হাজি মকবুলের মা একটা কথা প্রায়ই বলতেন-
“যেই মাটিত আছাড় খাইছস উঠতে হইলে হেই ধার দিয়াই উঠতে হইব।"
তার বাবারও পছন্দের একটা কথা ছিল-
“কানে পানি ঢুকলে তা বাহির করতে হইলে সেই কানেই আরো পানি ঢালতে হয়।"
মা-বাবার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাশীল মকবুল তার জীবনের পদে পদে দু'টি কথাই মেনে এসেছে । বাবা-মা গত হওয়ার পরেও তাদের প্রতি মকবুলের ভালোবাসায় কোন টান পড়েনি বরং তা বহুগুনে বেড়ে গেছে। তাদের মৃত্যুর পর সে শেয়াল কুকুরের নিরাপদ আখড়া গ্রামের কবরস্থানের চারপাশে পাকা দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে আর নিজ খরচে তার পাশে ছোট একটি মসজিদ বানিয়েছে যাতে মৃত আত্নীয় স্বজন কবরে থেকেও মুয়াজ্জ্বীনের আজান শুনতে পায় ( আইডিয়াটা কবি নজরুলের একটি গান থেকে নেয়া)। প্রতি বছর বাবা-মায়ের নামে সে দান খয়রাত করে, গরীব মহিলাদের জাকাতের শাড়ি কিনে দেয় ( যদিও ইমাম সাহেব ইদানীং শাড়ি দেয়ায় গভীর অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন , তার মতে শাড়ি হিন্দুয়ানী পোষাক), এতিমদের পড়ার খরচ দেয়, কোরান খতম আর মিলাদের নামে দুই চারটা গরু-ছাগল শহীদ করে দিয়ে শামিয়ানা টাংগিয়ে গ্রামের সবার ভুড়িভোজের ব্যবস্থা করে। তার দানশীলতায় মুগ্ধ গ্রামের লোকজন আগে হালকা-পাতলা আওয়াজ দিত , কিন্তু গত কয়েক বছরে তার চালু করা ' হাজি মকবুল গোল্ড কাপ ফুটবল' আর ' মনোয়ারা বেগম বুহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের'ব্যাপক সাফল্য দেখে জোরে সোরেই চেপে ধরেছে এম পি ইলেকশনে দাড়ানোর জন্য। যদিও মকবুল জানে এই দেশে ব্যবসার নামে হরিলুট করতে চাইলে রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে বেশী কার্যকরী কোন তাবিজ নাই, কিন্তু এ ব্যাপারে সে এখনই তাড়াহুড়া করতে চায়না। হুট করে কোন রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে আগ বাজারে মাছ কেনার চাইতে হাওয়া বুঝে নির্বাচনের আগে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে জনপ্রিয় কোন দলের নমিনেশন কেনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সব কিছুই তার পরিকল্পনার মধ্যে আছে, সময়মত তার প্রয়োগ ঘটাবে।
******
আলুবাজারে রবিউল আলমের ইনডেন্টিং অফিস। আশির দশকে তার ব্যবসার রমরমা ভাব ছিল। বড় বড় কোম্পানীর জি এম , এম ডি তার কাছে এসে ধর্না দিয়ে পড়ে থাকত...ভালো একজন সাপ্লায়ার বা বায়ারের খোজে। তখন ব্যবসায় অনেক গোপনীয়তা ছিল, চাইলেই যে কেঊ হুট হাট করে আমদানী বা রপ্তানী করতে পারতনা। সব করতে হত রবিউলের মত ইন্ডেন্টরদের সাহায্যে। খয়ের খাঁ ব্যবসায়ীদের তোষামদে রবিউলের নিকেকে মাঝে মাঝে গড ফাদারের মত হত, যায়গায় বেযায়গায় লোকজনেরে “ কীপ ইওর ফ্রেন্ডস ক্লোজ, বাট এনিমিজ ক্লোজার” টাইপের উপদেশ দেদারসে বিলিয়েছে। উপদেশ দিতে তার কোন দ্বিধা ছিলনা কিন্তু ব্যবসায়ে সবার আগে নিজের লাভ সে কড়ায় গন্ডায় গন্ডারের মত জোর করে হলেও বুঝে নিত। অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের দুর্বলতা আর অসহায়ত্বের সু্যোগে সে বেশুমার মাল-পাত্তি কামিয়েছে। রবিউলের কাজের ধরন ছিল ঐ জাতীয় স্বর্ণকারের মত যে নিজের মায়ের কাছ থেকেও চড়া লাভ করতে দ্বিতীয়বার ভাবতনা।
সাপ্লায়ার...বায়ার...সি এন্ড এফ এজেন্ট...শিপিং কোম্পানী এমন কি ইন্স্যুরেন্সের দালাল সবার কাছ থেকে সে তার কমিশন পাই টু পাই বুঝে নিত, অন্যদের লাভ হল বা লোকসান তাতে তার কোন পরোয়া ছিলনা। ভিতরে ভিতরে সবাই গোস্বা থাকলেও দুধেল গাইয়ের লাথি মানুষ যেভাবে হজম করে, তারাও রবিউলের কসাইগিরি সেভাবে সহ্য করতে বাধ্য হত।
পরে নব্বইয়ের দশকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে সব গোমর উদাম হইয়া খোলা বাজারে ভেটকাইয়া পড়িয়া রহিল। তারপর মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত ইন্টারনেটের জমানা আসিল। চেংরা পুলাপানও গুগলে সার্চ দিয়া সাপ্লায়ার বাহির করিয়া কারবার শুরু করিয়া দিল। ইন্ডেন্টরদের একছত্র সুবিধা ও ক্ষমতা দানকারী সরকারী নীতিও কালের প্রয়োজনে পালটে গেল। আস্তে আস্তে তার প্রায় সব ক্লায়েন্ট নিজেরাই লাইসেন্স করিয়া আমদানী-রপ্তানীর মাস্তানীতে সিদ্ধহস্ত হইয়া রবিউলের বাড়া ভাতে ছাই আর হোগায় বাশ দিয়া দিল। কিন্তু তার পরেও রবি ব্যবসা জগত হইতে অস্ত যায় নাই। এর মূলে আছে তার একেবারে প্রথম দিকের এক ইউরোপীয়ান সাপ্লায়ারের অমূল্য উপদেশ- " রব ডোন্ট বার্ন দ্য ব্রীজ নো ম্যাটার হোয়াট ,কীপ অন স্মাইলিং ..কানেকশন ইজ পাওয়ার অ্যান্ড স্মাইল ইজ ইটস সোর্ড।" রবিউল সে উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। পুরানা লোকজন সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সে কারো সাথে ব্রীজ বার্ন করে নাই, আর তার ট্রেডমার্ক একান ওকান হাসিও অমলিন হয়ে যায় নাই।
প্রায় ছয় বছর পরে মকবুলকে তার অফিসে ঢুকতে থেকে খানিকটা চমকে গেলেও রবিউল নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে হাজিকে জড়িয়ে ধরল।
হাজি তার অনেক দিনের জিগরী দোস্ত। হাজিকে পাদুকা ব্যবসার সব লাইন ঘাট রবিউলই শিখিয়েছে। তার মাধ্যমেই হাজি বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের জুতা আমদানী শুরু করলেও পরবর্তীকালে ঘোড়া ডিংগিয়ে ঘাস খাওয়ার ধান্ধায় রবিউলকে বাদ দিয়ে নিজ কোম্পানীর নামে সরাসরি আমদানী শুরু করে। মকবুল এতেও থেমে থাকনি, বছর কয়েক পরে ব্রান্ড মালিককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চায়না থেকে সমস্ত মাল কপি করে বাজারে ছেড়ে দেয়। রবিউল এত নাটকের পরেও হাজির সাথে সম্পর্ক খারাপ করেনি... সে বিশ্বাস করে রাজনীতির মত বানিজ্যেও স্থায়ী কোন শত্রু-মিত্র নাই।
