বিচরণ ক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়ায় পানির দিকে নিরীখ করে চঞ্চল গতিতে পাখা ঝাপটাচ্ছে, আকাশে কাল রং-এর অসংখ্য মেঘ গর্ভভারে স্থির হয়ে আছে। বিকেলের পরিণত সূর্য্য দুই মেঘের মাঝে আঁকা- বাঁকা যে এক চিলতে পতিত জায়গা পেয়েছে তার ফাঁক গলায়ে পদ্মার নবীন ঘোলা পানির দূরন্তপনাকে রাঙ্গিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। পানিতে থৈ থৈ করে ভেসে যাচ্ছে ঝোপ-ঝাড়, কচুরী পানা, ফসল, বিচালী, সদ্য ফোলা কলা গাছ, জড়াজড়ি করে থাকা পিঁপড়ার স্তুপ, গৃহস্থের ঘরকন্নার খুঁটিনাটি। প্রকৃতি জুড়ে পদ্মার এই যে উথাল-পাথাল আনন্দ যজ্ঞ, তার গভীরে যে বেদনার তাল ধ্বনীত হচ্ছে আলাউদ্দিনের মনের বীণায় সে বেদনার সুরের মিল আছে।
সন্ধ্যার আলো ম্লান হবার আগেই উঠান পানিতে ভরে গেল। হারিকেন ধরায়ে চকিতে বসে গভীর বিষাদে আলাউদ্দিন তার মায়ের কথা ভাবছে। মা কী , মার আদর, ভালবাসা কী জিনিস সে ব্যাপারে তার কোন সুখ-স্মৃতি নেই। ’৭১-এর কোন এক ভয়াল রাতে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে তার মাকে; সে তখন কোলের শিশু । এই ১৬ বছর বয়সেও আলাউদ্দিন সে তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
মা নিখোঁজের পর থেকে সে মামার বাড়িতে অবহেলা মেখে ধীক্কার খেয়ে খেয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে বড় হয়েছে। শিশু কাল থেকে কষ্টে ছাওয়া দৃষ্টি নিয়ে সে অন্য শিশুর মায়ের দিকে তাকায়ে থাকে। গাভী যখন তার বাছুরকে নিবীড় ভাবে আদর করে, তখন সে মনে মনে ভাবে “ইস আমি যদি গরুর বাছুর হতেম, আর আমার গরু মা যদি বাঁচে থাকতেÑ কত ভালই না হোতে।”
দু’একজন ফকীরনী বাচ্চা সাথে করে ভিক্ষায় আসে, করুণ চোখে আলাউদ্দিন চেয়ে চেয়ে দেখে; বাচ্চারা মার পিছে পিছে ঘুর ঘুর করছে, মার কাখে চড়ে ঝুঁকে পড়ে নিশ্চিন্ত মনে পরম তৃপ্তিতে স্তন পান করছে।
একদিন এক ফকীরণীর সাথে কোন বাচ্চা না দেখে আলাউদ্দিন তার পিছু নেয়। একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে সে আশ পাশ ভাল করে দেখে নিয়ে বলে, “এদো ও
ফহীরণী শোনই, তুমাক এক্কিন কতা কবো, তুমি শুনব্যা ?”
“যা পত ছাড়, জালাসনে!”
আলাউদ্দিন ধমক খেয়ে দমে যায়; কিন্তু সে আবার তার পিছু নিলে ফকীরণী লাঠি উঁচিয়ে খেঁকিয়ে বলে, “ওরে আমার নাগররে পিরিতের লেগেন পিছ লাগিছ্যাও, যা ভাগ হেন থেন - ভাগলু!”
আলাউদ্দিন আরো দু’তিন জনের কাছে তার কথা পারতে গিয়ে দ্বিধায় থেমে যায়। দূর থেকে আর একজনকে আসতে দেখে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয় এর সুশ্রী এবং হাসী-খুশী চেহারা দেখে। জড়তার আর ভেঙ্গে সে বলে, “ও মিয়িডা শোনই।”
ফকীরণী তার দিকে ঘার ফিরায়ে হেসে থেমে যায়, থেমে বলে “কী কোবু ক।”
আলাউদ্দিন ঘাড় নিচু করে থাকে ।
“ক কী কোবু।”
আলাউদ্দিন তার দিকে মুখ তুলে দ্বিধায় আবার মুখ নিচু করে।
“ও লজ্জা করতেছে তালি থাক, কওয়ার কাম নেই, আর এক দিন কোসিনে।”
“তুমি আমার মা হোব্যা?”
সে তার কথা বুঝতে না পেরে হাটা দেয়। আলাউদ্দিন দৌড়ে তার সামনে গিয়ে পথ আগলায়ে মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে তার মুখ পানে চেয়ে থাকে ।
“কিরে আড়ে হয়ে দাঁড়ায়ে তুই আমার পথ বন্দ করতিছিস ক্যা ?”
“তুমিতো উত্তের দিলে না।”
“কি উত্তের দেব ?”
“তুমি আমার মা হোব্যা ?”
ফকীরণী ধপ করে হাটু গেরে বসে পড়ে তার দুই হাত ধরে বলে, “আহারে সোনা আমার, তুমার মা হব, আমি? ক্যা তুমার মা নেই ?”
আলাউদ্দিন ঠোট ফুলায়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, “না, মা নেই।”
“নেই ?”
“না।”
“কোনে গেছে ? বেড়াতি ?”
“না।”
“তাহলি ?”
আলাউদ্দিন ফুঁপায়ে কাঁদতে থাকে।
সে তার মাথায় হাত বুলায়ে বলে, “ও সোনা কি হয়ছে তুমার মার ?”
“হালা গেতে! মলি গেতে!”-বলে জোরে কাঁদতে লাগল।
“মরি গেছে! আহারে সোনা আমার, মানিক আমার! ”-এই বলতে বলতে ফকীরণী ধপ করে ধুলার উপর হাটু গেড়ে বসে তাকে বুকে জড়ায়ে আদর করতে লাগল। বাগানের মাঝে একটু আড়ালে আলাউদ্দিনকে কোলে বসায়ে ঝোলা থেকে একটি পাকা বিচি কলা বের করে খেতে দিল। অনেকক্ষণ ধরে নতুন মা-ব্যাটার নানা সুখ-দু:খের আলাপ চলতে থাকল।
অনেক বাবা সোনা বলে, গায়ে মাথায় হাত বুলায়ে, দুই গালে চুমা দিয়ে আবার কাল আসব এই প্রতিশ্র“তি দিয়ে সে কোন রকমে বিদায় নিল। আলাউদ্দিন পথে পাওয়া মায়ের পথ পানে চেয়ে কাঁদতে লাগল।
এর পরে ফকীরণী চর আশুতোষপুরে আসার সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন ভঙ্গ করে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করল। সবার চোখ বাঁচায়ে একটি ঝোপের আড়ালে ছেঁড়া আঁচলের আসন পেতে মা-ছেলের স্নেহ-ভালবাসার অস্থায়ী সংসার শুরু হল।
মাস দুই যেতে না যেতেই ব্যাপারটা দুই এক জনের নজরে পড়ল। কানে কানে ঘুরতে ঘুরতে খবরটা আলাউদ্দিনের মামার কানে বংশ বিস্তার করল। মামা ছেলে ধরা সন্দেহে ফকীরণীকে মার-ধোর শুরু করল। আলাউদ্দিন মামার হাত থেকে ফকীরণীকে রক্ষার জন্য তার দুই হাতে ফকীরণীকে জাপটে ধরে চিৎকার শুরু করলে মামা তাকেও দু’ঘা বসায়ে দিল। অবশেসে চুল কেটে তাকে গ্রাম ছাড়া করা হল।
পাতানো মাকে হারায়ে শিশু আলাউদ্দিন এই প্রথম মাতৃ বিয়োগের প্রকৃত কষ্ট অনুভব করল। মা হারানোর বেদনা শিশুর কচি মনে যে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে তা আলাউদ্দিনের মৌন মুখের করুণ চাহনি দেখলেই বুঝতে পারা যায়। তখন থেকেই তার কৌশর পূর্ব নির্বাক যুগের সূচনা হল। প্রায় সময়ই সে মন খারাপ করে নিরালায় চুপ করে বসে থাকে। কেও ডাকলে, কথা বল্লে সে খুব একটা সারা দেয় না।
চার বছর বয়স পার হতে না হতেই আলাউদ্দিন চার- পায়া প্রাণীর সেবাদাস নিযুক্ত হল। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজের বাসি কাজ না সেরেই গরু-ছাগলের দেখভাল দিয়ে দিনমান কর্ম যজ্ঞের প্রভাত বউনি করে। অথচ বয়সে অনেক বড় মামাত ভাইরা জানালা দিয়ে আসা রোদে পাছা আঁচায়ে ঘুম থেকে উঠে।
মামাতো ভাইরা তার নাম বিকৃতি করে রাগায়:
আলাই বড় বালাই
আলাই খায় কালাই।
আলাই বড় বালাই
..................
