ছেলেবেলায় আমি চুড়ান্ত রকমের হাবা ছিলাম। প্রথম স্কুল যাত্রার বয়সে আমার চেয়ে বেশী হাবা নাকি শহরে খুব বেশী ছিল না।
সময়কাল ১৯৭৪ সাল। শহরে নতুন এসে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়েছি প্রথম শ্রেনীতে। স্কুলে ভর্তির আগে আমি ঘরে বসেই বাবা মার কাছে পাঠ নিয়ে ক্লাস ওয়ান, ক্লাস টু দুটোর বইই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম। তাই কথা ছিল আমাকে সরাসরি ক্লাস টু-তে ভর্তি করিয়ে দেয়া হবে যাতে একই ক্লাসে পাঠরত মামাতো ভাইয়ের সাথে আসা যাওয়া করতে পারি।
ভর্তি হতে গিয়ে হেডমাষ্টার সাহেব বললেন - 'দেখি পাঠশালা বানান করো তো?' তখন আমার শুধু পাঠশালা না, দুনিয়ার আরো বহু জিনিসের বানান মুখস্থ আছে। কিন্ত সমস্যা হলো প্রশ্নকর্তা। ইনি হেডমাষ্টার, মানে এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রানী। আমার ধারনা ছিল শিক্ষক এবং পুলিশ মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র প্রানী। তাদের প্রধান কর্তব্য হলো যাকে তাকে যখন-তখন বেধড়ক মারধোর করা। এরকম ধারনা কী কারনে গজিয়েছিল জানিনা, তবে সময়টা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার চুড়ান্তে, সেকারনেও হতে পারে। তো সেরকম একজন ভয়ংকর লোক আমাকে বানান জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দেয়া দুরে থাক- ভয়ে আমার হাতপা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাবার দশা হয়েছিল। আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করা গেল না। ফলে ক্লাস-টুর আশা বাদ দিয়ে ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি হতে হলো। ভর্তি হলাম ঠিকই, কিন্তু একা স্কুলে যাবার সাহস নেই, এমনকি অপরিচিত বালকদের সাথে ক্লাসে একা বসার সাহসও ছিলনা। তাই ঠিক হলো আমি বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস টু-তেই বসবো মামাতো ভাইয়ের পাশে। তথাকথিত 'ভয়ংকর' স্যারেরা খুব সাহায্য করেছিলেন। সেভাবেই বছর পার করেছিলাম।
শিক্ষক পুলিশ দুটোকেই ভয় পাওয়ার পাশাপাশি আমার ধারনা ছিল দুজন শিক্ষক বা দুজন পুলিশ যখন মুখোমুখি হবে তখন তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। কারন দুজনের হাতে সবসময় লাটি বন্দুক থাকে।
সেই ধারনায় ক্লাস ওয়ানে স্কুল থেকে একদিন বাসায় ফিরে মাকে অবাক হয়ে বলছিলাম- 'মা জানো, আজকে না দুজন মাষ্টারকে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি, কিন্তু ওরা একটুও মারামারি করে নাই।'
আরেকদিন বিকেলে খেলতে গিয়ে নতুন গজানো বন্ধুদের সাথে গপ্পো মারছিলাম,- 'জানিস, আমি সেদিন দুটো পুলিশকে কথা বলতে দেখছি স্কুলের গেটে, দুটোর হাতেই বন্দুক, আশ্চর্য ওরা কেউ গোলাগুলি করে নাই'
এরকম সহজ সরল একটা হাবা ছেলে নিষ্কলুষ হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু - ধারনাটা মারাত্মক ভুল। আমি তখন ক্লাস থ্রীতে উঠেছি, একা একা স্কুলে যাওয়া শিখেছি মাত্র। যদিও সেই হাবাই রয়ে গেছি। প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে তিনটা কলম, পাঁচটা পেন্সিল হারাতাম । হারাতাম মানে ছুটির পর ক্লাসে আমার ডেস্কের উপরে খাজকাটা জায়গাটায় পেন্সিল-কলম রেখে সরল মনে বাসায় চলে আসতাম, পরদিন গিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম ওগুলো কোথাও নেই। স্কুলের মতো শুদ্ধ পবিত্র জায়গায় চুরির মতো অপবিত্র ঘৃন্য কাজ হতে পারে সেটা হাবার পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল।
