গত লেখাতে উল্ল্যেখ করেছিলাম যে আমি ছোটবেলা থেকেই কিছুটা ভাবুক গোছের ছিলাম। আমার এহেন ভাবনার কারণে প্রায়শই দেখা যেতো গাছের মুচি এবং আমড়া পেকে বড় হবার আগেই গাছ থেকে নাই হয়ে যাচ্ছে! ওগুলো যে আমারই পেটে যাচ্ছে তা কি আর আমার নানা বুঝতেন? উনি লাঠি নিয়ে প্রায়ই চক্কর দিয়ে যেতেন বাগানে, যদি পাড়ার বাঁদর ছেলেপিলেগুলোকে হাতে নাতে ধরা যায়! যা হোক, প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান নিয়ে আমার ব্যাপক চিন্তা ভাবনা ছিলো সেইটিও বোধ করি বলা হয়েছিলো। আর তখন আমার ভাই ছিলো আমার একমাত্র জ্ঞানদাতা। আর সেই সুযোগে সে তার মাথায় আসা সম্ভাব্য সকল বিষয়েরই ছিলো আমার গুরু।
একবার সে আমাকে লাভা বিষয়ে বেশ লম্বা চওড়া বক্তৃতা দিলো এবং উপসংহারে জানালো যে পৃথিবীর গভীরতম স্থান হতে উত্তপ্ত গলিত লাভা যে কোন মুহূর্তে পৃথিবী ভেদ করে বেরিয়ে আসে! তার একমাত্র মনযোগী শিষ্য আমি, এইকথা শোনা মাত্রই ভয়ে অতিরিক্ত সাবধানতা সহকারে মাটিতে পা ফেলা শুরু করে দিলাম! যতোটা সম্ভব খাটেই থাকি সারাদিন, অতিশয় প্রয়োজন ছাড়া নামি না। আর নামতে একান্তই বাধ্য হলে কয়েক লম্ফ দিয়ে যতটুকু কম পা ফেলে যাওয়া যায় সেভাবে গন্তব্যস্থানে গমন করতাম। আমাকে অনেক বোঝানো সত্ত্বেও কেউ এই ভ্রান্ত ধারণা কিছুতেই ভাঙ্গাতে পারছিলো না। শেষমেষ ভাইয়াকেই এই গুরু দায়িত্ব দেয়া হলো। অতঃপর আমি বুঝলাম যে লাভা যেকোন স্থান হতে বের হবে না, কিছু নির্দীষ্ট এলাকা রয়েছে যেগুলো তার আওতায় পরে এবং সেক্ষেত্রে খাট আমাকে বিশেষ রক্ষা করতে পারবেনা। তারপর আমি খাট থেকে নামলাম, তবে সহজ ভাবে আবার পা ফেলে হাটতে একটু সময় লেগেছিলো বটে!
আরেকবার ভাইয়া শোনাচ্ছিলো কিকরে প্লেন আবিষ্কার হলো। মানুষ কতোদিন ধরে নিরন্তর চেষ্টার ফলস্রুতিতে আজকের এই বিমান আবিষ্কার করেছিলো সে কথা শুনে আমি বিস্ময় নিয়ে ভাবতাম, কি দারুন! আর নিরিবিলি দুপুরবেলায় একা একা আমাদের ঐ শান্তিবাগের পাকা বাড়ির উঁচু বাধাইয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত পাখির ডানা’র মতো মেলে ধরে, এক বুক নিঃশ্বাস টেনে দিতাম এক লাফ! লাফিয়ে পরে গতিসহকারে দিতাম ভোঁ দৌড়……দৌড়াতে দৌড়াতে উঠোন শেষ করে বাগানে পৌঁছে যেতাম কিন্তু চোখ খুলে দেখতাম আমি নীল আকাশে নই, মাটিতেই রয়েছি তখনও! নাহ! আরও গতি বাড়াতে হবে। আবার শুরু করতাম প্রচেষ্টা! এভাবে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েও যখন দেখলাম পারছিনা তখন আরেক নতুন বুদ্ধি আঁটলাম। মায়ের ওড়না নিয়ে এসে দু’হাতে বেঁধে সেটি সহ শুরু করলাম ওড়ার চেষ্টা। ওড়না ফুলে ফেঁপে রঙ্গিন পাখির মতো দেখাতো ঠিকই, কিন্তু তা ওড়ায় কোন সাহায্য করতোনা আমায়! হায়! অবশেষে দির্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত আমি বাগানে যেয়ে কাঁঠাল গাছের কান্ডে বসে আবারো মুচী খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর অবাক বিস্ময়ে দেখতাম পাখি ওড়া, আর মাঝে মধ্যে পাতার আড়াল দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেন!
বাবা মা নানা নানী সহ ঐ বাড়িতে আরও লোকের সমাগম ছিলো তখন। প্রতি সন্ধ্যায় খেলাধুলা শেষে রেওয়াজ ছিলো হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা। এবং অবশ্যই জোরে জোরে পড়তে হবে, নইলে আম্মুর কান মলা খেতে হতো। সবচেয়ে বিরক্ত লাগতো কবিতা মুখস্থ করার চেষ্টাটি! ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হতো এক একটি কবিতা মুখস্থ করতে, এবং বলাই বাহুল্য, দাঁড়ি কমা সহ মুখস্থ করতে হবে, এমনই নিয়ম ছিলো স্কুলে। এই বিভীষিকাময় সময় পার করতে ছোট্ট আমাদের বড়ই কষ্ট হতো কিন্তু থামার উপায় কোথায়! পেছনে মা বসে আছেন, একটু অধিকক্ষণ থেমেছি তো গিয়েছি! তবে প্রতি বুধবার খুব আগ্রহ সহকারে পড়া শেষ করতাম, কারণ ন’টায় ম্যাকগাইভার! ছোটবেলায় যে ক’টি টিভি সিরিজ দেখার অনুমতি ছিলো আমাদের, তার মদ্ধ্যে এটি একটি যার জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম সারাটি সপ্তাহ!
আমার নানী কয়েকটি মুরগী পালতেন। আমি আমার জীবনে যে’কটি প্রাণীকে ভয় পাই এবং এড়িয়ে চলি সেগুলো হলো তেলাপোকা এবং মাকড়শা। তবে ঐ সময়ে আরও একটি প্রাণীর ভয়ে প্রায়ই আমাকে প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াতে হয়েছে, বুঝতেই পারছেন সেটি হলো আমার নানীর পোষা মোরগ এবং মুরগীগুলো! মুরগী যে এতো বড়ও হয় তা আমি বিশ্বাস করতাম না যদিনা ওগুলোকে দেখতাম! হাতি সাইজ এর মুরগীটি তার সংগী ও বাচ্চা-কাচ্চা সহ বিকেল বেলা হাঁটতে বের হতো। সেই সময় তাকে বিভিন্ন এংগেল থেকে ডিস্টার্ব করা আমার খুব প্রিয় কাজ ছিলো, কারণ আমি ঐ হাতি-মুরগীটিকে দেখতে পারতাম না। একাজের দক্ষতা অর্জনে ভাইয়ার বিশেষ ভুমিকাও ছিলো। বিশেষত নানীর বকা খেলে আমাদের এই উপদ্রব বাড়তো। তবে ভয় পাই বলেছি এই কারণে যে, মুরগীটিকে উত্তক্ত করা মাত্রই ওটা কড়া চোখে তাকাতো এবং পরক্ষণেই তারস্বরে চিৎকার দিয়ে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসতো আমার দিকে! পরি মরি করে ছুটে পালাতাম কোন এক ঘরে, ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে বুকে থু দিয়ে ওপাশে শুনতে পেতাম হাতি-মুরগী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করছে দরজাটিকে।
নানা নানীর বদৌলতে আমরা যথেষ্ট আদরে ছিলাম, সেই সাথে আরও যারা থাকতো ঐ বাড়ীতে তারাও সকলে খুবই আদর করতেন আমাদের। বাবা মা সহ সকলের ভালোবাসায় নষ্ট হয়ে যেতাম যদিনা মাঝে মদ্ধ্যে শাসনটুকু না করতেন। এতো ঘুরিয়ে না বলে সরাসরিই বলি, মার’ও খেয়েছি মাঝে সাঝে নানান বাঁদরামির কারণে। এর সাথে যোগসাজস ছিলো ভাইয়ারও। আপনারা সকলেই আশা করি গ্লুকোজ খেয়েছেন একটু আধটু হলেও। আজ যেমন সব কিছুই হাতের মুঠোয়, তখন কোন কিছুই এতো সহজ লভ্য ছিলোনা। ইচ্ছে পুরণের জন্য অপেক্ষা করতে হতো বেশীর ভাগ সময়। তার অনেকগুলোই হয়তো পুরণ করতে হতো গুরুজনদের চোখের আড়ালে! ঝাল চকলেট, হজমি আর কটকটি সহ দারুন প্রিয় ছিলো চামচ চামচ গ্লুকোজ খাওয়া! একদিন দেখি ভাইয়া উঠোনে দাঁড়িয়ে ফিঁচেল হাসি দিচ্ছে। তার হাতে সবুজ রঙের গ্লুকোজের প্যাকেট! দেখিবামাত্র আমার মন টং করে উঠলো, কাতর কন্ঠে বললাম, “ভাইয়া আমাকে একটু দাও”। ভাইয়া তো পেয়েছে হাতের গুটি এবার, তার নামে যখন তখন নালিশ করার সাজা আজ পুষিয়ে নিতে হবে! সে ফিঁচেল হাসি থামিয়ে বল্লো, “দিবো যদি মাটিতে তোমার জ্বিহবা বেশী না, খানিকটা লাগিয়ে দেখাও।” ও, এ আর এমন কি কঠিন কাজ! আমি যেই না লাগিয়ে দেখাতে গেলাম, অমনি ভাইয়া তার দেয়া কথা না রেখে সজোরে বাবা কে ডাকতে লাগ্লো! আমিতো হতোবাক! বাবা এসে কাহিনী শুনে জাম গাছের ডাল ছিঁড়লো। তারপর ছিঁড়লো পাতাগুলো। আসন্ন বিপদের আঁচ পেয়ে যেই না আমি দৌড়ে পালাতে যাবো অমনি বাবা আমার এক হাত ধরে দে মাইর! আমি বাবার এক হাতে আটকে পরে তার চারদিক ঘুরছি আর মার খাচ্ছি! হঠাৎ হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দে দৌড়! গিয়ে পলায়ন করলাম রান্নাঘরে। সেখান থেকে জানালায় দাঁড়িয়ে উঠোনে তাকিয়ে দেখি এবার মার পড়ছে ভাইয়ার পিঠে। আসল ঘটনা তাহলে বুঝতে পেরেছেন বাবা! দেখলাম ভাইয়া কাঁদছে! সেটি দেখে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। সকল রাগ কোথায় যেনো উবে গেলো, সমস্ত মায়া এসে ভর করলো আমার মনে। হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম ভাইয়া’র জন্যে, প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগ্লো বুকের কোথাও। তারপর কিছুক্ষণ পরে যা ঘটবার তাই ঘটলো। কান্নাকাটি মারামারি সব শেষ, এবার সকলের আদর। দেখি ভাইয়া পা দুলিয়ে নানার খাটে বসে গ্লুকোজ খাচ্ছে। আমাকে দেখে ডাকলো, “গ্লুকোজ খাবে? চামচ নিয়ে এসো তবে।” আমি আনন্দে লম্ফ ঝম্ফ সহকারে চামচ নিয়ে গিয়ে ভাইয়ার পাশে বসলাম, ভাইয়া প্যাকেটটি আমার হাতে তুলে দিলো। মুখ ভর্তি গ্লুকোজ নিয়ে আমিও পা দোলাতে দোলাতে উঠোনে হাতের নাগালের মধ্যে থাকা জাম গাছটির দিকে কড়া চোখে তাকালাম!
ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটি এরকমই। দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসি কিন্তু প্রকাশের বেলায় কোনই খবর নেই, নেই কোন আদিখ্যেতা, বা আলগা কথা। এইসব ঘটনার অনেক অনেকদিন পার হয়ে গেলো। একদিন আমার বিয়ে হয়ে গেলো এবং কেমন করে যেনো একদিন স্বামীর সাথে দেশের মাটি ছেড়ে যাবার দিনটিও ঘনিয়ে এলো। আগে ভাবতাম কবে এক রাজকুমারের হাত ধরে আমি আমার তৈরী রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করবো! কোন কিছুই যেনো বিয়োগ হবেনা, শুধু হবে যোগ। কিন্তু যেদিন সব ছেড়ে আসছিলাম, সেইদিন প্রথম বুঝতে পারছিলাম আমি কি হারাতে বসেছি! যেনো আমাকে আমার আরেকটি অংগ থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে! রূপকথার রাজ্য?.....সেটিই আসলে ফেলে এসেছি! আর সেদিন আমিও জানতাম কার সবচেয়ে বেশী ভগ্ন হ্রদয় ছিলো। আমার ভাইয়ার।
মৃত্তিকা
মন্তব্য
এক কথায় অনবদ্য!
একটানে পড়ে গেলাম---
নাহ, মেয়ে, তোমাকে দিয়ে হবে-----
দু'একটা বানান ভুল না থাকলে পরে একেবারে নিখুঁত লেখা বলা যেত ;)।
অবশ্য আমি নিজেও কতটা বানান-বিশেষজ্ঞ তাতো আমার লেটেষ্ট পোষ্টে দেখেছই।
ভাল থাক মৃত্তিকা---আরো ভাল ভাল লেখ
নিরন্তর শুভেচ্ছা
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ অনিকেত'দা এমন সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
এত খেয়াল করে লেখার পরও বানান ভুল রয়ে যাওয়ায় আমি খুবই লজ্জিত। ভবিষ্যতে আরও সচেতন হবো।
ভালো থাকুন আপনিও।
মৃত্তিকা, খুব ছুয়ে গেল তোমার লেখাটা, তোমার ভাইয়ার সাথে তোমার এমন জুটি ভাঙ্গার জন্যে রব হ্যালফোর্ডকে তীব্র দিক্কার )। গল্প পড়ে শেষে মন খারাপ হল এমন একটা পরিবেশ ফেলে এসে বিদেশ বিভুইয়ে কষ্ট করছ দেখে। আমার বড় ভাইয়ের সাথেও আমার ঘনিষ্টতা ছিল খুব বেশী, সবাই মনে করত আমরা জমজ ভাই। আর গ্লুকোজ খাবার নেশা এমনই ছিল যে, চামচের পর চামচ খেয়েও মনে শান্তি হত না, গ্লকোজ খাবার ব্যাপারে মজা লাগতো মুখ ঠান্ডা হবার ব্যাপারটা। একদিন একগ্লাস গ্লুকোজে পানি দিয়ে এমন ঘন সরবত বানালাম যে খাওয়া মাত্র বমি হয়ে গেল। আশাকরি আরো পর্ব পাবো তোমার কাছ থেকে।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
মৃত্তিকা আপনার শৈশববেলা নিয়ে লেখা দ্বিতীয় লেখাটিও আগের মত চমৎকার ও সাবলীল হয়েছে। নিজের অনেক কিছুর সাথে মিলে গেল । গ্লুকোজের পাশাপাশি তখন নাবিস্কোর একটা গ্লুকোজ বিস্কিট পাওয়া যেত , আমি সেটার বিশেষ ভক্ত ছিলাম।
বড়ই মজা পাইলাম, আরো মজার মজার লেখা আসুক!
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...
চমৎকার লাগল পড়তে। স্মৃতিচারণ চলুক...
ধন্যবাদ প্রহরী, লেখা পড়ার জন্য আর মন্তব্যের জন্যে!
মজা পেলাম আপনার কর্মকান্ডের কথা শুনে!
অনেক ধন্যবাদ সাইফ ভাই লেখাটি পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য।
ভালো থাকুন।
- খুব ভালো লাগলো লেখাটা, খুবই। আরও নিয়মিত লিখুন না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অনেক ধন্যবাদ ধূগোদা, খুঁজে বের করে লেখাটি পড়ার জন্য!
লেখার প্লট খুঁজছি.....মাথায় এলেই লিখে ফেলবো।
এই মহিলা গেলেন কই? কতদিন দেখি না।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন