-পর্ব ১-
বন্দি হলেন কারিতাত
(দ্বিতীয় খন্ড)
<এই সিরিজের আগের পোস্ট>
------------
আদর্শ সমাজব্যবস্থার খোঁজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রফেসর কারিতাত; আর তার সেই ভ্রমনের বর্ণনা নিয়েই ঊনত্রিশ পর্বের এই গল্প। মূল নিবাস মিলিটারিয়াতে বন্দি হবার পর বিদ্রোহী গেরিলাদের সহায়তায় পালিয়ে গেলে তার ভ্রমন শুরু হয়। আগের খন্ডের ধারাবাহিকতায় এই খন্ডে আমরা মিলিটারিয়াতে কারিতাতের বন্দির ঘটনা আর তার বন্দি জীবনের কিছু বর্ণনা পড়ব। এই মিলিটারিয়ার আবহ ফরাসী বিপ্লব পরবর্তি ফ্রান্সের সমাজকেই ইংগিত করছে বলে অনুমান করলে হয়ত ভুল হবেনা। বিপ্লবিদের গঠন করা নতুন ব্যবস্থায় যে ত্রাসের রাজত্ব জারি হয় তার সাথে এখনকার বর্ণনার বেশ মিল রয়েছে। এই খন্ডের শেষে দার্শনিক কারিতাতের সাথে এই গল্পের কারিতাতের একটি যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবেন।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তবে এখন জান্তার ত্রাস সৃষ্টির কাজটি আরো গোছান। অন্যদিকে গেরিলারাও সুসংঘবদ্ধ। কাজেই দুর্যোগের আশংকা এখন আরো প্রবল। এই অবস্থায় তাকে বন্দি করা হলে ব্যপারটি হয়ত কারো নজরেই পড়বে না। দেশের বাইরে তার যেই শিক্ষানুরাগি বন্ধুরা ছিলেন তারা অনাচারের প্রতিবাদে এই দেশকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলে কারিতাতের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ছেলে মার্কাস আর মেয়ে এলিজার সাথেও যোগাযোগ করাও কঠিন। তার কারাবাসের একটি কারন স্পষ্টতই তার ছেলের কার্যকলাপ । ছেলেটি হয়ত এই মুহূর্তে কোন গেরিলা ক্যম্পে জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে। অন্যদিকে মেয়েটি কোন গোপন মানবাধিকার সংস্থার হয়ে কাজ করছে। কারিতাতের বন্দি হবার খবর পেলে সে নিশ্চই দেশে-বিদেশে এর বিরুদ্ধে প্রচারনা আর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কিন্তু এই ভিষন ধর-পাকর আর হট্টগোলের মধ্যে এই প্রচারনা কতটা আমলে নেয়া হবে বলা যাচ্ছে না।
যাহোক চটপট তৈরি হওয়ার নির্দেশ দেয়া ছোকরাটিই তার বিশালদেহী তিন সঙ্গির কমান্ডার বা নেতা বলে মনে হচ্ছে। গায়ে গতরে অনেক তাকতের অধিকারি হলেও ছোকরার সামনে কেমন জড়সড় হয়ে ছিল এই তিন সৈন্য – যেন মালিকের সামনে সন্ত্রস্ত অনুগত তিন বুলডগ। আদেশ পেলেই ঝাপিয়ে পড়বে যেকোন শিকারের ওপর। গভীর রাতের এই অনাহুত চার অথিতি তার সাথে সাথে তার শোবার ঘর পর্যন্ত এলো। এদের সামনেই পোষাক পালটে তৈরি হয়ে নিচ্ছেন কারিতাত। কিছুক্ষন ইতস্তত করে শেষমেশ ছোকরাটিকে সে ছুড়ে দিল প্রশ্নটাঃ
“আমাকে কেন গ্রেফতার করছ তোমরা?”
উত্তরে পালটা প্রশ্ন ছূড়ল ছোকরা। “কেন গ্রেফতার করছি?” বরাবরের মতই তার চেহারায় কোন অভিব্যক্তি দেখা গেল না।
উত্তর শুনে কারিতাত বেশ ধাঁধায় পড়ে গেল। এটাকি তার প্রশ্নের উত্তর? নাকি প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে ছোকরাটি এই প্রশ্নকে বোঝার চেষ্টা করছে? নাকি সে তার সাথের বুলডগ সৈনিকদের কাছে প্রশ্নটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করল? এই উত্তরটিই একটা প্রশ্ন নয়ত? নাকি তার নিজের প্রশ্নের উত্তর তার নিজেরই বের করতে হবে এটাই বোঝান হচ্ছে? অথবা তার প্রশ্নটিকে ব্যঙ্গ করার জন্যই এই অনুপ্রাস! হয়ত ব্যপারটা এমন যে, কেন তাকে গ্রেফতার করা হবেনা এটাই এখন মূল প্রশ্ন হওয়া উচিৎ। অবশ্য গ্রেফতারের জন্য কোন কারনইবা থাকতে হবে কেন? আজকের মিলিটারিয়াতে কিছু করার জন্য কারনেরতো প্রয়োজনতো পড়ছেনা। এরকম মাথামুন্ডু ভাবতে ভাবতেই সে বেশ যত্নের সাথে পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। এমন সুযোগ আবার কবে মেলে কে জানে।
এবার ছোকরা অফিসারটি বলে উঠল, ‘আপনাকে তো গ্রেফতার করা হচ্ছে না’। অবশ্য এতে আর কিইবা আসে যায়। এদের কাছে কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা না থাকলেও আদালত নামের প্রতিষ্ঠানটিকে যেভাবে নিষ্কৃয় করে রাখা হয়েছে তাতে কগুজে পরোয়ানার কি মানে থাকতে পারে? এই ঘোর অন্ধকারে হয়ত কোন এক অন্ধ বিবরে অকালে হারিয়ে যাবে কারিতাত; অসমাপ্ত কাজকে পেছনে ফেলে। কেউ হয়ত জানবেও না; দুফোটা চোখের জলও ফেলবে না। তাঁর সাথে তাঁর স্বপ্নও মিলিয়ে যাবে।
বেশ কর্মময় জীবন ছিল কারিতাতের। অষ্টাদশ শতকের প্রগতিমুখি দর্শনই গত তিন দশকে তার গবেষনা আর শিক্ষকতার মূল বিষয় ছিল। মানব সমাজের ভবিষ্যত প্রকৃতি কেমন হবে সেটা বোঝার জন্য ইতিহাসের পাতায় পাতায় হাতরে বেড়াতে গিয়ে হালের চাল নিয়ে সে কিছুটা উদাসিনই ছিল। বিগত দিনগলিতে ভবিষ্যত নিয়ে মানুষ নিশ্চই আশাবাদি ছিল; কিন্ত সেই আশার কি কোন যৌক্তিক ভিত্তি ছিল? এই শতাব্দির বিভিষিকার মাঝেও কি একই ভাবে আশাবাদ জাগিয়ে রাখা সম্ভব? তবে কি তার পছন্দের দার্শনিকেরা কেবল এতদিন যৌক্তিকতার নামে ভয়ংকর সব প্রহেলিকারই জোগান দিয়ে চলেছে যা একাধারে সাচ্চা বিশ্বাসিদের আর অন্যদিকে সিনিকাল লড়াকুদের অন্ধ করে রেখেছে? সন্দেহবাদি এই লড়াকুরাই এযাবত জেকবিয়ান ত্রাসের আদলে মানবতাকে ভুলন্ঠিত করেছে। তাদের ভাবনাওত সেই যুক্তির পিঠেই সাওয়ার! কারিতাতের এতসব দ্বান্দ্বিক ভাবনার উদ্দেশ্য আর বিধেয় দুই’ই ‘আশাবাদ’।
সৈনিকদের কথামত কারিতাত একটি ব্যগও গুছিয়ে নিল। ব্যগের মধ্যে সে তার ঝোলান আলখাল্লাটি ভাজ করে নিল। দিদেরত[২], ডি’এলেম্বার্ট [৩], লিবনিস [৪], কান্ট [৫], হেল্ভেশিয়া [৬], ভলতেয়ারসহ [৭] সব দার্শনিকদের সাথে আলোচনামুখর সন্ধায় এটা কাজে লাগবে তার। এছাড়াও দাড়ি কামানর সরঞ্জাম, দু’জোরা পাজামা, কিছু শার্ট এবং টাইও সে গুছিয়ে নিল। আর বরাবরের মত আশাবদি মন নিয়ে খালি চশমার বাক্সটিও যত্ন করে ঢুকিয়ে নিল কারিতাত।
নেতাগোছের ছোকরাটি যখন তাকে হলঘর পেরিয়ে সদর দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, কারিতাত তখন ভারি মন নিয়ে শেষবারের মত তার স্টাডিরুমের চারপাশটা দেখে নিচ্ছিল। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরটিকে ঘিরে। প্রতিটি আসবাব, জানালার বাইরের বাগান, বই ভরা মেহগনির তাক, রকিং চেয়ার, কাগজের তাড়া সবই তার রাত জাগা আলোচনা আর গবেষনার সাক্ষ্য বহন করছে। ছোকরা অফিসারের তাড়ায় কারিতাত যখন দরজার বাইরে এল সেই বুলডগ সৈনিকগূলোর আচরনে মনে হতে লাগল ছাড়া পেয়ে যেন তার আত্মাটাকে ছিড়ে খাবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
[প্রথম পর্ব সমাপ্ত]
-পর্ব ২ -
কারিতাতের কারাজীবন
(প্রথম খন্ড)
ছোকরা অফিসারটি কারিতাতকে ঘার ধরে ঠেলে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দিল আর দু’জন সৈনিক তার দু’পাশে চেপে বসল। অফিসারটি সামনে সিটে উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল আর তার হাত এবং চোখ বেঁধে ফেলা হল। চোঁখ বাধায় একটা সুবিধা অবশ্য হল – চারপাশের ঘোলা জগৎটাকে স্পষ্ট করার ক্লান্তিকর চেষ্টা থেকেত অন্তত বাঁচা গেল। আর হাতকড়াটি তার শারিরিক বন্দিত্বের প্রথম ধাপ, সামনে তার জন্য যা অপেক্ষা করছে সে তুলনায় এটাকে খুবই সামান্য বলেই আঁচ করল কারিতাত।
প্রায় ঘন্টাখানেক দ্রুত ছোটার পর গাড়িটি সম্ভবত কোন সামরিক কারাগারের সামনে এসে থামল। সে কিছু জড়ান কন্ঠ, গারদের তীব্র ধাতব শব্দ শুনতে পাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল দূর থেকে যেন চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে – এই সব শব্দ কি কষ্টের, হতাশার না রাগের? গাড়ি থেকে তাকে এক ঝটকায় নামিয়ে পাথরের সিড়ি ভাঙ্গিয়ে নিচে একটি প্যসেজের মধ্য দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে যেখানে ছুড়ে ফেলা হল তা নিঃসন্দেহে একটি কারা প্রকোষ্ঠ। আস্তে আস্তে দরজা বন্দ হবার ধাতব শব্দ মিলিয়ে গেল আর সৈনিকদের পায়ের শব্দও হারিয়ে গেল। এমনি ঘোর অন্ধকার আর নৈশব্দের মাঝে হাতকরা পড়া হাতদুটি দুই হাটুর মাঝখানে গুজে বসে থাকল সে। সময়ের সাথে তার হাতের বন্ধন আরো শক্ত ঠেকছিল আর গাঢ় অন্ধকারের বিভিষিকাও হচ্ছিল গভির । এই ধরনের পরিস্থিতির কথা সে আগে বইতে পড়েছিল কিন্তু এই প্রথম তার চরম রূপ প্রত্যক্ষ করল। তার নিজের জীবনে যে তা এমন নির্মম সত্যি হয়ে উঠবে এটা কখনো ভাবেনি। কোন ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে শারিরিক ভাবে বাচানর ক্ষমতা খর্ব হবার মুহূর্তে তার এনলাইটেনমেন্ট যুগের সবচেয়ে নামজাদা দার্শনিক কন্ডরসেটের [৮] অসহায় অবস্থার কথা মনে পড়ল। বিপ্লবিদের গঠিত সরকারের চোখ বাঁচিয়ে নিজের খামারে একজন শ্রমিক হয়ে পালিয়ে থেকেও শেষমেশ ধরা পড়েন কন্ডরসেট। তারপর এরকম একটি কারা কুঠরিতেই তাকে রাখা হয়। তার দু’দিন পরে কারাবাসে সাধারন ‘পিয়েরে সিমন’ হিসাবে তার মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুকি স্বাবভাবিক ছিল নাকি তিনি আংটির ভেতর লুকান বিষ সেবনে আত্মহত্যা করেন সেটা একটা রহস্য।
হঠাৎ দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকল আর তরিঘরি করে তার হাত আর চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল। আস্তে আস্তে এখানকার মৃদু আলোর সাথে মানিয়ে নেয়ার পর বুঝল তাকে ‘বিবেকি সংঘ’এর হাজতিদের সাথে রাখা হয়েছে।
হতবিহবল এক মুহুর্তে তার মনে হল যে লোকটি তার বাঁধন খুলে দিল তাকে ধন্যবাদ দেবে। কিন্তু তার উপর চোখ পড়তেই কারিতাত বুঝল সেটা কেমন বেমানান হত। (চলবে)
পাদটীকাঃ
[1] http://en.wikipedia.org/wiki/Reign_of_Terror
[2] http://en.wikipedia.org/wiki/Denis_Diderot
[3] http://en.wikipedia.org/wiki/Jean_le_Rond_d%27Alembert
[4] http://en.wikipedia.org/wiki/Gottfried_Leibniz
[5] http://en.wikipedia.org/wiki/Immanuel_Kant
[6] http://en.wikipedia.org/wiki/Claude_Adrien_Helv%C3%A9tius
[7] http://en.wikipedia.org/wiki/Voltaire
[৮] এই কন্দরসেটই ইতিহাসে খ্যত ফরাসি দার্শনিক/গনিতবিদ কারিতাত। কারাবাসে একই পরিস্থিতিতে পড়ায় এই গল্পের কারিতাত ইতিহাসের কারিতাতের কথা স্মরন করছেন। এখানে লেখক পাঠকদেরকে পরোক্ষ ভাবে বোধ হয় এই দুই কারিতাতের যোগাযোগটি ধরিয়ে দিচ্ছেন। বলে রাখা ভাল দার্শনিক কন্দরসেট নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
রিয়াজ উদ্দীন
মন্তব্য
পরের লেখাটা কবে পাব?
একটু চাপে আছি ভাই। দিন দশেক পর দিতে চেষ্টা করব।
নতুন মন্তব্য করুন