অভিযোজিত পরিকল্পনা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৮/০৩/২০০৯ - ৭:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেশ থেকে দূরে থাকার বেশ কিছু সুবিধা আছে, যদিও এমনটা বলছি না যে সেগুলো অসুবিধাগুলোকে ম্লান করে দেয় কোনভাবে। আমার ক্ষেত্রে তার একটি হল ইচ্ছেঘুড়ি ওড়ানোর স্বাধীনতা। ১২*১২ বর্গফুটের এক বদ্ধ কুঠুরিতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে, ল্যাপটপটাকে কোলে নিয়ে, কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে ৮২৬০ মাইল দূরের ১৩৪০০০ বর্গকিলোমিটারের দেশটির কত-শত সমস্যা সমাধানের উপায়-ই না বের করা হয়ে গেল! সম্ভবত বাস্তবমুখী চিন্তাগুলো তখনই প্রাধান্য পায় যখন সমস্যাগুলো চোখের সামনে ঘটে, নয়তো ওড়াও মনে আশার ফানুস, ট্যাক্স তো আর লাগছে না। ক্লাসের ফাঁকে ক্যাফের কোণে বসে মাফিন খাচ্ছি, আর দেশকে রাতারাতি মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর বানিয়ে দিচ্ছি – এতে দোষের কি! আকারে ‘তিল হতে কিঞ্চিৎ উত্তম’ প্রিয় ঢাকা নগরীও সহসাই তাই ‘তিলোত্তমা’ হয়ে গেল।

সেই যে সাড়ে তিন বছর বয়সে মা স্কুলে নিয়ে গেলেন, তারপর থেকে এই লাইনের বাইরে যাওয়া হয়নি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা, আর তারপরই ‘উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমণ’। স্বভাবিকভাবেই চিন্তা-চেতনার একটা মূল অংশ জুড়ে আছে শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যাগুলো। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ এই সংক্রান্ত সমস্যার নিরিখে কিংবদন্তিতূল্য। একমুখী শিক্ষা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকলের মহোৎসব, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নব্যাংক, অবৈজ্ঞানিক বিজ্ঞান শিক্ষা, জিপিএ পাঁচ এর ছড়াছড়ি, পাঠ্যবই সংকট – সব মিলিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি। তবে এগুলোর ভেতর আমি ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছি সেগুলোই ঘুরে-ফিরে মাথায় বেশি আসে। এই যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের অকার্যকর শিক্ষা প্রদান প্রসঙ্গ। কলেজ পার করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম খুব আশা নিয়ে, উন্নতমানের শিক্ষাগ্রহনের আশায়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে ‘উন্নতমান’ বলতে কিন্তু আমি অত্যাধুনিক গবেষণাগার বা প্রযুক্তিগত সুবিধার কথা বলছি না। আমার আশা ছিল খুবই সাধারন – প্রচলিত মুখস্তকেন্দ্রিক পড়ালেখার স্থানে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করে সত্যিকারের মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পাওয়া। কিন্তু বিধি বাম। হাতে গোনা দুই-চারটা কোর্সকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরলে বাকি সবকটা কোর্স-ই ছিল পলাশীর ‘মামা’-র ফটোকপি ভিত্তিক, অথবা বড় ভাইয়ের রেখে যাওয়া মহামূল্যবান চোথাভিত্তিক। আমি আবার বাসা থেকে ক্লাস করতাম বিধায় বিভিন্ন সময় কত-শত গুরুত্বপূর্ণ উপকরন থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। এখনও মনে পড়ে ম্যাথ কোর্সগুলোর কথা। বেসেল বা লেজেন্ডার পলিনোমিয়ালের গৎবাঁধা সমস্যাগুলো মুখস্ত করতে গিয়েই পিএল শেষ হয়ে গেল কিভাবে যেন, কিছুই বোঝা গেল না। অথচ এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর ক্লাসে যখন প্রফেসর এই ইকোয়েশন এর ট্রায়াল সল্যুশান কী ফরম্যাট এর হতে পারে গেস্ করতে বলেন, আমি আক্ষরিক অর্থেই ‘হাঁ’ করে থাকি আর আশপাশ থেকে সবাই অবলীলায় বলে দেয় লেজেন্ডার পলিনমিয়ালের নাম। আর আমি বাসায় ফিরে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হই। এসব প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র অথচ তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই কিনা জানি না, নিয়ম ধরে রাখার লৌহকপাট থেকে যেহেতু অনেক দূরে আছি, নিয়ম ভাঙার মগজ জুড়ে তাই সারাক্ষন হরেক রকমের পরিকল্পনা আঁটতে থাকি। ইচ্ছে আছে সচলে কোন এক সময় পুরো পরিকল্পনাকে সবার সামনে তুলে ধরার। পুরো সিস্টেমকে রাতারাতি বদলে দেয়ার পক্ষপাতি আমি নই, কারণ তা কখনোই সম্ভব নয়। পরিকল্পনার সারমর্ম হল অনেকটা এক গ্লাস পানিতে ডিস্প্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়ার মত, ধীরে ধীরে যার কণাগুলো পুরো পানিতেই ছড়িয়ে যাবে। দেশের শিক্ষা কার্যক্রম সম্বন্ধে যারা খোঁজ রাখেন তাঁরা একে বল্গাহীন অপ্টিমিজম বলে মনে করবেন জানি, কিন্তু আমার যুক্তি হল, পরিকল্পনা জিনিসটাকেই তো একটা সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে, বাস্তবায়ন না হয় এর দ্বিতীয় ধাপ। আর প্রথম বন্ধনীর ভেতরের কথা হল, সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুবাদে সারাজীবন ১৫ টাকা ২০ টাকা দিয়েই পড়েছি, বাকি খরচ তো দেশের মানুষই বহন করেছে। এই বিপুল ঋণ শোধের আপাতত তো কোন উপায় নেই, না হয় পরিকল্পনাটুকুই কৃতজ্ঞতা হিসেবে থেকে গেল।

