--কী সব চ্যাঁচাচ্ছিস বল তো?এগুলোকে গান বলে?
কালোমতন মেয়েটি মাথা গোঁজ করে তক্তপোষের ওপর পেতে দেয়া চাদোরের ফুলগুলো দেখতে থাকে। চরণ চুম্বনে বিশ্বকমল ফোটার গুঢ় রহস্য তার হৃদয়ের কোথাও ঠাঁই পায় না। তার নিজের চিত্তকমল সেই অজানা রসে সিক্ত হয় না কোনোভাবেই। এতোগুলো সাজানো শব্দের মানে তাকে কেউ বলে দেয়নি। যে শব্দের মানে জানা নেই তাকে সে কন্ঠে ধারণ করতে পারে না। না পেরে মাথা নুইয়ে বসে থেকে সে নীল চাদরের নীল ফুলের কথা ভাবে। গুরুজীর অসহিষ্ণু কন্ঠস্বরের কথা ভুলে যেতে চায় ।
--তুই অন্যমনস্ক, অমুক দাদা, আপনার এই মেয়েকে দিয়ে গান হবে না!
বাবা গনগনে মুখ নিয়ে তক্তপোষের পাশে চেয়ার টেনে বসেন। গুরুজীকে আজকের মতন আসতে বলেন । তারপর মেয়েকে কঠিন কন্ঠে বলেন,
--আজ সারাদিন বসে বসে তুই এই গান মুখস্থ করবি!
গান মুখস্থ হয়না। সন্ধ্যারাত ভরে জপের মালার মতন শব্দের পর শব্দ ফিরে ফিরে আসতে থাকে--মনমধুপ-বিশ্বকমল-হৃদয়ভিক্ষু-সুধাসাগর----
সুধাসাগর কি? সুধাসাগর পানে কেনো ধাইতে হবে? সুধা মানে যদি অমৃত হয়, তবে সেতো অমৃত সাগর--অমৃত সাগর কোথায় থাকে? তাকে কোথায় খুঁজতে হবে?
নির্জন রাতের দ্বিতীয় প্রহরে ছোট্ট এক টুকরো চাঁদ ওঠে মধ্য আকাশে।অদ্ভুত শব্দে বাতাস বয়ে যায় গাছের পাতা কাঁপিয়ে। টিনের চালে পায়রারা পা রাখার চেষ্টা করতে ই শির-শির, শর-শর! ঘুম না আসা মেয়েটি নীল ফুলের ছবি আঁকতে থাকে মনে মনে। তার পাশে পাতার মতন আধখানা চাঁদ, সে পাতা লেগে থাকে অস্পষ্ট বাদামী কোনো এক রহস্যময় গাছে; আর সে গাছের শেকড় মাটির দিকে আস্তে আস্তে নামে! শব্দগুলো চোখের সামনে গাছের শেকড়ে উঠে নাচে, শাব্দগুলো জ্বালিয়ে মারে! শব্দ গুলোকে বুকের মধ্যে নিয়ে নাড়াচাড়া করে তবে নাকি মেশাতে হবে সুরের স্রোতের সঙ্গে। কোথায় সে স্রোত, সব স্রোত তার বুকের মাঝে জমে নীল নীল হয়ে যায়। না জানা শব্দের সাথে সুর আর কিছুতেই মেলে না! শব্দ ও সুরের মালার মধ্যে খাবি খেতে খেতে মেয়েটি বুঝতে পারে কেন এমন হচ্ছে। বুঝতে পারে অচেনা শব্দের মাঝে সে বিচরণ করতে পারছে না, কারন এরা তার বন্ধু নয়! বুঝতে পারে তার একমাত্র বন্ধু হল নির্জনতা যার সাথে বান্ধবীর সম্পর্ক রয়েছে চাঁদের আলোর।
তার নিজের কোনো বান্ধবী নেই। সবাই যখন স্কুল থেকে ফিরে বৌ-চি খেলে, তখন তাকে দূর থেকে দেখতে হয়। তাকে কেউ খেলতে নেয় না। খেলতে নেয় না, কারণ সে “ছি-ছৈয়া” বলার সময় নিঃশ্বাস বন্ধ রাখতে ভুলে যায়। তাকে কেউ রান্নাবাটি খেলায় ও ডাকে না, কারণ সে ওস্তাদ গিন্নীর ভূমিকায় সরব নয়। কাকীমা-জেঠীমাদের মতন নির্ভুল ভাবে খেলার ডালে ফোড়ন দিতে পারে না সে। তার কোনো বান্ধবী নেই, তার কোনো বন্ধু নেই! স্বভাবতঃই তাই সবাই যখন ইস্কুল থেকে ফিরে কিছু একটা মুখে দিয়েই দৌড়ে বাড়ীর বাইরে যায়, সে তখন অংক খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে লাল কলম দিয়ে ছবি আঁকে। তার ছবিও ছবি হয় না; ঘরবাড়ী আঁকলে ঘরের চালা তার চৌকো, মানুষের মুখ আঁকলে নাকগুলো হয় বাঁকা! সে যদি গাছের ছবি আঁকে, গাছের ডালপালাগুলো শুধু আকাশের দিকে উড়াল দেয়, আর তাদের শেষ কখনো শেষ হয় না!
