কুমারী মা এবং গাভীন বকনা উপাখ্যান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ৩১/০৫/২০০৯ - ২:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুমারী মা এবং গাভীন বকনা উপাখ্যান
তাপু শিকদার

মেয়েটির পেট বাড়ে দিনে দিনে। একদিন সন্ধ্যে বেলা টের পায় আনকোরা ব্যথা.............।
হাওলাদার পাশের ঐ নির্জন বাড়িতে মাস ছয়েক কাটিয়েছে সে। তখনো পেটের আকার স্বাভাবিক ছিল। দিনে পাঁচবার প্রার্থনায় বসতো সে মূর্তাবেতের পাটিতে। পুরো মাস চালিয়েছিল প্রার্থনা, নিয়মিত। ব্যাপারটা তার মাকে সন্দিহান করে তুলেছিল,অতিমাত্রায়। আগের দিনগুলোতে মেযের ক্ষুধামন্দা ভাব আর বমির ব্যাপারটাকে মা তেমন পাত্তাই দেয়নি।মেয়ের প্রতি ছিল মায়ের প্রগাঢ় আস্থা। মা সেদিন মেয়েকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়েছিল। নির্জন বাড়িটিতে মা-ই ছিল মেয়েটির মেয়েলি বিষয়াদির খবর রক্ষক। ঐ মাসে বিশেষ দিনগুলোর অনুপস্থিতির কথা মাকে সে জানিয়েছিল।

মা তাঁর ষোড়শী মেয়েটির অপরিণত মানসিকতায় কামড় বসানো পুরুষটিকে গালিগালাজ করছিল। অনেকটা পীড়াপীড়ির পর জানতে পেরেছিল ছেলেটির পরিচয়। এ বাড়িরই কামলা ছিল, ছুটি নিয়ে আর ফিরেনি। মা আস্তে আস্তে মেয়েটিকে বকছিল, এমনকি মহিলা মাদ্রাসায় পাঞ্জম পর্যন্ত পড়ানোর খোঁটা দিচ্ছিল।

মেয়েটি মার কাছে স্বীকার করেছিল সব। মহিলা মাদ্রাসায় অল্প বয়েসেই সে হায়েজ-নেফাস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিল। মাদ্রাসা শেষ করার সে পেয়েছিল মকসুদুলমুমিনিন নামক গ্রন্থ। এ গ্রন্থ পাঠে মেয়েটি স্বামীতুষ্টির সকল কলাকৌশল জেনে গিয়েছিল আর কামনার রাজ্যে ক্রমানুসারে অনুপ্রবেশ করেছিল ছেলেটি। অঘটনটি তখন থেকেই ঘটতে শুরু করেছিল। মা দুহাত তুলে কি যেন আওড়াচ্ছিল-দৃষ্টিসীমায় কিছুই ছিলনা। চোখ থেকে কফোঁটা লোনা পানি গড়িয়ে পড়েছিল নীচে।

বিষয়টি সামাল দিতে মা মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল-শেষমেষ পথও খুঁজে পেয়েছিল। মা মেয়েটিকে রোগী সেজে মাস চারেক অন্দরকক্ষের মশারি টাঁনানো চৌকিতে শুয়ে থাকতে বলেছিল। সারাদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে গায়ে কাঁথা মুড়ে শুয়ে থাকা আর মাঝে মাঝে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মেহমানদের তার অসুস্থতার কথা জানানোই নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাড়িয়েছিল। রাতে মাকে সাথে নিয়ে গোসল করতে কলঘরে যেত আর ফিরতি পথে গোয়াল ঘরে ঢুকে তার প্রিয় গাভীন বকনাটিকে দেখত। মা তাতে বাধা দিতনা-মেয়েকে বুঝত মা কিন্তু সমাজকে বড়ই ভয় পেত।

বাধা নিয়মেই মেয়েটি মাসগুলো পার করে। গাভীন বকনাটির ওলান নামে এবং বাড়তে থাকে। স্বামীকে ঘটনাটা জানায় মা। স্বামী গোয়াল ঘরে ঢুকে তা পরখ করে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে কামলাকে আদেশ দেয়। কামলা সন্ধে বেলা গোয়ালঘর বন্ধের প্রাক্কালে গাভীন বকনাটির কপালে হাত বোলায়-অতঃপর গামলায় হাওড় থেকে কেটে আনা এক আঞ্জা কঁচি ঘাস খেতে দেয়।

সন্ধ্যে মিলানোর সাথে সাথেই আনকোড়া ব্যথার প্রাবল্য বাড়ে। মা মেয়ের মাথায় হাত বোলায়-শান্তনাবাক্য উচ্চারণ করে। মাঝে মাঝে স্বামীর কাছে ছুটে গিয়ে কী যেন ফিসফিস করে। মেয়েটি এ আনাগোনার অর্থ বোঝেনা। গোয়ালঘর থেকে বকনাটির হাম্বা হাম্বা ডাক শোনা যায় ঘনঘন।
গোয়ালঘরের লাগোয়া ঘরে অন্য কামলা অনড় অবস্থান নেয়-মনিবের ডাকের অপেক্ষায় থাকে। উৎকর্ণ থাকে গোয়ালঘরের দিকে। বড়ঘর থেকে মনিবের উৎকণ্ঠিত ডাক শোনা যায়। কামলা সতর্ক থাকে এবং পরবর্তি করণীয় নিয়ে ভাবতে থাকে।

মাস চারেক আগে একজন কামলা ছুটি নিয়েছিল এক সপ্তার, আর ফেরেনি। মনিব আর তাঁর স্ত্রী এই চাতুরীটা ধরতে পেরেছিল-পরবর্তি সময়ে। কামলাটি ছিল তাদের প্রিয়ভাজন। মেয়েটি তার প্রেমিক প্রবরকে অনুভব করে। শিগগিরই আসবে বলে যে কথাটি দিয়েছিল-তাই মনে পড়ে বারবার। মেয়েটি তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেনা-ব্যথার কাছে নিজেকে সমর্পন করে ক্রমান্বয়ে। গোঙাতে শুরু করলে-মা তার প্রার্থনার সাদা কাপড়টি ছিড়ে ত্যানা বানায়। উৎকণ্ঠিত থাকে, যদি পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে এই মূহুর্তে কোন আত্মীয় স্বজন আসে! ব্যথার যন্ত্রণায় মেয়েটি মাথা এপাশ ওপাশ করে-শরীর নাড়াতে পারেনা। পুরো শরীর ব্যথার মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়- প্রকট যন্ত্রণায় উচ্চগ্রামে গোঙানী শোনা যায়।
কামলাটি গোয়ালঘরের পাশে সদ্য বানানো গাদা থেকে খড় তুলে আনে। এক আঞ্জা খড় নিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে। লুঙ্গীর গিট্টু থেকে লাইটারটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে নিয়ে- আশ্বস্ত হয়। গাভীন বকনাটি ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। অন্যান্য গরুগুলো জাবর কাটে।

ব্যথাটা আরো প্রকট হয়। গাঢ় হয় যন্ত্রণার রং-সে মাত্রায় গোঙানীও। বাড়ীর শিশু সদস্যগুলো রাতের খাবার সেরে ঘুমোবার প্রস্তুতি নেয়। কেউ কেউ অসুস্থ বোনের পাশে যেতে চাইলে মা তাতে বাধা দেয়। ওরা প্রশ্ন করলে মা ধমকায়-ধমক পেয়ে ওরা সন্তপর্ণে বিছানার দিকে ছুটে।

গোয়ালঘরে ঢুকে মনিব। বকনাটির ফোঁসফোসানি আরো বাড়ে- হাম্বা হাম্বা ডাকে একবার। মনিব কামলার দিকে তাকালে কামলা বাতিটি নিভিয়ে দেয়। বকনাটি বসে পড়ে ধপাস করে। গাঢ় অন্ধকারে বকনাটির চোখ থেকে যেন আলো বিচ্ছুরিত হয়। অদ্ভুত ভেজা শব্দ শোনে দুজনে। আবার বাতি জ্বলে-বকনাটির পেছনে আঠালো পদার্থ জড়ানো বাছুরটি দেখা যায়। কামলা সেটাকে তুলে এনে বকনাটির সামনে রাখে-প্রাকৃতিক নিয়মবশতঃ আঠালো পদার্থ চাটতে শুরু করে বকনাটি। মনিব সামান্য খড় এনে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। বাছুরটি উষ্ণতার পরশে ঝরঝরে হতে থাকে এবং বারবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে শেষতক সফল হয়। বকনাটি এখন থেকে গাভী নাম ধারণ করে-উঠে দাঁড়িয়ে বাছুরটিকে চেটেচেটে আদর করে আর আনন্দে হাম্বা হাম্বা ডাকে।

যন্ত্রণাকাতর মেয়েটির চোখ মুদে আসে-প্রবল যন্ত্রণার এক পর্যায়ে চেতনাহীন হয়ে পড়ে। লাল আঠালো পদার্থ মাখা মানবশিশু নেমে আসে ভেজা শব্দের সাথে সাথে। মেয়েটির মা চমকে উঠে- ওঁয়াও ওঁয়াও শব্দে শিশুটি তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা ঘোষণার প্রাকমূহুর্তে মেয়েটির মা সদ্যজাত শিশুটির কোমল গলা চেঁপে ধরে-সর্বশক্তি বিনিয়োগে। শিশুটির হাত-পা দ্রুত নেড়ে উঠে এবং অদ্ভুত গোঙানী বাতাশে মিলায়। শিশুটি নির্জীব হয়ে পড়ে। মেয়েটির মা অপ্রসূত নাড়ীটির জন্যে অপেক্ষা করে অধীর আগ্রহে।