খুব ঘনিষ্ঠ একজন বলছিলেন সেদিন যে আমি নাকি আশ্চর্যজনক পরিমাণে কম ‘হোমসিক’, খুব সহজেই প্রবাসজীবনের সাথে অভিযোজন করে নিয়েছি। কথা সত্য। কিন্তু দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই তো দিন-রাত বুনে চলেছি, দেশের জন্য কিছু করার অভিপ্রায়েই না এই জীবন বেছে নেয়া, আমার কি ‘হোমসিক’ হওয়া সাজে?

বিশেষ অজ্ঞ


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই তো দিন-রাত বুনে চলেছি, দেশের জন্য কিছু করার অভিপ্রায়েই না এই জীবন বেছে নেয়া, আমার কি ‘হোমসিক’ হওয়া সাজে?

এই পালটা-প্রশ্ন দিয়ে যে প্রতি মুহূর্তের কত প্রশ্ন চাপা দিচ্ছি...

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

পলাশী ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আমি একমত।
আমাদের ভবিষ্যতে ও হয়তো আপনার মতো 'হোমসিক' হওয়ার যোগ রয়েছে।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

আমিও ছিলাম চোথা সংস্কৃতির ধারক। কেন যেন এরজন্য লজ্জাও অনুভব হয় না। সপ্তান্তের যেতাম লেকচার থিয়েটারের মামার কাছে। আর বলতাম আমাদের কী কী আছে। তিনি আমাদের ব্যাচের সব চোথা বের করে দিয়ে বলতেন, এখান থেকে দ্যাখেন কি কি নেন নি। আমি আমার চাহিদামাফিক চোথা নিয়ে চলে আসতাম।

ক্লান্ত পথিক [অতিথি] এর ছবি

সহমত........ আমার বুয়েট Experience অনেকটা একইরকম

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুবই দারুন লাগল লেখাটা।

ইচ্ছে আছে সচলে কোন এক সময় পুরো পরিকল্পনাকে সবার সামনে তুলে ধরার।
অপেক্ষায় থাকলাম।

আর "বিশেষ অজ্ঞ" নামটা বিশেষভাবে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানালাম। নিয়মিত লিখুন।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।