সেই গবেট আমি একদিন একটা ভিন্ন প্রতিভা দেখালাম। পাশের কলোনীতে ছিল টিএন্ডটি স্কুল। প্রতিবেশী বন্ধু মাহফুজ সেই স্কুলে থ্রীতে পড়তো। সে একদিন তাদের স্কুলে নিমন্ত্রন করে বললো,তাদের স্কুলটা অনেক বেশী মজার, কড়াকড়ি একদম নেই, ইচ্ছেমতো মাঠে ছোটাছুটি করা যায় ক্লাস ফেলেও। আমি তখন পড়াশোনা ফাঁকি দেয়া যায় এমন একটা গনতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য মরিয়া। সানন্দে তার নিমন্ত্রন গ্রহন করলাম। সেদিন নিজের স্কুল বাদ দিয়ে টিএন্ডটি কলোনী স্কুলে গিয়ে ক্লাস করলাম। ওখানে ওদের এক আপাকে ক্লাস নিতে দেখে ভীষন ভালো লাগলো। সবাই আপার সাথে হাসিখুশী দুষ্টুমি করছে, প্রানবন্ত স্বাধীন গনতান্ত্রিক পরিবেশ। কেউ পেছনের দরজা দিয়ে মাঠে ছুটে যাচ্ছে, আবার সারা হাত পায়ে ধূলোবালি মেখে ফিরে আসছে সামনের দরজা দিয়ে। অবাধ স্বাধীনতার চুড়ান্ত। মাহফুজরা সবাই আপাকে নানান ভাবে অতিষ্ঠ করে ফেলছে, অথচ আপা বেত দিয়ে পেটাচ্ছে না। আপা মাঝে মাঝে 'এই দুষ্টুমি করে না', 'এমন করে না' এরকম আদুরে শাসন করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আদরে আদরে পোলাপান সব আরো বাঁদর হয়ে উঠেছে। আমি তখনো জানিনা 'আপা' জিনিসটা কী। ভেবেছি 'আপা' বোধহয় মাহফুজের বড় বোন, তাই দুষ্টুমি করলেও না মেরে খাতির করছে মাহফুজের সৌজন্যে। পরে আক্কেল গুড়ুম হয়েছিল যখন জেনেছি ওটা মাহফুজের বোন না এবং স্কুলের শিক্ষিকাদের 'আপা' বলে ডাকার নিয়ম। যাই হোক, সেদিন স্কুল ছুটির পর মাহফুজের বাসায় গিয়ে খাতায় কিছু বানোয়াট অংক করে বাসায় ফিরলাম খুশী মনে। ভেবেছিলাম, বেঁচে গেছি, কারো হাতে ধরা পড়তে হয়নি। এখন থেকে এই মজার স্কুলেই যাবো প্রতিদিন।
কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবার নয়। মাকে সাত-পাঁচ চৌদ্দ বুঝিয়ে পার পেয়ে গেলেও বাবার ক্ষেত্রে তা হলো না। বাবা অফিস থেকে ফিরলেন এবং খাওয়া সেরে খাতা বই নিয়ে বসলেন আমার সাথে। জবানবন্দীর গোঁজামিলে দশ মিনিটের মধ্যে হাবা আমি ধরা পড়লাম। পরবর্তী পর্ব যে হাবার পৃষ্টদেশের উপর দিয়েই গিয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। এবং সেখানেই আমার বাল্যচোট্টামির অকালমৃত্যূ ঘটেছিল। ফলে দেশ একজন সম্ভাব্য জিনিয়াসের সেবা থেকে বঞ্চিত হলো।
নীড় সন্ধানী
১৪ মার্চ ২০০৯
মন্তব্য
হা হা হা। দারুণ মজার গল্প আপনার।
আমিও ক্লাশ টু'তেই ভর্তি হয়েছিলাম। যদিও আমার কলোনীর সব বন্ধুরা তখন ওয়ানেই পড়তো। তবে স্কুল আমার কাছে সবসময়ই মজার ছিল। বিশেষ করে প্রাইমারী।
নীড় সন্ধানী, আপনার লেখায় গতি আছে। তুমুল বেগে লিখে যান। ছোটবড়বেলার যে কোনো চোট্টামির কথা খুলে বলুন নিঃসঙ্কোচে
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
কী ভাগ্যবান আপনি! নিঃসন্দেহে আমার মতো ভীতু ছিলেন না। পাঠশালা বানানটাই খেয়ে দিয়েছে আমার একটা বছর। একটা শব্দের কতটা শক্তি অবাক লাগে।
আমিও সরাসরি ক্লাস টু-তেই ভর্তি হয়েছিলাম।
খুব মজা লাগল আপনার লেখাটা। নিয়মিত লিখুন।
আরেকজন ভাগ্যবান পাওয়া গেল! হা হা হা।
দেশ এভাবেই যুগে যুগে প্রতিভাবানদের হারায়।
........................................................
শাহেনশাহ সিমন
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
ঠিক। তবে বাংলাদেশে অনেক প্রতিভাবান টিকে গেছে, যারা অনেকসময় শাসনকার্যে এমনকি সংসদেও যোগ দেন।
অনেক মজা করে লিখেছেন তো! তাড়াতাড়ী আরো ছাড়ুন কিছু.......
.............................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
এমন প্রতিভাবানরা সচলায়তনে লিখলে আমরাও তাদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারি।
প্রতিভার দরকার নাই আমার। আপনার সাথে বনে বাদারে ঘুরিয়া প্রকৃতিপ্রেমিক হইবার চাই।
আপনার ছবিগুলিতে মজে গেলাম
আপনি তো দেখি আসলেই বেশ হাবা ছিলেন!
মানে, 'ছিলেন', তাই তো ?
এখনো হাবা আছি.......
তয় এখন বুঝি কখন হাবা থাকলে সুবিধা কখন অসুবিধা
মার হাবা........... মার হাবা.........
হাহাহাহহাহা........
( জয়িতা )
নতুন মন্তব্য করুন