কামলা বাছুরটির মুখ ছোঁয়ায় গাভীটির ভরাট ওলানের বোঁটায়-গুতি মেরে বাছুরটি বোঁটা চুষতে শুরু করে। কামলাটি মাঝেমাঝে বোঁটা পরিবর্তন করে দেয়। শরতের মধ্য রাতে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা ঝরতে শুরু করলে কাঙ্খিত নাড়ীটি বেরিয়ে আসে। মেয়েটির গোঙানী থামে-মার চোখ উজ্জ্বল হয় এবং মৃদু স্বরে স্বামীকে ডেকে আনে। অতঃপর ফিসফিসিয়ে কী যেন বলে। বাপ মেয়ের অচেতন অবস্থা দেখে-হত্যাকৃত মানবছানাটির নিষ্পাপ মুখ দেখে তার মায়া হয়। একটু ভাবতেই মায়াতে ভাটা পড়ে।

গোয়ালঘর থেকে কামলা বেরুলে মনিব চটের বস্তা জোগাড় করতে বলে। কামলা ধানের গোলা থেকে একটা ছোট বস্তা বের করে দেখায়। মনিব ইল্লতটি বস্তাবন্দী করে বারান্দায় রাখতে বলে। কামলা কাজটি করে ফেললে মনিব তাকে ঘরে গিয়ে সাময়িক বিশ্রাম নিতে বলে। কামলা তার ঘরে চলে যায়।

কামলা ঘরে ঢোকা পর্যন্ত মনিব অপেক্ষা। অতঃপর বস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে- উৎকন্ঠিত চোখে দৃষ্টি বিনিময় করে। বস্তার মুখ খুলে নাড়ী সমেত মানবছানাটি ঢুকায়। মা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা হচ্ছে আবছাভাবে বুঝতে পারে মেয়েটি-আবারো গোঙানীর চেষ্টা করে। দুধে ভারী হয়ে আসে বুক-যেন পৃথীবিচাপা ভার।মনিব আর কামলা বস্তা নিয়ে বাড়ীর দক্ষিণের মাঠে যায়। সাথে করে নিয়ে যাওয়া কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে-বস্তাটি পুঁতে ফেলে সন্তপর্ণে। পাতাযুক্ত করচ গাছের ডাল দিয়ে গর্তটি ঢেকে বাড়ীর দিকে যায়।

রৌদ্রকোজ্জ্বল সকালে বাড়ির ছোট্ট শিশুগুলো সদ্যপ্রসূত বাছুরকে নিয়ে হইহল্লায় মেতে উঠে। মেয়েটি পাতলা কাঁথায় নিজেকে মুড়ে চৌকিতে উবু হয়ে বসে। উঠোনে বাছুর সমেত ছোট্ট ভাইবোন গুলোর উচ্ছল মাতামাতি দেখতে থাকে।
--------------------


মন্তব্য

সালাহউদদীন তপু এর ছবি

ভাল লেগেছে।
আরো লিখুন আমরা আছি পড়ার জন্য।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

অসাধারণ ! পাঁচ তারা দিলাম।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

Md. Shirajul Alam Khan এর ছবি

খুউব ভাল লেগেছে .
ধুসর পৃথিবী

মামুন হক এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন!!!
আরো লিখুন শিকদার ভাই।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কষ্ট লাগলো পড়ে।

ভাল লিখেছেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

অসম্ভব ভাল্লাগলো!!!

উজানগাঁ এর ছবি

এই গল্পটি এর আগে কোথায় যেনো পড়া হয়েছিল। "কীর্তনীয়া" নামের কোনো একটি ছোটকাগজে হয়তো। প্রথম পাঠে ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আজ আবার যখন পড়তে শুরু করলাম তখন বার বার মনে হচ্ছিল কোনো একটি অনুবাদ গল্প আমি পাঠ করছি।

সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে। আপনার আরো গল্প পড়তে ইচ্ছুক।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো হইছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

কল্পনা আক্তার এর ছবি

অনেক কষ্ট হচ্ছিল পড়ার সময় মন খারাপ

লেখা খুবই ভালো হয়েছে।

........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা


........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

কীর্তিনাশা এর ছবি

চরম একটা গল্প পড়লাম।
অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।

চালিয়ে যান তাপু চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

স্নিগ্ধা এর ছবি

সুন্দর গল্প!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুণ।

বেগুনী-মডু এর ছবি

কাছাকাছি সময়ে (২৫ মে, ২০০৯) অন্য একটি ব্লগ সাইটে পূর্বপ্রকাশিত হওয়ায় লেখাটি অতিথি লেখকের নিজ ব্লগে স্থানান্তরিত করা হল।

সচলায়তন সম্মানিত অতিথিদের কাছ থেকে মৌলিক ও অনন্য লেখা আশা করে। প্রিন্ট-মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখার প্রতি কিছুটা শিথিলতা অনুসরণ করা হলেও অন্য ব্লগে সম্প্রতি প্রকাশিত লেখা সচলায়তনে প্রকাশ নিরুৎসাহিত করা হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।