অভিমান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৬/০৭/২০০৯ - ৪:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঝড় যেমন হঠাৎ এসে সব এলোমেলো করে আবার হঠাৎ মিলিয়ে যায়, কোথাও তার খোঁজ মেলেনা, তেমনি হঠাৎ নীলু মিলিয়ে গিয়েছে। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। হয়তো নীলু আশেপাশেই আছে, ঝড় যেমন বাতাস হয়ে থাকে, চেনা যায়না, তেমনি নীলুকে বহুকাল খুঁজে পাচ্ছিনা। এর আগেও একবার নীলু হারিয়ে গিয়েছিলো, নীলু মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়, হয়তো বারবার হারিয়ে যাবে, কেন যায় কিংবা যাবে আমি জানিনা। নীলু কি জানে? নীলু অবশ্য বলে আমিতো ফিরে এসেছি। ঠিক, নীলু ঝড় শেষে ফিরে এসেছে। কিন্তু রাতের সেই ঝিরিঝিরি বাতাসের নীলুকে আমি কোথাও পাবোনা। নীলু বলে ফিরে আসাটাই বড়কথা। আমি বলি না। যতোবার ঝড় আসে আমার সবুজ বাগানটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পৃথিবীর কোন সবুজ একই ঝড়ে দু’বার দোলেনা। যখন নীলু ফিরে আসে আমার বাগান তখন এক চিলতে নিকোনো জমি। আমি আবার সবুজ ফলাই। মাত্র ছয় মাস হয়েছে। সবুজগুলো পাতায় রোদ মেখে মিটিমিটি চাইছে। এবার বসন্তেই ফুলে সেজে উঠবে। তখনই ঝড়ো বাতাসটা আবার আসে। সব এলোমেলো। গাছগুলো পড়ে যায়, ভেঙে যায়, রোদে শুকিয়ে যায়, অন্য বাতাসে উড়ে যায় দূরে। এভাবেই শেষ হয়ে যায় বসন্ত । তখন আবারও সেই হাওয়ার দেখা মেলে। চেনা গন্ধে বুঝতে পারি, এই হাওয়াটাই ঝড় হয়েছিলো। এভাবে নীলু বারবার ফিরে আসে। বারবার হারিয়ে যায়।

আমি তখন স্কুলে পরি। সাহেব বাজার থেকে একটা রোদ চশমা কিনি খুব শখ করে। দিনে কতোবার যে মুছতাম চশমার সবুজ কাঁচ! পৃথিবীটা সেই কাঁচের মতোই সুন্দর আমার কাছে। রাতে মাথার কাছে চশমা রাখি, পড়ার সময় বইয়ের পাশে, স্কুলে ব্যাগের ভেতর, ক্লাসের ফাঁকে সবার চোখ এড়িয়ে মাঝে মাঝেই ব্যাগ খুলে দেখে নিই চশমা ঠিক আছে কিনা। একদিন খুব ঝড়। ঘরের জানালায় চোখ রাখি। দেখি বাইরে ভীষন ধুলো। আমি চোখে চশমা লাগাই। ধুলোগুলো সবুজ হয়ে যায়, আর আমার এতো ভালোলাগে...। দেখি বাইরে ছেলেমেয়েরা হৈ হুল্লোর করছে। আমার বাড়ির সামনের মাঠটায় তখন তিনটে আমগাছ ছিলো। ঝড় এলেই টুপটাপ আম পড়তো। তখন বুঝিনি গাছ অনেক যতেœ যে ফল ফলায় তা বীজে পরিনত হবার আগেই ঝড় এসে ঝরিয়ে যায়। গাছের তলায় দারুন উৎসব, ঝড় তখন মহানায়কের ভূমিকায়। কেবল গাছটি কাঁদে। আমি এসব ঐ বয়সে কিভাবে বুঝবো? আমি ঝড়ে বেরিয়ে পরি। কী দারুণ বাতাস। আমি নিজেকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে চেষ্টা করি। এতো ভালোলাগার মাঝেও খেয়াল রাখি চশমা যেন বাতাসে উড়ে না যায়। আমি আম কুড়াই মাত্র একটা। একটা ন্যাংটো ছেলে সেটা দেখে আমাকে দুটি আম দেয়। আমি তার বদলে ছেলেটিকে আমার রঙিন চশমা দুই মিনিটের জন্য পরতে দিই। ছেলেটি খুশি হয়। বৃষ্টি নেমে পড়ে। আমি বৃষ্টিতে ভিজি। ছেলেটার কাছ থেকে ঝিনুকের চাকু নিয়ে আমি আম কেটে খাই। রেল লাইনের পিছলা স্লিপারে হেঁটে বেড়াই। ওরা কেউ আমাকে পড়ে যেতে দেয়না। আমি ঠিকভাবেই বাড়ি ফিরে আসি। সন্ধ্যায় পড়তে বসার সময় আমি আর চশমাটা খুঁজে পাইনা। ফেরার সময়ওতো সাথেই ছিলো... আমি তো এতো অসাবধান নই। কোথায় গেলো সবুজ চশমা? সবুজ চশমার কষ্টটা এখনো আমার বুকের ভেতর টিকটিক করে বাজে। কিন্তু আমি আর কখনো চশমা কিনিনি। পাবার আনন্দের চাইতে হারাবার কষ্ট অনেক বেশী। যা হারিয়ে যায়, তা পাবার জন্য আমার ভেতর কোনো ইচ্ছা কাজ করেনা।

নীলু বলে ওর প্রেমিকের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে। আমি চাইনা। নীলুর মতো তাকে নিয়ে আমার ভেতর কোনো সুক্ষè অনুভূতি জাগবেনা। নীলুর হয়তো এখনো ওকে ভালোলাগে। সেকারণেই হয়তো আমার ভালোলাগবেনা। বরং নীলু যার কাছে ঝড় হয়ে উড়ে গিয়েছিলো তাকে দেখে আমার সবুজ বাগানের কথা মনে পড়বে। হয়তো আমি হাসিমুখে তাকে বলবো চলুন চা খাই। কিন্তু তার চোখে প্রাপ্তির আনন্দটা আমাকে যন্ত্রনা দেবে। নীলু এসব বোঝেনা। ভাবে, সেতো এখন ঝড় নেই। কিন্তু আমার সবুজ বাগানটা আমি চাইলেও আর ফিরে পাবোনা। নীলু ফিরে এলে সেই বাগানে আমাকে অন্য বীজ বুঁনতে হবে। আমি ফলবান কোনো বীজ খুঁজে পাইনা, যা আরো একটি ঝড়ের জন্য যথেষ্ট।

শেষবার নীলু যখন হারিয়ে গেলো সময়টা আমার বেশ মনে আছে। ক’দিন থেকেই রাতের ডাকে চিঠি আসতোনা। মেঘ পিয়নের অনিয়ম আমাকে বলে দেয়, ঝড়ের মৌসুম আসছে। একদিন বীজ্রের ধারে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নীলু ঝড় হয়ে উড়ে গেলো। সেই দমকায় আমিও গেলাম ছিটকে। আমার বাগানের মতো আমিও ভীষন এলোমেলো হয়ে গেলাম। অগোছালো কিছু নীলু একদম ভালোবাসেনা। নীলুর কাজের লোক আছে। ঘর এলোমেলো করলেও সে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেলে। নীলু কি জানতো না অগোছালো আমাকে গুছিয়ে দেবার কেউ নেই। আমাকে গুছিয়ে দেবে, নীলু? আমি প্রতিরাতে পাশ বালিশে শুয়ে ভাবি এসব কথা। যেদিন নীলু ঝড় হবে, সেদিন তার কথায় এতো মেঘ জমেছিলো...হয়তো একটু নাড়া দিলেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তো। আমি প্রচন্ড কষ্টেও কিছু বলিনি। নীলু আমাকে অনেক যুক্তিহীন কিছু বুঝাতে চেষ্টা করেছে। আমি বুঝিনি। আমার ভেতর অনুভূতিগুলো হিংস্র সিংহের মতো কেশর ফুলিয়েছে। নীলুও বোঝেনি। কেউ কাউকে ভালোবাসতেই পারে। নীলুও পারে। কিন্তু নীলু যখন নিজেকে মিথ্যে বলে, আমাকে মিথ্যে বলে, আমি নীলুকে হারিয়ে ফেলি। চেনা নীলুটিকে আমার অচেনা মনে হয়। মনে হয় নীলুকে কি আমি শুরুতেই ভুল বুঝেছিলাম? আমার কাছেও কি নীলু ঝড় হয়ে এসেছিলো? ঝড় থেমে গেলে নীলু আমাকে বন্ধু ভাবে। বলতে চায় সবকিছু। কেন? নীলু সব বলে ফেললেই কি আমার ঘটনাটা স্বাভাবিক মনে হবে? আমি কি শাহবাগের মোড়ে গিয়ে ছেলেটির জন্য মালা কিনে আনবো? আর নীলুকে কি প্রমাণ করতেই হবে ব্যপারটা কতোটা স্বাভাবিক? সবতো জানে নীলু। নীলু গান শোনে। গানের কথাগুলো কার কথা ভেবে ভালোলাগে? কাকে শোনাতে চায় গান? নীলুর সবকিছুতেই আমি ঝড়ের আভাস পাই। আসলে এখন আমি এমনিতেই ঝড়ের আভাস পাই সবকিছুতে।