" আরে গরীবের ঘরে হাতির পাড়া...আজকে সূর্য কোন দিকে উঠল?।"-খোচামারা স্বরে রবিউল বলে উঠল।
" হোগা দিয়া কথা বলা আজো ছাড়তে পাড়লানা দেখি...জরুরী একটা কাজে আসছি...ফালতু কথার টাইম নাই। খুব পেরেশানীতে আছি।"...হাজি বিরক্ত হয় রবিউলের খোচায়।
" কাজে আসছ ভালো কথা, কাজ করে দিব , তাই বইলা পুরানা দোস্তের ভালা মন্দের দুই একটা খোজ খবর নিবা না? এক ইংরেজ কবি খুব দামী একটা কথা বলছে... মেক নিউ ফ্রেন্ডস বাট কীপ দ্য ওল্ডস...দোজ আর সিল্ভার অ্যান্ড দিজ আর গোল্ড"। হাজি বুঝলনা কিনা এটা ভেবে রবিউল তাড়াতাড়ি অনুবাদ করা শুরু করে আর মকবুল বিরক্ত নয় বরং আহত দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকায়। শালার কথায় কথায় ইংরেজী ফুটানোর অভ্যাস এখন ও গেলোনা।
গান- বাজনা আর কবিতা-সাহিত্য মকবুলের পিত্তি জ্বালাইয়া দেয়। তার মতে কেবল মাত্র ভাদাইম্যা আর অকর্মন্য লোকেরাই শিল্পী-সাহিত্যিক হয়। সারা জীবনে তার কাছে একটা মাত্র কবিতা একটু ভালো লাগছিল...
"কবি নজরুল, করিয়াছ ভুল
রাখ নাই দাড়ি , রাখিয়াছ চুল।"
এই জাতীয় বাস্তব সম্মত কবিতা আজকাল আর কেউ লেখেনা, খালি সোজা কথা প্যাচায়, ঘুরাইয়া ফিরাইয়া একই কথা চোদ্দবার কয় আর মকবুলের ব্লাড প্রেশার বাড়িয়ে দেয়। রিসাইকলড প্লাস্টিক সোনার দাম বাজারে বিকায় এইটা সে বোঝে কিন্তু রিসাইকলড কথার চাইর আনা দামও তার কাছে নাই। সাহিত্য মানে তো কথার বেসাতি , কথার কারসাজি, এইসব বাদ দিয়া তারা যদি খাল কাটত বা দুই একটা চারা গাছ লাগাইতো তাইলেও দেশের কিছুটা উন্নতি হইত। তা না কইরা তারা খালি বেবাক ফালতু আন প্রডাক্টিভ বিষয় নিয়া মাতামাতি করে, কাউ কাউ করে শাহ বাগের মোড়টা সারা বছর গরম করে রাখে। মকবুল মনে করে নারী শাসন বঙ্গোপসাগরে ফালাইয়া বীর্যবান পুরুষের শাসন কায়েম করিয়া দেশের সব শিল্পী-সাহিত্যিকদের রমনার বটমূলে একত্র করিয়া ঠাইসা পান্তা ভাত জন্মের মত খাওয়াইয়া তাহাদের পাছায় হর্স ট্রাংকুলাইজার দুই ফুটি সিরিঞ্জে ভরিয়া মারিয়া দিয়া ঘুম পাড়াইয়া রাখিতে পারিলে দেশের মানুষ শান্তিতে কিছু কাজ কাম করিতে পারিত, দেশে উন্নয়নের জোয়ার দেখা দিত।
মকবুল মাথা ঠান্ডা করে রবিউলকে সব খুলে বলে । তার মাথায় যে ফন্দি আসছে তা রবিউলের পুর্ন সহযোগীতা ছাড়া করে দেখানো শুধু কঠিন না একেবারেই অসম্ভব। এই কাজে তার দরকার একজন ওয়েল কানেক্টেড এবং ওয়ান স্টপ সলিউশন প্রভাইডার । পুরা ব্যাপারটার শোনার পরে রবিউলের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল, এই জাতীয় ধুরন্ধর আইডিয়া যে হাজির মাথায় খেলতে পারে তা তার ধারনায় ছিলনা। ঠিক ঠাক মত এইটা শেষ করতে পারলে তারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলে রীতিমত কিংবদন্তী হয়ে যাবে...আগামীতে নতুন ব্যবসায়ীদের মুখে মুখে ফিরবে তাদের কথা। রবিউল বিষয়টার গভীরতা আর জটিলতা অনুভব করে উত্তেজিত হয়ে উঠল। কিন্তু হাজিকে তার উত্তেজনা বুঝতে দিলনা...সে আপাদমস্তক পেশাদার মানুষ। সে সিরিয়াসলি আলাপ শুরু করে-
" তোমার এই কামে পুরা চাইর মাস টাইম লাগবো আর যোগাড় যন্ত্র লাগবো অনেক।"
" যা লাগবো কইবা...খরচ পাতি সব আমি দিমু।"
" তা তো দিবাই... কাম হইছে তোমার, খরচ পাতি কি আমি আমার নানী বাড়ী থিকা আইনা দিমু? তয় দুইটা কথা-"
" বল, শুনি...তয় উলটা পালটা দাও মারার ধান্ধা কইর না"...মকবুলের স্বরে সতর্কতা।
" প্রথম কথা হইল সব তোমার প্লান মত হইব তয় লোকজন সব আমার খাটবো। তুমি বা তোমার পেয়ারের আক্কাস এর ধারে কাছেও আসতে পারবানা কাম শেষ না হওয়া পর্য ন্ত। " ...হাজি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
" আর দ্বিতীয় কথা হইল এই যে এত রিস্ক আর লোকজন খাটাইয়া কাম বাহির করুম এতে আমার ভাগে কি থাকব?"
" আগে যেই রেটে করছ তার থিকা কিছু বেশী নিবা এই তো? তা নিবা... আমি তোমারে পোষাইয়া দিমু...চিন্তা কইরনা।"
রবিউল হেসে ফেলল..." পাছার ফোড়াঁ কাটা আর গল ব্লাডারের পাত্থর সরানো কি একই মাপের অপারেশন? হাসাইওনা।"
তারা চোখে চোখ রেখে দর কষাকষি চালিয়ে যায়, দু'জনেই সমঝদার মানুষ রফা হতে বেশী দেরী হয়না। সব কিছু রবিউল কে বুঝিয়ে দিয়ে খরচ পাতির জন্য পাঁচ লাখ টাকার একটা আগাম চেক দিয়ে মকবুল হাসিমুখে বেরিয়ে আসে।
*************
ফাইনাল খেলা শুরু। গ্যালারী কানায় কানায় ভর্তি। তবে খেলোয়াড় বা দর্শক কেউই খালি চোখে দৃশ্যমান না। খুব ভালো মত খেয়াল করলে কেবল স্কোর বোর্ডে ফলা ফল দেখা যায়। খুব খিয়াল কৈরা।
প্রায় একই দিনে ইউরোপ আর নর্থ আমেরিকার দুই দেশে বাংলাদেশ থেকে দুইটা বড় পারচেজ অর্ডার ইস্যু হল। বহুদিনের পুরোনো অ্যাসোসিয়েটের কাছ থেকে অনেকদিন পর এত বড় পরিমানের অর্ডার পেয়ে দুই সাপ্লায়ারই মহা খুশী। তারা দেরী না করে দ্রুত প্রফর্মা ইনভয়েস ফ্যাক্স করে দিল। মেঘ না চাইতেই জলের মতই পর দিন তাদের অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট পেমেন্টের টাকা জমা হল।
কিন্তু পরের সপ্তায় শিপিং ইন্সট্রাকশন দেখে তাদের দু'জনের চোখ ছানাবড়া। তাদের দীর্ঘ দিনের ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতায় এ ধরনের উদ্ভট শিপিং এর কথা তারা কখনো শোনেনি। কিন্তু ঘাগু কাগু রবিউল বাংলাদেশের আমাদানী শুল্কের নামে সরকারী অত্যাচারের কাদুনী গাহিয়া তাহাদের কাইত করিয়া ফেলিল। ফেল কড়ি মাখ তেল আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নীতি, টাকা দিয়া মাল নিয়া তুমি যদি গাংগে ফেল তাহলে কাহারো কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হয়না। তারা রবিউলের অনুরোধে ঢেকি গিলতে হাসি মুখে রাজী হইল।
