-হ্যালো মাহমুদ
-কে বলছেন?
-আমি, চিনতে পারছেন না?
-অ, আচ্ছা, কেমন আছেন?
-ভাল, অনেকদিন দেখি না, ঘুমোচ্ছেন নাকি?
-না, এমনি শুয়ে আছি
-অনেকদিন পাড়ায় যাই না, ভাবলাম আপনাকে বিরক্ত করি, বাসায় আছেন এখন?
-আছি
-আমি আসতে পারি বিকেলের দিকে
-আমিতো ওই এলাকায় থাকি না
-বলেন কী? জানি না তো? এখন কোথায় থাকেন?
-বাকলিয়া, গতমাসে এসেছি, কাউকে বলা হয়নি
-অ, অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছেন
-জী
-বাসার সবাই কেমন আছে?
-বাসায় আর কেউ নেই
-নেই মানে?
-মা তো আগেই গ্রামে চলে গিয়েছিল, বাবার রেখে যাওয়া জমিগুলো দেখাশোনা করার কেউ নেই। জমিজমা সব চাচার দখল করে নিয়েছে, মামলা ছাড়া হবে না, মামলার অনেক খরচ, নিজেই চলতে পারিনা, মামলা কীভাবে চালাবো। চাকরীটা এখনো আছে, মাঝে মাঝে বেতন পাই, অর্ধেক। বাসাভাড়া দিতে পারতাম না, তাই মেসে উঠেছি। ঝাড়া হাত পা।
-বাকী ভাইবোনরা কোথায়, গ্রামে?
-জী গ্রামে চলে গেছে, বড় আপা তো অসুস্থ জানেন, ৪০ পেরিয়েছে বয়স, ওর বিয়ে হবে না কখনো। মাও অসুস্থ এখন এইসব ঝামেলায়।
-ভাবী, মানে আপনার প্রাক্তন বউয়ের কী খবর
-হা হা হা, প্রাক্তন বউ, ভালোই বলেছেন, কাবিনের পাঁচ লাখ দিয়েই তো ফতুর হলাম, এরপর যোগাযোগ নেই আর। ডিভোর্সের পর কে আর যোগাযোগ রাখে।
-আর বিয়ে করবেন না?
-নাহ, সেই ভুল আর করবো না। এখনতো সামর্থ্যই নেই।
-আমাদের সেই আড্ডার দিনগুলো কী হারিয়ে গেছে?
-দিন হারায়
-অফিস থেকে ফিরে কী করেন?
-তা অনেক কিছু করি, খুব ব্যস্ত থাকি, সেই পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছি আবার
-বলেন কী, জেল থেকে ফিরে আর কখনো রাজনীতি করবেন না বলে খত দিয়েছিলেন না সরকারের কাছে?
-জীবনে তো অনেক খত দিয়েছি, এবার খত তুলে নেবার পালা
-বিদ্রোহ করবেন?
-হা হা হা, রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া কী বিদ্রোহ হলো?
-না, তবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা তো, তাই ভয় হয় আপনার জন্য
-আমার হারাবার কী আছে আর, দরিদ্র শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করা যদি দেশদ্রোহী হয়, তাতেই আমি রাজী, তাই আবার ফিরে গেলাম
-সাবধানে থাকবেন
-আছি, এবার এত সহজে ধরা দেবো না।
-বাসায় আসবেন একদিন
-সময় হয় না,
-ছুটির দিনে কী করেন?