ছয় বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে হাতে খড়ির উদ্দেশ্যে যাতায়াত শুরু হল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদে গ্রামের মেঠো পথে কখনো হেটে কখনো উত্তপ্ত বালু থেকে নগ্ন পা বাঁচানোর জন্য দৌড় দিয়ে পথ চলতে হয়। এই ভাবে ক্লান্ত-শ্রান্ত-ক্ষুধার্থ হয়ে যখন সে বাড়ি ফেরে তখন সেখানে কোন স্নেহ-শীতল আঁচলের আশ্রয় অপেক্ষা করে না। তার বদলে গিয়ে পড়তে হয় মামীর আচরণের তপ্ত কড়াইয়ের উপর। বই রেখে যখন সে একটু জিরানোর আয়োজন করে তখন মামীর কণ্ঠস্বরে ঠাঠা ভেঙ্গে পড়ে - “গরু গুলেন তিষেয় দাপায়ে মরতেছে; আর, উনি লাট সায়েব যায়ে গর্তের ভিধেন সাধায়ছেতো সাধায়ছেই বারানের নাম গোন্দো নেই। যাহ্ গরুগুলেক খোল-পানি দেহা।” সেই সকালে পান্তা খেয়ে স্কুলে গেছে আর পড়ন্ত দুপুরের ক্ষুধা-তৃষ্ণায় দশমী দশায় গরুর, না তার; খাদ্যের প্রয়োজন বেশি জরুরী - সংসার অনভিঙ্গ আলাউদ্দিনের শিশুমন সে হিসাব মিলায়ে উঠতে পারল না।
যদি কোন দিন হঠাৎ দৈব গুণে মামীর ফুট-ফরমায়েসের ফাঁক গলায়ে খেলার মাঠে গিয়ে হাজির হয় তখন গ্রহবৈগুণে মাঠের বাইরে দাঁড়ায়ে মামাতো ভাইদের পোষাক কাঁধে ভার বাহী হয়ে নয়ন-সুখ মেটাতে হয়। খেলার সুযোগ খুব সামান্যই ঘটে।
মামা-মামীর অনেক আপত্তি সত্বেও নানীর ইচ্ছায় আলাউদ্দিন পাবনা শহরের জি.সি.আই-স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তী হল। গৃহস্থালীর কাজ করে এবং স্কুলে দশ-বার মাইল পথ পায়ে হেটে যাতায়াত করে কোন দিন শরীর খারাপ লাগলে সকাল সকাল শুয়ে পড়ে শেষ রাতে উঠে পড়তে বসে। পরদিন সকালে মামীর এজলাসে তার ছেলেদের ঘুম নষ্টের এবং তেল পোড়াবার শুনানী শুরু হয়।
স্কুল থেকে ফিরে আলাউদ্দিন মামীর কাছে নালিশ জানাল, “আপনের ছাওয়ালরা স্কুলের অন্য ছাওয়লেরে সাথে লিয়ে আমাক খালি -
‘আলাই বড় বালাই
আলাই খায় কালাই’-
কয়ে কয়ে রাগায়।”
“ঠিকই করে, বালাই লাতো কী। বাপের কোন খোঁজ নেই, পরের পয়সায় ব্যাসাদ আমার ব্যালিষ্টার হোবি। যাহ্ লেহা-পড়া বাদ দিয়ে মানসের বাড়িত কাম করি খাগা।”
আলাউদ্দিন এই প্রথম ‘বালাই’- শব্দটির প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে শিখল। তার কাছে ‘বালাই’, ‘মা-হারা’, ‘এতিম’- এই শব্দগুলি সমার্থক বলে মনে হল। অনেক কটু কথার পর মামী যখন লেখা-পড়ার ব্যাপারে ছাফ জবাব দিয়ে দিল, তখন আলাউদ্দিন নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে নানীকে জড়ায়ে ধরে মা মা করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
এর পরের ইতিহাস ভিন্ন । নানী তাঁর বাপের বাড়ীর দৌত্তর বেচে আলাউদ্দিনকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান এবং তার লেখা-পড়ার ব্যাবস্থা করেন।
সেই নানীও আজ নেই। এই আনন্দের দিনে মায়ের একটা কাল্পনিক মুখচ্ছবি গড়ার চেষ্টা করল; কিন্ত পারল না। রাত দ্বিপ্রহরে দরজা দিয়ে পানি ঢুকে চকির ও মাচার নিচের আনাচে কানাচে ভরাট করে ঘরের মেঝেতে খেলা করতে করতে আলাউদ্দিনের পার গিরার উপর উঠে গেল। কিন্তু সে দিকে তার কোন খেয়াল নেই। তার চোখের পানি নাকের পানি বানের পানির সাথে মিশে ঘরের মেঝেতে পাক খেতে লাগল।
বন্যার আকস্মিকতার ধাক্কা কাটায়ে আক্কেল, জব্বার, মধু ও আলাউদ্দিন কলা গাছের ভেলা বানায়ে মাছ মারতে বের হল। তারা ট্যাটা হাতে উৎসুখ দৃষ্টির সন্ধানী জাল ফেলে ফেলে লগি ঠেলে ধান ক্ষেত বিলি দিচ্ছে।
মধু বলল, “অনেক ক্ষণইতো ভূতের ব্যাগার খটলেম বড় মাছতো দূরের কতা মাছের একটা লাতি-পুতিরও দেহা পালেম না। শালা ! চল বাড়িত যাই; ভুরের মুখ ঘুরা।”
আক্কেল বলল, “লোতুন পানি পায়ে মাছগুলেন সব ছাই গুষ্টি লিয়ে উস্সব করি ছুটে বেড়াচ্ছে। মনের মত আস্তানা বাছাই করে একজগায় লক করে দাবতি দুই এক দিন সময় লিবিনি।”
আলাউাদ্দন কাছা মেরে ট্যাটা হাতে উঠে দাঁড়াল। তার ট্যাটার অব্যার্থ নিশানার জন্য এ তল্লাটে খ্যাতি আছে। ট্যাটা দিয়ে সে মাছ, সাপ, বেজি এমনকি শিয়াল পর্যন্ত মেরেছে।
জব্বার বলল, “আলাই এত ভাল রেজাল্ট করলু তোর বাপ কী জানে ?”
-“না।”
-“তুই জানাস নিই ?”
-“না।”
- “কামডা ঠিক করিস নিই।”
-“থো তোর ঠিক-বেঠিক, বলেই একটা গালি দেয়।”
-“মুখ খারাপ করিস ক্যা।”
-“অম্বা শালা বাপের লেগেন মুক খারাপ করবি লায়তো ছোগিনা খতম দেবো ?”
-“তার পরেও সে তো তোক জন্মদেছে।”
-“হে হে ! জন্ম দেছে, জন্ম দিয়েই খালাস। যে শালা বাপ কুনো দিন ফিরি ফুসকি দিলে না, ছাওয়ালডা কী খাচ্ছে, কী পড়তেছে, ক্যাম্বা করি ল্যাহা পড়া চালাচ্ছে, মোরলে কি বাঁচলে; একটা ভাংগা ওক্তের লেগেনো এক ফুটা তত্ব তালাশ কল্লে না - তাক আবার বাপ বুলি ছ্যালাম করা, হুহ ! অম্বা বাপেক রেজাল্টের খবর জানানে না জানানের ভিদেন কুনো সুকও নেই দুক্কও নেই; আবার, ছোয়াবও নেই, গুনাও নেই। জানিসিতো মা মরি যাবার পর বাপ যহন আরেক্কিন নিহি করে বাপ তহন হএে যায় তাঐ।” কথা বলতে বলতে আলাউদ্দিন উদাস হয়ে গেল; আকাশের দিকে মুখ তুলে কষ্ট মথিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আলাউদ্দিনের কষ্ট সবইকে সংক্রমিত করে আবেশিত করে ফেলল, তারা তার দু:খ প্রশমিত হবার অবকাশ দিয়ে মৌন হয়ে রইল।
একটা ঝোপের পাশ দিয়ে যাবার সময় খুব জোড়ে ঝপাৎ করে শব্দ হল। আক্কেলকে সে দিকে লগি ঠেলার নির্দেশ দিয়ে ট্যাটার দড়ি হাতে প্যাঁচায়ে ট্যাটা তাক করে আলাউদ্দিন পেশী শক্ত করে কিছুটা বাঁকা হয়ে ভ্যালার উপর দাঁড়াল।
লতা-পাতা সরায়ে ঝোপের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় ভেলার মুখ ঢুকায়ে তারা চুপ মেরে থাকল। দেখল একটা আহত ব্যাঙ প্রাণপণ চেষ্টা করছে একটা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার জন্য।
ব্যাঙের দিকে আঙ্গুল দেখায়ে আলাউদ্দিন ইসারায় লগি পুততে বললো। কিছুক্ষণ পর কচুর ঝোপের মাঝে অসংখ্য বুদবুদ উঠতে দেখে মধু ঠোটে চকাশ করে ধ্বনি তুলল। একটা কচু গাছ মৃদু দোল খেল। সে দিকে তাকাতেই প্রসশস্ত সাদা পেট দেখা দিয়েই মিলে গেল।
জব্বার ফিসফিস করে বলল, “যদি কাম ফতে হয়, তাহলি ভাড়াড়া মজিদে পাঁচ শিকির সিন্নি মানত করলেম।”
সবাই অপেক্ষার পল-অনুপল অতিক্রম করছে। মধু চাপা স্বরে বলে উঠল, “বেটি এক ঝলক পেটি দেহায়ে লোভ ধরায়ে দিয়ে পাতালে সাধালে নাহী?”
আলাউদ্দিন ধমক দিয়ে বলল “লক কর, খালি বকবক করে।”
নৌকা থেকে কয়েক হাত দূরে আক্কেলের বিস্ফারিত চোখ স্থির হয়ে গেল। আলাউদ্দিন আক্কেলের দৃষ্টি পথ অনুসরণ করে দেখল আহত ব্যাঙটি অস্বাভাবিক উত্তেজনায় পানি ঝাপটাচ্ছে। ব্যাঙ থেকে নল খানিক পিছে প্রকাণ্ড দুটি ভাসমান দাড়ি হেলে দুলে আসতে দেখে ‘ইয়া-হাহ্’ বলে ট্যাটা ছুঁড়ে দড়ি ছাড়া শুরু করল। পানি একটু একটু করে লাল হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে ঢেকি আকৃতির বিশাল একটা রাঘব বোয়াল ত্যারছা হেয় ভেসে উঠে কাতর ভঙ্গীতে খাবি খেতে লাগল।
আলাউদ্দিন কিছু কাজ সেরে এসে দেখল মধুর বাংলা ঘরের মেঝেতে মাছ সমান চার ভাগে ভাগ করেছে, আর মাথাটা আলাদা করে রাখা।
মধু বলল, “আলাই তুই ট্যাটা দিয়ি নিজ হাতে মাছক্ষিণ মারলু তাই আমরা মাতাডা তোক দিলেম।”
“শালারা আমাক লেতা বানানের ফন্দিত আছেও। আমি কী মোল্লা নাহি যে কল্লা খাবো। তুরাওতো গতর খাটাইছিস। আক্কেলের বাড়ির মাতা গুনতি খানেয়ালা বেশি, মাতাডা আক্কেল লিই যা।”
জব্বার বলল, “খানেয়ালা আমারোতো বেশি।”
আলাউদ্দিন বলল, “ও তাইতো। তোরোতো খানেয়ালা বেশি। ঠিক আছে আমার অর্ধেক ভাগ তুই লে।”
জব্বার বলল, “তুই আসলেই ভালো।”
মধু বলল, “আলাই তুই মাছটা মারলু, আর তুইই লিলু সবচে কম; ইডা ক্যাম্বা কতা হোলে?”
