"কিরে বইসা আছোছ ক্যান? আজকা কুনো কাম নাই?"
"না গো চাচা। দুইডা দিন ধইরা কুনো কাম পাই নাই। ট্যাহা যা আছিলো বেবাক শ্যাষ হইয়া গেছে। আজকা না খাইয়া থাকন লাগব"।
করিম সওদাগর ছেলেটির দিকে অনেক মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই সব। কখনই তিনি মায়ার বহিঃপ্রকাশ করেন না। তিনি চাইলে খুব সহজেই ছেলেটির জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। ছেলেটির ভরণ-পোষন, লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়া তার জন্য কোন ব্যাপার নয়। ছেলেটিকে দেখলেই তার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের কোন সন্তান না থাকার কারণেই হয়তো একটু বেশী মায়া হয়। কিন্তু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? তাই কখনই ছেলেটিকে বুঝতে দেননি তার হৃদয়ের আকুতি। ছেলেটির নাম জামাল। বয়েস হবে হয়তো ১৩-১৪। এই বয়েসেই জীবনের নির্মম বাস্তবতা সম্পর্কে ভালই জ্ঞান অর্জন করছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে। কখনও কাজ পায় কখনওবা পায় না। কাজ না পেলে না খেয়ে থাকতে হয় না একমাত্র করিম সওদাগরের কল্যাণে। করিম সওদাগর ছেলেটিকে বাকীতে তার হোটেলে ভাত খেতে দেয়। নামেই বাকী। এই টাকা কখনই পরিশোধ করতে হয় না।
"এইখানে বইয়া থাকলে কি কাম পাবি? ভাত খাইয়া যা কামের খোঁজে। তোরে কি ঘর থ্যাইক্যা কামের লাইগা ডাইকা লইয়া যাইব নাকি?"
করিম সওদাগরের হোটেলটাই জামালের ঘর। রাতে সে হোটেলেই থাকে। জামালের কাজে ফাঁকি দেয়ার একটা প্রবণতা আছে। প্রায়ই কাজের খোঁজে না গিয়ে হোটেলে বসে থাকে। ফাঁকিবাজ হবেই বা না কেন? কি আর এমন বয়েস হয়েছে? জামাল ভাত খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল কাজের খোঁজে।
করিম সওদাগর জামালের চলে যাওয়া দেখছেন। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা তার ছিঁড়ে গেল। জলিল শিকদার এই হোটেলে নিয়মিত আসেন চা খাওয়ার জন্য। এলাকার প্রভাবশালী একজন। সবাই তাকে শিকদার সাব বলে সম্বোধন করে। তিনি বসে বসে সবই লক্ষ্য করলেন। করিম সওদাগরের উদ্দেশ্যে বললেন,
"মিয়া তুমিতো পোলাডারে এক্কারে মাথায় তুইলা রাখছো। এইসব রাস্তার পোলাপাইনেরে এতো লাই দিতে নাই। কোনদিন দেখবা তোমার সর্বনাশ কইরা ভাগছে। তহন আর দুঃখের সীমা থাকবো না"।
করিম সওদাগর তার কথার কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল আর মনে মনে বলল,
"শিকদার মিয়া তুমি কি বুঝবা মায়া কি জিনিস? তুমি হইলা আস্তা একটা পিচাশ"।
বিকেলে করিম সওদাগর বাজারে গেলেন। হোটেলের জন্য কাঁচা বাজার, মাছ, মাংস এইসব কিনতে হবে। বাজারে আজকাল আগুন লেগে থাকে সব সময়। জিনিস পত্রের যা দাম। তবে করিম মিয়ার সাথে কয়েকটা দোকানের চুক্তি আছে। একটু নিম্নমানের জিনিস কম দামে করিম সওদাগর ওদের কাছ থেকে কিনে নেয়। অনেকটা সময় নিয়ে তিনি বাজার করে হোটেলে ফিরলেন। হোটেলে ঢুকেই দেখলেন এক কোণার টেবিলে জামাল মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্ধকারে ছেলেটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বাজারের ঝুড়ি বাবুর্চীকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়ে বসলেন ক্যাশে। একজনকে বললেন লাইট জ্বালাতে। জামালের দিকে চেয়ে আছেন মায়া ভরা চোখে। আজও বোধহয় ছেলেটা কোন কাজ পায়নি। হোটেলের লাইট জ্বলে ওঠা মাত্র শিউরে উঠলেন তিনি। জামালের নাকে-মুখে রক্ত। মাথা বেয়েও রক্ত পরছে। করিম সওদাগর কখনো এতটা বিচলিত হননি। তিনি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন -
"ওই জামাল তোর কি হইছে? এত্ত রক্ত ক্যান? কেডায় মারছে তোরে?" বলেই ছুটে গেলেন ছেলেটার কাছে। "কিরে কথা কস না ক্যান? কি হইছে তোর?"।
জামাল একটা কথাও বলল না। দু'চোখ বেয়ে চোখের জল ঝরে পরছে। চোখের জল আর রক্ত মিশে এক হয়ে যেন ওর অব্যক্ত কষ্টের কথা চিৎকার করে বলতে চাইছে। করিম সওদাগর দেরি না করে দ্রুত জামালকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
রাতে করিম সওদাগর জামালকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। তার স্ত্রী জামালের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে অস্থির হয়ে পরলেন। করিম সওদাগরের স্ত্রীও জামালকে অনেক পছন্দ করেন। তিনি স্বামীকে প্রায়ই বলেন,
"তুমি জামালরে আমাগো বাড়িত নিয়া আসো। আমাগো কোন পোলাপাইন নাই। হেরে আমি আমার পোলার মত মানুষ করুম। পোলাডারে দেখলেই কলিজার ভিতর কিমুন য্যান করে। আহা! কি চান্দের লাহান পোলাডা মাইনষের কামলা খাটে। ভাবলেই যে কি কষ্ট হয় হেইডা তুমি বুঝবা না"।
করিম সওদাগরের একটাই কথা, "কি লাভ মায়া বাড়াইয়া? পরের পোলা, একদিন দেখবা আমাগোরে ছাইড়া চইল্যা গেছে। নিজের পোলাই মা-বাপরে দ্যাহে না আর হ্যায়তো পরের পোলা"।
রাত ভর জামালের সেবার করলেন করিম সওদাগরের স্ত্রী। একটু পর পরই ঢুঁকরে কেঁদে উঠেছেন। জ্বরের ঘোরে সারারাত আবোল তাবোল বকেছে জামাল। টানা তিনদিন প্রচন্ড জ্বরে ভুগলো সে। ধীরে ধীরে জ্বর কমে গেছে। এর মধ্যে করিম সওদাগরের স্ত্রী মাজারে সিন্নি দিয়েছেন, হুজুর ডেকে দোয়া-তাবিজ, ঝার-ফুঁক আরো কত কি করিয়েছেন। জামালের জ্বর কমতেই তিনি ৪ রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করেছেন। সেদিন রাতে আবারো স্বামীর কাছে মিনতি করেছিলেন জামালকে নিজেদের সাথে রাখার জন্যে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। করিম সওদাগরের একটাই কথা, "কি লাভ মায়া বাড়াইয়া!!!"।
সুস্থ হয়ে জামাল আবার কাজের খোঁজ শুরু করল। আবার আগের মত জীবন-যাপন। একদিন সন্ধ্যায় মহা আনন্দে জামাল করিম সওদাগরের হোটেলে ফিরল। কামাই-রোজগার আজ ভালই হয়েছে। এক সাহেব ওর কাজে খুশি হয়ে মোটা টাকা বকশিস দিয়েছে। মহা আনন্দ ওর মনে আজ। হোটেলে ঢুকেই দেখল জলিল শিকদার বসে আছেন। ওকে দেখেই জলিল শিকদার ডাক দিলেন।
"ওই ছ্যামরা এদিক আয়। আমার লাইগা এক প্যাকেট বেনসন লইয়া আয় যা। বিদেশীডা দিতে কবি" বলেই পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। জামালের যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে তার মুখের উপর না বলার সাহস হলো না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোকানের দিকে রওনা দিল জামাল। সিগারেট নিয়ে দোকানদার থেকে বাকী টাকা ফেরত নিয়ে যেই ঘুরে দাঁড়ালো অমনি একটা লোক ওর হাত থেকে টাক ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড় দিল। ও অনেক চেষ্টা করল দৌড়ে লোকটাকে ধরার। কিন্তু পারলো না। মনে মনে ভয় পেয়ে গেল জামাল। এতগুলো টাকা নিয়ে গেছে এখন কি হবে? শিকদার সাব কে বললে উনি যদি বিশ্বাস না করেন। নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে দেখল মাত্র দু'শ সত্তর টাকা আছে। ভয়ে ভয়ে সে করিম সওদাগরের হোটেলে গেল। গিয়ে যখন ঘটনা বলল শুনে রেগে আগুন। জলিল শিকদার জামালের পকেট হাতিয়ে দু'শ সত্তর টাকা পেয়ে বললেন,
"বাকী ট্যাকা কি করছোছ এইডা ক। ভালায় ভালায় ট্যাকা গুলান ফেরত দে নইলে এমন মাইর দিমু......."।
জামাল অনেক মিনতি করে বলল, "সাব আমি সত্যি কইতাছি এক বেডায় আমার হাত থেইকা আফনের ট্যাকা টাইন্যা লইয়া গ্যাছেগা। বিশ্বাস করেন আমার আইজকা সারাদিনের কামাই হইল ওই দুইশ সত্তর ট্যাহা"।
কিন্তু জলিল শিকদার কিছুতেই তার কথা বিশ্বাস করল না। একটু পরেই শুরু হল বেদম প্রহার, যা দেখে যে কেউ শিউরে উঠবে। জামাল শুধু একটানা চিৎকার করে গেল "মাগো মা মইরা গেলাম, আর মাইরেন না। মাগো.................."।
করিম সওদাগরের স্ত্রী অসুস্থ। স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। ওষুধ কিনে বাসায় স্ত্রীকে দিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দেখলেন হোটেলের সামনে জটলা। তাড়াতাড়ি গেলেন সেদিকে। দেখলেন জামাল হোটেলের সামনে পরে আছে। রক্তে ভেসে গেছে জামালের মাথার চারপাশ। করিম সওদাগর চিৎকার করে উঠলেন,
"কিরে কি হইছে? কেডায় মারছে আমার জামালরে? ওই জামাল কথা কস না ক্যান?"
জটলার মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো "জামাইল্যা মইরা গ্যাছে"।
করিম শিকদারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল। তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরুচ্ছে না। কেউ একজন ডাক্তার ডেকে এনেছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন জামাল মারা গ্যাছে। করিম সওদাগর একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষন পরে পুলিশ আসলো। পুলিশের প্রশ্নের জবাবে করিম সওদাগর চিৎকার করে বলল,
"আমি মারছি। আমার লাইগাই মরছে পোলাডা। আমারে নিয়া যান"।
সবাই অনেক কষ্টে করিম সওদাগরকে সামলালেন। ওদিকে ওনার স্ত্রী খবর শুনে বার বার মূর্ছা গেলেন। সারা এলাকায় স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু করিম সওদাগরের স্ত্রীর কান্নার প্রলম্বিত শব্দ ভেসে বেড়েচ্ছে। করিম সওদাগর বাসায় ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী তখনও কাঁদছে। এতক্ষনে করিম সওদাগরের দু'চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসলো। তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
"কইছিলাম না মায়া বাড়াইয়া কি লাভ?"।
(সমাপ্ত)
নিবন্ধন নাম : মেঘলা জীবন
ই-মেইল :
মন্তব্য
কাহিনীতো অনেক পরিচিত, কিন্তু আপনার লেখার গাথুনীটা ভালো লাগলো। সচলে প্রথম লেখা? সেক্ষেত্রে স্বাগতম! আরও লিখুন পরিচিত-অপরিচিত নানা বিষয় নিয়ে।
ধন্যবাদ আপনাকে
সচলায়তনে স্বাগতম।
বেশ লাগল। নিয়মিত লিখুন।
স্বাগতম.. ভালো লাগলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভালো লেগেছে, খুব মায়ামায়া লেখা।
শেষটুকু আরেকটু অন্যরকম হলে আরো ভালো লাগতো।
লেখক, আপনি আরো লিখুন, শুভেচ্ছা রইল।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ। অন্যরকম করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু লেখার সময় কেন যেন এমনই হয়ে গেল।
জামাল তো করিম সওদাগরের হোটেলেই কাজ করতে পারতো। সেটা না হওয়ার কারণটা ঠিক ধরতে পারলাম না।
আপনার লেখার হাত চমৎকার। নিয়মিত লিখুন। সচলে স্বাগতম!
..................................................................
ঐ যে হাঁটছি মুদ্রা দোষে নাকটা ঘষে
আড্ডা মানেই সেকেণ্ড হাফে খেলছি সোলো
গুজবো না শার্ট আমার পাড়া স্মার্ট পেরিয়ে
সে রোদ্দুরের স্মরণ সভাও লিখতে হল
ধন্যবাদ। ওইযে মায়া বাড়াতে চায়নি। কিন্তু না বড়িয়েতো পারলো না। ভাল থাকবেন
- বাহ্
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
খুব ভাল লাগছে! জটিল লেখা!
-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
নতুন মন্তব্য করুন