-লেখালেখি করি
-কী লিখছেন
-পার্টি থেকে কাজ দিয়েছে একটা, 'বিশ্বমন্দায় পুজিবাদের সংকট' নিয়ে একটা পেপার রেডী করছি এ মাসেই শেষ করে জমা দিতে হবে।
-অ, আচ্ছা। ভাল থাকবেন
-নিশ্চয়ই
-রাখছি
-জী
ফোন রেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাহমুদের সাথে প্রায় দশ মাস পর কথা বললাম। এই মাহমুদকে দশ বছর আগের মাহমুদের সাথে মেলাতে পারি না। জীবন কোন কোন মানুষকে এমন বঞ্চনা করে! বউ চলে গেছে, চাকরি থেমে গেছে, জেলের ঘানি টেনেছে, পারিবারিক সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়েছে, বড়বোনের অসুস্থতা হিস্টিরিয়া চরমে উঠেছে, দুমাসের ব্যবধানে বাবা হার্ট অ্যাটাকে, ছোট ভাইটা গাড়ীচাপায় দুম করে মরে গিয়েছে, এই সবগুলো সমস্যার যৌথ সুত্রপাত মাহমুদের জীবনকে উলটপালট করে দিয়েছিল। দু-তিন বছরের মধ্যে হাসিখুশী চেনা মানুষটা কেমন রূঢ় অচেনা হয়ে উঠেছিল। প্রতিটা আঘাত যেন তার চেহারায় ছাপচিত্র এঁকে গিয়েছে।
আমরা মাহমুদ থেকে দুরে থাকি। মাহমুদের দৈন্যতার জন্য নয়। মাহমুদের রাজনৈতিক অবস্থানে। আমাদের কারো বোধে মননে কাজ করে না কেন মাহমুদ রাজনীতি করার জন্য এমন একটা দল বেছে নিল যাকে কেউ চেনেনা পুলিশ আর টিকটিকি বাদে। এমনকি মাহমুদ যে রাজনীতি করে এটাও জেনেছি অনেক পরে। মাহমুদ যখন রমজানের প্রথম দিনে পুলিশের হাতকড়া পড়ে জেলখানায় ঢোকে তখন জেনেছি মাহমুদ নিষিদ্ধ এক বাম দলের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত দীর্ঘদিন থেকে। সেই থেকে মাহমুদকে ভয় পাওয়া শুরু করি। ভয় মাহমুদকে না, মাহমুদের সাথে যোগাযোগের সুত্রটাকে। মাহমুদের উপর টিকটিকির নজর। সুতরাং মাহমুদের বাসায় দিবারাত্র যে আড্ডা হতো পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই সেই আমলনামার রেকর্ড আছে, তাতে অপরাধ সহযোগীর তালিকায় আমাদের নাম থাকলেও অবাক হবার কিছু নাই। তবু বাংলাদেশের পুলিশ আমাদের ধাওয়া করেনি কখনো, করেছে মাহমুদকে। তা সত্ত্বেও আমরা এখন মাহমুদের আশপাশ মাড়াই না রিস্ক নিতে চাই না বলে।
আজ সকালে ফোনের বোতাম টিপে মাহমুদের নামটা যখন স্ক্রীনে আসলো, ভাবলাম এই সেই পড়ুয়া বন্ধু এখন জেলফেরত ঘুঘু। জীবন যাকে নিদারুন বঞ্চনা করেছে তবু জীবনের প্রতি কেমন তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিয়ে মাহমুদ ফিরে গেছে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক জীবনে। জেল থেকে ফেরার পর যখন তার বাসায় যাই, আমাদের চা সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করে। বলে, জেলে নাকি আগের চেয়ে অনেক বেশী আরাম। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভগ্নমলিন চেহারায় রাজবন্দীর তৃপ্তি।
আমাকে বেনসনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে, জেলগেটে এক শুভাকাংখী দিয়েছে, আপনার জন্য রেখেছি। আমার এখন এসবে পোষায় না। আমি এখন আকিজ বিড়ি খাই। এটা জেলখানার নিজস্ব মুদ্রা। বিড়িতেই লেনদেন সব। বারবার যেতে হবে তাই অভ্যেস করে ফেলেছি।
আমি মাহমুদের জীবনকে দেখি এবং আমার কথা ভাবি। শ্রেনী সংগ্রামে মাহমুদ কী আমার বিপরীত ট্রেনের যাত্রী? মাহমুদের সংগ্রাম কী আমাদের বিরুদ্ধেই না?
