সেন্টমার্টিন অভিযানঃ ১৯৯৪ (প্রথম পর্ব)

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০৪/২০০৯ - ৮:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভনিতা

পাঠকঃ সেন্টমার্টিনের গল্প শুনাইবেন? দুরো মিয়া, মার কাছে মাসীর গল্প করেন! কত কত বার গেছি। কোন ব্যাপারস হইলো? টেকনাফ গিয়া 'কেয়ারী সিন্দবাদ' বা 'কুতুবদিয়া' জাহাজে চইড়া বসেন, এক ঘন্টার যাত্রায় ঝাঁ কইরা পৌঁছায়া যাইবেন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। তীরে নাইমা হাত বাড়াইলেই নাওয়া-খাওয়া-শোয়ার জায়গা। সেন্টমার্টিনে এখন ভুরি ভুরি হোটেল রেষ্টুরেন্ট। বুকিং তো ঢাকায় বইসাই দেয়া যায়।

লেখকঃ ওক্কে, আপনে গেছেন আপনার কাছে মাফ চাই, কিন্তু এখনো তো বহুত মানুষ যায় নাই, তাদের সাথে একটু গপ্পো মারতে চাই। ২০০৯ সালে বইসা ১৯৯৪ সালের সেন্টমার্টিনের গপ্পো মারতে ইচ্ছা হয়। খুব কি খারাপ হইবো?

পাঠকঃ নাহ, তা খারাপ হইবো না, তয় আপনের কাম আপনি করেন, আমি চা খাইয়া আসি।

[বিঃদ্রঃ বেশীরভাগ চা খেতে চইলা গেলে কিন্তুক লেখা বন কইরা দিতে হবে ]

ছয় মজারু অভিযাত্রী

ছেলেবেলায় রবিনসন ক্রুসো পড়ার পর থেকে দ্বীপ ভ্রমনের স্বপ্নটা মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। ঘুরপাক খায় কিন্তু উপায় হয় না। কারন সাগর-মহাসাগরে গিয়ে দ্বীপ খোঁজার সুযোগ কই। একদিন কোথায় জানি সেন্টমার্টিনের সরস গল্প পড়ে মাথা গরম হয়ে গেল। খাইছে, এই দেশেও তো মজারু দ্বীপ আছে! তবে সেখানে পাহাড়-টাহাড় নাই। কেবল প্রবাল পাথরের রঙিন বাগান আছে লেগুনের তলদেশে। সেখানে নানা বর্নের মাছেরা ঘুরে বেড়ায় যা কূলে বসেও দেখা যায়। এরকম দৃশ্য ডিসকভারী বা জিওগ্রাফিক চ্যানেল ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। তবে আমার কাছে এর মূল আকর্ষন হলো সভ্য জগত থেকে তার দুরবর্তী অবস্থান। একেবারে জনমানবহীন না হলেও সভ্য জগত থেকে প্রায়-বিচ্ছিন্নতাই দ্বীপটাকে অনন্য করলো আমার কাছে। কিন্তু জানা শোনার মধ্যে কেউ যায়নি বলে কিভাবে যেতে হবে তার কোন দিশামিশা পাচ্ছিলাম না। তাই সেন্টমার্টিন নিয়ে যেখানে যত লেখা পেতাম গোগ্রাসে গিলে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে লাগলাম।

স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বছর কয়েক কেটে গেল, সুযোগ মিললো না। মিলবে ক্যামনে, লোকজন বলে সাগর পাড়ি দিয়ে এরকম অজ দ্বীপে বেড়াতে যাওয়া একটা আকাম। বইয়ের অ্যাডভেঞ্চারে অনেকের প্রানে বান ডাকে, কিন্তু বাস্তব অ্যাডভেঞ্চারে কেউ নেই। নানান আক্কেলীয় অজুহাতে এড়িয়ে গেল। আবার আমিও এরকম একটা জায়গায় একা একা যাবার ভরসা পাচ্ছিলাম না।

একদিন হঠাৎই উপায়টা বেরিয়ে এল। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ দিক তখন। আমার সবচেয়ে ভ্রমনপিয়াসী বন্ধু সমীরের সাথে দেখা, তাকে বলামাত্র এক লাফে রাজী সে। যদিও সেন্টমার্টিন ভ্রমনের সবচেয়ে নিরাপদ সময় পেরিয়ে গেছে তখন (মাঝ ডিসেম্বর থেকে মাঝ জানুয়ারী সবচেয়ে উত্তম সময়)। তবু সমীরকে জোটাতে পেরে আমি বুকে সাহস পেলাম। লোক বাড়লে এরকম ভ্রমন রসময় হয়। আর কেউ রাজী হয় নি শুনে সে বললো 'চিন্তা করিস না, আমি কি করি দেখ'।

সমীরের তাজ্জব কেরামতিতে দুই দিনের মাথায় আমাদের অভিযাত্রী ৬ জনে দাঁড়ালো। এর মধ্যে আমার এক খালাতো ভাইও ম্যানেজড হয়ে দলে যুক্ত হয়েছে। দ্রুত মাষ্টার প্ল্যান করা হলো। সমীর দলনেতা হিসেবে রুট-বাজেট-টিকেট ইত্যাদি কাজ ভাগ করে দিল সবার মধ্যে। মাথাপিছু ৫০০ টাকা বাজেট। কম লাগে? কিন্তু এই টেকা জোগাড় করতেই অনেকের বাবার পকেট কাটার কাছাকাছি হলো। বাট হু কেয়ারস।

সেন্টমার্টিন অভিযানে সমীরের এত আত্মবিশ্বাসের মূল উৎস তার এক দুর সম্পর্কিত আত্মীয় 'বাবলু ভাই'। বাবলু ভাই টেকনাফে এক ফিশিং কোম্পানীর কর্মকর্তা। সমীরের মতে টেকনাফ পর্যন্ত যেতে পারলেই আমাদের কাজ শেষ। বাকী রাস্তা বাবলু ভাইই ঠিক করে দেবেন। শুধু সেন্টমার্টিন না চাইলে নাকি তিনি আকিয়াব রেঙ্গুনেও পাঠাতে পারেন আমাদের। নাসাকা বাহিনীর সাথেও তার খায়-খাতির আছে। আমরা সেই অজানা শক্তিধর বাবলু ভাইয়ের উপর ভরসা করে প্রস্তুতি চুড়ান্ত করলাম। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই যাত্রা। সমীর বাবলু ভাইকে বলেছিল আমরা যাবো, তবে সঠিক দিন তারিখ দিতে পারেনি।

মুরব্বীদের অযাচিত হস্তক্ষেপ এড়াতে ছয়জনের কেউই বাসায় বলিনি যে আমরা সেন্টমার্টিন যাচ্ছি। বলেছি কক্সবাজার যাচ্ছি - বড়জোর টেকনাফ পর্যন্ত যেতে পারি। যাত্রার আগের দিন মাসুমের বাবা বাধ সাধলো টেকনাফের কথা জেনে। বড়লোক বাবার আদরের সন্তান মাসুম। টেকনাফ গিয়ে কোথায় থাকবে, কী খাবে, অজানা অচেনা জায়গা। ওদিকে টিকেট করা হয়ে গেছে সবার জন্য। মাসুমকে ফেলে যেতে চায় না কেউ। শেষমেষ রাতে ওর বাসায় গিয়ে চাচাজানকে অনেক বুঝিয়ে আমি ওর জীবনের উপর যত হুমকি আছে তার দায় দায়িত্ব ঘাড় পেতে নিয়ে রাজী করালাম। ওরে বাপস্!! হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সবাই।

পরদিন সকালে আগ্রাবাদের বাসা থেকে রওনা দিয়ে বহদ্দারহাট পৌছালাম নটার দিকে। সৌদিয়ার ঝকঝকে নতুন চেয়ারকোচ। আসন ব্যবস্থা খুবই চমৎকার। আমাদের মনটা ফুরফুরা। শখের পর্যটকগন আসছেন কাঁধে ব্যাগ ঝোলা ঝুলিয়ে। খুশীতে বত্রিশ দাঁতের অন্ততঃ গোটা তিরিশেক বেরিয়ে আছে একেকজনের। গুনে দেখলাম পাঁচজন পৌঁছেছে। ছয়জন হবার কথা। কে আসে নাই? ইকবাল। বাস ছাড়ার মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। কাট মারলো নাকি শালা? দুশ্চিন্তায় পড়লাম। শেষকালে বিশ্বাসঘাতকতা করলো!

আমরা খচ খচ মনে বাসে উঠে বসলাম। একটা সিট খালি। বাসটা হর্ন দিচ্ছে, ছেড়ে দেবে। তখুনি বাসের পাশে একটা টেক্সী এসে দাঁড়ালো। টেক্সী থেকে নামলেন মান্যবর ইকবাল হোসেন। কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ, কিন্তু হাতে ওটা কী? কমলা রঙের চৌকোনা খন্ড খন্ড মালার মতো গাঁথা। চেনা চেনাও লাগলো। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। আরে! এ তো লাইফ জ্যাকেট। ব্যাটা বিরাট বুদ্ধিমান তো? সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপে যাবো জীবন থাকবে হুমকির মুখে। সেখানে জীবন বাঁচাবে লাইফ জ্যাকেট। পুলকিত হলাম ওর বুদ্ধির বহর দেখে। সে দাঁত কেলিয়ে জানালো - ''আরে ওটা জোগাড় করতে করতেই তো দেরী হয়ে গেল।'

"ওই ব্যাটা, একটা লাইফ জ্যাকেট আনলি ক্যান, মানুষ কয়জন আমরা, সবাই ডুইবা মরবো আর তুই বাঁইচা থাকবি? ফাজিল কোথাকার!" সমীর খোঁচানো শুরু করলো।

"অসুবিধা নাই, ডুইবা যাওনের সুময় আমরা ওরে জড়াইয়া ধইরা মরবো।" জুনায়েদ নির্বিকার জানালো।

হাসির হল্লা উঠলো বাসে। ইকবাল লাইফ জ্যাকেটটা মাথার উপরের র‌্যাকে ঝুলিয়ে বসে পড়লো মাসুমের পাশে। গাড়ীর সকল যাত্রীদের চোখে দর্শনীয় কমলা বস্তু হয়ে উজ্জলতা ছড়াতে লাগলো জিনিসটা। পরবর্তীতে এই বস্তুটাই আমাদের প্রচুর আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে পুরো ভ্রমনে।

কক্সবাজারে পৌঁছাতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। খিদের চোটে পেটের ভেতর পিঁপড়ে ডাকছিল। বাস ষ্ট্যান্ডের লাগোয়া রেষ্টুরেন্টে লাল ঝোলের গরু মাংস দিয়ে হুপহাপ খেয়ে নিলাম সবাই। তারপর? টেকনাফ কী আজকে যাবো না কালকে? তর্কবিতর্কে 'আজকে যাবো' জিতে গেল। তবে তার আগে বীচে ঘুরে আসি। টেকনাফের শেষ বাস পাঁচটায়। আমরা ব্যাগগুলো বাস কাউন্টারে রেখে বীচে গেলাম। ঘন্টা খানেক ঘুরে পাঁচটার আগে ফিরে টেকনাফ বাস ষ্ট্যান্ডে গিয়ে সবচেয়ে আরামদায়ক বাস পছন্দ করতে লেগে গেল সবাই। টেকনাফ যাবার সবচেয়ে ভালো বাসগুলোকে বলা হয় লালবোর্ড সার্ভিস।

টিকেট করে স্পেশাল লালবোর্ডে উঠলাম সবাই। গুলিস্তান রুটের মিনিবাসের চেয়ে একটু বড় হবে। তবে বাসের ভেতরে সোজা হওয়া নিষেধ। দাঁড়াতে হয় ঘাঁড় গুজে- কোমর বাঁকিয়ে, বসতে হয় হাঁটুযুগল পেটের ভেতর সেঁদিয়ে। সবাই একসাথে বসার জন্য শেষের দিকের খালি সীটগুলো বেছে নিলাম। বসতে গিয়ে টের পেলাম লালবোর্ডের ঠেলা। সিট ক্যাপাসিটির বাস, কিন্তু 'সিট ক্যাপাসিটি' ঘোষনাটা আজকালকার মোবাইল কোম্পানীদের মতো -'শর্ত প্রযোজ্য'। মানে সিট পূর্ন হবার আগ পর্যন্তই এই ঘোষনা প্রযোজ্য। সিট পুরা হওয়ামাত্র গনতান্ত্রিক হুড়াহুড়ি লেগে গেল বাসে। 'জোর যার বাস তার' পদ্ধতিতে তিন মিনিটের মধ্যে জনতা লালবোর্ডকে মুড়ির টিন বানিয়ে দিল। ছাড়ার আগে এমন কমপ্যাক্ট হলো যে এই বাস খাদে টাদে পড়ে গেলেও আমরা জানটা নিয়ে আটকে থাকবো সিটের চিপায়।

বাসের সিটগুলো সম্ভবত হাঁটুবিহীন মানবদের জন্য বানানো। এটার সিট নির্মাতা শুধু পাছা রাখার জায়গার কথা ভেবেছে। পাছা থেকে উরু হয়ে হাটু পর্যন্ত দেড়ফুট দৈর্ঘ্যের একটা হাড় বয়ে গেছে সেটার কথা নির্মাতার মনে ছিল না। যাই হোক হাঁটুযুগল ভাঁজ করে উরুটা যথাসম্ভব পেটের ভেতর সেঁদিয়ে পাঁচজন বসলাম ঠেসেঠুসে। সমীর তো বসতেই পারলো না। কারন সৃষ্টিকর্তা ওর উরু পেট আমাদের চেয়ে এক সাইজ করে বড় বানিয়েছিল।

বসেই মনে পড়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইটালী সরকার সিসিলিতে মাফিয়াদের উপদ্রপ কমানোর জন্য একটা অদ্ভুত কঠোর শাস্তি প্রচলন করেছিল। কেসাট্টা নামের ওই শাস্তিটা ছিল অপরাধীকে দেড়ফুট বাই দুইফুট একটা লোহার বাক্সে যে কোনভাবে ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়া। ওই বাক্সে ঢোকাতে গিয়ে কয়টা হাড়গোড় ভাঙবে সেটা বিবেচনায় আসবে না। যারা ওই শাস্তি একবার পেয়েছে তাদের হাড়গোড় যে একটাও আস্ত থাকেনি সেটা বলাই বাহুল্য। সেই শাস্তিটা মুর্তিমান আতংক ছিল মাফিয়াদের জন্য। সেই কারনেই বোধহয় অনেক মাফিয়া ডন আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। লালবোর্ড সার্ভিস আজকে আমাদেরকেও কেসাট্টা সেবা দিয়ে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

তবে অল্পক্ষন পরেই ভুলে গেলাম হাঁটুযন্ত্রনা যখন দন্ডায়মান জনতার মনোযোগ ইকবালের কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেটের প্রতি আকৃষ্ট হলো। শুরু হলো জনতার প্রশ্নমালা। উত্তরদাতা কিন্তু ইকবাল নয়, সমীর। লাইফ জ্যাকেটের দিকে আঙুল দিয়ে জনতার প্রশ্ন শুরুঃ

-ইবা কি( এইটা কী?)
-ইবা লাইফ জ্যাকেট (এটা লাইফ জ্যাকেট)
-বুঝজি ত, ইবা দিয়েরে কী গরিবান (জানি, এটা দিয়ে কী করবেন)
-ইবা ফরিয়েনে সাগরত মিদ্দি হাবুডুবু কেইল্লুম( এটা পরে সাগরে হাবুডুবু খেলবো)
-অনেরা হন্ডে যাইবেন (আপনারা কোথায় যাবেন)
-টেকনাফ
-এন্ডে কী (ওখানে কী)
-বেড়াইতাম যাইদ্দি
-টেকনাফত বেড়াইবার কী আছে? (টেকনাফে দেখার কী আছে)
-এন্ডেততুন আঁরা সেন্টমার্টিন যাইয়ুম (ওখান থেকে আমরা সেন্টমার্টিন যাবো)
-অবুক সেনমাটিন? এন্ডে কিল্লাই, মাতা ফল অই গেইউগুই নি? (সেন্টমার্টিন কেন? মাথা খারাপ হয়নি তো)
-ক্যায়া? অসুবিধা কী (কেন অসুবিধা কী)
-অমা, তোঁয়ারা ন জানো? এন্ডে তে বেয়াক ডাহাইত জাইল্যা (ওমা, তোমরা জানো না? ওখানে সব ডাকাত আর জেলে)
-ডাহাইত আঁরারে কিছু গইরতু ন, আঁরার লগে খান বাহাদুরর নাতি আছে (ডাকাত আমাদের কিছু করবে না, আমাদের সাথে খান বাহাদুরের নাতি আছে)
-তেঁই হন (উনি কে?)
-ওই যে উইবা খানবাদুরর ১৭ তম নাতি (ওইতো ওটা খানবাহাদুরের ১৭তম বংশধর)

সমীর মাসুমের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। ইকবাল, জুনায়েদ আর আমি পেট চেপে হেসে উঠলাম। মাসুম খানবাহাদুর শুনে রাগে কটমট করছে। খান বাহাদুরের একটা ঘটনা আছে। একদিন জুনায়েদ আর মাসুম বসে গল্প করছিল। এক পর্যায়ে দুজনের বংশ মর্যাদার কথা এসে যায়। দুজনেই দাবী করে তারা খান্দানে উঁচু। জুনায়েদ বললো তাদের বংশের কোন পুরুষ খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিল। অমনি মাসুম বললো তার বাবা খানবাহাদুরের সরাসরি ১৭তম বংশধর। জুনায়েদ এই তথ্যটা বন্ধুমহলে প্রচার করে এবং মাসুম খান বাহাদুর ১৭ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। কেউ কেউ খান-সেভেনটিনও বলে। মাসুমকে ক্ষেপানোর মোক্ষম অস্ত্র এটি। এখন লোক ভর্তি বাসের ভেতর সবাই যখন হেসে উঠলো তখন মাসুমের চেহারাটা দেখার মতো হলো।

বাস ছেড়েছে বেশ আগেই। সন্ধ্যা নেমে গেছে। অন্ধকার চিরে টেকনাফের সরু রাস্তায় চলছে লালবোর্ড। সমীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে জুনায়েদের কোলে বসে পড়লো। জুনায়েদ বসেছি বাসের মাঝখানের আইলের সোজা শেষ সিটে। পুরো বাসে সমীরের বসার একমাত্র সিট।জুনায়েদ ওজন সইতে না পেরে খিস্তি করে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। সিট বেদখল। আমরা যখন গল্পে মশগুল তখন ইকবাল হঠাৎ যেন কার উদ্দেশ্য হাঁক দিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখি এক লোক উপরে ঝোলানো লাইফ জ্যাকেটের ফোমগুলো টিপছে-

-কী রে ভাই টিবাটিবি গইত্তা লাইগ্গু ক্যা(কিরে ভাই টিপাটিপি করেন কেন?)
-বিতুরে ফানি আছেনি ছাইদ্দি (ভেতরে পানি আছে কিনা দেখছি)
-ফানি ক্যানে তাইবু (পানি কেন থাকবে)
-ফানির জিনিসত ফানি ন থাইবু না? (পানির জিনিসে পানি থাকবে না?)
-ইবা আইজু ফানিত ন নামে(এটা এখনো পানিতে নামেনি)
-অ তইলে ইবা বাসল্লাই বানাইয়েদে (তাইলে এটা বাসের জন্য বানানো)