নীলুর কেনো ভালোলাগে ঐ ছেলেটিকে? হয়তো নীলুকে সে ঝড় করতে পেরেছিলো ভেবে। ঠিক, ঝড় করতে পেরেছিলো, রাতের ঝিরিঝিরি বাতাস ভেবে নীলুকে ভালোবাসতে পারেনি। তবেতো নীলু বদলে গেছে। সহজে বদলে যায়। এতো সহজ নীলুর জন্য আমি কেমন বাগান সাজাই? সামনেই ছেলেটির বিয়ে। নীলু বলেছে সে কথা। নীলুর ভালোলাগবেনা কিনা আমি জানিনা। ছেলেটার একটা কিশোরী বন্ধু ছিলো। তার জন্য কি নীলুর কষ্ট হতো? নীলু কি আক্ষেপে বলেছিলো, যদি মেয়েটির কথা ভাবো তবে আমার চিঠি পাবেনা, আর ফিরিয়ে দিও ছবিগুলো? বলেছিলো, তুমি আর কাউকে ভালোবাসবেনা? বলেছিলো, আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি? নীলু কিভাবে বলেছিলো, এবার তাকে ফিরতে হবে? নীলু কি সত্যিই ফিরতে পেরেছে? আমার নিকোনো উঠোনে শুধু আগাছা। তার মাঝেই দেখি একটি ফুল ফুটে রয়েছে। নীলুর জন্য বাগান করতে গেলে ফুলটাকে খুন করতে হবে। আমি এর ভেতর ভালোবেসে ফুলটার নাম দিয়েছি অভিমান।

আশরাফুল আলম রাসেল
(চন্দ্রবিন্দু)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো...

(জয়িতা)

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

গল্প পড়তে পড়তে আমি দেখলাম এক সদ্য কৈশোর পেরুনো এক বালককে, যে প্রিয় মানুষটিকে (বালিকা-ই হবে আসলে চোখ টিপি ) অন্য ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে গাল ফুলিয়ে অভিমানে বসে থাকে। আর ভাবে ওই সাথে আড়ি, কথা বলবো না ইহজনমে। এই সময়ের অভিমানগুলো আসলে এমনই। সেইসব অভিমানগুলো ভালোই এসেছে গল্প-ব্লগে।

অতিথি লেখক এর ছবি

পান্থ গল্পটা আসলেও সদ্য কৈশরে পা দেয়া এক যুবককে নিয়ে। ভাবনার জায়গাটা আপনি যেভাবে ভেবেছেন সেরকমই। ভালোলেগেছে জেনে ভালোলাগলো।

আশরাফুল আলম রাসেল

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো চলুক

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

এসব গল্প পড়লে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়; কেন তা বলবো না।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে কৈশরের সবকিছুই বোধহয় এরকম। ভাবতে গেলেও বুকের ভেতর ব্যাথা অনুভূত হয়।

আশরাফুল আলম রাসেল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এইসব অনুভূতি, অকারণ অভিমান সবই কেমন যেন অদ্ভুত, অবুঝ...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রানা মেহের এর ছবি

সুন্দরতো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যি ভালোলাগে যখন কেউ পড়েন। আরো ভালোলাগে যখন মন্তব্যগুলো দেখি। আরো ভালো লেখার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ সবাইকে।

আশরাফুল আলম রাসেল

shegufta এর ছবি

khub valo.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।