নীড় সন্ধানী
১১ মার্চ ২০০৯
মন্তব্য
লেখাটা ভালো লাগলো। ডেডিকেটেড বামপন্থীদের প্রায় সবার কাহিনী আসলে এমনই। যারা একেবারে উপরের স্তরের নেতা, তাদের কথা অবশ্য আলাদা।
চালিয়ে যান।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ধন্যবাদ আপনাকে। বাংলাদেশের আরো অনেক মাহমুদ হয়তো আছে। তবে এত প্রবঞ্চিত জীবন আমি আর দেখিনি। ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে, তাকে ঘৃনা করতে ইচ্ছে হয়।
সুবিধাবাদ, জিন্দাবাদ। আর সব ভুয়া।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
আমাদের দৈনন্দিন সুবিধাবাদীতার বিপক্ষে মাহমুদের এই যে সংগ্রাম, তার বয়ান গল্পটা ভালো লাগলো।
ভাই আমিও বিয়ে করে ফতুর হতে চলেছি, যদি বলেন আমার এই দুঃখের কথা নিয়ে অনেক বড় একটা পোষ্ট দিতে পারি।
দিতে পারেন, সমস্যা নাই। তবে দেইখেন, আপনার বউ মানে আমাদের ভাবী আবার মাইন্ড না করে বসেন।
চোখ বা মন এড়ায়নি বলে ৫তারা। কোন নাটক সিনেমায় দেখলাম না এ বিষয়টা। চোখ বুঁজে থাকা কত সহজ!
লেখাটা ছুঁয়ে গেল।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কঠিন জাগতিক সত্যি
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
সহমত
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
অসাধারণ লেগেছে লেখাটা।
নিজের ফুলদানীতে যারা পৃথিবীর সব ফুলকে আঁটাতে চায় তারা মুদি; কবি নয়। কবির কাজ ফুল ফুটিয়ে যাওয়া তার চলার পথে পথে। সে ফুল কাকে গন্ধ দিলো, কার খোঁপায় বা ফুলদানীতে উঠলো তা দেখা তার কাজ নয়।
___________________________ [বুদ্ধদেব গুহ]
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
লেখাটা ভালো লাগলো, খুবই! আপনার লেখা মুক্তাঙ্গনে আগেও পড়েছি। সচলায়তনে স্বাগতম!
এটাই আসল কথা, হার মানতে হলেও যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া
ভালো লাগলো লেখাটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হ্যাঁ
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
হুম...... ভাল লাগল লেখাটা
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
- কী অবস্থা বস? সচলায়তনে স্বাগতম।
লেখাটা চরম লিখেছেন, তবে কয়েকটা জায়গায় ভ্রু কুঁচকে গেলো। আপনার মতো অভিজ্ঞ ব্লগারের কাছে বানানের দীনতা অথবা দৈন্য দেখতে ভালো লাগলো না বলে!
লিখুন আরো আরো।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ ধূসর গোধুলী। সচলের আঙিনায় প্রথম লেখা। লেখাটা এক টানে লিখে ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে এডিট করা হয়নি, দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে বানান ও বাক্যে কিছু ভুল দেখলাম। সামনের বার এগুলো খেয়াল রেখে ছাড়তে হবে।
- বস, কিছু মনে করবেন না। আপনি তো দেখি বানান দেখে দেখে লেখাতেও কিঞ্চিৎ "সবুজ"!
আমার নামের বানানটা একটু কষ্ট করে দেখে নিন। বিশাল রকমের ভুল করে বসে আছেন তাতে।
সেন্টু নিয়েন না বস। আপনে আপন মানুষ বলেই এভাবে বলা।
সচলের আঙিণা আপনার (লেখার) পদভারে ঘনঘন আন্দোলিত হোক।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এ যে বাংলা স্যারের পাল্লায় পড়লাম!!!!
কোন সময় জানি ডেকে বলবে -"ওরে বলতো 'সকাল' এর সমাসটা ভেঙে বল!!"
ভয়ে আছি।
এমনিতেই চল্লিশ পেরুনোর পর থেকে চালশে হয়ে যাচ্ছি। চশমা দিয়েও অনেক সময় হ্রস্ব উকার আর দীর্ঘ উকার এর পার্থক্য বুঝতে পারি না। তাই 'ধুসর গোধূলী' আর 'ধূসর গোধুলী'র মধ্যে কোন পার্থক্য পাই নি। বাংলা ভাষায় টাইপ করা যে কী ঝক্কি! ছুডমুড বানানগুলান মাফ কইরা দেওন যায় না?
গোধূলি বানানটি হ্রস্ব-ইকার দিয়ে লেখা। আপনার মনোযোগ সেখানেই আকর্ষণ করা হয়েছে। ধূসর বানানটি দীর্ঘ-উকার দিয়ে এবং গোধূলি হ্রস্ব-ইকার দিয়ে লিখতে হবে।
.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...
.......................................................................................
Simply joking around...
না বস। গোধূলি বানানটি কিন্তু হ্রস্ব-উকার দিয়ে লেখা। ভালো করে দেখুন আবার।
বানান বিভ্রাট থেকে কেউ মুক্ত নই আমরা। হে হে... সঙ্গী সাথী পেয়ে ভালো লাগছে।
আমিও একটু শামিল হলাম বানান নিয়ে গুঁতোগুঁতিতে। 'আঙিনা' বানানে কিন্তু ণ ব্যবহারের কোনো কারণই নেই। আর ধূসর কিন্তু কখনোই ধুসর নয়। মাইন্ড খাইয়েন না, বস।
.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...
.......................................................................................
Simply joking around...
গোধূলির ব্যুত্পত্তিগত মানে বলুন দেখি!
বাস্তব কতো নিষ্ঠুর মাহমুদ সাহেবের মতো মানুষের জন্য...
=============================
জীবনের আরেক নন্দিত নরকে।
-----মর্তুজা আশীষ আহমেদ
আমরা কত সহজেই পালিয়ে যাই বাস্তবতা থেকে, বিপরীত ট্রেনে শুধু চেপেই বসি না, চাই এসি ক্যুপে, গরম খাবার, নরম আদুরে বিছানা, ট্রেনের মৃদু আরামদায়ক দোলন।
সকল ভোগে মেতেই আমাদের কানে পুরু স্তর পড়ে যায়!
লেখাটা, মাহমুদ খুব বেশি বিষণ্ণ করে দিল!
===
অনীক আন্দালিব
http://www.jochhonabilashi.blogspot.com
লেখার বিষয়টা দুর্দান্ত
কিন্তু স্যার এ ধরনের লেখায় কথাগুলো বক্তৃতা হয়ে না উঠার জন্য যে বাড়তি যত্নটা নিতে হয় সেটার সময় হয়তো ছিল না আপনার
মাঝে মাঝে ডিরেক্ট বক্তৃতা হয়ে গেছে কোথাও কোথাও
আসলে লেখাটা এক বসাতে কোন ঘষামাঝা ছাড়াই লেখা হয়েছিল। তাই প্রথম দৃষ্টিতে ভুল ধরা পড়েনি। কোথাও বক্তৃতার ঢঙ লেগেছে কিনা খেয়াল করিনি। তবে প্রকাশিত হবার পর পড়তে গিয়ে বাক্য ও বানানে বেশ কয়েকটা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। এডিট করার নিয়ম জানা নেই বলে ঠিক করতে পারছি না। আপনাকে ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম।
.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...
.......................................................................................
Simply joking around...
লিখাটা ভাল লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন