হুঁক্কুঁ
জুলফিকার কবিরাজ
মণ্ডল বাড়ির বংশ রক্ষার মত উপায় নাই। এই চিন্তায় মণ্ডল বাড়ির সবচেয়ে বর্ষীয়ান মরুব্বি টেনু মণ্ডল ৮০ বছরের কিনরায় বসে লাঠিতে ভর দিয়ে দুই হাটুর মাঝে মাথা গুঁজে ঝিম মেরে আছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দূরে তাকাচ্ছে কিন্তু চৈত্রের রোদ ঝলমল দুপুরেও চোখে তার কুয়াশার মেলা। দুই হাতে চোখ রগড়ে আবার তাকায়; কিন্ত বংশ রক্ষার চিন্তায় চিন্তায় চোখে তার ঘোলার পরত বারতে থাকে। তারা ছিল তিন ভাই এক বোন। বোন ও এক ভাই বরজখ জগতের বাসিন্দা। দুই ভাই বসত তুলে তফাতে শ্বশুরের এলাকায় উঠে গেছে। উৎসব পর্বে আঁৎকা তাদের দেখা হয়। টেনু মণ্ডল বাপ-দাদার বাস্তু ভিটার ফজিলতে বিশ্বাসী, তাই সে বাপের ভিটায় পাকা তাল গাছটি হয়ে দাঁড়ায়ে আছে।
টেনু মণ্ডলের মনে সুখের আকাল। ৪ মেয়ে জন্মানর পরে টেনু যখন হতাস হয়ে পড়ল; দাই তখন আশার বাণী শুনায়ে বলল, ‘ও মণ্ডলের ব্যাটা অভরসা খায়ে না, আমার আদি দাইমা আকবর বাতসার হেরেমে দাই গিরি করতে। সেই রাজ বদ্যির বিদ্যে পিরায় ৪০০ বছর ধরি এক দাই-ইর এক শিশসো এই মান্নি মানে, এ্যাহে ব্যারে তজবির গুটার মত পিটে- পিঠি ১৫ হাত ঘুরে আমার হাতে আসে গচেছে। এ যাতা বিদ্যে লা; এ হোলে এ্যাহে বারে রাজ বিদ্যে- হ্যাঁ। আমি তুমার বোর ফুলের লারী দেহিচি, তুমার কপালে ছাওয়াল আছেই আছে; সিডা ৭-তেও হবের পারে আবার ১২-তো হবের পারে। হবি ইডা আমি লিচ্চিত। তয় তুমার টানা মেহেনত করা লাগবি, মেহেনত বাদ দেয়া যাবি লায়’।
-মেহেনত তো আমি চালা যাবই; কিন্তুক, বছর বছর ছাউ পয়দা করলি বউ যে আমার ছুবরা হয়ে যাবিনি; সেকুন ওতস (স্বাদ,আনন্দ) পাব লানে - বউডা আমার পানসে পানসে লাগবিনি।
-আরে বছর বছর বিয়েন দিলিউ তুমার বোর গতরের ইকটুউ কুয়া খসপিলানে। উএর গা-গতরের যে গাতনি, ঠিক যিনি বাবলা গাছের ডুম। শরীলে কুন রহম টুসকা পড়বি লানে। তুমি চোক বুজি কাম চালা যাও। বাকি খোদা ভরসা।
-আচ্চা, দেহি।
মেয়ের সংখ্যা ৯-এ পৌঁছলে টেনু দাইকে বলল, ‘ময়েনের মা এহুন তুমি আমার বোর লারি (নাড়ি)-ত গিরু দ্যাও, আমি আর জোড়- বিজোড় খেলা খেলবের চাইনে; ঢের হয়চে। আমার ছাওয়ালের শক টসকে গেচে’।
-মণ্ডল এত সহালেই মচকালিতো চলবি লায়।
-তুমি সহাল দেকলে কোনে, এই ৯-ডা জন্মাতিই আমার জীবনের দুইপর গড়া পরেচে ; তার পরে একে একে সব কয়ডা শ্বশুর বাড়ি পার নাই করতিই আমার সাঁঝ ঘনা আসপিনি।
-আমার হিসেব-নিকেস, গুনা-পরার পর ভরসা রাকো, তুমার কপালে ছাওয়াল ঠিকই আছে। আর ইকটু মেহেনত কর মণ্ডল, হপকায়ে না।
-বাড়িত যায়ে এবার তুমি মেহনত করগে। অমার সব ফু বার হয়ে গেছে।
কলেরার তাড়া খেয়ে এক দিনেই মণ্ডলের বউ তিন কন্যাকে সাথে করে পর পারে পালাইছে। বাকি ৬ মেয়ের ঘরেই নাতনি দিয়ে ঠাসা, সেখানে নাতির প্রবেশাধিকার নেই।
নাতি সম্পর্কের দুষ্ট ছেলেরা মণ্ডলের মুখের উপর হাসতে হাসতে বলে, ‘ও বুরে তুমি খারা যৌবনে কত বার কলকাতা - লকনু মারে খাইচ্যাও, কত মিয়ের অকাম করিচ্যাও এহন আল্লা তুমার ঘারে মিয়ের পাল চাপা দিয়ে অকামের ঝাল তোলতেছে’।
টেনু মণ্ডল ভেতরে ভেতরে কষ্টে কষ্টে ঢোল হয়ে উঠে।
ছোট মেয়েটি আবার গর্ভবতী হ’লে টেনু মণ্ডল তাহাজ্জত কাজা করে না। তাহাজ্জত শেষে প্রতিদিন সে আল্লার কাছে ফরিয়াদ জানায়, ‘ হে আল্লা তুমি তো তোমার বান্দার গুনা মাপ করার লেগিন, আর, তারে মনের নানা আপেত্তি, নানা খায়েস মিটেনির জন্নি ৪ নাম্বার আসমানে নামি আস । নামি আসে তুমার বেবাক ক্ষ্যামা, সব রহমত নাকি নিংড়ে ঢালে দেও। জোইবনের দাপটে ,জোইবনের জালায় জিবনে ম্যালা আকাম-কুকাম করিচি, সেই লেগেন এক ঝাড় মিয়ের বুজা মাতায় বোবের দিয়ে ঘারডা আমার সুজা করবের দেও নেই। শাস্তি ঢের হয়চে এহন মাপ কর, ক্ষ্যামা কর। আর জিবনে পাপের পিটে-পিঠি ভাল কামওতো কম করি নিই, তাই কচ্চিলেম কি, হে আল্লা ঐ ভাল কামগুলেনের ভিদিন (ভেতর) একটা কামও যদি তুমার মনে যুতসই লাগে তাহলি সেই ভাল কামের বদলে আমাক দয়া কর, রহম কর’।
‘তুমি তো জানই, আমার ছোট মিয়েডা পুয়াতি (গর্ভবতী), তার ঘরে এক্কিন ছাওয়াল দেও। ছাওয়ালের বদলে আমাক একে একে ৯ - ক্ষিণ মিয়ি দিল্যা; তাও কত কষ্ট করে সইচি। ও আল্লা, আল্লারে, তুমি এওতো জান যে, ছাওয়ালের আশায় বুক ভাংয়ার পর, এক্কিন লাতির লেগেন সব সুময় তুমার মুকির দিক চাতকের ল্যাহান (মত) ক্যাম্বা যে বেল্লিগ (হন্নে) হোয়ে চায়ে থাহি। আল্লাগো আমার কোচ ভরি এবার এক্কিন লাতি দেও’।
(চলবে)
মন্তব্য
দেইখেন, আপ্নে আবার চা খাইতে চইলা যাইয়েন না।
এঁদো এদিখি এক্কেবার তুমার মতো গপ্প..........এইহিন হুঁক্কু নাহহি।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
লেখাটা চমৎকার। আঞ্চলিক ভাষার কথোপকথন অন্যরকম লাগে বলে পড়তে আগ্রহ পাই। পরের পর্বটা তাড়াতাড়ি দিবেন।
===
অনীক আন্দালিব
http://www.jochhonabilashi.blogspot.com
তাড়াতাড়ি পরের পর্ব ছাড়েন!
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নতুন মন্তব্য করুন