সিনেমা-উপন্যাসের সকরুন বেদনার্ত দৃশ্যগুলো মেয়েদের চোখেই বান ডাকবে- ছেলেদের নয়। কৈশোর থেকেই এই ধারনায় অভ্যস্ত আমি 'ছুটির ঘন্টা' সিনেমাটা দেখার সময় হলের আলো আঁধারিতে চুপি চুপি চোখ ভিজিয়েছিলাম স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়া সেই ছেলেটার জন্য। হলের ধুসর আঁধারে কেউ দেখেনি সেই জল। ক্লাস এইটে পড়ছি তখন। সিনেমায় একবার চোখের জল ডাকলেও বই পড়ে তেমন ঘটনা এই বইপোকার জীবনে ঘটেনি তখনো। জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' যখন ধারাবাহিকভাবে সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হচ্ছিল তখন আমি বেশ ছোট। মামার বাসায় সন্ধানী রাখা হতো, কখনো সখনো চোখেও পড়েছে, কিন্তু নিয়মিত পত্রিকা পড়ার বয়স হয়নি বলে আগ্রহও হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেবার পর একদিন বইটা কিনলাম। নতুন বই কেনার পর সাধারনতঃ শেষ না করে উঠতে পারি না। খাওয়া দাওয়ার সময়ও বইটা পাশে থাকে। ডাইনিং টেবিলে ভাতের প্লেট আর বই দুটো পাশাপাশি থাকতো। মা বলতো- 'পাতে আর পাতায় - দুই চোখ দুই জায়গায়'। তবে একাত্তরের দিনগুলি পড়ার সময় শেষের দিকে এসে ডাইনিং ছেড়ে নিজের ঘরে চলে আসতে হয়েছিল। কারন চোখটা কেন যেন অনাকাংখিতভাবে জ্বালা করতো যেটা সেই বয়সে বিব্রতকর। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বইটা যখন শেষ করলাম চোখে আমার আষাঢ়-শ্রাবন, জলের ধারা গাল বেয়ে নামছে। কী লজ্জার কথা! এত বড় দামড়া তরুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চড়ে বেড়ায়, তার চোখে জল! অবিশ্বাস্য!!
'একাত্তরের দিনগুলি' একমাত্র বই যেটি পড়ে আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম। রুমীর বয়সী ছিলাম বলেই কী? ভেবেছি প্রথমবার পড়েছি বলেই খারাপ লেগেছে। কিছুদিন পর দ্বিতীয়বার পড়লাম, তাও একই কান্ড। এক বছর পর তৃতীয়বার পড়লাম। নাহ চোখের ভিজে ওঠা থামাতেই পারি না।
মাঝে মাঝে ভাবি, ১৯৭১ সালে যিনি স্বামী সন্তান হারিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এমন একটা জীবন্ত ডায়েরী জাতিকে উপহার দিয়েছেন, তাঁকে বাংলাদেশ কী দিয়েছে? অপমান, অবমাননা আর দেশদ্রোহীতার অভিযোগ ছাড়া কী পেয়েছেন তিনি শেষ জীবনে?
তাঁর সন্তান হারানোর বেদনার সাথে জাতীয় চেতনার সাজুয্য কোথায়? রুমী কী সমগ্র মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে? ভূমিকায় এর খানিক উত্তর দেয়া আছে-
'বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহবল ফরিয়াদ নয়, তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনকার নিভৃততম দুঃখ অনুভুতি। তার ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে, তাঁর আপনজনের গৌরবগাঁথা যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো বীরগাঁথার সঙ্গে।'
সত্যিই তাই নয় কী?
মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত চেতনা রক্ষাকারী অতীব প্রয়োজনীয় এই বইটা কী জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করা যায় না?
নীড় সন্ধানী
২৫ মার্চ ২০০৯
মন্তব্য
লেখাটা খুব সুন্দর, কিন্তু মন্তব্য করলাম
সিনেমা-উপন্যাসের সকরুন বেদনার্ত দৃশ্যগুলো মেয়েদের চোখেই বান ডাকবে- ছেলেদের নয়।
এই লাইনটা পড়েই। খুব স্টিরিওটাইপড কিন্তু।
একাত্তরের দিন গুলি নিয়ে আবেগ সব সময়ই বেশি। খুব বেশি। ব্যক্তিগত কারণে।
আরো লিখুন। ভালো লাগলো।
আদৌ কি পরিপাটি হয় কোনো ক্লেদ?ঋণ শুধু শরীরেরই, মন ঋণহীন??
মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত চেতনা রক্ষাকারী অতীব প্রয়োজনীয় এই বইটা কী জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করা যায় না?
অনেক আগেই করা দরকার ছিল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের এই বই পড়া বাধ্যতামূলক করা উচিৎ।
কয়েকদিন আগে কোন এক পোস্টে দেখছিলাম একজনকে মেলাঘর কী এটা বুঝিয়ে বলতে হচ্ছে। দেখে দু:খ পেয়েছিলাম খুব।
আমার ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। আরও সঠিকভাবে বলি, শুধু অঝোরে নয়, আর কোনও বইই চোখে পানি আনতে পারেনি আমার। কষ্ট পেয়েছি অনেক বই পড়ে, মন খারাপও হয়েছে, কিন্তু কাঁদিনি কখনওই। সেই একটিবার ছাড়া।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
একই হাল। কী যে কেঁদেছিলাম বইটা পড়ে... শহীদ জননীর লেখার ধরনটার জন্যই বোধহয় দুঃখ আরো বেশি পেয়েছিলাম। অবশ্যই বইটি পাঠ্য করা উচিত।
এই বইটার মতো আরেকটি বই পড়ে আমি কেদেছিলাম। আনিসুল হকের "মা"। এটাও আমি যতবার পড়ি, ততবারই কাদি।
বইটি পড়ার পর ১৯৭১ নিয়ে আপনার মতো একই রকম আবেগ, অহংকার আমারো হয়েছিলো। আর আপনি লেখায় তা খুব সুন্দর করে প্রকাশ করতে পেরেছেন। আপনাকে নিয়মিত লেখার অনুরোধ জানাই।
আপনার সঙ্গে আমিও একমত, এ রকম একটি জীবন্ত-ইতিহাস পাঠ্য-পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ। অনেক ধন্যবাদ।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
এই বইটা আমি এত দেরিতে পড়েছি যে এজন্য নিজের কাছেই লজ্জিত। সবার অবশ্যই অবশ্যই পড়া উচিত ।
আরও একটা বইয়ের নাম বলি যেটা চোখে পানি এনে দেয় - মু. জা. ইকবাল স্যারের আমার বন্ধু রাশেদ
জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের এ্যানা ফ্র্যাঙ্ক।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
নতুন মন্তব্য করুন