ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য-দূরীকরণ : ইউনূসের দাবি ও বাস্তবতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৩/০২/২০০৯ - ৩:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য : ইউনূসের দাবি ও বাস্তবতা

ড. ইউনূস দাবি করেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া থেকেই দারিদ্র্য-কে তারা জাদুঘরে পাঠিয়ে দেবেন। বাংলাদেশের সব দরিদ্র্ মানুষ এখনো এ খবর পায়নি। কারণ তারা অনেকেই রেডিও শোনে না, টিভি দেখে না, পত্রিকা পড়ে না। শুনলে তারা নি:সন্দেহে খুশিতে উল্লসিত হয়ে উঠত। তবে আমরা যারা একটু আধটু পত্র-পত্রিকায় চোখ বুলাই, দু-একটা বই-পত্র পড়ি, আমরা খুশি হওয়ার চেয়ে বরং কৌতূহলী হয়েছি। বলে কি? সত্যিই কি সম্ভব? বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এবং সুশীল সমাজের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূসকে নিয়ে অনেক রকম মত, অনেক রকম আশা, অনেক প্রত্যাশা। বিশেষত, গত ২০০৬ সালের অক্টোবরে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হল তখন ওই উচ্ছ্বাসের সীমা যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সে উচ্ছ্বাসের বেলুন চুপসে গিয়েছে। আবার কখন কবে যে তা ফুলে-ফেঁপে ওঠে বলা মুশকিল।
আমরা ড. ইউনূসের দাবি ও দেশের বাস্তব চিত্রটির দিকে একটু চোখ ফেরাই।
ড. ইউনূস ২০০৫ সালে 'সাপ্তাহিক ২০০০'-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করলেন _ "বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ এত সম্প্রসারিত যে, বলা যায় ৮০/৯০ ভাগ দরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এসেছে। ... আগে একবেলা খেল এখন দুবেলা খায়। আগে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতোনা। এখন পাঠায় এটাই আমাদের সান্ত্বনা।" [২৯ জুলাই ২০০৫]
উনি বেশ সন্তুষ্ট। নোবেল পাওয়ার পর নিশ্চয়ই আরো সন্তুষ্ট।
কিন্তু দেশের পরিস্থিতি তো ভিন্ন কথা বলছে!
"দেশে ৪৪% অর্থাৎ ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দরিদ্র। ... সমাজে উপরের ৫ ভাগ মানুষের আয় নীচের ৫ ভাগ মানুষের আয়ের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি ছিল ১৯৯১-৯২ সালে, পরবর্তী ৫ বছরে ২৮ গুণ, তার পরবর্তী ৫ বছরে ৪৬ গুণ এবং ২০০৫ সালে হয়েছে ৮৪ গুণ।" এ তথ্য ছাপা হয়েছে ১৭ মে ২০০৬ দৈনিক যুগান্তরে - পরিসংখ্যান ব্যুরো, অর্থনীতি সমিতি, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এন্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র পক্ষ থেকে প্রকাশিত তথ্যাবলীর সার-সংশ্লেষ হিসাবে। একই তথ্য ওইদিন অন্যান্য জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে।
ইউনূস-প্রশস্তিকারী দৈনিক প্রথম আলোতে গত ৯ আক্টোবর ২০০৬ বিআইডিএস এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের ক্রনিক পোভার্টি রিসার্চ সেন্টার (সিপিআরসি)-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণার উল্লেখ করে বলা হয়েছে _"... গ্রামের ১৯ শতাংশ পরিবারই তিন বেলা খেতে পায় না। বছরের কয়েকটি মাস ১০ শতাংশ পরিবারই দুই বেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। ... দেশে ২৮ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্য অবস্থার মধ্যে বাস করে। অর্থাৎ দেশের আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ চরম দরিদ্র।"
দৈনিক প্রথম আলোর আরেকটি খবর। ২ ডিসেম্বর ২০০৬ ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), সাউথ এশিয়ান সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ (সাসেপস) ও নিজেরা করি আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হল, "সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর দারিদ্র্য বিমোচনের হার শুন্য দশমিক ৫২ শতাংশ। যদি এ হারেই দারিদ্র্য কমতে থাকে তাহলে দেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করতে ৮১ বছর লাগবে। আর অর্ধেক কমিয়ে আনতে লাগবে ৪০ বছর।) [প্রথম আলো, ৩ ডিসে. '০৬]
এ হল ছোট বেলায় শো্না ধর্মীয় কল্পকাহিনীর মতো। অজুত-মাজুদ বলে নাকি একটি খুব ভয়ঙ্কর বর্বর জাতি আছে যারা পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে থাকে। কোনো এক নবী তাদের হাত থেকে পৃথিবীকে এবং মানবজাতিকে রক্ষা করতে লোহার দেয়াল দিয়ে তাদের ঘিরে রেখেছে। ওরা প্রতিদিন জিব দিয়ে ওই দেয়াল চাটতে থাকে। চাটতে চাটতে দেয়াল এক সময় পাতলা হয়ে আসে, সামন্য ধাক্কা দিলেই ভেঙে পড়বে এমন। কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ওরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভাবে আগামীকাল বাকিটুকু শেষ করবে। কিন্তু পরদিন সকালে এসে দেখে দেয়াল আগের মতোই মোটা হয়ে গেছে (আল্লাহর ইশারায়)। অগত্যা ওরাও নতুন করে দেয়াল চাটা শুরু করে। আমাদের ড. ইউনূসদের বেলায়ও সম্ভবত এমন কিছুই ঘটছে। তবে অজদু-মাজুরা নাকি রোজ কিয়ামতের আগে সে দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। ইউনূস সাহেবরা কবে দারিদ্র্যের দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হবেন খোদাই জানে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, ইউনূসরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে না পারলেও ভবিষ্যতের পৃথিবীর জাদুঘরে ওনারা ঠিকই ঠাঁই পাবেন _ মানুষ দেখবে, এরাই তাহলে সেই ক্ষুদ্রঋণ-ওয়ালা যারা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে চেয়েছিল!

ভ্যানগার্ড


মন্তব্য

জিজ্ঞাসু এর ছবি

চড়াসূদের ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্রমুক্তি হয় না। হয় ঘরের চালের টিন অবমুক্তি। আর গ্রামীণের মত প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার পাহাড় আর মিথ্যে নামের মহড়া দেয় দরিদ্র কৃষকের বুকে চড়ে। চাকুরির নামে ঠকায় দেশের শিক্ষিত বেকারদের। ইউনুস সাহেব শোষণের সূত্র আবিস্কার করে পুঁজিবাদি সমাজের বাহবা পেয়েছেন, তাতে তার নিজের বোধিপ্রাপ্তি ঘটেছে, তাতে দারিদ্রমুক্তি সুদূরপরাহত।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

গৌতম এর ছবি

দিকদারি কইরেন না তো! মাইনসের টেকা দিয়া জাদুঘর বানাইতাসি। বানানো শেষ হইলে হেরপরে মানুষ লইয়া চিন্তা করমু। আগে বিল্ডিং, পরে মানুষ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

গ্রামীন ব্যাংক যাদেরকে ক্ষুদ্রঋন দিয়েছে সেই মানুষগুলোর জীবন যাত্রার মান কতটুকু উন্নত বা অবনত হয়েছে তার উপর কোন গবেষনা করা হয়েছে কী? গবেষনা করা হয়ে থাকলে তার ফলাফলটা কী জানাবেন কী? আমি তাত্ত্বিকভাবে গ্রামীন ব্যাংকের প্রচুর সমালোচনা পড়েছি, কিন্তু সমালোচকরা কেউই মাঠের লোক না। মাঠ পর্যায়ের গবেষনামূলক সমালোচনা থাকলে ইউনুসের ভন্ডামির মুখোশ খুলে দেয়া যাবে, যদি তিনি সেরকম ভন্ডামি করে থাকেন।

যদি সেরকম কোন গবেষনা না থাকে সমালোচনাটা কিন্তু অর্থবহুল হয় না। এমনিতে আমরা সমালোচনা প্রিয় জাতি, যেটা জেনেটিক সমস্যা বলা হয় বাঙালীর। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পরও কূলীন সমাজের একটা অংশ সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ পেয়েছিলেন তাতে। তাতে রবীন্দ্রনাথের কী হয়েছে?