মাঝে মাঝে তখন ছবির ওপর বিরক্ত হয়ে সে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করে রুলটানা বাংলা খাতায়। হাতের সাথে প্রভাত মেলাতে গিয়ে তার ছন্দপতন হয়।তখন সে নতুন করে ছন্দ খোঁজে---“ক” থেকে শুরু করে---কাত, খাত, গাত, ঘাত, চাত, ছাত, জাত্,----হাতের সাথে কাকে ভালো লাগে? ছাত, নাকি জাত? কিন্তু হাত তো ছাতে পৌঁছাতে পারবে না, তাহলে তাকে আরো অনেক লম্বা হতে হবে। আর জাত? হাতের আবার কিসের জাত, হাত তো হাত ই। মানুষের মাঝে অবশ্য জাত পাতের ব্যাপার রয়েছে-বড়-ছোট, উঁচু-নীচু, পুরুষ-মেয়ে জাত।আচ্ছা, মানুষ নিজেও তো একটা জাত! মানুষ নিজেও একটা প্রানসম্বৃদ্ধ জাত! বেশ তো! মানুষ নিজেও একটি জাত!
জাত বা জাতি কথাটা তাকে বেশ ভাবায়। তবে সে ভাবনাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সে ভাবনা মানুষ শব্দটিকে আশ্রয় করে ডালপালা মেলতে থাকে। প্রথম যে মানুষটি তার সামনে আসে সে একটি শিশু। তাকে দুধ খাইয়ে দিতে হয়,তার প্রস্রাবে ভেজানো বিছানা পরিস্কার করে দিতে হয়, তাকে কোলে না নিলে তার কান্না থামে না! তারপর সেই শিশুটি একটি কিশোরী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, যাকে কেউ বুঝতে পারে না, যাকে সবাই ভুল বোঝে, আর যে কিচ্ছুটি ভালোভাবে করতে পারে না; যার কোনো বন্ধু নেই, যার সাথে কেউ খেলে না । আর যার কাছে রয়েছে অনেক লুকোনো ছবি, লুকোনো পদ্য, রাজকন্যা-রাজপুত্তুরের গল্প কোনোদিন যা কেউ জানবে না!
কালোমতন মেয়েটির এই না জানা গোপন জগত তার দুই চোখে এক ফোঁটা, দু-ফোঁটা করে জল এনে দ্যায়। সেই জলের ধারা তার দুই গাল বেয়ে নিচে নেমে আসে, তার কামিজের ওপরপ্রান্ত ভেজায়। একসময় কিশরী বুকে জলের উষ্ণধারা একধরনের সুখবোধ তৈরি করে। সে বাইরে শিশির পরার অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়। জানালার নীচে দুর্বাঘাসের ওপর চাঁদের প্রতিবিম্ব আবিস্কার করে সেই সুখের পরিমাণ বেড়ে যায়। টিনের চালে পাখিদের হাঁটাচলার শব্দ ও তাকে গভীর ভাবে আনন্দিত করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে তার দু চোখে দু হাত বোলায়। জানালার শিক গলিয়ে বাইরের অন্ধকারে মেলে ধরে দু হাতের দুই পাতা। ঘাসের মতন তারো হাতে যদি চাঁদ এসে প্রতিবিম্ব এঁকে দ্যায়!
দুহাতে তার মধ্যরাতের বাতাস এসে চুমো খায়। কালোমতন মেয়েটি তখন বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলে-
--আহ,!
সহসা “সুধাসাগর”এর উতসস্থল খুজে পেয়ে ঘুমিয়ে যায় সে নিজেরই অজান্তে।
মণিকা রাশিদ।(মন্ট্রিয়্ল-কানাডা)
মন্তব্য
বাহ্ চমৎকার লিখেছেন তো!! উপমাগুলো মনলোভা হয়েছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
খুবই চমৎকার লিখেছেন! অসাধারণ !
আরো লেখা আশা করছি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
- দারুণ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভাল্লাগ্লো।
শিরোনাম দেখে ম নে হয়ে ছিল এটা তোমার লেখা হলে ও হতে পারে। বাহ, কেমন মিলে গেলো! খুব ভালো আর সাবলীল লেখা মনিকা! আরো লেখো।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
চন্দ্রাতপা- সুন্দর শব্দ , কিন্তু মানে বুঝিনি
বুঝাবেন?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
চন্দ্রাতপ হল চাঁদের ত্রিপল বা শামিয়ানা।
মণিকা রশিদ
বাহ । কি চমৎকার একটা শব্দ । বাঙ্গালী মেয়েদের নাম এমন হয়না কেনো?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
অন্য কথায় বলতে গেলে চন্দ্রাতপা হল জোছনা। অন্য অর্থেও ব্যবহার করা হয় শব্দটি, কিন্তু আমি এটাই ভেবেছি। ধন্যবাদ।
একবার পড়লাম, দু'বার পড়লাম। প্রথমে সেই কালোমতন মেয়েটার জন্য মন কেমন করল, কিন্তু তারপর যখন দেখলাম চাঁদের প্রতিবিম্ব ওর মনে আনন্দের আলপনা এঁকে দিল, যখন দেখলাম সুধাসাগর ও খুঁজে পেল, তখন অনেক আনন্দ হল ওর জন্য! অমন কালো মেয়ের শিশু থেকে কিশোরী হয়ে ওঠার একাকিত্বের গল্প হয়ত অনেক মানুষের জীবনে আছে, কিন্তু ওই চাঁদের আলোয় খুঁজে পাওয়া সুধাসাগরের পাড়ে, অনাবিল আনন্দে ঘুমিয়ে পড়ার মত পৃথিবীটা বেঁচে আছে ক'জনের জীবনে? কিন্তু নাহ্, তোমার লেখা পড়ে অনুভব করলাম সেই জগতটা এখনো বেঁচে আছে! আশা করব তোমার লেখনী সেই জগতটাকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। কলম থামিয়ে দিয়ো না, কখনো না!
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো লেগেছে জেনে অনেক উতসাহ পেলাম।
নতুন মন্তব্য করুন