১০/৭/২০০৯
মাটির ঢাকনা সরালে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল থেকে ভাপ ওঠা ভাত ভাত গন্ধ ছড়ায়। ঝোলের সমুদ্রে মাংস খুঁজে পাওয়া ভার। ডালের হাঁড়ি পরিপূর্ণ, পাতলা- তবু অতোটা বিস্বাদ নয়। পলাশীর মোড় থেকে এগিয়ে এসে রিক্সা দাঁড় করায় আলম। পরিচিত খদ্দের সৌজন্য হাসির আভা ফুটিয়ে তোলে রুকির মুখে।
সূর্য তখন সবটুকু তেজ নিয়ে মধ্য আকাশে। পরিশ্রমকে দরকষাকষির পাল্লায় তুলে অনেকেই ছুটে আসে এই ফুটপাতের ধারে মধ্যাহ্ন আহারে। কোন ঘর, ঘরণী, এককোণে সাজানো ঘরের লক্ষী চুলো নেই। মূল্যের হিসেব কষে কেউ এখানেই বসে পড়ে চকচকে এক থাল ভাতের সামনে। নিয়মিত খদ্দেরদের চাওয়া একটু বেশি থাকে, কিছুটা আবদারও। দিনমজুর, রিক্সাচালক, ঠেলাওয়ালা, পাঁচমেশালী কাজে উপার্জনওয়ালা পুরুষ, খদ্দের সাধারণত এরাই। তরকারী আর ডালের দাম আলাদা, এক থাল ভাত দশ টাকা। নিয়মিত খদ্দের পাবে একটুকরো কাঁচামরিচ কিংবা পেঁয়াজ, যদি বাজার গরম না থাকে তবেই। কুড়িয়ে পাওয়া পত্রিকার হাতপাখায় রুকির হাতের সোহাগী বাতাস, বাড়তি পাওনা। ওটুকু রুকি নিজে থেকে করে, বড্ড মায়া হয় ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত পুরুষগুলোর জন্যে। কিংবা হয়ত কিছুটা সময় গিন্নী-গিন্নী খেলায় মেতে ওঠে ওর যৈবতী মন।
ফুটপাতের ওপর গণগণে আগুনের উত্তাপমাখা ইটের অস্থায়ী চুলো, হাড়ি-পাতিল, গুটিকতক পানির বোতল - সবই সংসারের সরঞ্জামাদি। কিন্তু এখানে কোন সংসার নেই। রোজদিন দুপুরের প্রারম্ভে পসরা সাজিয়ে বসতে হয় রুকিকে। বিকেলের লালচে আভায় আকাশের যখন লাজরাঙা রঙ তখনও পাওয়া যায় দু-তিনজন খরিদ্দার। এরপর সব গোছানোর পালা। প্রায়ই তখন মনে ভাসে মেয়েবেলার সংসার-সংসার খেলা।
যখন মনে হয় ছোট্ট শিশু-হাত জলরঙে আঁকা সূর্যকে লেপটে দিয়েছে আসমানের গায়ে, তখনই ছিল খেলা সাঙ্গ করার সময়। কখনও উঠোনে শিমের মাচানের পাশে, কখনও মাটির বারান্দায়, জমে উঠতো উচ্ছ্বল ক’টি কিশোরীর জমজমাট মিথ্যে ঘরকন্না।
সময়গুলো তখনকার যখন রুকি বনেদি কৃষক পিতার কন্যা, শহুরে তাচ্ছিল্যের ‘চাষার মাইয়্যা’ নয়। তখনও নদীর যৌবন বাঁধ ভেঙে ওদের জমিন আর উঠোন গিলে খায়নি। চিন্ চিনে ব্যাথায় বুক ভার হলে এককালের স্বপ্নভঙ্গ কোন্ এক অতল থেকে উঠে আসে। এই শহর অনেক দিয়েছে, অনেক নিয়েছে। শহরের ভাগাড়-বস্তিতে মাথা গোজার ঠাঁই দিয়েছে, বাপ মরলে এক গন্ডা ভাই-বোন আগলে রাখতে এই পথ দিয়েছে। এ শহর জোয়ান কৃষকের যৌবনরস চুষে নিয়েছিলো। বাপটা শহরে এসেই বুড়িয়ে গেল।
‘মাটির গন্ধ কই? চাষ নাই, ভিক্ষে করে খাই, এই দোযখে মাটির গন্ধ নাই।’-কোন হতভাগা কৃষকের নাকি ভিক্ষুকের আর্তচিৎকার রুকির ভেতরকে নাড়িয়ে দেয় আজও। মৃত্যুই সকল যন্ত্রণার নিষ্কৃতি -এতোটা ভাল করে বোঝা হয়নি আর কখনও।
