সাদামাটা ভাবে এবং মোটাদাগে পণ্য তৈরীর পরিকল্পনায় (প্রডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট) দুটি ধারা দেখা যায়। প্রথমটিতে ভোক্তার বা সর্বিক চাহিদার ভিত্তিতে পণ্য তৈরীর পরিকল্পনা করা হয় এবং দ্বিতীয়টিতে প্রথমে পণ্যের কন্সেপ্ট তৈরী করা হয় এবং পরে চাহিদা তৈরী করা হয়। তা এই দ্বিতীয় ধারায় বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সাফল্য আছে যা আমাকে সবসময়ই আলোড়িতো করে।
আমার এখনো মনে আছে ছোটোবেলায় বন্ধুদের আড্ডায় এই খবরে আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম যে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশে জ্বালানি তেল থেকে বিশুদ্ধ পানির দাম বেশী। তার কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে প্রথম মিনারেল ওয়াটার ছাড়া হয়। স্মৃতি যদি প্রতারনা না করে, প্রথম দিকে এক লিটার পানির দাম এক লিটার জ্বালানি তেল থেকে বেশী ছিল – এই বাংলাদেশে, আক্ষরিক অর্থে। তখনকার দিনে এক লিটার পানি ২০ টাকায় বিক্রী হয়েছে আমাদের এই নদীমাতৃক বাংলাদেশে। তারপর সব ইতিহাস - মিনারেল ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রীর দিকে চেয়ে দেখুন। মাস ছয়েক আগে একজন প্রবীণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আড্ডার ছলে আমাকে বলেছিল যে আশির দশকে একটি বিদেশী ‘সিকিওরিটি এজেন্সির’ প্রতিনিধি উনার সাথে দেখা করে বাংলাদেশে ‘সিকিওরিটি এজেন্সির’ ভবিষ্যত নিয়ে জানতে চেয়েছিল। তিনি ডিস্কারেজ করেছিলেন এই যুক্তিতে যে বাংলাদেশে প্রচুর বেকার আছে যারা এই কাজ করতে পারবে এবং ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে আমরা ‘চৌকিদার’ রাখতেই আগ্রহী। বর্তমান সিকিওরিটি এজেন্সি ইন্ডাস্ট্রীর দিকে চেয়ে তিনি স্বীকার করলেন উনার ভবিষ্যতবাণী কতটুকু ভুল ছিল। তারপর আছে ‘হালাল সাবানের’ কন্সেপ্ট। সাবান বিক্রীর বাজার তছনছ করে দিয়েছিল এই কন্সেপ্ট। উনারা ছিলেন দ্বিতীয় ধারায় পাইওনিয়ার।
তারপর আছে দ্বিতীয় ধারায় ‘কিছুটা অন্যরকম’ পণ্যসামগ্রী। ভায়েগ্রা, তার বিভিন্ন দেশীয় ভার্ষান থেকে শুরু করে ‘ফর্সা-ত্বকই সমষ্যার একমাত্র সমাধান’ জাতীয় পণ্যসামগ্রী। এখন তো আবাব ছেলেদের ‘সমষ্যার একমাত্র সমাধানের’ জন্য আলাদা পণ্য বাজারজাত করা হয়েছে। এত গেল কর্পোরেটের ম্যানেজমেন্টের-থিওরী গুলে খাওয়া লোকজনের ব্যাপার স্যাপার। ‘পুরুষত্বর’ পুঁজিকে সফলভাবে দেশজ উপায়ে ব্যবহার করে সারা দেশে দ্বিতীয় ধারায় যে বিরাট ইন্ডাস্ট্রী গড়ে উঠেছিল বা এখনো আছে তার একটা ধারনা পেয়েছিলাম নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে। কী সেই ইন্ডাস্ট্রী? কিছু ‘কী-ওয়ার্ড’ ব্যবহার করি – যা দিয়ে সুস্থ/স্বাভাবিক মানুষজনকে প্রায় অসুস্থ বানিয়ে ছাড়া হয় – ‘অতি-ছোটো’, ‘তরল-ঘন’, ‘আগা-গোড়া-মোটা-চিকন’, ‘ব্যর্থ’, ‘দ্রুত’, ‘গোপন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় এক যুগ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন এক ‘ম্যানেজমেন্টের’ উপর একটি রিপোর্ট তৈরীর সময় একজন বন্ধুকে মজা করে বলেছিলাম এই সফল ব্যবসার উপর একটা চ্যাপ্টার ঢুকালে কি হয় এবং কী ভাবে ‘উপাত্ত’ সংগ্রহ করা যায়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রিপোর্টে এ ধরনের চ্যাপ্টার ঢুকানো অসম্ভব। বন্ধুবর ঠিকই কিছু ‘উপাত্ত’ সংগ্রহ করেছিল। দুইভাবে ‘উপাত্ত’ সংগ্রহ হয়েছিল – গ্রামাঞ্চলে এবং শহরতলীতে মানুষ কতটা প্রভাবিত হয়েছে তার ‘সেকন্ডারী’ কিছু উপাত্ত এবং কিছু ‘জনপ্রিয়’ সাপ্তাহিকী বা মাসিকের ‘সমষ্যা-সমাধানের’ বিশ্লেষন। সেইসব ‘জনপ্রিয়’ সাপ্তাহিকী বা মাসিকে ‘ডাক্তার ছায়েব, ছালাম নিবেন’ জাতীয় কিছু ‘সমষ্যা’ থাকত এবং ‘ডাক্তার ছায়েবেরা’ এসবের ‘সমাধান’ দিতেন। ‘সমষ্যা’ গুলো একত্র করে একজন ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল – এবং বেশীর ভাগই কোন সমষ্যাই না। প্রভাবের সেকন্ডারী উপাত্তও ছিল রীতিমত ভয়ানক। কিন্তু কী ব্যবসা সফল একটা ইন্ডাস্ট্রী? এবং বিরাট এক সফল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। প্রবাসী সেই বন্ধু অবশ্য বলেছে বিভিন্ন দেশে ‘ওভার-দ্য-কাউন্টার’ ঔষধ দেখে সে বুঝতে পেরেছে এই কন্সেপ্ট বিদেশেও রপ্তানী হয়েছে।
তা প্রথম ধারায়, মানে যেখানে ভোক্তার বা সর্বিক চাহিদার ভিত্তিতে পণ্য তৈরীর পরিকল্পনা করা হয়, সে ধারায় আমাদের তিনটি অবাস্তবায়িত ব্যবসা প্রস্তাবনাসমুহ নিয়ে আলোচনা করা যায়। কন্সেপ্টগুলির যিনি রূপরেখা দিয়েছিলেন – তিনিও প্রবাসী (যুক্তরাজ্য ছেড়ে এখন কানাডায়, দ্রুতই নাকি বাংলাদেশে ফিরে আসবে)। অতি কাছের পরিচিত জনদের সাথে আলোচনায় প্রস্তাবগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। (এখানে নিম্নগামী দৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্লেষন বাদ দিলাম – ভাল কাজে বাধা আসেই। আমাদের পরিচিত একজন ডি,এইচ,এলে যোগ দেওয়ায় কঠোর সমালোচনা শুনতে হয়েছিল – শেষ পর্যন্ত কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানীতে!!)। প্রস্তাবনাসমুহ ভাগগুলো - ১। বাহ্! বেশ ভালই তো। ২। মস্তিষ্কের সুস্থতা প্রশ্নাতীত নয়। ৩। পাগলের প্রলাপ। আজ এক যুগ পরেও পরিকল্পনা গুলি কেউ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করল না। কেউ কথা রাখল না।
১। বাহ্! বেশ ভালই তো – ধানমন্ডীতে ৫০০০/৬০০০ স্কোয়ার ফিটের একটা ‘ডিপারটমেন্টাল ষ্টোর’ টাইপ দোকান হবে ।(তখনো ডিপারটমেন্টাল ষ্টোর আসে নাই।) শধুমাত্র বাচ্চাদের জিনিসপত্র থাকবে। অনেক গুলো সেকশান থাকবে। ২য় সেকশান শুরু হবে ‘০-১ বছর’ নামে – জন্মের পর থেকে ১ বছর বাচ্চাদের জন্য সবরকম পণ্য থাকবে। এভাবে ৩য় সেকশান ১-৩ বছরের বাচ্চাদের জন্য সবরকম পণ্য থাকবে। এভাবে চলবে ১০ বছর পর্যন্ত। ১ম সেকশান ‘-১ থেকে ০’ – প্রাক-মাতৃকালীন পণ্য। জন্মের আগ থেকে ভোক্তাকে আকর্ষন করা।
২। মস্তিষ্কের সুস্থতা প্রশ্নাতীত নয়- গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ভবিষ্যতে বাসায় কাজের লোকের সমষ্যা হবে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান হবে যেখানে ‘বাসার কাজের লোকের’ প্রাথমিক প্রশিক্ষন দেওয়া হবে, প্রয়োজনীয় উপাত্ত রেখে ‘ডেটাবেজ’ তৈরী করা হবে। ‘সিকিওরিটি’ দেওয়া হবে উভয় পক্ষকে - কাজের লোকের এবং যে বাসায় যাবে তার মালিককে। সঠিক ম্যাচিং করা হবে। বিভিন্ন ক্যাটাগরী থাকবে – সাধারন কাজের লোক থেকে ‘গভর্নেন্স’ পর্যন্ত । সার্বিক ভাবে প্রফেশনালিজম আনা হবে।
৩। পাগলের প্রলাপ- এই কন্সেপ্টটাতে ভাল ফিলসোফী ছিল। প্রথমত কিছুটা ‘শ্রমঘন’ তারপর ঐতিহ্যবাহী পেশাজীবিদের পেশাকে সম্মুন্নত রাখার একটা প্রয়াস। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম প্রাইভেট সেক্টার ব্যাংকের দ্রুত বৃ্দ্ধির প্রেক্ষিতে এবং কর্পো্রেট সেক্টারে চকচকে জুতার চাহিদা বাড়তেই থাকবে। কিন্তু জুতা পালিশ একটা সমষ্যা। (তখনো বাটা বা এপেক্সের জুতা পালিশ বাজারে আসেনি।) ধানমন্ডীতে আধুনিক গ্রাহক সেবক/সেবিকা সমেত ঝাঁ চকচকে একটা দোকান থাকবে। আফিসে যাওয়ার সময় লোকজন জুতা রেখে রশিদ নিয়ে চলে যাবে। পিছনে ‘ব্যাক-অফিসে’ একদল অভিজ্ঞ আদি এবং আকৃ্ত্রিম মুচী ‘অনেকটা আধুনিক পরিবেশে’ কাজ করে যাবে। আধুনিক সরঞ্জামাদি অফিস থেকে দেওয়া হবে। জুতা-প্রতি কমিশন।---
হল না। হাজারো অবাস্তবায়িত প্রস্তাবনার মধে্য্য হারিয়ে গেল। আচ্ছা, দ্বিতীয় ধারা, মানে প্রথমে পণ্যের কন্সেপ্ট তৈরী করা এবং পরে চাহিদা তৈরী করা, এ নিয়ে কোন কন্সেপ্ট ছিল? মনে পড়ে না। তবে আমার ‘উপাত্ত’ সংগ্রহকারী বন্ধু, যে কিনা সোশাল মার্কেটিং কোম্পানীর উপর বিশাল এক রিপোর্ট করেছিল, কথা দিয়েছিল অস্ট্রেলীয়াতে স্থায়ী হয়ে একটা বই লিখবে – “কন্ট্রাশেপ্সন – বিয়ের আগে ও পরে”। কথা রাখেনি।
সুমন সবুজের কাছে
মন্তব্য
লেখাটার ফোকাস আর শিরোনাম কিছুটা হারিয়া যাচ্ছিল পড়ার সময়। মজার বিষয় বলতে হবে। আরো উপকরন থাকলে একটা সিরিজ নামিয়ে দিয়েন।
ধন্যবাদ। দ্রুত শেষ করার চেষ্টার জন্য এমন হয়েছে।
দ্বিতীয় ধারার বক্তব্যটা একটু অপরিস্কার ঠেকেছে। তবে 'ব্যাক অফিস' টার্ম এর অভিনব প্রয়োগের জন্য পাঁচতারা।
ধরুন হালাল সাবানের কন্সেপ্টটা । যেহেতু কন্সেপ্টটা ভোক্তারা জানত না, এর চাহিদার কোন প্রশ্ন ছিল না। কেউ আগে পণ্য তৈরী করেছে এবং পরে বিপননের মাধ্যমে চাহিদা তৈরী করেছে। কিন্তু সাধারন ক্ষেত্রে চাহিদার ভিত্তিতে পণ্য তৈরী করা হয়।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এইটুকু পড়ে মন্তব্য করতে অপারগ। "পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি"
ধন্যবাদ।
লেখার মাঝের অংশটা মাথার উপর দিয়া গেলো...
তয় শেষের অংশ পড়ে কিছুটা বুঝলাম আপনার আইডিয়া !!
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ভাইজান, কোন তাড়া ছিল নাকি? লেখা হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেল, যখন উপভোগ করতে শুরু করেছি, তখনই ধুম করে শেষ করে দিলেন। লেখাটা কিন্তু অসাধারণ হয়েছে, একটা জিনিষ খুব চোখে লাগল, মাইন্ড খাইয়েন না, সিরিয়াস সমস্যা আপনার "সমষ্যা" বানানে। আমি নিজেই বানানে দুর্বল, কিন্তু আমারো চোখে লাগল ভাই, তবে চালিয়ে যান, আশা করি শীঘ্রই পরের লেখা আসবে। তবে মাইন্ড যদি খাইয়াই যান, আমার লেখায় একগাদা গালি দিয়েন মনের সুখ মিটায়।
http://dsal.uchicago.edu/dictionaries/biswas-bengali/
এক সম্মানিত সচল আমাকে এই লিংক খানা দিয়েছিল, আমার তারপরেও কোন উন্নতি হয়নাই, যদি আপনার হয়।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
বানানে দুর্বলতার ব্যাপারে সচেতন। ঠিক করবার চেষ্টা করব। লিঙ্কটির এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আইডিয়া গুলা দারুন কোন সন্দেহ নাই। আপনার আইডিয়া গুলা অনেক পরিণতও বলা যায়। একেবারে কল্পনা বা পাগলের প্রলাপ বলা ঠিক হবে না । বিশেষ করে যে সময় আপনি বা আপনারা আইডিয়াগুলোর জন্ম দিয়েছেন।
.................................................................................................................
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। যদিও মজা করে লেখা , এক দশক আগের হিসাবে কন্সেপ্টগুলি ভালই ছিল।
নতুন মন্তব্য করুন