একটা বয়সে বাঙ্গালী কিশোর মাত্রই কবিতা লিখার অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়। নব্য গোঁফ গজানোর আনন্দেই হোক বা কিশোরীদের নিয়ে নানাবিধ চিন্তায় মগ্ন হবার বেদনায়ই হোক, কবিতা তখন ভুরভুর করে বের হতে থাকে নানাবিধ দিক দিয়ে (আমার পরিচিত একজন এই ব্যাধিকে পাতলা দাস্ত এর সাথে তুলনা করেছিলেন, আমি অবশ্য অত নিষ্ঠুর হতে পারিনা, নিজেও ঐ গোত্রের অন্তর্গত কিনা)। যাই হোক, এই কাব্যরোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আমার আরেকটা উপসর্গ দেখা দিয়েছিলো, রাতে হন্টনের। একটা সময় গেছে, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন (আসলে রাত) বাইরে থাকার ব্যতিক্রম ছিলো না কোন। পূর্ণিমা তো কিছুতেই মিস নাই। হিমু হিমু ভাব করে রাতে হেঁটে বেড়াতাম এই শহরের নানাবিধ রাস্তায়। পারলে আরো ঘুরতাম, কিন্তু বাবার হোটেলের বোর্ডার হবার সুবাদে সপ্তাহে ঐ একদিনটাই বর্ডারলাইন ছিলো।
আমাদের চিরচেনা এই ঢাকা শহর রাত একটু গভীর হলে অনেকটাই বদলে যায়। মনে হয় সারাদিন দৌড়ঝাঁপ শেষে জীর্ণ-শীর্ণ এই শহর একটা রহস্যময়ী খোলসে ঢুকে গিয়ে ব্যস্ততা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। দিনের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোই রাতে কেমন অচেনা রূপ ধরে সামনে এসে দাঁড়ায়, আর এই আমি রাস্তাগুলোতে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে কত কি-ই যে দেখলাম যা কিনা পরদিন সকাল বেলাতেই অবাস্তব মনে হতে থাকে।
রাতে ঘোরাঘুরি আমার শুরু হতো এই মোটামুটি আটটা থেকে। শুরুর জায়গাটা সাধারণত রমনাই হতো, লেকের পাশে কোন বেন্চিতে বসে বসে। যে যে দিন সাথে কোন বন্ধু থাকতো সেদিন তো কথাই নেই, নির্ঘাত হেঁড়ে গলায় গান ধরতাম একসাথে (কেউ ঐ সময়ের দিকে রমনায় গিয়ে যদি খুন-জখমের আর্তনাদ শুনে থাকেন, তাহলে সেটা আমি। আমার গান শুনে একবার সত্যিসত্যি একটা কুকুর ঘুম ভেঙ্গে দৌড় দিয়ে পালিয়েছিল)। রমনাতেই কাটাতাম রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত, এর বেশী থাকা যেত না নিশিকন্যাদের জ্বালায়। মাঝে মাঝে সংসদ ভবন থেকেও রাত শুরু করেছি, সেখানেও একি কারনে পালিয়ে আসতে হতো ঐ দশটা-এগারোটা নাগাদ।
তবে সবচেয়ে বেশী ভালোলাগতো আশুলিয়া। আশুলিয়া তখনো এত বানিজ্যমুখর হয়নি, আজকাল যে মর্ডান ঘাট আর দোকানপাট দেখা যায় তাও ছিলো না। এক সন্ধ্যার কথা তো আজো মনে আছে, মেঘলা মেঘলা রাতে অর্ধেক চাঁদ, এর মধ্যে নৌকায় শুয়ে সিগারেট খেতে খেতে আকাশের মর্ম উদ্ধারের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় কখন যে সময় বয়ে যাচ্ছিল, টেরও পাই নি একটুও। মাঝি বেচারার তাড়া খেয়ে নৌকা ছাড়তে হয়েছিল, কিন্তু রাত ফিকে হয়নি মোটেও। সেদিন আশুলিয়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে সাভার পৌঁছে গিয়েছিলাম, সে রাস্তা আর সেরকম রাত আজো তো আর ফেরত পেলাম না কখনো।
এতো গেল রাত শুরুর কথা। দশটা-এগারোটার পর আসল চলা শুরু হতো, কোথায় না যাইনি। রাতে সবচেয়ে ভালো লাগতো ইউনিভার্সিটি এলাকায় ঘুরে বেড়াতে, আর খিদে লাগলে মেডিকেল কলেজ এর সামনে। হাসপাতালের সামনে অবশ্য কখনোই ঠিক রাত হয়না। নগরীর এমন অনেক জায়গা আছে যা রাত হলেও ব্যস্ততা ভোলে না; কিন্তু সেই ব্যস্ত জায়গাগুলোই আজব লাগতে থাকে তখন। কাপ্তান বাজার এমন একটা জায়গা। এখানে গেলেই কেন জানি আমার শখানেক বছর আগের কোথাও চলে আসছি বলে মনে হতে থাকে। নদীর পাশেই রাস্তা, বিশ কদম পর পর ঝুপ করে নেমে গেছে দশ-বিশ ফিট, একএকটা ঘাটে একের পর এক এসে থামছে নৌকা রাজ্যের যত মালামাল নিয়ে, লটবহর নিয়ে মুটেরাদের লম্ফঝম্ফ - সবমিলিয়ে এক এলাহি কারবার। আর এখানে চরম চা পাওয়া যায়।
খবরের কাগজের অফিসগুলোর সামনেও হালকাপাতলা নাস্তা পাওয়া যায় সারা রাত। তিনটা-চারটা বাজলে জমিয়ে ক্ষুধা লাগতো, তখন ঐ পরোটা-ডিমকে দ্রৌপদীর রান্না কোন পদের চেয়ে কম মনে হতো না। ওয়ারীর ঐদিকে এক ভদ্রলোক বেচতেন হট পেটিস, মূলত রিকশাওয়ালারাই ছিলেম খদ্দের, ঐ বস্তুটিও বেশ লাগতো। একই জিনিষ ফার্মগেটেও বেচতে দেখেছি, একই স্বাদ - নিশ্চয়ই একই জায়গা থেকেই সাপ্লাই হতো।
রাতকে রাত যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোনদিন ছিনতাইকারীর সামনে পড়িনি। পুলিসের সামনে অবশ্য বহুবার পড়েছি, তবে আইডি কার্ড দেখালেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছি বেশীরভাগ সময়। তারা মনে হয় নিশাচর মানুষ দেখে অভ্যস্ত। দুই-একবার অবশ্য ঝামেলায় পড়তে হয়নি তা না, তবে হাতের পাঁচ হিসেবে আমাদের বহু দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয়ের নাম-ফোন নং মুখস্ত ছিলো, উনি আবার বেশ নামকরা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিনা। নাম বললেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছি।
রাতে দেখা মিলতো অনেক অদ্ভুত চরিত্রের সাথে। তাদের বর্ণনা দেয়া শুরু করলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে।তাই ঐদিকে আর এগোলাম না। বরঞ্ছ আমার একটা ভয় পাওয়ার কাহিনী বলি।
আমি এমনিতে তেমন একটা ভীতু নই। ভীতু হলে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না। তো একবার এরকম ঘুরতে ঘুরতে খিলগায়ের দিকে এসে আমি মেইন রাস্তা থেকে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ওদিকটা আমি মোটামুটি চিনি, কাজেই অতটা রাস্তা খেয়াল না করেই ঘুরছিলাম। অলিগলি করতে করতে বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম কোথায় যেন এসেছি, ঠিক চিনতে পারছি না। অতটা পাত্তা দিলাম না, একদিকে গেলেই হলো। যে রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছিলাম, সেটা গলি হিসেবে একটু অদ্ভুত, কারণ অনেকদূর পর্যন্ত ডান-বামে যাবার কোন তস্য গলি ছিল না, বেশ সোজা এগিয়ে গেছে। রাস্তা ধরে আগাতে আগাতে সামনে খেয়াল করলাম তিনটা কুকুর রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর শুয়ে আছে। একটা বিশালদেহী, রাস্তার কুকুর এত বড় আমি আর দেখিনি। বাকি দুইটা সাধারণ আকার এর। আমি কুকুর একটু এড়িয়ে চলি, রাতে দেখা হলেই তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয় দেখে। এই কুকুরগুলা দেখলাম খান্দানী, কোন শব্দ করলো না। আমি ওদেরকে পার হয়ে সামনে আগায়ে গেলাম কোন ভ্যাজাল ছাড়াই। কিছুদূর যাবার পর পিছনে কি মনে করে তাকায়ে দেখি কুকুর তিনটা একদম নিঃশব্দে আমার পিছে পিছে আসছে। একটু ভয় লাগলেও পাত্তা দিলাম না। আবার কিছু দূর গিয়ে পিছনে তাকায়ে দেখি একই দূরত্ব বজায় রেখে আসতেছে, কিন্তু কোনও শব্দ নাই। এবার ভালোই ভয় লাগলো, ভাবলাম কামড় না দেয়। এবার একটু যাই, একটু তাকাই, একই অবস্থা। আমি দাঁড়াইলে কুকুর দাঁড়ায়, আমি চললে চলে। এভাবে কতক্ষণ গেছি জানি না, হঠাৎ দেখি একটা তেরাস্তা। আমি তাড়াতাড়ি ডানে মোড় নিয়ে হাঁটা ধরলাম, কিছুদূর গিয়ে দেখি কুকুরগুলা তিনরাস্তার ঠিক মাথায় বসে পড়ছে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হাসি পাইলো, হায় হায়, কুকুরকে এত ভয় পাইলাম কেনো? ভাবলাম ফেরত যাই আবার একই রাস্তায়, কুকুর আমার কি করবে? ফেরত পথে গিয়ে দেখি কুকুর তিনটা ঠিক একই জায়গায় একই ভঙ্গীতে বসে আছে। কি অবাস্তব প্রাণহীন লাগতেছিল, কোনরকম ব্যাখ্যার অতীত এক ভয় এসে চেপে ধরলো আমাকে। কোনদিক না তাকিয়ে উল্টা ঘুরে দৌড়। অনেকদূর আসার পর একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে ওটার বারান্দায় উঠে ঠকঠক করে কেঁপেছি। একেবারে মুয়াজ্জিন এসে ফজরের আযান দেয়ার পর উঠেছিলাম। এরপর প্রায় দুই মাস রাতে বের হবার সাহস করে উঠতে পারি নি।
ভুল বুঝবেন না কেউ, আমি ব্যাপারটাকে আধিভৌতিক কোন রং দিই না। কিছু অস্বাভাবিক আচরণ হয়ত ঘটেছে, কিন্তু যুক্তির সীমানার বাইরে নয়। তবে প্রচণ্ড ভয় যে পেয়েছিলাম এটা সত্য। মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে এই শহরের রহস্যময়তা এখনো বাকী রয়ে গেছে কোথাও কোথাও।
এখন যখন যাবার অনেক গন্তব্যেই একে একে তালা পড়ে যাচ্ছে, তখন রাতের শহরটা টিকে থাকুক জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পালানোর একটা শেষ আশ্রয় হয়ে।
-------------------------------------------------------------
ভুতুম
মন্তব্য
ভাল লিখছেন জনাব..
আরও বেশী করে লিখুননা..
মহাভারত হয়ে গেলে হোক না, লিখুন সেই সব অদ্ভুত চরিত্রদের কথাও।
এই মহাভারত পড়তে চাই। আপনাকে লিখতেই হবে, কোন ছাড়াছাড়ি নাই।
চরম ধন্যবাদ। লিখবো জরুর।
চরম ভাল লিখেছেন। আমিও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম অলি গলির হাটাহাটিতে।
এরুম আরো চাই!!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বিশাল ধন্যবাদ ভাইজান।
রাতের শহর অন্যরকম। একদম অন্যরকম। কী যে অবাস্তব আর অপাক্রত লাগে, বলে বোঝানো যাবে না!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ঠিকই বলেছেন, না দেখলে কেউই বুঝতে পারবে না শহরের নৈশরূপটা কতটা অন্যরকম।
মিয়া আসলেই, খুব ইমারসিং লিখা লাগছো। আমি জীবনে এই কাম করি নাই। পইড়া মনে হইতেছে করা দরকার।
কইরা দেখেন, মজা পাবেন। আর থ্যান্ক ইউ পছন্দ করার জন্য।
রাতের ঢাকা একেবারেই একটা ভিন্ন ঢাকা। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরঘুর করার অনেক অনেক স্মৃতি মনে করায়ে দিলেন। তবে আমি কখনোই একা থাকতাম না। সঙ্গী ছাড়া রাত মজার হয়? ইনডোর অর আউটডোর?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমার আবার আউটডোরটা দুইরকমই ভাল্লাগে - কখনো একা, আবার কখনো দল বেঁধে। তবে ইনডোর এর ব্যাপারে পুরাপুরি এক মত।
দারুণ লাগলো !
আপনি তো হিংসা করার মতো হন্টক রে ভাই !!
শেষের অংশটুকু ভুত-ভুত লাগলো, ভুতুম।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আমারও একটু ভুত ভুত লাগছিলো।
ধন্যবাদ!
( পার্থসারথি মুখার্জী )
আপনার তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হওয়া উচিত ! আপনি একজন অত্যন্ত বাজে ধরণের লোক । আপনার লেখাও আমাদের না পড়াই উচিৎ ! কারণ এমন চমৎকার লেখার এত অল্প আয়তন হওয়াটা লেখকেরই অপরাধ । আরে মশাই , সাইট টার নাম তো সচলায়তন । স্বল্পায়তন তো নয় ! শীগগির আরো কিছু এমন ধরণের মালপত্র ছাড়ুন । নইলে আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার নয় ।
ভালো থাকবেন ।
আপ্লুত হয়ে গেলাম আপনের কমেন্ট পড়ে। এখন তো মাস্ট লিখবো। অসংখ্য ধন্যবাদ।
কটঠিন হইছেরে ভাই কটঠিন হইছে। আমারই এখন রাতের ঢাকায় কুত্তার দৌড় খাইতে ইচ্ছে করতেছে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
দৌড় খাইলে অবশ্য আত্মা শুকায়ে যেত। তবে এখন অনেক মজা লাগে চিন্তা করলে।
ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন