শ্রদ্ধেয় ‘মুরতাদ’ আহমদ শরীফ
জুলফিকার কবিরাজ
আহমদ শরীফের মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন যখন শেষ পর্যায়ে তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উত্তর দিকের গাছ তলায় চেয়ারে বসে ছিলেন হুমায়ন আজাদ। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন ফকীর আলমগীর। তিনি তাকেঁ ডেকে বললেন ‘তুমি একুশে পদক পাওয়াতে আমি খুব খুশি হয়েছি’। ফকীর আলমগীর বিনয় করে বললেন ‘কোন কোন সময় পদক দ্বারা ব্যক্তিকে সম্মানিত করা হয়, আবার কোন সময় ব্যক্তির দ্বারা পদকই সম্মান্নিত হয়, আমি এ পদকের যোগ্য না’। তার পরে তিনি আবার বললেন, ‘গুরু এবার তো আপনি প্রথম হয়ে গেলেন’।
‘তার মানে’?
‘এত দিন আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলাদেশের এক নম্বর নাস্তিক আর আপনি ছিলেন তার পরেই’।
হুমায়ন আজাদ হেসে বললেন, ‘উনি মরে গিয়ে অমায় সে সুযোগটা করে দিলেন’।
আমি পাশ থেকে ব্যাপারটা উপভোগ করলাম।
পৃথিবীতে যত সমাজ সংস্কারক, যত ধর্ম প্রবর্তক এসেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন প্রচলিত ধারণা এবং ধর্মের প্রতি বিদ্রোহী; আহমদ শরীফ ছিলেন তাঁদেরই অনুসারী।
ফরাসী বিপ্লবের চিন্তা নায়ক ছিলেন ভল্টেয়ার, রূশো; আর আমাদের দেশের ভল্টেয়ার, রূশো ছিলেন আহমদ শরীফ।
তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা অমাদের ঋদ্ধ করেছে। এক দলের কাছে তাঁর বক্তব্য সাদরে গৃহীত হয়েছে, অন্য দল তাকেঁ ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ উপাধী দিয়ে কল্লার দাবী করেছে। কবি নজরুলকেও এ উপাধীর মুকুট পরে মরতে হয়েছে।
আমি তার লেখার ভক্ত। যদিও তার সব মত মেনে নেয়া অমার পক্ষে সম্ভব না; তবুও তাকে ভাল লাগে কারণ প্রচলিত ধারণাকে ভাঙ্গার এবং তার বিরুদ্ধে বলার মত তাঁর যথেষ্ট সাহস ও প্রজ্ঞা ছিল।
স্রষ্ঠার প্রতি বিশ্বাস সম্পর্কে রবীন্দ্র নাথ বলেছেন, ‘আমি আমার ভগবানকে বিশ্বাস করি কারণ তাকেঁ অবিশ্বাস করার অধিকার তিনি আমায় দিয়েছেন’।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল আহমদ শরীফের সাহচর্য পাওয়ার।
কিন্ত হয়ে উঠে নাই।১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী খবরে শুনতে পেলাম আহমদ শরীফ মারা গেছেন। তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে শেষ শ্রদ্ধা জানানর জন্য।আমি তখন গাজীপুরে ১৫০০ টাকা বেতনে চাকরী করি। বেতন যেমন অল্প সুযগ-সুবিধা, ছুটি-ছাটা তারচেও কম; তাই অপিস পালায়ে দুপুরের আগে যখন শহীদ মিনারে পৌঁছালাম তখন মনে হল যে আজ নাস্তিকদের হাট বার।
নাস্তিক আস্তিক সহ অনেক বিক্ষাত লোক লাইন ধরে দাড়িয়েছেন ফুল হাতে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। আমার একটু সামনে নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান ও অসাদুজ্জামান নূর।
মাইকে আহমদ শরীফের শেষ ইচ্ছের কথা বলা হচ্ছে - মাইকের ঘোষণা শুনে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড অনুষ্ঠানের শেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল।
# ভক্তরা যখন গুরুর শেষ ইচ্ছের কথা জানতে চাইল, তখন তিনি কানে কানে বললেন, ‘অমুকের কাছে একটা মুরগী খেয়েছি দামটা বাকী আছে দিয়ে দিয়ো’।
# সক্রেটিসের বউ কেঁদে বললেন, ‘ওগো বিনা দোষে তোমাকে মরতে হোচ্ছে’।
সক্রেটিস বললেন, ‘এর চেয়ে কি দোষ করে মরা ভাল ছিল’?
# বিচারদের উদ্দেশ্শে বললেন, ‘আমি মারা যাচ্ছি তোমরা বেঁচে থাকছ, কোনটা উত্তম একমাত্র আল্লাই জানেন’।
মাইকে নাট্যকার মামুনর রশিদ ষোষণা দিলেন, ‘আহমদ শরীফ একটি উইল করে গেছেন। আমাকে উইল কমিটির আহব্বায়ক করেছেন’। একে একে তিনি উইলের শেষ ইচ্ছা গুলি পড়লেন -
# আমার(আ শ)মর দেহের জানাজা করা যাবে না।
# আমার মৃত্যুর পর আমার একটি চোখ এক জন জন্মান্ধ কোরআনে হাফেজকে, আরেকটি চোখ জন্মান্ধ এক গরীব মেয়েকে দান করবেন(ব্যক্তি দুই জনের নাম মনে নাই)।
# আমার মৃত দেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের গবেষণার জন্য দান করবেন’।
আহমদ শরীফের উইলের শেষ ইচ্ছেগুলি শুনার পর এই ‘মহান মুরতাদ’-এর প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল।
মন্তব্য
আমার চোখ পানিতে ভিজে গেল আপনার লেখার মাধ্যমে আবারও আহমেদ শরিফকে মনে পরাই। সত্য জেনেও প্রচলিত ধারনার বাহিরে আসলেই কি আমরা যেতে পারি?
এইসব আহমেদ শরিফ রা ই যুগে যুগে পথ দেখান
এতদিন পরে পড়লাম লেখাটি। ধন্যবাদ সচলায়তনের নীতি এবং ধারনাকে।
প্রথম আলোতে ভিতরের পাতায় শুধু একটা স্মরণ সভার খবর দেখলাম। খবরের কাগজ এবং মানুষ জন মনে হয় ওনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাইতে একটু দ্বিধায় ভুগে।
এই দেশে আবাল লোকদের নিয়া অনেক মাতামাতি। কিন্তু আহমদ শরীফ দের কে আমরা খুব দ্রুত ভুলে যাই।
নতুন মন্তব্য করুন