ইউনুস সাহেবের সবগুলো কথা, সবগুলো স্বপ্ন বাস্তবমূখী হয়তো নয়। কিন্তু সেই কথা কাজ ও স্বপ্নগুলোর মধ্যে এমন কোন অশুভ গন্ধ পাইনি, যাতে এমন দোষী সব্যস্ত করা যায় বেচারাকে। গ্রামীন ব্যাংকের দুজন ঋনগ্রহীতাকে নিয়ে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে আমারব্লগে প্রকাশিত। পড়ে দেখতে পারেন।

ভ্যানগার্ড [অতিথি] এর ছবি

@ নীড় সন্ধানী
আপাতত যতগুলো বই হাতের কাছে আছে সেগুলোর নাম দিচ্ছি --
(১) 'সোসিও-ইকোনমিক এন্ড ইনডেবটেডনেস-রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অব মাইক্রোক্রেডিট ইন বাংলাদেশ।' বইটির লেখক ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ। ইনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি, বইতে তিনি তাঁর মাঠ-পর্যায়ের সমীক্ষার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। বইটিও প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।
(২) 'নোবেল শান্তি পুরস্কার, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস।' এর প্রকাশক বাসদ। এটিও এবার বইমেলায় (২০০৯) প্রকাশিত হয়েছে।
(৩) 'গ্রামীণ ব্যাংক : মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার'। এর লেখক মীর ইলিয়াস হোসেন। এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে।
* অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০০৬ সালে তাঁর গবেষণার সারাংশ তুলে ধরে একটি লেখা লিখেছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনীক পত্রিকায়। শিরোনাম ছিল 'নোবেল পুরস্কার, মঙ্গা এবং ক্ষুদ্রঋণের দারিদ্র-‌বিমোচন'। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানি না।
এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের জনৈক কর্মচারী গতবছর একটি বই প্রকাশ করেছেন। আমি বইটির নাম ভুলে গেছি। অধ্যাপক মেসবাহ কামাল ও আরো কয়েকজন মিলে 'বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের অভিজ্ঞতা' বা এ-ধরনের একটি নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৭/১৯৯৮ সালের দিকে।
আগ্রহী পাঠক চাইলে খুঁজে দেখতে পারেন।
ভ্যানগার্ড

তীরন্দাজ এর ছবি

লেখক একটি সমস্যা তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে, তাঁর নিজস্ব চিন্তায়, ... একান্তই নিরপেক্ষভাবে। জানিনা এই লেখায় কি কারণে এক দিতে হয়!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

রণদীপম বসু এর ছবি

যেহেতু ক্ষুদ্রঋণ ধারণাটা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে গেছে এবং তা নোবেলও জয় করে ফেলেছে, তাই এটা নিয়ে অবশ্যই মননশীল আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা ইত্যাদি চলা উচিৎ। তত্ত্ব, বাস্তবতা, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা, কিছু্কেই খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই।
রেটিং-এ যিনি এক দিয়েছেন, তিনি হয়তো পছন্দ করেন নি। কিন্তু এটা তো কোন বিনোদনমূলক পোস্ট নয় ! খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, যা আগামীতেও আমাদের সামনে বারবার আসতে থাকবে। কেননা এটা একটা নোবেল জয়ী ধারণা। পক্ষে বিপক্ষে বিশ্লেষণী মতামতগুলো আসা উচিৎ। আমাদের প্রয়োজনেই।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

গৃহান্তরী এর ছবি

তত্ত্ব, বাস্তবতা, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা, কিছু্কেই খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই।
চলুক

রেটিং নিয়া বলার কিছু নাই। হাই জিপিএ, হাই পাব্লিকেশন কাউন্ট, প্লেন্টি মানি আর হাই রেটিং -- এত সম্পদ কৈ রাখবেন? সম্পদ কম হওয়াই ভাল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।