(উৎসর্গ : ভালবাসার রক্ত ঢেলে যারা গড়ছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ )
- স্যার মনে হয় ওর হাতের আঙ্গুলগুলান বেশি লম্বা। একটু কাইট্যা দিলেই সব সাইজ হইয়া যাইবো। তহন আর কিছু লেখবার পারবোনা। হালা বইলে শিক্ষিত, দ্যাহেন তো স্যার , সামান্য একখান কথা কইতে পারেনা আবার বইলে ভাষার জন্য যুদ্ধ করছে। হাম তিনবার প্যারাইমারী ফেইল দিয়াও ওর চেয়ে ভাল কইতে পারি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মাঝরাতে দেয়ালের গাঁথুনিতে, সিলিংয়ের কোণায় বাড়ি খেয়ে কথাগুলো ঠুকঠাক করতে থাকে । মস্তবড় এই দালানের একটুকরো ইট আমি আড়ি পেতে থাকি আরো কিছু শোনা যায় কিনা। প্রায় প্রতিরাতেই কিছু না কিছু ঘটছে। দিনগুলোও বাদ পড়ে নেই । ফাগুনের এই শেষ বিদায়ের বেলায় আমরা ঘরের প্রতিটি কাঠ, আসবাব, ইট, সিমেন্ট, সুরকি চুপিচুপি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি । কখনো ঔৎস্যুক চোখে , কানের ফুটোগুলোকে একটু বড় করে একাত্তর দেখি।
ওপাশে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার পেশীগুলো তখন ফুঁলে উঠেছে। কিছু না করতে পারার ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের কোষে কোষে। যদি একবার হাতের মুঠোয় পেতো। একটা দীর্ঘশ্বাস লুটোপুটি খায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বাম নিলয় থেকে ডান নিলয়ে, কলিজায়।পরক্ষণেই ঝলকে উঠে পেশীগুলো শান্ত হয়ে আসে। হাত দুটো বাঁধা। চুলগুলোকে কে যেন মুঠোর মধ্যে প্রবল আক্রোশে চেপে ধরে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে মাতৃভূমির বিশ্বাসঘাতক সন্তানের মুখ । শরীফ সর্দার। একদিন কবরের মাটিও যাকে আলিঙ্গন করতে অস্বীকার করবে।
-আপ কুছ লেঙ্গে কেয়া? ঠান্ডা অর কফি? সিগরেট পিয়েঙ্গে আপ? ও হাম তো ভুল হি গ্যায়া, আপ মুসলমান হে। আরে হাম তো ভাই স্রেফ মু বোলি মুসলমান হ্যায়। থোরা সা জাম , থোরা নাম অর থোরা সা ............মুখটা’কে অশ্লীলভাবে বিকৃত করে মেজর কিছু একটা অসভ্য ইঙ্গিত করে।
- মি: রাইটার , শুনাহে আপ রোমান্টিক কাহানী লিখতাহে বহত খুউব। ক্যান ইউ ইমাজিন দ্যাট হাম আপকা আম্মি কে সাথ সুহাগ রাত মানানে গেয়ি অর আধি রাত কো .........হা হা হা । এক পশলা কুৎসিত হাসি সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা’র চোখদুটো রর্ক্তাত্ত হয়ে ওঠে যেন চোখ দিয়েই ধূলিস্মাৎ করে দেবে সামনে দাঁড়ানো মানুষরুপী জানোয়ারটিকে।
- আরে , আপতো বহত গুছ্ছেমে হে। আরে ভাই , হাম বুরা ক্যা বোলা? আপকো মন্জুর নেহি তো হাম নাহি যায়েঙ্গে আপকা ঘর আপকা আম্মিকে সাথ সুহাগরাত মানানে। লেকিন ইসকে লিয়ে আপকো তো কুচ দেনে পড়েগা হামকো। সমঝিয়ে সাম স্মল গিফট। কেয়া আপকো হামারি দোস্তী মন্জুর হ্যায়? সামনের চোখ দুটো নির্বাক। জানোয়ারটা কি বলতে চায়।
-নো নো আপ টেনশন মাতলো। হাম কুচ মেহেঙ্গা গিফট নাহি মাঙ্গতা, আপ স্রেফ ইয়ে কাহিয়ে আপকা আউর সাথি কাহা হে । হাম আপকো ছোড় দেঙ্গে।
একদলা রর্ক্তাত্ত থুথুর শিলাবৃষ্টি চেয়ারের দিক থেকে ছুটে আসে। মেজরের মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে লাল-সাদা থুথুর বৃষ্টি।
-শালা হারামকে আওলাদ। কাট দো উসকে হাত কো।
-হ স্যার, হামভি ইয়ে বলতে চাই। উসকা হাত কাইট্যা দ্যান, তারপর দেহি কোন হাত দিয়া শালা বন্দুক ধরে, কলম দিয়া রাইট করে। চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার হাতদুটোকে সুপারীর মত ঝাঁতার বাহুডোরে আবদ্ধ করে দেয় শরীফ সর্দার । তারপর টুক করে একটা শব্দ, শূন্য থেকে কয়েকটা আঙ্গুল পাকা করমচার মত টুপ করে মাটিতে খসে পড়ে।
-দেখলি তো আমি কি করবার পারি। শরীফ ফুঁসে ওঠে ।
-একদিন এই হাত দিয়া তুই আমার কলাট চাইপ্যা ধরছিলি মনে নাই? দুষটা কার বেশি ছিল ক, আমি না হয় তোর সুন্দরী বউটার দিকে চাইছিলাম, তুই ক্যান অমন সুন্দর একটা মাইয়া বিয়া করছিলি? ক? চুপ কইরা থাহস ক্যা? অহন তো তর বউ, ঘর সব ভ্যানিশ।
-পানি, পানি। একটু পানি। গলাটা শুকিয়ে আসছে। একটু পানি............চেয়ারের উপরে থাকা মানুষটা চেঁচিয়ে ওঠে ।
-শরীফ সাহাব, আপকা পাস কুছ হ্যা কেয়া , উসকো পিলাইয়ে না। আফটার অল ইয়ে আপকা মুল্লুকটা লেড়কা হে। মেজর সাহেবের গলায় দরদ উপচে পড়ে।
-হ স্যার, জরুর হ্যায়। হামারা তল পেট কুচ ভরা ভরা লাগতা। স্যার হাম আভি আতিহে। পা চাটা কুকুরের মত কুঁইকুঁই করতে করতে শরীফ ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেজরের হুকুম তামিল করতে।
-আরে শরীফ সাহাব, আপ উধার কাহা যাতিহে, এহি আনজাম করো না। যরা হামভি দেখে।
শরীফ তার তলপেট খালি করে সবটুকু শয়তানীর নির্যাস চেয়ারের উপর বসে থাকা মানুষটার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটদুটোর দিকে ছড়িয়ে দেয়। ক্লান্ত দেহটা ঘৃণায় কুকঁড়ে ওঠে।
-আল্লাহ তোদের কক্ষনো ক্ষমা করবে না শয়তান। একদিন এই বাংলাদেশে তোরা কুকুরের মত মরে থাকবি।রাগে , ঘৃণায় , ক্ষোভে চেয়ারটা দুলে ওঠে।
-আমি শয়তান? শরীফ খেঁকিয়ে ওঠে। দেহাইতাছি কেডা কুকুরের মত মইরা থাহে। মেজর সাব, ইয়ে আপকো শয়তান বোলা। এইডারে বেহেস্তে পাঠানোর বন্দোবস্ত করদি জি য়ে স্যার। দেরী করলে কিন্তুক ব্যাটা আমগোরেই বেহেস্তে পাঠাইয়া দিবো।
-নাহি, ইয়ে ছোটামোটা কাম তুমহি করো। হামারা তবিয়ত আচ্ছি নেহি হে। হামকো থোরাসা চেন্জ জরুরত হ্যায়। নয়া মাল কো আচ্ছি সে পিনা হ্যায়। ক্যায়সি খুবসুরত। হ্যায়, নিন্দ উড় গ্যায়ী।
চল, বেজন্মার পূত, আল্লাহর কাছে যাইয়া পরাণ ভইরা আমগো গাইল পার। কোরবাণীর ছুরি টা বাতাসে লাফিয়ে ওঠে ।আল্লাহু আকবর.............রক্তের স্রোত ঘরটাকে ভাসিয়ে দেয়। চেয়ারের উপর বসে থাকা বন্দী দেহটা একসময় দেহের খাঁচা ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমায়।
অমাবস্যা
১৯মে ২০০৯
মন্তব্য
গল্প ঠিকাছে। মনে হয় উর্দু একটু বেশি হয়ে গেছে! দুইবার পড়ে হিন্দির কথা চিন্তা করে অর্থ উদ্ধার করেছি।
"আজাকার" রংপুর অঞ্চলের দিকের উচ্চারণ তাই না? গল্পে শরীফ সর্দার কি রংপুরের ভাষায় কথা বলছে?
ধন্যবাদ দ্রোহী । আসলে পাকিস্তানীরা তো উর্দূতেই কথা বলতো তাই না ? তারপরও আপনার কষ্টের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত । ভবিষ্যতে এই বিষয়টি খেয়াল থাকবে ।
আজাকার উত্তরাঞ্চলের উচ্চারণ। আমি উত্তরের লোক ।গল্পে উল্লেখিত শরীফ সর্দারের ভাষা রংপুরের নয়। আজাকারের লাগি শিরোনামে উত্তরাঞ্চলের কিছু ঘটনা নিয়ে লেখার প্রয়াসে গল্পের শুরু। শরীফ সর্দার যদি রংপুরের ভাষায় কথা বলতো তাহলে এমন হতো ," একদিন এই হাত দিয়া তুই হামার কলাট চাপি ধরিছিলু মনে নাই? বাহে কও তো দোষখান কার বেশি , মুই না হয় তোমরা গুলার সুন্দরী বেটিছাওয়াটার দিক তাকাইছিনু, তোমরা গুলা ক্যান অমন সুন্দর দেখি বেটিছইল ঘরত আনিছিলু? "
লেখার পরে শিরোনাম টা বদলে দেবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এখনো তো সচলদের অতিথি তাই সম্পাদনার স্বাদ নিতে পারলাম না ।
অমাবস্যা
২০ মার্চ , ২০০৯
নতুন মন্তব্য করুন