“আমারতো এক প্যাট; এই আদ ভাগইতো আমার লেগেন ঢের। এই তাইতো আমার সাত বাসি করে খাওয়া লাগবিনি।”
মধু বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “আসলে লেতা কেউ কাউক বানাতি পারে নারে, আচার-বিচারে মানুষ বড় হয়ে যায়। লেতা হটাস করি গজানে জিনিস লা। তোর যে কাম-কাজ, বাচ-বিচার তাতে তোক আমরা এ্যাম্বাই লেতা মানি লিচি।”
নিজ হাতে মাছ রান্না করে আলাউদ্দিন গোসলে গেল। গোসল সেরে বাড়ির উঠানে ঢুকতেই রান্না ঘরে শব্দ হল। পানির মধ্যে পা টিপে টিপে রান্না ঘরের সামনে এসে উঁকি দিয়ে দেখে বিড়াল মাছ খাচ্ছে। আলাউদ্দিন মনে মনে বলল দারা মজা দেহাচ্ছি। নিত্যি নিত্যি চুরি করে খায়ে খায়ে তুমি পগার পার দিবে, আজ তা হবির দিচ্ছিনি। তুমাক আজ জম্মের মতোন পরাণ ভরি জিফোত খাওয়াবো। সাপের মত আলগোছে, নি:শব্দে পানির পেট চিরে ঘরের ছানছেতে ঝোলান ট্যাটা এনে বিড়ালকে তাক করল। পাতিল যাতে ট্যাটার আঘাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য একটু সরে গিয়ে আবার তাক করল। যখন ট্যাটা ছুড়তে যাচ্ছে ঠিক সেই মূহুর্তে এক সেঙ্গে কয়েকটা কচি কণ্ঠের মিউ মিউ আওয়াজ শোয়ার ঘরের চাতাল থেকে আলাউদ্দিনের কানে ভেসে আসা মাত্র তার চোখ চলে গেল বিড়ালের পেটের নিচে, দেখতে পেল দুধ ভার নত ফোলা ফোলা লালচে টসটসে ছোট ছোট কয়েকটি বান। মূহুর্তে আলাউদ্দিনের হাত শিথিল হয়ে ট্যাটা পানিতে পড়ে গেল; মনে পড়ে গেল, ’৭১-এর কাল রাত, মনে পড়ে গেল, মা হারানোর স্থায়ী অব্যক্ত কষ্টের কথা।
মন্তব্য
গল্প ভাল লাগল।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
ধন্যবাদ জুলফিকার কবিরাজ। আসন্ন একুশ সকালে এই বিষন্ন গল্প দিয়ে গেল অনেক কিছু। একটা আঞ্চলিক ভাষা- সালাউদ্দিন লাভলু হয়ে চঞ্চল চৌধুরীর মুখ ঘুরে যা আমাদের কানে আসত মিডিয়ার হাত ধরে আজ সেই ভাষার লিখিত রূপ চোখে ভাসল এই ব্লগে। আপনাকে স্বাগতম। আপনার ধৈর্য প্রচুর আমাদের ধৈর্যের প্রার্থনা।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
অসাধারন।
খুবই চমত্ কার লাগলো গল্পটা।
আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এক কথায় দারুণ দেখিয়েছেন। এটা কী পাবনার ভাষা?
পড়তে একটু সময় নিলে ও গল্পটা ভাই ভালো হয়েছে, আপনার ভাষা প্রয়োগ সুন্দর।
(শব্দশিল্পী)
ধন্যবাদ অম্লান অভি আঞ্চলিক ভাষার উপর সুন্দর মন্তব্যের জন্য।আমার স্বর্গীয় গুরু নরেণ বিশ্বাস যিনি বাংলা দেশে শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা দানের প্রধান গুরু এবং উচ্চারণ অভিধানের লেখক; তিনি উচ্চারণ ক্লাশে বলতেন, ‘তোমরা সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে, কিন্ত প্রয়জনে আঞ্চলিক ভাষাকে অবহেলা করো না – আঞ্চলিক ভাষা হচ্ছে মায়ের আঁচল।’ মা হারায়ে আমরা এতিম হই; কিন্ত আঞ্চলিক ভাষা হারায়ে আমরা যেন ঐতিহ্যগত ভাবে এতিম না হই। আঞ্চলিক ভাষারও একটি লিখিত রূপ এবং কথ্য ভঙ্গী আছে। দু:খের বিষয় অঞ্চল ভেদে ভাষার যে রূপ-রস-ভঙ্গী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কী প্রীণ্ট মিডিয়া কী ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া আলাদা আলাদা অঞ্চলের আঞ্চলিকতার কাদা-মাটির গন্ধ মাখা যে শ্রী তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এর কারণ এই ক্ষেত্রটি যারা চাষ-বাস করছেন তারা প্রায়ই ঐতিহ্য তথা শিকড়-বাকড় ছাড়া।
মনে পড়ে গেল, ’৭১-এর কাল রাত, মনে পড়ে গেল, মা হারানোর স্থায়ী অব্যক্ত কষ্টের কথা।
আহারে, সুন্দর হয়েছে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
নতুন মন্তব্য করুন