ভদ্রলোক গালের আঁচিলটা একবার চুলকাইয়া আবারো ভাবনায় মন দিলেন। এ স্থানের নাম ‘ধামরাই’ না হইয়া ‘কামড়াই’ বা ‘চামড়াই’ হইলো না কেন? নিদেনপক্ষে ‘বিলাই’ও হইতে পারতো। এতসব থাকিতে ধামরাই কেন? ইত্যাদি সাতপাঁচ কষিয়া ভাবিয়া তিনি সিদ্ধান্তে পৌছিলেন, “ধুচ্ছাই, নামে কিবা আসে যায়?” অতঃপর ম্যারাথন ভাবনার পরবর্তী অংশে অগ্রসর হইলেন...
বহুক্ষণ ধরিয়া রাস্তার মোড়ে গাড়ী লইয়া বেকায়দায় আটকা পড়িয়াছেন ভদ্রলোক। ড্রাইভার বেচারাকে স্টিয়ারিং ছাড়িয়া গলা হাঁকাইয়া পথ করিতে হইতেছে। এ জন্যই নিজ এলাকা হওয়া সত্বেও এই নচ্ছাড় অঞ্চলে তিনি আসিতে চান না। মফস্বলের রাস্তায় গাড়ী চলাচল অপ্রতুল হইলেও এহেন সংকীর্ণ সড়কে এসব গাড়ীগুড়ী চড়িবার চেয়ে হামাগুড়ি পাড়িলেও সময় বাঁচে। তবে আজ ভদ্রলোকের তাড়া কম। সময়টা তাই চিত্রবিচিত্র বস্তুর নামকরণের স্বার্থকতা ভাবিয়া আর ইঁতিউঁতি চাহিয়া কাটাইয়া দিতেছেন।
খট খট......গাড়ীর জানালায় টোকা পড়িলো। ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরাইয়া কালোকাঁচ ভেদ করিয়া দেখিলেন, ততোধিক কৃষ্ণবর্ণ কেহ একখানা লাঠিতে ভর দিয়া ভিক্ষা চাইতেছে। কালো কাঁচের বদৌলতে গাড়ীর ভেতরের সুশীল ভদ্রলোক দৃষ্টিগোচর হইতেছেন না, নইলে গ্লাসে টোকা দেবার মত ধৃষ্টতা কোন অর্বাচীনের হইতো না। সুশীল ভদ্রলোক কিন্তু কিছু মনে করিলেন না, এসব ‘জাররা’ সাইজের ধৃষ্টতা তিনি অহরহই ক্ষমা করেন। সাইড পকেটে হাত দিয়া খুচরা টাকা কটা বের করিলেন তিনি। মুখখানা প্রকৃত দানবীরের মত করিয়া জানালার গ্লাসখানা নামাইতে গিয়াই চমকিয়া উঠিলেন, ‘আরে, এই তো সেই পামর!! হাঁ হাঁ, সে-ই বটে, এ-ই তো এককালে আমাকে রাম চড়ে কাবু করেছিল। কোন ভুল নেই, এই সেই হারামী। ছিলো কই এতোকাল?’
ভদ্রলোক উত্তেজনায় ফুটিতেছেন, চোয়াল শক্ত হইয়া গেছে। সেই সাথে বাম কানটাও ভোঁ ভোঁ করিয়া উঠিলো। বহুদিনের পুরাতন ব্যাদনা চাগাড় দিয়াছে। ততোধিক বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে উঁকি দিতেছে।
এ তো সেদিনকার কথা যেন। পুকুরপাড়ের সেই বিকেলের ঘটনা ভদ্রলোকের স্পষ্ট মনে আছে বৈকি। বাইরে দন্ডায়মান এই পামর সেদিন উহার জ্ঞাতি গোষ্ঠী দিয়া তাড়া করিয়া এই পুকুরপাড়েই তাহাকে ধরিয়া ফালাইলো। তারপর যাহা হইলো তাহা ইতিহাস। সেদিন উহাদের একটি চড়ও আক্ষরিক অর্থে মাটিতে পড়ে নাই। পড়িয়াছিলো তাহার পৃষ্ঠে, গ্রীবাদেশে, পশ্চাৎদেশে। আর এর মাঝে এই অর্বাচীন পামর আহত পায়ে ল্যাংচাইয়া আসিয়া যেই সোয়া টনি চড় খানা হাকাইয়াছিলো তাহার সাক্ষ্য আজো বহন করিতেছে তাহার ফুটো বাম কর্ণপটহ।
তবে সেদিন যে উহারা কি মনে করিয়া তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলো তাহা তিনি নিজেও বুঝেন না। হাতে না মারিলে নিদেনপক্ষে পুকুরে ছুড়িয়া ফালাইলেও পারিতো। তিনি জানেন, আতংকে সেদিন তিনি সাঁতারও ভুলিয়া যাইতেন। নিশ্চিত ডুবিয়া মরিতেন।
আবারো খট খট টোকা পড়িলো।
কানটা সজোরে ভোঁ ভোঁ ভেঁপু বাজাইতেছে।
পশ্চাৎদেশের হাড়ের গিটে পুরাতন ব্যাদনা সগর্বে অবস্থান জানান দিতেছে।
ভদ্রলোকে মেজাজ খিচড়াইয়া উঠিলো। ভাবিতেছেন, নামিয়া বসাইবেন নাকি এক চড়, লাগাইবে নাকি দু ঘা?
কাঁচভেদী দৃষ্টি হানিয়া সক্রোধে উহার দিকে আবারো তাকাইলেন তিনি। হাঁটু থেকে কাটিয়া লওয়া পায়ের স্থানপূরণ করিতেছে প্যাঁচাইয়া ধরা লাঠিখানা। ভিক্ষা লাভের বাসনায় হস্ত প্রসারিত। সে হস্তে কিলবিল করিতেছে পেশী। চোয়াল দৃঢ়। স্কন্ধ স্ফীত। দেখিয়া শুনিয়া দমিয়া গেলেন ভদ্রলোক। বলা বাহুল্য, তিনি ভীত হইলেন। তিনি জানেন, সামনে পাইলে আবারো তাহার টুটি চাপিয়া ধরিতে দ্বিধা করিবে না এই বেজন্মাটা। অতীতের ভীতি ভদ্রলোকের আজও প্রবল। এতটাই যে, জানালার কাঁচ ঈষৎ নামাইয়া দুটি টাকা তিনি ছুড়িয়া দিলেন কোনরকমে। চেহারা দেখাইতেও অপারগ।
বড়সাহেবদের উপর বেজায় চটিলেন ভদ্রলোক। উনাদের হাতের টিপ কি এতোই জঘন্য ছিলো? উনারা যদি শালার একখানা হাতও একইসাথে বিকল করিতে পারিতেন তাহলেও আজ তিনি দেখাইয়া দিতেন। যাহোক, দেখাইতে তিনি পরেও পারিবেন। তাহার কর্মীশিবিরকে কেবল একখানা পয়গাম পাঠাইতে দেরী, উহারা এই পামরের বাকি পা খানারও ফার্স্টক্লাসে স্বর্গযাত্রা নিশ্চিত করিবে। ইহা লইয়া তিনি বিচলিত নহেন। কেবল আফসোস, নিজে তিনি কিছু করিতে পারিলেন না। সামান্য খোঁড়ার পেশীশক্তি তাহার মনে কাঁপুনি ধরাইয়া দিলো।
গাড়ী আবার চলিতে শুরু করিয়াছে। মাথার টুপিখানা দু হাতে ঠিকঠাক করিয়া বসাইলেন মাওলানা রজতুদ্দি। কিছুকাল আগেও লোকে তাহাকে ডাকিতো ‘বয়রা রজত’। তারও কিছুকাল আগে ডাকিতো ‘রজত রাজাকার’। সত্যই, নামে কিবা আসে যায়??
#ওসিরিস
মন্তব্য
সাধু ভাষায় চমৎকার এক রম্য রচনা করেছেন! শেষটাও করেছেন চমৎকার ভাবে।
খুব ভালো লাগলো।
________________________________________________
সামনে যদি যাবি ওরে, থাক-না পিছন পিছে পড়ে।
ধন্যবাদ কষ্টকরে পড়ার জন্য। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
#ওসিরিস
মহাশয়,
আপনার রচনাটি ব্যাপক হাস্যরসাত্বক হইয়াছে বটে কিন্তু একদন্ড ভাবিয়া দেখিলেই
ইহাতে বর্তমান চিত্র ভাসিয়া উঠে।
বিচিত্র এই দেশের চিত্র আপনার কিবোর্ডো লহরী তুলুক।
অধমের শুভেচ্ছা জানিবেন।
সত্যি বলতে, একটা সিরিয়াস থিম নিয়েই লিখতে বসেছিলাম। এটা যে ঠিক কিভাবে রম্য হয়ে গেল পরে বুঝি নাই। অন্তর্নিহিত ভাবটুকু একদন্ড ভেবে দেখেছেন তাই ধন্যবাদ। সেটাই চাইছিলাম।
#ওসিরিস
যথেষ্ট ভালো হয়েছে রে। বিশেষ করে ভাষার ব্যবহার।...
বনফুলোফোবিয়া !!
গপ্পো
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
হে হে...ধন্যবাদ।
আরে ফোবিয়া হবে কেন?? ওটা তো ভয়। বল "বনফুলোফিলিক" [এটা বলার পর আমি দুবার কাঁধ ঝাকিয়ে, নাক উঁচিয়ে ভাব নিব। তুমি নিশ্চিত কর, ইশতি ভাই কিছু দেখেন নাই।]
#ওসিরিস
আহেম...
...উঁহু, হবেনা, চোখ বন্ধ... চোখ বন্ধ...
#ওসিরিস
চিন্তা, বলার ধরন, ইত্যাদি চমৎকার। তবে, আরেকটু সময় ও মাংস যোগ করলে একেবারে ক্লাসিক হতে পারতো। ট্রানজিশনগুলো আরেকটু ধীরে করা যেতো, কিছু আপাত-অপ্রাসঙ্গিক তথ্য ও অণুঘটনা যোগ করা যেতো। সেগুলোয় কাহিনীর চেয়ে অলংকার বাড়তো বেশি। সম্ভাবনা দেখলাম দেখে বলে গেলাম।
অনেক ধন্যবাদ ইশতি ভাই। ভবিষ্যতে নিশ্চয় এগুলো মাথায় রাখার চেষ্টা করব।
#ওসিরিস
ভালো গল্প হলো গরম গরম চা খাওয়ার মতো। চুমুকে চুমুকে সুখ। একটু সুখ দিয়ে সেটা হজম ও উপভোগ করার জন্য কিছু সময় দিতে হবে পাঠককে। পাঠক সেই চুমুকটা গিলতে গিলতেই কাপ উঠে যাবে মুখের কাছে। পাঠককে অতিব্যস্তও রাখা যাবে না, অলসও রাখা যাবে না।
শেষ দিকে এসে এসে পাঠক দ্বিধায় থাকবেন। চায়ের সুখে খেতে ইচ্ছা করবে, আবার শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাপ নামিয়ে রাখতেও মন চাইবে না। সুখ ও অতৃপ্তির এই মিশেলই গল্পের সার্থক হয়ে ওঠা।
এই কাপের চা মজাদার ছিলো, কিন্তু তা যেন একবারে ঢেলে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে পাঠকের গলা দিয়ে। "অণুগল্প" একটা নতুন চল, কিন্তু এটা অনেক সম্ভাবনাময় গল্পকে নষ্ট করে দেয়। এই গল্পটাই "গল্প" হিসেবে লিখলে দুর্দান্ত হতো।
পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনার পুরো মন্তব্যটা আগাগোরা তিনবার পড়লাম। সম্ভবত পরের প্রতিটি গল্প লেখার আগে একবার করে এসে এই মন্তব্য আবার পড়ব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
#ওসিরিস
খুব ভালো লাগলো গল্পটা।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ...
#ওসিরিস
ব্যাপক হইসে রে ভাই।
এত রসাত্নক বর্ণনাভঙ্গিতে গল্পের মূল বিষয়বস্তুটা আরো বেশি আঘাত করলো যেন।
---------------------------------
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?!
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
রসাত্মক বর্ণনায় মূল বিষয়বস্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি তাহলে? ওটাই স্বার্থকতা।
#ওসিরিস
ভাল হইয়াছে।
অতীব আনন্দ লাভ করিয়াছি।
- লোকটার পরিচয় বের হয়ে গেছে আগেই। তারপরেও যথেষ্ট উপভোগ্য হয়েছে। ইশতির নির্দেশনা নিঃসন্দেহে ভালো। তবে সেক্ষেত্রে সেটা আর অণুগল্প নাও থাকতে পারে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সবচেয়ে বড় কথা, এই লেখা গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট......
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
#ওসিরিস
অনভ্যস্ততার কারণে সাধু ভাষায় পড়তে কষ্ট হয়। লেখাটা কিন্তু পুরোপুরি সাধু ভাষাতেও হয়নি। মিশ্রণ আছে মনে হলো। এছাড়া বেশ ভালো লাগল। লেখার ধরনটা সুন্দর।
আরো লিখুন।
ইচ্ছা করেই করা। ডায়লগ গুলো মূলত। এছাড়াও কিছু জায়গায় সাধুর চেয়ে চলিতই মনে হচ্ছিলো ভালো মানাবে।
ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগলো।
#ওসিরিস
আসলেই নামে কীবা আসে যায়!
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ......
লেখাটি ভালো লেগেছে। আরও আসুক এমন লেখা। তবে ইশতির মন্তব্যের সাথে আমিও একমত।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ধন্যবাদ ভাইয়া......ভবিষ্যতে নিশ্চয় এগুলো মাথায় রাখার চেষ্টা করবো।
#ওসিরিস
ভালো লেগেছে আপনার লেখাটি। আরও লিখুন
ধন্যবাদ মামুন ভাই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
রেটিং করতে পারলে ৫ তারা দিতাম।
জুহের, ঢাকা
নতুন মন্তব্য করুন