বাসের জনতার মধ্যে একচোট হাসির ছররা বয়ে গেল, আমরাও মজা পেলাম। ইকবাল চুপ মেরে গেল। জুনায়েদ ইকবালকে বললো, "তুই লাইফজ্যাকেটটা পরে ফেল। বাসটা যদি নাফ নদীতে পড়ে যায়, কাজে দেবে, নইলে পরে পস্তাবি" শুনে ইকবাল মারমুখী হয়ে ঘুষি পাকালো।

বাস চলছে। যাত্রীদের কোলাহল আস্তে আস্তে কমে আসছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি নিকষ কালো অন্ধকার। কোন জায়গায় আছি বোঝার উপায় নেই। পাহাড় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বাস এগিয়ে যাচ্ছে। এই পথে নাকি সন্ধ্যের পর ডাকাত নামে। সরু রাস্তায় গাছ ফেলে লাইন ধরে দশ পনেরটা গাড়ী একসাথে গনডাকাতি করে। গা শির শির করে উঠলো একটু। কোথাও বাস থামলে কিংবা গতি কমালে আঁতকে উঠছে সবাই। যাত্রীরা কেউ কেউ এখন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। কারন এই মুহুর্তে সবাই চুপ মেরে আছে। আবার আমরাও ভয় পাচ্ছি যাত্রীদের মধ্যে কেউ ডাকাত আছে কি না। দাঁড়ানো যাত্রীদের মধ্যে খালি গা এবং মলিন জামাচোপড় পরা যাত্রীই বেশী এখানে। তাদের কেউ কী ডাকাত দলের সদস্য হতে পারে?

এরকম বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা চলতে চলতে বাসটা একটা বাজার ধরনের জায়গায় পৌছে গেল। লোকজন দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। কলকোলাহলময় জায়গা। এটাই টেকনাফের প্রানকেন্দ্র। আলো ছায়াময় বাজারটিতে আমাদের যাত্রার আপাতঃ সমাপ্তি ঘটলো। এই প্রথম এসেছি বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিনের নগর টেকনাফে। রাস্তাঘাট কিছু চিনিনা। বাস থেকে নেমে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম।

[চলবে]

নীড় সন্ধানী
৯ এপ্রিল ২০০৯


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি এখনো যাই নি। আপনার মত কোনো সমীর-এর সন্ধানে আছি।

আপনার দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। ভাল থাকেন

তাহসিন গালিব

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

এখনো যাননি? দিরং কইরেন না। প্রবাল পাথরের শেষটুকু অবশেষ থাকতেই ঘুরে আসুন, নইলে গিয়ে শুনতে হবে -ওয়ানস আপন এ টাইম দেয়ার ওয়াজ স্টোনস নেম কোরাল.. হাসি

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনি চালাতে থাকুন , আমি চা খেয়ে এসে মন্তব্য দিচ্ছি ।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

আমি চা খেয়ে ফিরে আসলাম, আপনার চা এখনো শেষ হয় নাই?

জুলফিকার কবিরাজ [অতিথি] এর ছবি

চাটগাইয়া ভষার কথপকথন এবং গল্প বলার ভঙ্গী ভাল লেগেছে

মুস্তাফিজ এর ছবি

চা খাওয়া শেষ হয় নাই?

...........................
Every Picture Tells a Story

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

চা এক কাপ শেষ, কিন্তু প্রথম পাতা থেকে প্রথম পর্ব বিদায় হবার আগে আরেকখান দিলে মডুদের কোপানলে পড়তে পারে, চা আরেক কাপ নিয়া বসলাম তাই হাসি

...অসমাপ্ত [অতিথি] এর ছবি

ডেইনচারাস হইছে!!! হাসি

....জলদি পরের পর্ব আসুক।

নীড়সন্ধানী এর ছবি

ডেনজারাস? ভয় খাইছেন ভাইডি? চোখ টিপি

পাঠক এর ছবি

বকম্বততদ কতবজদত
সকহদকবহদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।