-খোকা, এই খোকা, সাত সকালে জানালা খুলে রেখেছিস কেন? কতদিন বারণ করেছি হিমে বাইরে যাবিনা। ঠান্ডা লাগবে। কথা শুনিসনা কেন? কবে বড় হবি?
আমার সেকেলে মা। এই চব্বিশ বছরের উঠন্ত যৌবনকেও অনায়াসে কৈশোরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কখনো কখনো বাইরে যাবার সময় একটু ঝাঁড়ফুঁক, যদি কারো নজর লেগে যায়। অনেকটা বড় হয়েও আমি কপালে কাজলের টিপ পড়তাম। ছেলেরা ক্ষ্যাপাতো, কিরে তোর দুধের বোতল কই? মেয়েগুলো অবশ্য কিছু বলতো না। শুধু মিটমিট করে হাসতো। কোন কোন দিন টিপ পড়বো না বলে একটু আগে ভাগেই বাড়ি থেকে বেরোতাম। মা হয়তো গোয়াল ঘরে, কিংবা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মোক্ষম সুযোগ।
- মা , আমার স্কুলে দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম।
- খোকা, খোকা, শোন,দাঁড়া।
- কি হলো দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।
- হোক দেরী, টিপ টা দেয়া হয়নি।
- মা আমি এখন বড় হয়েছি। মা মুখ টিপে হেসে আমার হাফপ্যান্টের দৈর্ঘ্য দেখে নেয়। যেদিন ফুল প্যান্ট পড়বি, সেদিন বুঝবো বড় হয়েছিস। এখন কাছে আয় টিপ পরিয়ে দেই।
-মুখটা হাঁড়ির মত করে শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। ভরা র্পূণিমার চাঁদের মত আস্ত একটা টিপ আমার কপালের আকাশে আলো ছড়াতে থাকে। আর আমি স্রষ্টার কাছে তারস্বরে প্রার্থনা করি, আল্লাহ্ , তাড়াতাড়ি আমাকে বড় করে দাও। একনিমেষেই যেন স্রষ্টা দিন, মাস, বছর গড়িয়ে আমার অপেক্ষার ক্লান্ত গাড়িকে বয়সের প্লাটফর্ম থেকে হাফপ্যান্ট নামের স্টেশন থেকে ফুলপ্যান্টের স্টেশনে পৌঁছে দেবে।
গ্রাম দেশে ফিডারের প্রচলন তেমন একটা নেই। অনাহারে, অর্ধাহারে আমার মায়ের বুক শুকিয়ে গিয়েছিল সেই আতুঁড় ঘরেই। মার মুখে শুনেছি যতদিন লাল গাভিটার বুকে দুধ ছিল ততদিন বাছুরটা’কে একটু কম খেতে দিয়ে দুধ গুলো সব আমাকে একটা বোতলে ভরে নিপল লাগিয়ে খাওয়ানো হত। মায়ের কোলে শুয়ে নিরেট বোতলটার বুক চিরে অমিয় সুধা টেনে টেনে পান করতাম। আর ঐদিকে গোয়াল ঘরে বাছুরটা আমাকে অভিসম্পাত করতে করতে খইল মেশানো খড়-ভূষি খেয়েই বড় হতে থাকতো। বড় হয়ে অনেক দিন মনে মনে বাছুরটা’কে বলেছি-
-হ্যাঁরে ধলা, তোকে আমি ঠকিয়েছি না? তোর ভাগের দুধগুলো খেয়েই তো আমি বড় হয়েছি। কি করবো বল, আমি যে ঘাস খেতে পারিনা। তুই তো জানিস আমার বাবা নেই। মামাদের কাছ থেকে আর কতইবা নেয়া যায়। তাদেরও তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আমি যদি তাড়াতাড়ি বড় না হই তাহলে কি করে মা’র দু:খ ঘোচাবো বল? তুই তো দেখিস কত কষ্ট আমার মায়ের। মন খারাপ করিস না, আমি যখন বড় হবো, মস্ত বড় চাকরী করবো, তখন তোকে মেলা মেলা দুধ কিনে খাওয়াবো। কিরে , তখন আমায় ভাগ দিবি তো, নাকি একাই সব খেয়ে নিবি?
-খোকা, খোকা, কি করছিস ওখানে?
-ধলা’কে খাওয়াচ্ছি। এই ফাঁকে বলে নেই ধলা বাছুরটার নাম।
-তোর খাওয়াতে হবে না । তুই পড়তে বস।আমি দেবোক্ষণ। কথা না বাড়িয়ে সুবোধ ছেলের মত পড়তে বসে যাই। যাবার আগে ধলাকে হয়তো ফিসফিস করে বলে যাই, ধলা মনে থাকে যেন, তখনকার সব দুধ তোর, আমি একটুও ভাগ নেবোনা, দেখিস।
-খোকা। মা বিরক্ত হয়। ধলার সাথে তোর এত কি কথা রে?
-আমি সূর্যের হাসি হেসে মা’কে বুঝিয়ে দেই ঘটনা অতীব গুরুত্বর্পূণ। তৃতীয় পক্ষের প্রবেশ নিষেধ। মা বুঝে নেয় এ আমার আর ধলার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই কথা না বাড়িয়ে বলে,
-কি জানি, তোর ব্যাপার স্যাপার আমার মাথায় কিছুই ঢোকে না। এখন পড়তে বস।
আমি মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মত বলি,
- বুঝলে মা, আমি একদিন মস্ত বড় কিছু হবো, হাতির মত।
মা হেসে কুটিকুটি। তার ছেলে বড় হয়ে কিনা হাতি হবে।
-হ্যাঁ রে হাতি হলে তুই ফুলপ্যান্ট পড়বি কি করে? অতবড় ফুলপ্যান্ট বানাতে দোকানের সব কাপড় ফুরিয়ে যাবে না? মা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।আমার ছোট্ট মাথায় কিছুই ঢোকেনা, ভুলটা কি বললাম।
কোন কোন দিন মাথা চুলকে দিদিভাই কে জিজ্ঞেস করি, হ্যাঁরে দিদিভাই, আমি ভুল কি বলেছি বল? মা শুধুই হাসে। দিদিভাই বোঝেনা তার ছোট্ট ভাই বন্ধুটি কি ভুল করলো। গালে হাত দিয়ে পন্ডিতের মত দুই অবুঝ শিশু পৃথিবীর সব জটিলতা উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে যাই।
-শোন খোকা, হাতিরা তো ফুলপ্যান্ট পড়েনা। সার্কাসে দেখিসনি হাতিগুলো উদোম থাকে। বুদ্ধু, বড় হলে কি আর ন্যাংটোপুটু থাকা যায়? আমিও ভাবি ।
-আচ্ছা, হাতিরা না হয় উদোম থাকে কিন্তু বানরগুলো?
এবার দিদিভাই মায়ের চেয়েও বেশি হেসে ওঠে। হাসির ঝলকে ওর মোমের মত ছোট্ট দেহটা মাটিতে গড়াগড়ি খায় আর আমি মুখ শক্ত করে রাগে ফুঁসতে থাকি। মেয়েদের বুদ্ধি আসলেই কম। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মশকরা?
-দিদিভাই। আমি খেঁকিয়ে উঠি।
-কিরে খোকা?
-হাসছিস যে বড়?
-বারে , হাসি পেলে হাসবোনা? আচ্ছা খোকা, তুই বাদঁড়ের মত বড় হয়ে সারাক্ষণ কি এমন করে মুখ ভেংচাতে থাকবি? বলেই দিদিভাই মুখটাকে ভ্যাংচাতে থাকে। দিদিভাই, আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সাথী। ছুতোরের মেয়ে বলে ভদ্র সমাজের ছেলেমেয়েরা ওর সাথে মেশেনা। আমি মুসলমানের ছেলে হয়েও কিভাবে যেন ওর ছোট্ট হৃদয়টাকে দখল করে ফেলেছি। একমাত্র শিশুদের কাছেই কোন প্রভেদ নেই। মানুষ যত বড় হয় ততই বৈষম্যর বেড়াজালে একটু একটু করে জড়িয়ে যায়। চাইলেও অনেকসময় এড়াতে পারেনা। যারা পারে তাদের সমাজ অন্য চোখে দ্যাখে ।
সময়ের গাড়ি চড়ে আমি একদিন সত্যিই হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টের রাজত্বে পা রাখি।আমি খোকা ভবিষ্যত খোকাদের আবাসস্থল হিসেবে নিজেকে গড়তে থাকি। মা অবাক হয়ে দ্যাখে তার খোকা একটু একটু করে কত বড় হয়ে গেছে। গালের সেই কমনীয়তা নেই। হেমন্তের ধান গাছের পরিত্যক্ত শিকঁড়ের মত সারাটা মুখে খসখস খসখস। হাতগুলোকে নিজের মনে হয় না।চামড়ার দেয়াল ভেদ করে বটবৃক্ষের শাখার মত এখানে ওখানে বেড়ে উঠছে পশমের আস্তরণ। বিব্রত লাগে। নিজেকে কেমন অচেনা মনে হয়। নিজের গলার স্বর শুনে নিজেই চমকে উঠি। একটু মোটা, একটু ভারী ।কয়েকদিনেই আমি খোকা থেকে অন্য মানুষে বদলে যাই। হয়তো দুইশ সত্তর কিংবা চারশ চব্বিশ কিংবা আরো কিছু কমবেশি সূর্য ওঠা। নিজেকে লুকিয়ে রাখি ।পাছে মার চোখে আরো বেশি বড় হয়ে যাই। মায়ের বুকটা ভাবনার নদীতে হারিয়ে যায়। একটু একটু করে খোকা কেমন বদলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের পেটের উপর হাত বুলিয়ে ভাবতে থাকে এই ছেলেটাকেই সে গর্ভে ধরেছিল কিনা। সদ্য বেড়েওঠা গোঁফের কাটাঁঝোপগুলোর আড়ালে যে মুখটা লুকিয়ে আছে সে যেন খোকা নয়, অন্য মানুষ, অন্য এক খোকা যে পরির্পূণ হবার প্রতিক্ষায় আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস জীর্ণ দেয়ালের ঝুলগুলোকে ছুঁয়ে যায়। তার সেই ছোট্ট খোকা কোথায় গেল?
কখনো কখনো অবহেলায় সার-সেচ ছাড়াই মুখের জমিতে ঘন আগাছা জন্ম নেয়। তারপর কোন একদিন সময় বুঝে সেই বনভূমি উজাড় করতে লেগে যাই। জীবনটা যেন কেমন, চলতে চলতে মাঝে মাঝে স্থবির হয়ে যায়।প্রিয়মুখগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। ধলা কিন্তু এখন অনেক বড়, রীতিমস্ত আস্ত একটা ষাঁড়। আমাকে মোটেই তোয়াক্কা করেনা। শিং বাঁকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে যেন বলে, দ্যাখো খোকা, আমি হাতির মতই বড় হয়েছি। আর তুমি এত এত দুধ খেয়ে কি করলে? মাঝ থেকে দুধগুলো আমি খেলে আরো একটু বেশি সবল হতাম।কলেজ, র্ভাসিটি.........সময় কি করে গড়িয়ে যায়। মায়ের মেঘের মত কালো চুলে রং ধরে। সাদা সাদা, কালো কালো। মাঝে মাঝে ধলার কথাগুলো মনে মনে আওড়াই, হয়তো খইল ভুষি খেয়ে বড় হলেই ভাল হতো। নইলে এত এত দুধ খেয়ে বড় হয়ে ওঠা এই আমি গাঁদা গাঁদা বই পড়েও একটা ভাল চাকরী পেতে হিমসিম খেয়ে যাই।চাকরীর পড়া পড়তে পড়তে আনমনে জানালার ফাঁক দিয়ে কখনো সখনো চেয়ে দেখি ধলা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে । ওর নীরব চোখের ভাষা যেন চুপচুপ করে বলে যায়
-খোকা,আর কত পড়বে খোকা। একটু তাড়াতাড়ি পড়ো আর যে সয় না। আমি সবভুলে পড়ায় ডুবে যাই। সামনে কত কাজ। শীতের কোন এক সন্ধ্যায় মায়ের পেটের ব্যথাটা হঠাৎ হাই তুলে জেগে ওঠে। তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেই। কিডনিতে ইনফেকশন। অপারেশন করতে হবে। অনেক, অনেক টাকা দরকার। জমি-জমা সব বন্ধক রেখেও শেষ রক্ষা হয়না। ডাক্তারের তাগাদা, তাড়াতাড়ি করেন , নইলে আপনার মাকে বাঁচানো যাবে না। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত দেহটা'কে বিছানায় এলিয়ে দিতে দিতে বাইরে চোখ রাখি। জ্যোৎস্নার আলোয় ধলার চোখ দুটো চকচক করছে। আমার মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। আমি সব ভুলে যাই।
স্যালাইনের পাইপ চুঁইয়ে চুঁইয়ে জীবনের সার প্রবেশ করছে মায়ের শরীরে। নরম কোমল পাঁপড়ি মেলে মায়ের চোখ দেখছে পৃথিবীর মুখ। আর অন্য দিকে , অন্য একটা ঘরে ধলার টানা টানা চোখদুটো বুঁজে আসছে। কসাইখানার দূর্গন্ধের ভেতর থেকে ধলার শেষ নিশ্বাস হাসপাতালের বেঞ্চে বসে থাকা খোকার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দেয়। হাসপাতালের সমস্ত রোগীদের চিৎকার ছাপিয়ে খোকার কানে কানে ধলা যেন বলে যায়, খোকা, আমিতো তোমার ভাই ছিলাম .......................
অমাবস্যা
২৪ জুন, ২০০৯
মন্তব্য
বাহ্! দারুন লিখেছেন আপনি। একজন ভালো গল্পকার!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চমৎকার লিখেছেন। আরো লেখার প্রত্যাশায় থাকলাম।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
প্রাঞ্জল বর্ণনায় সাধারন ঘটনার অসাধারন বর্ণন। খুবই ভাল লিখেছেন ভাই।
খুব, খুব ভাল হইছে লেখাটা !! কয়েক বার পড়লাম, এখন আমার মন খারপ লাগছে !
লেখার প্রাণ হচ্ছে পাঠক। যখন কোন লেখা অন্তত: একজন পাঠকের হৃদয়কেও স্পর্শ করে লেখকের পরিশ্রম সার্থক হয়। মূল্যবান মন্তব্যের জন্য সবাইকেই ধন্যবাদ। যারা পড়েছেন, যারা পড়ছেন, যারা পড়বেন তাদের সবার জন্যই শুভকামনা।
অমাবস্যা
২৫ জুন ২০০৯
চমতকার লাগলো পড়ে
নিয়মিত লিখুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন