নৌকা থেকে নেমেই প্রথম সংলাপটা ছিল ইকবালের। প্রচন্ড তিক্ত, বিরক্ত, বিধ্বস্ত, লাইফ জ্যাকেটের ফিতাবদ্ধ ইকবালের মুখ দিয়ে যেটা বেরুলো-
'দুশশালা! এ কী জায়গা? এই বালি দেখতে এত ফাইটিং করে এখানে আসতে হইছে? কী আছে এখানে ঘোড়ার ডিম! আগে জানলে আমি আসতামই না। তবে আগামী এক সপ্তাহেও ফিরতেছি না আমি। সমুদ্র শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার'।
"সমুদ্র শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাচ্ছি না"- এই অংশের সাথে আমি মনে মনে একমত পোষন করেও মুখে বললাম, 'দুর ব্যাটা এত ভয়ের কী আছে, এরুম একটু আধটু ঢেউ না থাকলে জমে নাকি।' যদিও আমার কলিজার ভেতরে ভয়শীতের কাঁপুনিটা তখনো তির তির করছিল।
পানি ডিঙিয়ে বালিতে পা রাখার সাথে সাথে ভয় ডর সব উবে গেল। সুন্দর, তুমি এত সুন্দর। এত সুন্দর একটা দ্বীপ আমাদের আছে। এত দেরী করে তোমার কাছে এসেছি! প্রথম অনুভুতি প্রকাশের কোন ভাষা নেই। আমি যেন আসলেই রবিনসন ক্রুসোর সেই দ্বীপে পদার্পন করেছি। ডাইনে বাঁয়ে বিস্তৃত বালিয়াড়ি। সাদা সাদা বালি।
বেশ কিছু জেলে নৌকাকে বালিতে লোহার শিক গেড়ে আটকে রাখা হয়েছে। সামনে নারকেল আর কেয়াগাছের সবুজ বনানী। তার ভেতরে গ্রাম। বালির মধ্যে হেঁটে গ্রামের দিকে এগোলাম। সম্পূর্ন অচেনা একটা জগতে চলে এসেছি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেক দুরে নীলাভ পাহাড়শ্রেনী দেখা যাচ্ছে। এটা দ্বীপের পূর্বদিক। তারমানে পাহাড়গুলো বার্মায়। বাংলাদেশ দেখা যায় না এখান থেকে। ব্রজেন দাস হলে সাঁতরে বার্মা চলে যেতে পারতো অনায়াসে।
দুপুর দেড়টা বাজে তখন। ছয়জন নবীন পর্যটক মাসুম, সমীর, ইকবাল, আমির, জুনায়েদ ও আমি বালিয়াড়ি পার হয়ে সদ্য তৈরী একটা কংক্রীটের বাধানো রাস্তায় উঠলাম। রাস্তাটা দশ ফুট প্রশস্ত। বড়জোর দুটো রিকশা পাশাপাশি যেতে পারবে। সেন্টমার্টিনের একমাত্র হাইওয়ে। রাস্তায় উঠতেই একটা ঠেলাগাড়ী দেখতে পেলাম। সেন্টমার্টিনের একমাত্র বাহন। ঠেলাগাড়ীর লাল রঙের এলোমেলো আঁচরে এমাথা ওমাথা পর্যন্ত বড় অক্ষরে লেখা - 'লালবোর্ড'। আমরা হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। এখানেও এসে ঠেকেছে লালবোর্ডের ধাক্কা। পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে না হলে এই লালবোর্ড ভাড়া নিতে পারবে।
কনক্রীট রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে ছন বেড়ার একটা ঝুপড়ি দেখা গেল। সেন্টমার্টিনের একমাত্র রেষ্টুরেন্ট। বালিতে বাঁশের খুটি গেড়ে ছনের ছাউনি দিয়ে বানানো হয়েছে। চতুর্দিকে তিন ফুট বেড়া দিয়ে ঘেরা। একদিকে প্রবেশ করার জায়গা রাখা হয়েছে। প্রবেশ পথে একটা চুলায় তরকারী রান্না হচ্ছে। কয়েক কেজি শসার টুকরা কড়াইয়ের মধ্যে ডালের পানির ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছে। চুলা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
একটা টুলে ক্যাশবাক্স নিয়ে একজন বসা। সারিবদ্ধ বেঞ্চ পাতা। স্কুলের মতো অনেকটা। বেঞ্চগুলো কুড়োল কাটা টাইপ এবড়ো থেবড়ো। মোটেও সুনির্মিত নয়। কতগুলো তক্তাকে বালিতে বাশ গেড়ে তার উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। হোটেলে মেঝে বলতে কিছু নেই। সরাসরি সৈকত বালি। আদিম বালিয়াড়িতে হোটেলের ভেতর বাহির সমান। রেষ্টুরেন্টের ভেতরেও জুতো সবার হাতে হাতে। এই দ্বীপে কেউ জুতো স্যান্ডেল পায়ে হাঁটে না, হাঁটার উপায় নেই।
আমরা ক্লান্ত হয়ে তক্তা বেঞ্চগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়লাম। খিদে পেয়েছিল খুব। হোটেলে তেমন কাস্টমার নেই। হোটেল ম্যানেজার বা মালিককে জিজ্ঞেস করলাম কী আছে। মালিক জানালো ওই শসা- ডাল ওটাই আজকের তরকারী। আর কিছু নেই? না। মাছ মাংস কিছু নেই? না। জানলাম এখানে একটা আইটেমই রান্না হয়। মাছ থাকতো, কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকাতে সাগরে নৌকা নামেনি, তাই শসা তরকারীই আজকের একমাত্র আইটেম। আমরা তাতেই রাজী।
মোটাচালের ভাত দিয়ে গপাগপ খেয়ে নিলাম। খারাপ না। খাওয়া সেরে রাতের আশ্রয় খুজতে বেরুলো সমীর আর জুনায়েদ। সমীর আস্বস্ত করলো, সে আসার পথে এখানকার একজনের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। সে থাকার জায়গার ব্যাপারে সাহায্য করবে বলেছিল। এখন তাকেই খুঁজতে যাচ্ছে। বাকীরা বসে থাকলাম সেই ঝুপড়িতে। আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি নামতে পারে যে কোন সময়। তার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে পারলে হয়।
আধাঘন্টার মধ্যে সমীর জুনায়েদ ফিরে এলো। ব্যবস্থা হয়েছে। সমুদ্রের পাড় দিয়ে দক্ষিনে হাঁটা দিলাম সবাই। সমুদ্র পাড়ে শুটকির আড়ত দেখা গেল বেশ বড় বড়। এগুলো পেরিয়ে আরো কয়েকশো গজ যাবার পর সমীর অদুরে সমুদ্রপাড়ে দোতলা একটা বাংলোটাইপ দালান দেখিয়ে বললো ওটাই আমাদের আশ্রয়। বলে কী? এ যে মেঘ না চাইতে জল। যেখানে বেড়ার ঘর পাবো কি না সন্দেহ ছিল সেখানে সৈকতে দাঁড়ানো ইট সিমেন্টে বাধানো দোতলা বাংলো?
সমীর তখন জানালো, বাংলোটা একটা এনজিও'র রেষ্টহাউস। আসার পথে নৌকায় যার সাথে খাতির করেছে সে ওই এনজিওতে চাকরী করে বাংলোটার কেয়ারটেকার হিসেবে। পাশেই তার বাড়ী। এক রাতের জন্য তাকে শ খানেক টাকা দিলেই চলবে বলেছে। বাংলোটা ছোটখাট কয়েকটা পিলারের উপর দাড়িয়ে আছে উপজাতীয়দের বাড়ীর মতো। নীচতলায় কিছু নেই। উপরে দুটো রুম আছে, যে কোন একটা আমরা নিতে পারি। একটা কমন বাথরুম। পানি নেই, পানি নীচের টিউবওয়েল থেকে সংগ্রহ করতে হবে। রুম দুটোর মধ্যে একটা ফার্নিচার দেখলাম, অন্যটা একদম খালি। আমরা ফার্নিচারসহ রুমটা নিলাম। খাটে তিনজন, নীচে তিনজন থাকা যাবে।
আমরা রুমে ঢুকে আয়েশ করে বসলাম। জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতের উপরে মাত্র কয়েকশ ফুট দুরে। কী অপূর্ব এক দৃশ্য। দিগন্তজোড়া নীলাভ সবুজ জলের উথালপাথাল ঢেউ। বাংলাদেশে বসে কখনো এরকম একটা দৃশ্য দেখা যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আমাদের চিরচেনা সমুদ্র এতটা রূপবতী ছিল না। এই সৌন্দর্যের সাথে কক্সবাজারের সমুদ্র ভীষন ভীষন ম্লান। এমন অদ্ভুত স্বপ্নের মতো সুন্দর জায়গায় এমন একটা আশ্রয় পাবো কখনো ভাবিনি। তাও প্রায় বিনামূল্যে। পোষাক বদলে আয়েশ করে বসলো সবাই। ঘুরতে যাবার প্ল্যান হচ্ছে। এমন সময় দরজার বাইরে কিছু উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল। এই বিরানভূমিতে সভ্যমানুষের চিৎকার হল্লা বড় বেমানান লাগলো। জুনায়েদ দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে আসলো ব্যাপারটা। এসেই খিক খিক করে হাসতে থাকলো।
'এই ব্যাটা ঘটনা কী বল'- সমীর ধমকে উঠলো। ব্যাপার হচ্ছে, টেকনাফে দেখা হওয়া সেই নবীনবাবু টাইপ ছেলেগুলো একটু আগে এসে পৌছেছে বিশেষ ব্যবস্থায়। বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে ছোট জেলে নৌকা ওরা পাঁচ জনে রিজার্ভ করে এসেছে। আসার পথে ছোট নৌকাটার ঝাঁকুনি নাকি জীবনে ভোলার মতো না। আমরা কল্পনা করে শিউরে উঠলাম।
আমাদের বড় নৌকার যে অবস্থা দেখেছি, ওদের ছোট জেলে নৌকার ডিসকো নাচন যে তার দশগুন বেশী ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা দ্বীপে নেমেই আয়েশী জায়গা খুঁজতে লেগেছে। কারো কাছে এই বাংলোর খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখলো ভালো রুমটা দখল হয়ে গেছে এবং দখল করেছে সেই দল যাদেরকে গত রাতে ফুঁ পাত্তাও দেয়নি টেকনাফে। কেয়ারটেকার তাদেরকে আমাদের উল্টোদিকের ফার্নিচার বিহীন ঘরটায় থাকতে বলাতেই তীব্র আপত্তি, চেঁচামেচি এবং ওয়াকআউট। ভাগ্যিস আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় আসিনি।
এখানে সবকিছু অন্যরকম। পরিচিত সভ্যজগত থেকে অনেকটা ভিন্ন। দুপুরে হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার আগে আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল রাতে আমরা ওখানে খাবো কি না বিকেলের মধ্যে জানিয়ে দিতে। তাহলে আমাদের জন্য রান্না করবে। নইলে রাতে তেমন রান্না হয় না। আমরা তখুনি জানিয়ে এসেছিলাম রাতে খাবো। মাছ তো নেই তাই হোটেল মালিক জানিয়েছে রাতে মুরগী রান্না করার চেষ্টা হবে যদি কোন বাড়ী থেকে একটা ধরে আনা যায়। এখানে বাজার নেই। সাগরে নৌকা নামলে মাছ পাওয়া যায়। আর মুরগী খেতে হলে গ্রামের কোন বাড়ী থেকে ছুটন্ত মুরগীকে কব্জা করে আনতে হয়। এরকম আদিম অবস্থা দেখে আমরা চমৎকৃত হলাম।
বাইরে বেরুতে চেয়েছিলাম কিন্তুএকটু পরই ঝির ঝির বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো এবং আমরা আটকে গেলাম এই বীচ কটেজে। নিরাপদ জায়গায় বসে ভাবছি সেই নবীনবাবুদের কি দুর্দশা চলছে এই বৃষ্টিতে। বাইরে যাওয়া হলো না বলে চারজনে তাসের প্যাকেট খুলে বসে গেলাম। চারজন খেলছি, দুজন দর্শক। জুনায়েদ আর আমির ভাই। আমির ভাই আমার খালাতো ভাই, কয়েক বছরের বড়, কিন্তু বন্ধুর মতো। উনি তাস খেলার কিছু বোঝেন না। তাই কিছুক্ষন খেলা দেখার পর বিরক্ত হয়ে জুনায়েদকে পটিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন গ্রাম দেখতে। আমরা বললাম, সাবধান এখানে কেসাট্টা দিলে বাড়ীতে ফেরা যাবে না আর।
আমরা খেললাম ঘন্টাখানেকের মতো। ওরা গেছে তো গেছে আর ফিরে না। আমরা সত্যি টেনশানে পড়লাম। খেলা শেষ হয়ে গেছে বেশ আগে। সবাই একসাথে ঘুরতে বেরুবো বলে বসে আছি। ওই দুইজনের পাত্তা নেই। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। কোন আপদ বিপদে পড়লো না তো? খবর নেবারও উপায় নেই। কোথাও বেফাঁস কৌতুহল দেখাতে গিয়ে সত্যি সত্যি কেসাট্টা মার খাচ্ছে না তো? এখানকার লোকজন যেরকম কালো কালো দৈত্যটাইপ, ধরলে রক্ষা নাই।
অবশেষে আমরা গ্রামের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়তে দেখা গেল ওরা দুজন আধভেজা হয়ে বালি ভেঙে ফিরছে অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারা গ্রাম চষে ফেলেছে। কোথায় কি আছে সব মুখস্ত হয়ে গেছে। হুমায়ুন আহমেদের বাড়ীর অসমাপ্ত কাজও পরিদর্শন করে এসেছে।
জুনায়েদ আফসোসের সাথে জানালো - তবে এই দ্বীপে একজন জেনানাও দেখা যায়নি কোথাও। বোধহয় তেনারা এই নির্জন দ্বীপে বসবাস পছন্দ করেন না।'
সমীর খিস্তি করে উঠলো - 'শালা লুইচ্যা যেখানে যাও সেখানেই মাইয়া মানুষ খোঁজো, খাসলত আর গেল না।'
[চলবে]
নীড় সন্ধানী
২১ এপ্রিল ২০০৯
মন্তব্য
দুর্দান্ত হচ্ছে ... চলুক
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...
ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য। আনন্দটা শেয়ার করতে পেরে সত্যিই ভালো লাগছে।
চলুক
...........................
Every Picture Tells a Story
চলছে, কিন্তু সিরিজটা ৩ পর্বে শেষ করতে পারলে আরো ভালো লাগতো। লম্বা হয়ে গেল স্মৃতিচারনের কারনে।
চমৎকার।
আপনাকে চমৎকৃত করতে পেরে আমি ভীষন আনন্দিত।
নতুন মন্তব্য করুন