বিশ ফুট কন্টেইনার ভর্তি বিদেশী জুতা আর দাম মাত্র সারে বারো হাজার ডলার? এইটা হারামী মকবুলের কাজ না হয়েই যায়না। উত্তেজিত ফারুক হোসেন আগ বাড়িয়ে এই চালানের দায়ীত্ব নিল। পরে দেখল না এইটা মকবুলের কোম্পানী না, ইম্পোর্টারকে ডাকিয়ে আনল। নতুন মানুষ, একেবারে অল্প বয়স। ফারুক জানতে চাওয়ায় বলল ইন্টারনেটে খুজে স্টক লট পেয়েছে তাই দাম এত কম। সামনে ঈদের বাজার আর হাজি মকবুল আমদানী বন্ধ করে দিয়েছে , এই সুযোগে যদি দুই চার পয়সা কামিয়ে নেয়া যায়। ফারুকের মনের খুত খুতানি গেলনা। অতি উতসাহী নতুন ব্যাপারী কামাল মিয়া ব্যাংক এ এল সি পেমেন্ট তড়ি ঘড়ি করে দিয়ে কাগজ পত্র সব নিয়ে এসেছে, পারলে আজকেই ডেলিভারী নিয়ে নেয়। ফারুক তাকে নিয়েই কন্টেইনার খুলল। কার্টন খুলে দেখে ঝক ঝকে নতুন ছেলেদের লেদার স্যুজ। কিন্তু দু'টাই ডান পায়ের। ফারুক ভাবল হয়ত সিলি প্যাকিং মিসটেক। সে আরেকটা খুলল...তার পর আরেক টা...এক একে দশটা কার্টন খুলল... সব ডান পায়ের জুতা।
ঘটনা বুঝতে পেরে কামাল মিয়ার ততক্ষনে বেহুশ হওয়ার অবস্থা। সে লাফ দিয়ে নিজেই ক ন্টেইনারে উঠে পড়ে পাগলের মত কার্টন খুলতে থাকে... সবই ডান পায়ের।
বিকাল হয়ে গেছে। সব কার্টন খোলা শেষ...একই কারবার। খোজ খবর না নিয়েই ধাম করে আমদানীতে নেমে যাওয়ায় ফারুক তাকে খুব ধ্মকাল। আজকাল ইন্টারনেটে হাজারে হাজার স্ক্যামার...এই সব আবাল লোকজন দিয়া তারা সকাল বিকাল নাস্তা করে। কামালের তাতে কিছুই আসে যায়না...সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল...তার ব্যবসার শখ শেষ। কামাল আর কাস্টমস ফর্মালিটিজ শেষ করলনা। সব ডান পায়ের জুতা দিয়ে সে কি করবে। বেচারার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ফারুক বিষয়টা খুব বেশী ঘাটালোনা। নিয়ম অনুযায়ী আন ক্লীয়ারড গুডস নির্ধারিত সময়ের পরে নিলামে চলে গেল। তিন মাস পরে লাল বাগের চামড়া ব্যবসায়ী হোসেন ব্রাদার্স নাম মাত্র মুল্যে
( বিনা আমদানী শুল্কে) সব মাল কিনে নিল। ফারুক এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করে খুব একটা পাত্তা দিলনা।
কামালের জুতা আসার পরের মাসে প্রায় একই রকমের একটা ঘটনা ঘটে চিটাগাং বন্দরে। তবে পণ্য আলাদা। প্রথমবার আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে নেমেই লোভে পরে বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে বিপুল পরিমানে দামী প্লাস্টিকের প্লেইং কার্ড ইম্পোর্ট করে আমেরিকা থেকে। সোর্স এবারো সর্বনাশা ইন্টারনেট। বক্স খুলে দেখা গেলো বায়ান্ন কার্ডের প্যাকেটে কার্ড আছে একান্নটা...কোন টাতেই টেক্কা নাই। নাই নাই নাই।
টেক্কা ছাড়া কার্ড দিয়া কি বালা ফালামু? ঝাঁঝিয়ে উঠে আমদানীকারক হনহনিয়ে পোর্ট এলাকা ত্যাগ করে গাড়ি নিয়ে এক্কেবারে বান্দর বন চলে যায়।
তিন মাস পরে আগ্রাবাদের অখ্যাত এক লোক নিলামে বাতিল কার্ড গুলো পানির দামে কিনে নিয়ে যায়। পরবর্তী কালে তাকে আর ঐ ঠিকানায় খুজে পাওয়া যায়না।
এরই মধ্যে মংলা বন্দরে আরেকটা বিদেশী জুতার চালান আসে। আগে থেকেই টাকা পয়সা দেয়া থাকায় কোন ঝামালে ছাড়াই দুই দিনেই মাল ছাড়ানো হয়ে যায়। আক্কাসকে বন্দর এলাকার বাইরে সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। মাল ছাড়িয়ে তা ঢাকাগামী ট্রাকে তুলে দেয়া হয়।
পরদিন সকালে শ্যামলী এলাকার হাজি মকবুলের গোপন গুদামে মাল খালাস করে ট্রাক বিদায় হয়। ভিতরে প্রায় শ'খানেক লোকজন কাজ করে চলেছে...থরে থরে সাজানো জুতার বক্স থেকে ডান পায়ের জুতা একটা বের করে তাতে সদ্য আসা বাম পায়ের একটা জুতা বসাতে হবে। সোজা কাজ। তবে মজুরী বেশী। সবাই মন দিয়ে কাজ করে চলে।
হাজি প্রসন্নমনে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে গুদামের ভেতরে তার অফিসে চলে যায়। সে ওখানে থাকে অবস্থায়ই ফেড এক্সের লোকজ়ন দু'টি বড় কার্টন ডেলিভারী দিয়ে যায়।
নিজ হাতে প্যাকেট খুলে হাজি দেখে ভেতরে হাজারে হাজার টেক্কা, টেক্কার মধ্যে মকবুল যেন তার নিজের চেহারা খুজে পায়। প্লেইং কার্ডের উপর আমদানী শুল্ক একশ ভাগের চাইতেও বেশী, বিশাল একটা লাভ হবে ট্যাক্স ছাড়া মাল পাওয়ায়। সে হাসি মুখে মোবাইলে রবিউলকে একটা স্মাইলি এস এম এস করে পাঠিয়ে দেয়।
রোজার ঈদের শেষে কোরবানীর ঈদ আসে। ঢাকা শহর অসংখ্য নিরাপরাধ পশুর রক্তে গোসল করে, বাতাসেও রক্তের গন্ধ। মকবুল হাজি হিসাব করে দেখে তার জাকাতের পরিমান এবছর পাচঁগুন বেড়েছে। সব খোদার মেহেরবানী... স ন্তুষ্টচিত্তে সে ভাবে।
কাস্টমসের বেশ কিছু লোকজন আগে থেকেই তালেবান ফারুকের কার্যকলাপে যার পর নাই ত্যক্ত ছিল। হালায় নিজেও খাইবনা আমাগোও খাইতে দিবনা...এইটা কোন ধরনের বাইচলামী...এ প্রশ্ন জ্বলন্ত হয়ে ঘুরত ছোট- বড়-মাঝারি অফিসার থেকে ট্রেড ইঊনিয়নের অনেকের মাথায়। আক্কাস তার চ্যানেল মত সব তথ্য সরবরাহ করে। দুর্নীতির অপরাধে ফারুকের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীন তদন্ত শুরু হয়। প্রমান করতে বেগ হয়না যে নিলামে যাওয়া মাল গুলো ফারুকের সহায়তায় তার পারিবারিক বেনামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোসেন ব্রাদার্স কিনে নেয় এবং পুরো ব্যাপারটাই লোভী ফারুকের মস্তিস্ক প্রসুত। সরকারকে তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার অপ্রাধে ফারুককে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাস্পেন্ড করা হয়। লজ্জায় এবং ক্ষোভে ফারুক চাকরী ছেড়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও প্রাত্যাহার করে নেয়া হয়।
জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মাস ছয়েক পরে ফারুক ঢাকা ইপিজেড এ এক গার্মেন্টস এ মাত্র ছয় হাজার টাকা বেতনে সুপার ভাইজার হিসাবে চাকরি নেয়।
সেখানে ফারুকের ভাগ্যে কি ঘটে তা লিখতে গেলে দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে। হালার কার খাইয়া দাইয়া এত সময় আছে?
মন্তব্য
ব্স না আমার বালা !! দয়া করিয়া লেখা টা শেষ করেন ।এক নিশ্বাস এ লেখা টা পরলাম। ভাবছিলাম এই বার কোনো একটা গতি হইব। দিলেন তো বস মুলা ঝুলাইয়া। ফারুক হালার কাহিনি জানার জন্য এখন ঘ্ন্টায় ঢু দিতে থাক্। এক্টউ কষট কইরা পরের কাহিনি টা ঝারেন ।
আপনার গল্প বলার স্টাইলটা সাবলীল। ধরে রাখে।
বোনাস কার্ডের কাহিনীটা শুনেছিলাম বহু বছর আগে। একটু ভিন্নভাবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
বাম্পার জোশ---!!!
ধন্যবাদ। তবে এসব নিয়ে আর লিখবনা। মন খারাপ লাগে। এমনিতেই প্রায় মাস খানেকের উপ্রে হয়ে গেল শারীরিক ও মেন্টালি নট ফিলিং ওয়েল। সচলায়তনকে অনেক ধন্যবাদ পোস্ট ক্যাপিলাটিজমের এই যুগে এত নির্লোভ , নির্মোহ আর আকাশের বিশালতার শান্তিময় এই ঠাই গড়ে দেওয়ার জন্য।
আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা কোন নিক্তিতে মাপা সম্ভব না।
তাই বইলা আপদ বিদায় হইছে ভাইবা সেলিব্রেট করা শুরু কইরেন না, ভাঙ্গা কলমে হাবিজাবি লেখা থামাবনা , বান্দ রের হাতে খন্তা যখন আদর কইরা ধরাইয়াই দিছেন এখন মজা ভোগ করেন।
কাজ কাম নাই, বাসায় বসে থাকি ( বেকার না,ইচ্ছা করেই ব্রেক দিতেছি), দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অনেক গল্প জমে আছে, কোনটা দিয়া আপনাদের হাড্ডি জ্বালানো শুরু করব ভাবতেছি।
- বস, চালায়ে যান। আবঝাব, যা-ই লিখেন, আপনাকে স্বাগতম।
ওয়েলকাম টু দ্য সচলায়তন আবঝাব ক্লাব।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
চলুক। এই গল্পটা পড়ে বহুকাল আগে পড়া হিমানীশ গোস্বামীর গোয়েন্দা দে আর গোয়েন্দা দাঁয়ের একটা গল্প মনে পড়ে গেলো, গল্পের নামটা সম্ভবত হাওয়াই চটি রহস্য বা এরকম কিছু, পরিষ্কার মনে পড়ছে না।
একটা অনুরোধ, লেখার শেষে আপনার নিবন্ধিত নিকটি উল্লেখ করবেন। আর মেইল চেক করে দেখুন, আপনার নিবন্ধনে উল্লেখিত মেইল ঠিকানায় একটি বার্তা যাওয়ার কথা।
কঠিন!
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
নতুন মন্তব্য করুন