"কিরে কি করিস?"
আত্ম চিন্তায় মগ্ন ছিলাম তাই হঠাৎ কানের কাছে শব্দ শুনে কেঁপে উঠলাম। পেছনে তাকিয়েই দেখি নাজমুল। আমার নিজের সম্পর্কে কেউ যদি কিছু জানতে চায় তবে আমি বলব আমি বিশ্বের সবচাইতে আবুল একটা মানুষ। কিন্তু তারপরও যখন আমারই মত আবুল কাউকে দেখি তবে হাসি আটকে রাখতে পারি না। এই যেমন নাজমুল। সে দেখছে আমি বই হাতে বসে আছি এবং বইটি খোলা তাতে ওর বুঝে নেয়া উচিৎ ছিল আমি পড়ছি। তবুও সে প্রশ্ন করল কি করছি? হা হা হা। যদিও পড়ছিলাম না। আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। ভাবনার কোন সীমা ছিল না। সীমাহীন ভাবনা যাকে বলে। নাজমুলের প্রশ্নের উত্তরে বললাম-
"বইয়ের প্রতিটি পাতার স্ন্যাপ নিচ্ছি। পরীক্ষার হলে কোন পড়া মনে না আসলে সেই স্ন্যাপ মনে করার চেষ্ট করব। জানিস তো মন হল সবচাইতে শক্তিশালী মেমরী কার্ড?"
নাজমুল আমার দিকে এমন একটা ভাব নিয়ে তাকাল যেন আমি ওর সাথে কঠিন মশকরা করেছি। আসলে ওর দোষ নেই। বন্ধুরা সবাই মনেকরে আমি মানসিক রোগী। ওদের ভাষায় মেন্টাল। কারো মানসিক সমস্যা থাকলে তাকে কেন মেন্টাল বলা হয় তাই বুঝতে পারিনি এখনো। মেন্টাল শব্দটাকে অনেক বিশ্লেষন করেও এর সাথে মানসিক সমস্যার কোন যোগসূত্র খুঁজে পাইনি আমি আজো। ডিকশনারীতে দেখলাম মেন্টাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ মানসিক। কিন্তু এর সাথে মানসিক সমস্যার কি সম্পর্ক। যাইহোক সবার ধারণা আমি উল্টা-পাল্টা আচরণ করি। যদিও আমি আমার মাঝে অস্বাভাবিক কিছুই খুঁজে পাইনি এখনো পর্যন্ত। তবে এই কথাটি কাউকে সাহস করে বলিনি এখনো। সেক্ষত্রে সবাই বলবে পাগল কি আর নিজেকে পাগল বলে? হা হা হা। নিজের বুদ্ধিমত্তায় নিজেই মাঝে মাঝে মুগ্ধ হই। সীমা ছাড়ানো মুগ্ধতা। দীর্ঘ একটা মুহুর্ত নিশ্চুপ থাকার পর নাজমুল বলল-
"পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে চল"।
উত্তরে হেসে বললাম - "আচ্ছা পরীক্ষা যদি দিতে না হত কত ভাল হত। যদি পরীক্ষা দেয়ার বদলে বলা হত রিডিং পড়তে কতই না ভাল হত। নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা থাকত সেই সময়ের মধ্যে রিডিং পড়া শেষ করতে পারলে পাশ"। বলেই অট্টহাসি হাসলাম। ঠিক অট্টহাসি না। যারা নিয়মিত সিনেমা দেখে তারা অনায়েসেই একে ভিলেনী হাসি বলে চালিয়ে দেবেন। নাজমুলের চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম ও চরম বিরক্ত হয়েছে। নাজমুর যখন বিরক্ত হয় ওর ডান গালের মাংস কাঁপতে থাকে। অনেককেই দেখেছি রাগলে গালের মাংস কাঁপে কিন্তু নাজমুল একটু ব্যতিক্রম। সেই দিক থেকে ওকেও আমি মেন্টাল বলতে পারি। হা হা হা। ওকে আরো বিরক্ত করার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম স্বেচ্ছায়। কারণ এই বিরক্তির কারণে হয়তো দেখা যাবে এক পর্যায়ে নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়বে। কলেজের শিক্ষকরা নিশ্চই তাকে সুস্থ মনে করবেন না তখন। সোজা হেমায়েতপুরের টিকেট ধরিয়ে দেবেন হাতে। হা হা হা।
আজকে পরীক্ষার প্রশ্ন অনেক সহজ হয়েছে। যদিও জহির স্যার এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি হাসলেন যেন অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন করেছেন। তার হাসিতে বোঝা যাচ্ছিল উনি মনে মনে বলছেন "কেমন লাগে বাছাধনরা? এইবার বাগে পাইছি তোমাদেরকে। ক্যামনে পাশ কর দেখা যাবে"। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে স্যারকে হাসি মুখে বলতে যে প্রশ্ন সহজ হয়েছে। কিন্তু এত স্যার আবার ক্ষেপে যেতে পারেন। জহির স্যার আমাদের অর্থনীতির শিক্ষক। গণিত, অর্থনীতি এবং ইরেজীর শিক্ষকরা একটু মেজাজী হন। গণিত এবং অর্থনীতি একটু কঠিন বিষয়। এই কঠিন বিষয় নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে শিক্ষকরা মেজাজী হবেন এটাই স্বাভাবিক। তেমনি ইংরেজীর ক্ষেত্রেও শিক্ষকরা কথায় কথায় "You Idot", "You Fool" ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগের মাধ্যে তাদের ইংরেজীর পারদর্শীতার প্রমাণ দিয়ে যান সর্বদা।
একটা প্রবাদ আছে "ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়"। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার হল অন্যদশা "ইচ্ছা হইলে বাধ্য হয়"। ইচ্ছার কাছে পরাজিত হয়ে জহির স্যারকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম- "স্যার আজকের পরীক্ষার প্রশ্ন অনেক সহজ হয়েছে"। বলেই এমন একটা হাসি দিলাম যেন আইনস্ট্যাইন এর "থিওরী রিলেটিভিটি" ভুল প্রমাণিত করেছি। স্যার যে বিরক্ত হয়েছেন সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন নাকি নিজের উপর সেটা বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিটি মানুষের কিছু মানসিক সমস্যা আছে। তার মধ্যে যেটা সবচাইতে বেশী দেখা যায় সেটা হল হেরে গিয়েও হার না মানা। হয়তো এই মানসিকতা থেকেই স্যার বললেন- "পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে দেখা যাবে প্রশ্ন সহজ হয়েছে নাকি হয়নি"। প্রশ্ন যে সহজ হয়নি এটা প্রমাণ করার জন্যেই হয়তো তিনি রাহাত কে জিজ্ঞেস করলেন- "রাহাত প্রশ্নে কোন সমস্যা আছে?"। রাহাত বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলল - "স্যার ফ্রশ্ন সহজ হয়েছে"। স্যার সাথে সাথে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলেন।
রাহাত এর একটা সমস্যা আছে। ও 'প' কে 'ফ' উচ্চারণ করে। এই কলেজের প্রথম দিন আমাদের বাংলা স্যার সবাইকে একে একে প্রশ্ন করেছিলেন "তুমি কেন এই কলেজে ভর্তি হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?" সেদিন রাহাত উত্তরে বলেছিল- "স্যার আমার মামার ফরামর্শে এই কলেজে ভর্তি হয়েছি। আর শুনেছি এই কলেছে নাকি ফড়াশুনা ভাল হয়"। বাংলা শিক্ষকরা সাধারণত ভুল উচ্চারণে খুবই বিরক্ত হন। আমাদের বাংলা শিক্ষকও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তিনি ক্লাস চলাকালীন শুদ্ধ এবং সুন্দর উচ্চারণে সবাইকে বিমোহিত করার চেষ্টা করে যেতেন। যদিও আমার মনেহয় না কেউ তার এই প্রয়াসে বিমোহিত হত। বরং তার কঠিন কঠিন শব্দের ব্যবহারে অনেকেই বিরক্ত হত। তবে স্যারের একটা ভাল গুণ হল তিনি সহজে রাগ করেন না। সেদিন তিনি রাহাতের উচ্চারণ শুদ্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন।
"রাহাত ফরামর্শ নয় বল পরামর্শ। প রা ম র শ"।
রাহাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল "ফরামর্শ। ফ রা ম র শ"।
স্যার অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি যতবারই বললেন 'প' বলার জন্যে ততবারই রাহাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল 'ফ। তাতেও স্যার এতটুকু বিরক্ত হননি। সুযোগ পেলেই তিনি চেষ্টা করেছেন রাহাতের উচ্চারণ শুদ্ধ করার জন্য। এমনকি তিনি ওকে দিয়ে "পাখি পাঁকা পেঁপে খায়" এই বাক্যটিও উচ্চারণ করিয়েছিলেন। প্রতিবারই এক নিশ্বাসে রাহাত বলেছিল "ফাখি ফাঁকা ফেঁফে খায়"। হা হা হা। আমরা সবাই ক্লাসে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম। হাসার মধ্যে এককাঠি বাড়া ছিল সুজন। ওতো একবার ফ্লোরে শুয়ে পরেছিল হাসতে হাসতে। একেবারে গড়াগড়ি হাসির প্রত্যক্ষ দর্শন। হা হা হা।
পরীক্ষা চলাকালীন এক পর্যায়ে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার আসলেন হল পরিদর্শনে। তিনি ঘুরে ফিরে প্রতিটি ছাত্রের কাছে গেলেন। দেখলেন কে কি লিখছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম স্যার সুজনের পাশের দেয়াল পরীক্ষা করছেন নিবিষ্ট মনে। দেয়াল পরীক্ষা শেষে স্যার সহাস্যে বললেন -
"বাহ! বাহ! আমার কলেজের ছাত্ররা দেখি বিদ্বান হয়ে যাচ্ছে! দেয়ালে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রেখা এঁকে ফেলেছে একেবারে। চমৎকার ব্যাপার। এই বলে তিনি সুজনের খাতা নিয়ে ফেললেন। বললেন- "যাও তুমি পাশ করেছো আর তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে না। সুজন অবাক হয়ে বলল - "স্যার ওইটা আমি আঁকি নাই। আর এই প্রশ্নতো পরীক্ষাতে আসে নাই"। স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন - "আমি কি বলেছি তুমি এঁকেছো? তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে না। তুমি পাশ করেছো যাও"। সুজন খুব আনন্দিত বদনে বলল "স্যার পরশুদিনের পরীক্ষার পড়া কিছুই পড়িনি আপনি যদি ওই বিষয়টাতেও পাশ করিয়ে দিতেন খুব ভাল হত"। সবাই একযোগে হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। স্যার এবার মহা গরম হয়ে গেলেন। "এই যাও দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে"। সুজন আর কোন কথা না বলে হল থেকে বের হয়ে গেল। স্যার ঘুরতে ঘুরতে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন - "কি লিখছো তুমি?"। মনেমনে বললাম এতো দেখি আরেক নাজমুল। ওইযে আগেই বলেছিলাম আমি মহা আবুল হলে কি হবে? আমার মত কোন আবুল দেখলেই আমার অনেক হাসি পায়। আমি হঠাৎ করে অট্টহাসি (ভিলেনী) হাসলাম। স্যার ঘাবড়ে গেলেন কিছুটা। "এভাবে হাসছো কেন? আমি কি তোমাকে হাসতে বলেছি? যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও"। আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম "স্যার শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' এর ভূতটাকে নিয়ে কবিতা লিখছি। শুনবেন স্যার?"। স্যারের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলা শুরু করলাম "হে ভূত তুমি কি রাজা হ্যামলেট এর ভূত নাকি শেক্সপিয়ারের ভূত? তোমার নাম কেন হল ভূত? তোমার মাঝে কি আছে ভূতত্ত্ব? নাকি করেছো বায়োলজি আত্মস্ত?" বলেই ঘুরে তাকিয়ে দেখি স্যার চলে গেছেন হল থেকে। সবাই আমার দিকে কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আপনিও নিশ্চই একটু অবাক হলেন আমার কথায়? হা হা হা। ওইযে বললাম না সবাই আমাকে মেন্টাল তথা মানসিক রোগী মনে করে?। হা হা হা। আমি নিশ্চিত আপনিও আমাকে তাই ভাবছেন।
পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পর দেখি সবাই আমার দিকে তখনও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাহাত এসে বলল "তুই এত সাহস কোথেকে ফাইছোস? তুই ফ্রিন্সিফাল স্যারের সাথে মশকরা করছোন এত্তো সাহস!!"। আমি উত্তরে বললাম "ফ্রিন্সিফাল স্যারের সাথে আমার ঠাট্টার সম্পর্ক তোরা জানিস না। তোরা দেখি ফুরা হাবা!!"। বলেই আর দাঁড়ালাম না সোজা হাঁটা দিলাম। হাঁ হয়ে থাকা কিছু মুখ পেছনে পরে রইল। কি বলেছিলাম না সবাই আমাকে মেন্টাল ভাবে। আমিও সবার ধারণাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করি সর্বদা। কারণ আমি সবাইকে জিতিয়ে দেবার পক্ষে। হা হা হা।
চলবে......................
নিবন্ধন নাম - মেঘলা জীবন
মন্তব্য
গল্প মনে হলনা, মনে হলো আপনার স্মৃতিচারণ অথবা দিনপঞ্জী। গল্প হিসেবে যদি এটাকে সূচনা পর্ব বিবেচনা করি তাহলে বলবো প্রথম প্যারাটা সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
চলুক।
নতুন মন্তব্য করুন