একত্রিশের কোঠার আইবুড়ো মেয়েকে কাঁখে-পিঠে বাচ্চা ছাড়াই গ্রহণ করে এ শহর। তৃষ্ণা, গভীর তৃষ্ণা। প্রায়ই ছলকে ওঠে রুকি, বাঁকা হাসি, মাতাল চাহনি, উচ্ছ্বল খুনসুটি। ফুটপাতবাসী কিংবা বস্তিঘরের সংসারী যুবতীরা দেখে - বড় বেহায়াপনায় মেতেছে মেয়েটি।
বস্তির দূর্গন্ধে আতুড়ঘর সাজে কখনও, নবজাতকের চিৎকার জানায় - আরেকটি মুখের অন্ন যোগানোর পালা। রাতের অন্ধকারে খুপড়ি ঘরে রুকি তখন দেখে মুগ্ধ এক তরুণী মা, স্তনদানের স্বর্গীয় অনুভবে বিভোর।
ফুটপাতের খসখসে পাথুরে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বন্যার পুতুল পুতুল মেয়েটা প্রায়ই এগিয়ে আসে ওর দিকে। বুকে তুলে নিতেই খলবল করে ওঠে; হাত-পা ছুড়ে সে কী চাঞ্চল্য! রুকির সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে তখন নরম মাটিতে কুড়োল বসানোর যন্ত্রণা।
কিশোরকালে টলমলে নদীতে গা ভাসিয়ে ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার দিতে দিতে বহুদূর চলে যেতে পারতো। দিগন্ত ছোঁয়ার বড় ইচ্ছে হতো। আজ আবার সেই অবাধ মুক্তি খুঁজে ফেরে রুকি। খুপড়িতে পড়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত আতুড় মা, শৈশব-কৈশোরে খেলে বেড়ানো গন্ডাখানেক ভাই-বোনের মুখ ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট হতে থাকে। একটা বৃত্ত, একটা গন্ডি ডিঙিয়ে যাওয়ার সাধ প্রবল হয় ক্রমশ..........
--------------------------------------------------------------------
মন্তব্য
১। শাবাশ!
২। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটির পাশে ফুটপাত ঘেঁষে প্রতি সন্ধ্যায় বসে এমনই এক ভাত-তরকারি-চা-পাউরুটির 'ইটালিক রেস্তোঁরা। রিকশা ও রিকশা ভ্যান চালকরাই এর প্রধান ক্রেতা। সারারাত খোলা থাকে দোকানটি।
একসময় কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকায় দেখেছি, এরকম ফুটপাতের দোকানে দাঁড়ি-পাল্লায় ভাত বা বিরিয়ানি বিক্রি করতে। কিন্তু চালের বাজার চড়া বলে এখন বুঝি আর সেই চল নেই।...
৩। সচলে স্বাগতম; নিয়মিত লেখা অনুরোধ রইলো।
৪। কিন্তু হের নির্জলা অতিথি, আপনার নাম জানা হলো না!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
গল্প পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
দারুণ। খুব ভালো লাগলো। আপনার আরো অনেক লেখা পড়তে চাই।
ধন্যবাদ
আরে, আপনি না কবিতা লিখতেন? গল্পটা দারুণ হয়েছে।
জ্বী, কবিতাও লিখি।
ধন্যবাদ.....
লেখা চমৎকার হয়েছে, বাস্তবকে খুব সুন্দর দেখানো হয়েছে
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ধন্যবাদ
প্রিয় মউ,
রুকির না পাওয়ার কষ্ট আর বাস্তবের কঠিন সত্যকে যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো তা সত্যিই চমৎকার!!!!!আরো ভাল করো দোয়া রইল মামনি.
ধন্যবাদ আপনাকে
দারুন লাগল আপনার লেখাটা। আশা করি দেখা হবে আপনার অন্য কোন ভাল লেখায়
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ
চমৎকার। হাতের টান দেখেই দক্ষশিল্পী চিনে নেওয়া যায়।
অনেক শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্প পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা। কাব্যিকতা দেখা আমারও মনে হল, কবিতা লেখেন নাকি? আপনার দক্ষ হাতে বড় কোনো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ
জানি রবি ঠাকুর বলেছিলেন যে ছোটগল্প হবে "শেষ হয়ে হইলোনা শেষ।" কিন্তু এই লেখাটির ভিতরে আমি গল্পটা যে কি, তা বুঝতে পারিনি। গল্পের বর্ণনা খুবই ভালো, একদম চিত্রকরের নিপুণতায় ভরা। কিন্তু যদি বলি যে এই লেখাটির সারাংশ কি, তাহলে "একটি গ্রাম থেকে আসা মেয়ে ভাতের দোকান চালাচ্ছে এবং দিগন্তকে ছোঁয়ার কথা ভাবছে" ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। অনেক সময় অবশ্য একটি ভাবনাটিকেও গল্পের আকারে বর্ণনা করা যায়, কিন্তু সেটাও এখানে খুব একটা পাইনি।
আশাকরি আমার মন্তব্যকে পার্সোনালি নেবেন না। আপনার লেখার হাত ভালো।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ধন্যবাদ.....
অনেক ভালো লাগলো লেখার স্টাইল।
মৌ তুমি যে আকমল হোসেন নিপু'র সবগুলো বই পড়ছো এটাও প্রকাশ পায় তোমার গল্পের ভাষায়। দূর্দান্ত...
ধন্যবাদ তোমায়......
প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে এসেছেন, আপনার লেখা পড়লেই সেটা টের মিলে মউ।
দারুন লাগলো গল্পটা ।
কিন্তু আজ আবার সেই অবাধ মুক্তি খুঁজে ফেরে রুকি -এই রকম সিদ্বান্তধর্মী বাক্য, এতো বেশী উন্মোচনপ্রবণ হয়ে উঠে কখনো কখনো, গল্পের শক্ত ভিতটাকেই নাড়িয়ে দেয় ।
নিজের লেখা সন্তানতুল্য, সেই লেখাকে আরো কাঁটাছেড়া করতে দেখা কখনোই সুখকর নয়। কিন্তু এ এক পাঠকের গল্পপাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরে নেবেন এই মন্তব্যকে আশা করছি ।
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা লেখা নিয়ে আরও একবার ভেবে দেখবার প্রয়াস যোগায়।
গল্পটি আপনার দারুন লাগলো জেনে ভাল লাগছে।
ধন্যবাদ
ভাল লেগেছে। চমৎকার লেখা! আরো চাই...
-------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
ধন্যবাদ
ভার্সিতে থাকার সময় এসএম হলে যেতে যেতে কতদিন যে ভাত বিকিকিনি দেখেছি!
গল্প ভালো লাগলো।
আমারও প্রথম দৃশ্যটি চোখে পড়ে ঐ রাস্তাতেই । পরে অবশ্য আরও কয়েক জায়গায় দেখেছি।
ধন্যবাদ
একবার খেয়েছিলাম রাস্তার পাশে এভাবে, অনেক তৃপ্তি করে। দারুণ লাগল আপনার লেখাটা।
------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ধন্যবাদ
আপনার কবিতা পড়েছি আগে। ভালো লেগেছে। এবার গল্প পড়ে খুব ভালো লাগল। আরো লিখুন।
অতন্দ্র প্রহরী, আপনাকে ধন্যবাদ
কারওয়ান বাজার বা ঢাকা কলেজের সামনের ইটালিক হোটেলগুলো মনে পড়ে গেলো। আপনি দেখছি লেখায় আমার চেয়েও অনিয়মিত।
অনিয়মিত..... হুম......
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন