...... পানে হানি যুগল ভুরু

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২০/০৭/২০০৯ - ৬:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০০৭ সালের মার্চের এক সকাল। মেজাজ প্রচন্ড রকমের খারাপ হয়ে আছে। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে অলস চোখ চেয়ে আছি 'ব্যাংকক পোষ্টের' পাতায় - কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে ঢাকার পত্রিকা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে - অনেক কিছু ঘটছে ঢাকায়। বসে আছি ব্যাংককের 'সূবর্ণভুমি' বিমানবন্দরের ছোট একটা ক্যাফেতে - থাই এয়ারয়েজের বিমানে ঢাকায় যাব। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। বুঝতে বাকি নেই মন খারাপ করা একটি দিন শুরু হতে যাচ্ছে।

মন খারাপ করা অলস একটা সকাল। সামনে অচেনা ভাষার টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে। অলস ভাবে পত্রিকার উপর দিয়ে সামনের টেবিলে চোখ বুলালাম। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশের অল্প বয়সী এক রমণী - বসে আছে সম্ভবত পিতার সঙ্গে। শরীর ঢাকা বোরখায় - শুধু কাজল দেয়া টানা টানা চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি অবনত। আবার তাকাতেই হল। অপুর্ব এক জোড়া টানা টানা চোখ। কাজলের কারুকাজ? মাধুরী মেশানো আমার মনের আতিশয্য? বোরখায় ব্যাকগ্রাউন্ড কি কোন দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে? চোখ কি হাসতে পারে? মাঝে মাঝে চকিত চাহনী। আরে, এক জোড়া চোখ দেখে আমি আলোড়িত হচ্ছি কেন? চারিত্রিক...। আমার 'হাইপোথিসিস' দাড় করতে করতে সুনায়না উঠে দাড়ালো এবং চলে যেতে যেতে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে আবার ফিরে তাকাল। সেকি তার চোখের শক্তি সম্বন্ধে পুরো মাত্রায় সচেতন?

আরে - খেয়ালই করিনি। ঝলমলে রোদ উঠেছে বাইরে। সুন্দর একটা দিন। আচ্ছা সূবর্ণভুমি তো বাংলা একটা নাম - ঘটনা কী জানতে হবে ইন্টারনেটে। রাতে এমিরাটসে আবার দুবাই হয়ে যুক্তরাজ্য যাব। ভাল লাগছে। ঢাকায় তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সারাদিনের পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললাম। ঢাকায় গিয়ে কিছুক্ষন পত্রিকা পড়ব, কিছু বই কিনব আর টানা একটা ঘুম দিব। অফিশিয়াল কোন ই-মেইল চেক করব না আজ। আরও ঠিক করলাম - ভারী একটা ল্যাপটপ কাধে নিয়ে ট্রাভেল কারার কোন মানে নাই - সোয়েটারে মোড়ে ল্যাগেজে দিয়ে দেব। হ্যান্ড ব্যাগে থাকবে শুধু দুইটা বই - এবং কিছু ওষুধ। (শেভিং কিট ইত্যাদি বাদ- ১০০ মি.লি. লিকুইড ইত্যাদি নিয়ে বড় ঝামেলা করে) বিমান ল্যান্ড করার আগে বেল্ট, ঘড়ি, ওয়ালেট সব হ্যান্ড ব্যাগে রেখে দিব। দুবাই এবং যুক্তরাজ্যের আভ্যন্তরীন ফ্লাইটে সিকিওরিটি বড় যন্ত্রনা করে।

অফিসের কাজে যুক্তরাজ্য যাওয়া সুতরাং বিজনেস ক্লাশ। ঢাকায় সুন্দর একটা দিন কাটিয়ে বিমান ছাড়ার এক ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে রিপোর্ট করলাম। চেক-ইন করতে গিয়ে শুনলাম বিজনেস ক্লাশে মাত্র হাতে গোনা যাত্রী। একেতো শেষ মুহুর্তে চেক-ইন, তারপর সকালেই ব্যাংকক থেকে এসেছি শুনে ইমিগ্রেশনে যাবার আগে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন যখন আলাদা করে প্রশ্ন করল - তখন ভালই লাগল। ওয়ারলেসে 'পজেটিভ' বলায় আমি মনে করেছিলাম কোন সমস্যা আছে - ব্লাড টেষ্টের মত। কিন্তু ছেড়ে দিল - হতাশ হল কি? লাউঞ্জে গিয়ে আরেকটা ভাল(!) খবর পেলাম - 'ফ্লাইট ডিলে' হবে। তাড়া নাই - দুবাইতে 'কানেক্টিং ফ্লাইট' মিস করলে হোটেলে চলে যাব। কাল সকালে দুবাইতে এক একচক্কর মেরে তারপর যুক্তরাজ্য রওয়ানা দেয়া যাবে। শুভ লক্ষন।

যাই হোক, দু’ঘন্টারও বেশী লেটে যাত্রা করলাম দুবাই। অস্বাভাবিক রকমের ভীড় দুবাই বিমানবন্দরে পৌছে রুটিন রিপোর্ট করলাম নির্ধারিত গেটে। নির্ধারিত বিমান ছেড়ে চলে গেছে। নো প্রব্লেম। বিজনেস লাউঞ্জে এসে দেখি - 'নরক গুলজার'। চেয়ারে/সোফায় যায়গা নাই - কিছু কিছু লোক কার্পেটে বসে আছে অথবা ঘুমাচ্ছে। টয়লেটেও কিউ - ইউরেনালে ঘারের উপর একজন এসে দাড়াতেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই হাজীর বিরিয়ানীর লাইনের কথা মনে হল। খবর নিয়ে জানতে পারলাম বাংলাদেশ বিমানের এক এয়ারক্রাফট সকাল থেকে মুখ থুবড়ে রানওয়েতে পরে আছে। সব ফ্লাইট শেডিউল লন্ডভন্ড। হোটেল তো দুরের কথা - কখন পরবর্তী বিমানে উঠতে পারব বলা যাচ্ছে না। সবচেয়ে মেজাজ খারাপ করা ব্যাপার হল - 'কেউ সঠিক ভাবে কিছু জানে না'। এবং বিমানবন্দরের লোকজনকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

যাই হোক - বিভিন্ন কাউন্টারের বিশাল 'কিউ' তে দাড়াচ্ছি - যদি কোন একটা বিমানে সিট পাওয়া যায়। কিন্তু বেশীর ভাগ কাউন্টারে কোন লোকই নাই। একটা বিশাল লম্বা কিউর একদম পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে অশীতিপর এক দম্পতি দাঁড়িয়ে আছে। পারস্পরিক নির্ভরতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত - ভাল লাগল। স্বামী স্ত্রী মিলে দুবাই ভ্রমন শেষে যুক্তরাজ্য ফিরে যাচ্ছে। কাউন্টারের এখনো লোক আসে নাই। আড্ডাতে মজে গেলাম সুরসিক স্বামী-স্ত্রীর সাথে। কিউতে দাড়ানো আমাদের সামনে যেজন - চল্লিশ ছুই ছুই একজন মহিলা - আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়ালো - যোগ দিল আমাদের আড্ডায়। নিঃসন্ধেহে সুন্দরী, ফ্যাশন সচেতন এবং অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য সচেতন। তবে যেটা প্রথমই নজর কাড়ে .... ‍‍‍‍‍‍ "হচ্ছেটা কি আজকে"? গভীর নীল বড় বড় দুটি চোখ তার সাথে মাপা হাসির এক 'লেথাল কম্বিনেশন' প্রথমেই নজর কাড়ে। নো মোর চোখ বিজনেস। কথায় কথায় জানা গেল - সুনয়না সাউথ আফ্রিকাতে মডেল ছিল। এখন সেখানে নাম করা ফ্যাশন হাউজের কর্ণধার। যুক্তরাজ্য যাচ্ছে - ফর 'বিজনেস এন্ড প্ল্যাজার'।

আমাদের চার জনের দলটি (!) চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন কিউতে - কিন্তু কোন কিউই যেন এগুচ্ছে না। অবশেষে 'সিনিয়র সিটিজেন' হিসাবে সেই রসিক দম্পতি এক জোড়া টিকিট পেল - রইল বাকী দুই। আরেকটা কিউতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন - সামনে আরো দুই জোড়া দম্পতি বা হোয়াটএভার (এই ইংরেজী শব্দটিই আদর্শ মনে হল।)। প্রথম দম্পতি কিছুক্ষন তর্ক করে হতাশ হয়ে চলে গেল। কাউন্টারে বসা ব্যাক্তির সঙ্গে আমাদের সামনের দম্পতির কথপোকথন শুনতে চেষ্টা করলাম। যাত্রী ভদ্রলোক রাগের চোটে কাউন্টারে আঙ্গুল ঠোকে বললেন, 'টিকিট না থাকলে আমাকে হোটেলে পাঠাতে তুমি বাধ্য, অথবা আমি অভিযোগ করব'। পাঠরত পত্রিকার থেকে মুখ না তুলেই কাউন্টারে বসা দুর্বিনীত যুবক বলল - 'আই ডোন্ট কেয়ার'। ভদ্রলোক - 'আই অ্যাম ফ্লাইং অন আ ফা.... বিজনেস ক্লাশ'। যুবক - 'আই ডোন্ট গিভ আ ফা....'। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আমি। গট গট করে ভদ্রলোক রওয়ানা হলেন - সম্ভবত অভিযোগ করতে - কিন্তু কাকে?

ফিরে তাকালেন আমার সামনে দাঁড়ানো সুনয়না।
বাললাম - চলনা অন্য কোথাও যাই।
চোখ টিপে নয়না বলল 'লেটস ট্রাই'।

অপ্রতিরোধ্য দৃষ্টি হেনে মধুর হাসি দিয়ে কথা শুরু করল সুনয়না, হাসাহাসি হল এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম টিকিট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দুর্বিনীত যুবকের চেহারার পরিবর্তন হল যখন আমাকে সামনে এগিয়ে দেওয়া হল। আমি আকর্ণ-বিস্তৃত হাসি নিয়ে সামনে দাড়ালাম। 'আমার সঙ্গে ভ্রমন করছে - এর টিকিট লাগবে'। টিকিটের অভাব বলায় সুনয়নার উত্তর - 'সেক্ষেত্রে আমার যাওয়া হবে না'। সমস্যা আরো দেখা দিল যখন 'সবুজ পাসপোর্ট' বাড়িয়ে দিলাম। 'বাট, হি ইজ ট্র্যাভেলিং ফ্রম বাংলাদেশ। হু ইজ হি'। 'মাই পার্টনার' - ছোট উত্তর সুনয়নার। (সকলে ঘুম থেকে উঠে কার মুখ দেখেছি আজ? বেল বয়, হোটেল রিসেপশনের মেয়েটা, নাকি ট্যাক্সি ড্রাইভার?) টিকিট পেয়ে গেলাম - এক ঘন্টা পর ফ্লাইট - ইকে ০০৭। দৃষ্টিতে ভষ্ম হওয়ার ব্যাপারটা থাকলে হয়ত সেদিন ভষ্ম হতাম সেই দুর্বিনীত যুবকের দৃষ্টিতে।

বিমানে উঠে বুঝতে পারলাম কাউন্টারে বসা সেই যুবক হয়ত শেষ প্রতিশোধ নিয়েছে - সুনয়না সবচেয়ে সামনের সারির ডানে। আমি বিজনেস ক্লাশের সবচেয়ে পিছনের সারির বায়ে। তবে খারাপ না - একঘন্টার মধ্যেই আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার পাশের 'ইংলিশ মহিলা' যেচে পরে আলাপ শুরু করল। টেনশন আচমকা কেটে গেলে মানুষ কথা বলা শুরু করে - তার প্রভাব?

ভাবছি এই যাত্রার সমাপ্তি একাধিক ভাবে হতে পারে আজ। আমি আজ গন্তব্যে না গিয়ে সুনয়নার সাথে লন্ডনে কিছুটা সময় কাটাতে পারি। অথবা সুবোধ বালকের মত বৃটিশ এয়ারওয়েজের আভ্যন্তরীন ফ্লাইটের 'হ্যাট এবং নীল জ্যাকেট' পরা, আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে অমার্জিত বিমানসেবিকা দ্বারা আপ্যায়িত হতে হতে গন্তব্যে যেতে পারি।

সুমন সবুজের কাছে।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

আপনি তো বোধহয় অতিথি সচল। নিজের নামে লগ-ইন করেই তো লিখতে পারবেন। অতিথি লেখকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের আর প্রয়োজন তো নেই।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

ফকির লালন এর ছবি

বাংলা ও থাই ভাষার উতস এক। রাজদরবারের পোশাকী ভাষায় প্রচুর শব্দ পাবেন যা বাংলাতে আছে। রাজার নামই দেখুন না - ভূমিবল। শ্রমন/ভিক্ষুরা ধর্মের সাথে ভাষাও নিয়ে গেছে অতীতে।

যদ্দুর জানি, সুবর্নভূমিতে আগে জলাশয় ছিলো আর সাথে সাপের উতপাত। বিমানবন্দর হবার আগে সে এলাকাকে জনগ্রহনযোগ্য করতে রাজা এই নতুন নাম দেন যাতে তার আগের অপবাদ কাটে। খুব একটা নিশ্চিত নই এ তথ্য নিয়ে, লেখায় ব্যবহার করতে চাইলে যাচাই করে নিয়েন।

নৈষাদ এর ছবি

তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। ফিরে আসার পরে জানতে পারলাম। নববর্ষ নিয়ে তাদের সাথে আমাদের মিলও বিস্ময়কর।

ধুসর গোধূলি (টেনশিত) এর ছবি

বস, আর যাই করেন, দোহাই লাগে আপনের পরের অংশটাও বর্ণনা করেন। সুনয়না, নীলনয়নার সাথে একটু সময় লণ্ডনে কাটান। বড়ই জানতে ইচ্ছা করতেছে। আজকে যে কী হইলো আমার! মন খারাপ

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ। থাক না কিছু বিষয় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।

স্বপ্নহারা এর ছবি

যদি বোরখা পড়াতেই হয়...তবে চোখেই পড়ানো উচিত...দেঁতো হাসি
-----------------------------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

নৈষাদ এর ছবি

...... কেন বঞ্চিত করতে চান?

স্পর্শ এর ছবি

বাহ্‌ সুন্দর লিখেছেন! ভালো লাগলো পড়ে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

"মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশের অল্প বয়সী এক রমণী - বসে আছে সম্ভবত পিতার সঙ্গে"

আমার সন্দেহ আছে। ব্যাংককে এই দৃশ্য বহুবার দেখেছি এয়ারপোর্টে-হোটেলে-রেস্টুরেন্টে-শপিং সেন্টারে-হাসপাতালে, একটু খোঁজ-খবর করলে দেখা যায় জেনানা লোক সাথের মরদ লোকের তৃতীয় বা চতুর্থ বিবি। তবে তাতে হতাশ হবার কিছু নেই। কেন হতাশ হবার কিছু নেই "সুমন সবুজের কাছে" যদি সেটা জানতে চান তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

জনগুরুত্বপূর্ন তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। কেন হতাশ হবার কিছু নেই সেটা জানতে চাই।

রানা মেহের এর ছবি

তোতাপান্ডবের অভিগ্গতায় অভিভূত হলাম হাসি

লেখা সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।