বৃদ্ধ স্বামী মরে গেছে কিশোরী স্ত্রীকে ধরে বেঁধে তার সাথে চিতায় শুইয়ে দেয়া হচ্ছে, কিংবা তরুণী স্ত্রী নিজেই স্বামীর মৃত্যূর পর সহমরণে যাচ্ছে এরকম ঘটনা আমরা ইতিহাস,গল্প-উপন্যাসে বিস্তর পড়েছি। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে, আরো সঠিক করে যদি বলি এই মাসেই - স্ত্রী’র সাথে স্বামী সহমরণে গেছেন, শুনলে কেমন লাগবে? এবং সে মরণ যদি প্রাকৃতিক নিয়মে না হয়ে দুজনেরই স্বেচ্ছায় হয়? অর্থাত আত্মঘাতী হন কোন যুগল!
এ যেন আরেক রূপকথার গল্প, নাকি অমরপ্রেমের আখ্যান বলবো? অর্ধশত বছরেরও বেশী বিবাহিত জীবন কাটিয়েও একে অন্যকে ছেড়ে একটি মূহুর্তের জন্যও একা থাকতে চাননি তারা “তোমায় নিয়েই বাঁচবো আমি তোমায় নিয়েই মরবো। পৃথিবীতে আমরা দুজন অমর কাব্য গড়বো” – তারা কি অমর হবার জন্যেই এভাবে মরলেন? মরলেন না বলে ‘নিজেদের মারলেন’ বললে সঠিক হবে। তারা মরবার জন্যে উড়ে গিয়েছিলেন ভিন্ন এক দেশে। অত্মহনন যেখানে আইনগতভাবে বৈধ। শেষ যাত্রায় নিজ পূত্র নিজ কন্যা সঙ্গ দিয়েছে জনক-জননীকে। তাদেরকে যুথবদ্ধ হয়ে জগত ত্যাগে সহযোগীতা করেছে সে দেশের একটি ক্লিনিক। (এদের সমন্ধে আলাদা করে বিশদ লিখেছি। পরে কখনো পোস্ট করবো)।
আমি যাদের কথা বলছি আপনাদের অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে তাদের কথা জেনে গেছেন। তারপরও যাদের চোখ এড়িয়ে গেছে তাদের জন্যে একটু বলি।
প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া ইংরেজরা বিয়ে-শাদি করে কদাচিত। তার উপর যাদের নিয়ে এ লেখা তাদের বিচরণ ছিলো সঙ্গীত আর নৃত্যের ধ্রুপদ আঙিনায়। তাদের এক একটি সৃস্টি- প্রেমের বিনির্মাণ। ভালোবেসেই তারা একে অন্যের হৃদয়ে বসতি গড়েছিলেন। তাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় তারা কাটিয়েছেন অপেরার আলোকিত মঞ্চে। দারাশ সাপের মতো দেহ ভেংঙে ভেঙে এক দেবী আঁধার ছিড়ে আলোতে আর্বিভূত হতেন, মঞ্চের এধার থেকে ওধারে প্রজাপতির মতো দেহবল্লরী নিয়ে উড়তেন, ভাসতেন শূণ্যে। আর তাই দেখে একজন সঙ্গীতের উপাসনা ভুলে, সিম্ফনীর সম্মোহন ভুলে মগ্ন হতেন সেই দেবীতে।
বিখ্যাত ব্রিটিশ কন্ডাক্টর–কম্পোজার স্যার এডোয়ার্ড টমাস ডাউন্স এবং লেডি জোয়ানা ডাউন্স ৫৫বছরের বিবাহিত জীবনে ছিলেন হংস-মিথুন। যৌথ জীবন শুরুর দিনটি থেকে মৃত্যূর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তারা একে অন্যকে জড়িয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। আর এই সুন্দর পৃথিবীকেও তাই বিদায় জানালেন একই সাথে – এক একটা ধ্রুপদ সৃস্টি শেষে সুর আর নৃত্যের যাদুতে মোহাবিষ্ট করে মঞ্চ থেকে যেভাবে অভ্যাগতদের শুভরাত্রি বলতেন – ঠিক সেইভাবে।
১৯২৪ সালের ১৭ জুন বার্মিংহামে জন্ম নেয়া এই ব্রিটিশ সঙ্গীত প্রতিভা তার পঁচাশি বছরের সৃস্টিশীল অথচ নিভৃতচারী জীবনে অসংখ্য অর্জন অর্কেস্ট্রার ঝংকারে ছড়িয়ে রেখে গেছেন। ও. বি. ই. এবং নাইটহুড সম্মানে ভূষিত স্যার এডোয়ার্ড ডাউন্স ব্রিটেনের রয়্যাল অপেরার সাথে যুক্ত ছিলেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় ধরে, আর এই অর্ধ শতাব্দী জুড়ে তিনি কন্ডাক্ট করেছেন ৪৯টি অপেরার ৯৫০টি শো। “টিইডি” নামেই তার পরিচিতি ছিলো অধিক। কভেন্ট গার্ডেন অপেরার সাথে যুক্ত ছিলেন প্রায় সতেরো বছর, বিবিসি’র পিলারোমনিক সার্ভিসের প্রিন্সিপাল কন্ডাক্টর হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউসেও তার হাতের ইশারায় সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়েছে অসংখ্যবার। কাজ করেছেন আরো বহু অপেরা কোম্পানী, বহু সংস্থার সাথে। ইতালীয়ান এবং রাশান সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল বোদ্ধা মহলে।
অন্যদিকে লেডি জোয়ানা, চুয়াত্তর বছরের জীবনে একজন ব্যালেরিনা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে পর্যায়ক্রমে কোরিওগ্রাফার এবং পরবর্তীতে টিভি প্রডিউসর হিসেবে কাজ করেছেন বিলেতের বিভিন্ন অপেরা এবং টেলিভিশনে।
স্যার এডোয়ার্ড ডাউন্স জীবন প্রান্তিকে এসে দুনিয়ার রং ও ধ্বনি থেকে বঞ্চিত হয়ে ছিলেন অনেকদিন। দৃষ্টি এবং শ্রবণ শক্তি হারিয়ে অনেকটাই অথর্ব হয়ে গিয়েছিলেন। অবসরের অলস দিনগুলোতে সর্বদাই তাকে আগলে রেখেছেন তার আত্মার আত্মীয়া জোয়ানা। কিন্তু হায় নিয়তি! সেই জোয়ানাই আক্রান্ত হলেন দূরারোগ্য ক্যান্সারে। স্ত্রীর পলে পলে মৃত্যূর দিকে এগিয়ে যাওয়া -কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না টিইডি। জোয়ানাও মহাপ্রস্থানে স্বামীকে একা রেখে যেতে চাননি। তাই বলে এমন না যে তারা মৃত্যূর দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছিলেন। তারা হয়তো আরো কিছুকাল বেঁচে থাকতেন, উপভোগ করতেন ভালোবাসার পরন্ত রোদের উষ্ণতা-কোমলতা। কিন্ত জরাক্রান্ত জীবন তারা চাননি। তাই দুইজনে মিলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন- মরতে হয় একই সাথে মরবো।
১৪/০৭/০৯ তাদের বর্নাঢ্য জীবনকে পিছে ফেলে এরা বিদায় জানালেন পৃথিবীকে। জুরিখের একটি ক্লিনিকে হেমলক পান করে একসাথে চিরনিদ্রায় শুয়ে পরলেন দুজনে। না ভাঙ্গা সে ঘুম ব্যথিত-শোকাহত-অশ্রুশিক্ত করেছে অগণিত ভক্ত মানুষকে। ব্রিটিশ মিডিয়ায় প্রচারিত-প্রকাশিত হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ আহা উহু করে আফসোস করেছে- কেউ করেছে কড়া সমালোচনা। সেই সংস্থাটির কথা উঠে এসেছে ঘুরে ফিরে, যারা সেচ্ছামৃত্যুকে সহযোগীতা করে চলেছে নিরলসভাবে। সমালোচকদের ভাষ্য- এই হাইপ্রোফাইল দম্পতির সহমরণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে নিজেদের জীবনাবসান করতে আগ্রহী হবে আরো অনেকে, বিশেষ করে সেলিব্রেটি’রা। শেষে না এটা আবার ফ্যাশন হয়ে যায়! জীবনের শেষ কভারেজটা একটু ব্যতিক্রমি- একটু অন্যরকম। মরবার কালে শেষ চমক!
পূনশ্চ: এ খবরটা প্রায় দুই সপ্তার পুরনো। লেখাটা লিখেছিলাম এ মাসের পনেরো তারিখ। পোস্ট করছি- করবো করতে করতে বাসি হয়ে গেলো!
রেজুয়ান মারুফ
মন্তব্য
আসলেই তো এরকম ভাবা যায় না! এই যুগে, এই সময়ে...
আমি আর আমার বউও প্রায়ই এ ধরনের চিন্তা করতাম, দুইজন একইসাথে মরব... বিয়ের আগে না, বিয়ের পরও... এখনও
এমন ঘটনা শুনলে আসলেই মনটা যেন কেমন হয়ে যায়...
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
বৌ এর সাথে এই রোমান্টিক চিন্তাটা চালায়া যান...।
খবরটি শুনে আমার একটি সিনেমার কথা মনে পরে গেলো...."দ্যা সী ইনসাইড"।
সিনেমাটা দেখতে হবে।
আমি ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে। বিশেষ করে ইউথ্যানাসিয়ার আমি একজন প্রবল সমর্থক!
আমিও প্রবলভাবে পক্ষে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি যে কোন পক্ষে... ...কখনো মনে হয় ইউথ্যানাসিয়া দরকার আছে, আবার কখনো মনে হয়ে প্রকৃতির দেয়া মৃত্যু যন্ত্রনা প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানু প্রাপ্য, তার দায় এড়ানো কি দরকার?
ভাল লাগলো তাদের ইচ্ছাপূরন হয়েছে দেখে ।
নো কমেন্ট।
অসীম সাহস।
আসলেই!
আমিও ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে। ইচ্ছা করে বাবা-মা যেদিন যাবেন...একসাথে চলে যেতে!
-------------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
আমার বউ একদিন আবেগাক্রান্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, আমি মারা গেলে তুমি কী করবে?"
আমি কালবিলম্ব না করে উত্তর দিয়েছিলাম, "কী আর করবো! পাশের বাসার মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলবো।"
বউ আর কখনো জানতে চায়নি।
আপনারই মনে হয় সহমরণে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী!
ইউথেনেশিয়া অল্প কিছু দেশে এবং আমেরিকার ওরেগন ও ওশিংটনে বৈধ। বিস্তারিত
http://en.wikipedia.org/wiki/Euthanasia
লিঙ্কের জন্য ধন্যবাদ।
হাউ সুইট !
আমি ভীষণভাবে ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে।
ভাবিবামাত্র পোস্ট দিয়ে ফেলা দরকার, মারুফ।
খামাখা দেরি করার দরকারটা কী?
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
থ্যাংক ইউ শিমুল।
এইবার থেইকা ঠিক ঠাক সময়ে পোষ্ট দিবো ।
লেখাটা ভাল লাগল। ভাবাই যায় না এই যান্ত্রিক যুগেও এরকম কোনো ঘটনা ঘটতে পারে।
আমিও ইচ্ছামৃত্যুর ভীষণরকম পক্ষে।
অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্যে!
মন খারাপ হল কিছুটা। আমিও ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে, ভীষণভাবে!
--------------------------------
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
আমারও মন খারাপ হয়েছিল আর সেই মন খারাপ হওয়া থেকেই এই লেখা।
শেষ বয়সে ধুকধুকে মরা... নিজে কষ্ট পাওয়া, আশপাশের মানুষগুলোকে কষ্ট দেওয়া... এসব নানাবিধ কারনে আমি নিজেও ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে... যতদিন বাঁচবো আনন্দে... আজাইরা বেঁচে লাভ নাই...
তবে ইচ্ছামৃত্যু বলতে প্রেমে ছ্যাঁক খেয়ে বা পরীক্ষায় খারাপ ফল করে আত্মহত্যা হইলে ঐগুলারে মাইর...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খুব ভালো বলছেন।
নতুন মন্তব্য করুন