হোঁচট খেয়ে পরতে গিয়েও পরলো না লোকটা। ঠিক হোঁচট খাওয়াও না। একজন সুস্থ সবল মানুষের মত হোঁচট খাওয়া নয়। অসুস্থ একজন মানুষের হোঁচট খাওয়া। লোকটি অনেক কষ্টে আবারো হাঁটা শুরু করল। প্রতিটি কদম যেন কয়েক যুগ পরে পরছে। অনেক কষ্টে নিজের দেহটাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলেছে লোকটা। কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ সে অনুভব করল তার পায়ের নিচে মাটি নেই। তারপরে শুরু হল দীর্ঘ পতন। তার মনে হল সে পরছেই পরছে। অথচ মাত্র আড়াই ফুট নিচে পতনের সমাপ্তি ঘটল। উপর দিকে তাকাতেই দেখল সূর্যটা যেন ঠিক তার মাথার উপর ভেসে আছে। সূর্যের অসহ্য তাপ সে অনুভব করতে পারছে। মনে হচ্ছে যেন এখনই পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পরবে। গরু-ছাগল খেদানোর মত করে হাতটা সামান্য ঝাঁকালো লোকটি যেন এতেই সূর্যটা গায়েব হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক মন মত ঝাঁকাতে পারলো না। হঠাৎ করেই চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসলো। পরমুহুর্তেই ধপ করে একটা আলো জ্বলে উঠলো। লোকটি দেখলো এক ভদ্রলোক হাস্যোজ্জ্বল মুখে চেয়ে আছে তার দিকে। লোকটি ভদ্রলোকের পোশাক দেখেই বুঝতে পারল তিনি একজন ডাক্তার। ডাক্তার ভদ্রলোক হাসি মুখে বললেন -
"Congratulations !! আপনি বাবা হয়েছেন"।
পরক্ষনেই ভদ্রলোক নাই হয়ে গেলেন। সেই ভদ্রলোকের জায়গায় এবার দেখা গেল একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটির কাছে এই ভদ্রমহিলাকে অতিপরিচিত মনে হল। ভদ্রমহিলাম চোখে মুখ থেকে আনন্দ যেন ঠিকরে পরছে। ভদ্রমহিলা লোকটিকে বললেন -
"তোর মেয়েটা ঠিক যেন চাঁদের টুকরো। মাশাল্লাহ!"।
এবার ভদ্রমহিলাও নাই হয়ে গেলেন। তার জায়গায় আবার সেই ডাক্তার ভদ্রলোক। এবার ডাক্তার ভদ্রলোকের চোখে মুখে হাসির জায়গায় বিষাদ ঘিরে আছে।
"জুয়েল সাহেব আপনার জন্য একটা দুঃখের সংবাদ আছে..........."।
লোকটার অনেক ইচ্ছে হচ্ছিল দুঃখের সংবাদটা শুনতে কিন্তু ডাক্তার সাহেব মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে গেছেন। লোকটা বুঝতে পারল সে দিবা স্বপ্ন দেখছে। এই স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। স্বপ্ন দেখার স্থানের কোন ঠিক নেই। যে কোন সময় যে কোন জায়গায় এই স্বপ্ন হানা দেয়। আর স্বপ্ন একটাই ঘুরে ফিরে দেখে সে। স্বপ্নের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার বলা কথাগুলো কোনটাই বাস্তব নয়। লোকটার বিয়ে হয়েছে মাত্র ৩ মাস সুতরাং এখনই বাচ্চা হবার কোন সম্ভাবনা নেই। আর ডাক্তার সাহেব লোকটাকে জুয়েল নামে সম্বোধন করেছে কিন্তু তার নাম জুয়েল না। জরুরী কিছু একটা মনে পড়ছে না লোকটির। বিষয়টা মনে করার অনেক চেষ্টা করল সে। কিন্তু লাভ হল না কোন। তখনই লোকটা গুন গুন করে একটা শব্দ শুনল। আরে এটাতো মৌমাছির শব্দ! লোকটি দ্রুত চোখ মেলতে চাইল। সে কখনও মৌমাছি দেখেনি। বইয়ে পড়েছে মৌমাছি গুন গুন শব্দ করে। কিন্তু চোখ মেলতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট করেই চোখ মেলে উপর দিকে তাকালো লোকটা। দেখল সূর্যের চারিদিক গোলাকার কি সব যেন ঘিরে রেখেছে। আরেকটু স্পষ্ট হতেই দেখল গোলাকার বস্তু গুলো মানুষের মাথা। আর গুন গুন শব্দটা ছিল লোকগুলোর কথা বলার শব্দ। কেউ একজন বলল -
"একটা সিএনজি ডাকেন ভাই। ওনারে মেডিকেলে নিতে হবে"।
লোকটির অনেক ঘুম পাচ্ছে। চেষ্টা করছে জেগে থাকার। কিন্তু আর পারল না। ঘুমিয়ে পরল।
লোকটি চোখ মেলতেই দেখলো সাদা ধবধবে একটা রুমে শুয়ে আছে। তার প্রথমেই মনে পড়ল কোন একটা বইয়ে সে পড়েছিল নায়কের হাসপাতলে জ্ঞান ফেরার চারিদিকে সাদা রং দেখার পর ভেবেছিল সে স্বর্গে আছে। লোকটিরও খুব ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে যে সে স্বর্গে আছে। আবার হঠাৎ মনে হল সে তো এমন কোন বই পড়েনি যেখানে নায়ক এই ধরণের চিন্তা করেছিল। তাহলে তার মাথায় এই কথা আসল কেন? ভাবতে ভাবতেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আবার আলো জ্বলে উঠলো। একটা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা চ্যাংরা টাইপের ছেলে লোকটির দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এক পর্যায়ে বলল -
"ওই বেটা তুই এখনো বর্ন আইডেন্টিটি শেষ করোছ নাই?"
সাথে সাথে আরেক লোক হাজির। এই লোক একটু মাই ডিয়ার টাইপের। মুখে হাসি হাসি ভাব।
"তোমার কাছে নাকি অনেক মাসুদ রানার বই আছে?"
হঠাৎ করে এই লোকটাও হাওয়া হয়ে গেল। কে যেন অনেক দূর থেকে তাকে ডাকছে -
"সজীব এই সজীব, সজীইইইইইব"
লোকটা চোখ খুলে দেখলো একটা মেয়ে খুব মায়া ভরা চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। লোকটা মেয়েটিকে চিনতে পারল। এটা তৃষ্ণা। তার স্ত্রী। তৃষ্ণা বলল -
"সজীব তুমি কি আবার ওই স্বপ্ন দেখেছিলে?"
সজীব মুখে কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়ালো।
"ঠিক আছে তুমি বিশ্রাম নাও আমি ডাক্তার সাহেবের সাথে আলাপ করে আসি"। বলে তৃষ্ণা চলে গেল।
হঠাৎ করে সজীবের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে এই ঘটনাটি তখন মনে করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মনে পরেনি। এখন মনে পরেছে।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটা লোক সজীবের পথ আগলে দাঁড়ালো।
"আরে জুয়েল ভাই না!!!!! আপনি এইখানে? আর আমরা সবাই আপনাকে কত জায়গায় না খুঁজেছি!!"
"ভাই আপনি ভুল করছেন। আমার নাম জুয়েল না। আমি সজীব"
"কি বলেন ভাই? আপনার নাম তো জুয়েল। আপনি আমাকে চিনতে পারেন নাই? আমি সুমন। আর তোতলা সুমন। আপনাদের দোয়ায় আমার তোতলামি সেরে গেছে"।
"দেখেন ভাই আপনি ভুল করছেন। আমি তোতলা সুমন নামে কাউকে চিনি না। আপনি বোধহয় অন্য কাউকে খুঁজছেন"।
"আরে না ভাই আমি নিশ্চিত আপনি জুয়েল ভাই। আপনার কপালের কাঁটা দাগটা দেখে আরো নিশ্চিত হয়েছি। মনে আছে জাহাঙ্গীরের সাথে মারামারি করে মাথা ফাটিয়েছিলেন?"
"উফ!! ভাই বিরক্ত করবেন না তো। আমার রাস্তা ছাড়েন দেরী হয়ে যাচ্ছে।"
"জুয়েল ভাই আসলেই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? কি বলছেন এসব!! আপনার মেয়েটা মাশাল্লাহ পরীর মত হয়েছে দেখতে। তার কথা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন?"।
"ভাই সব কিছুর একটা সীমা আছে। আমার মেয়ে আসবে কোথা থেকে। বিয়ে করেছি মাত্র ২মাস হল"
এখন সজীব অনেকটা অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ওই লোকটা ওকে জুয়েল নামে ডেকেছিল আবার তার স্বপ্নে ডাক্তার সাহেবও ওকে জুয়েল নামে ডেকেছিল। স্বপ্নে তাকে এক ভদ্রমহিলা বলেছে তার মেয়েটা নাকি চাঁদের টুকরো। আর ওই ভদ্রমহিলাকে ওর অনেক অনেক পরিচিত মনে হয়েছিল। আরো একটা ঘটনা আছে। একবার তৃষ্ণাকে নিয়ে জুয়েলারীর দোকানে গেল কানের দুল কিনে দেবার জন্য। তৃষ্ণা এক জোড়া কানের দুল পছন্দ করল কিন্তু সেটা সজীবের পছন্দ হয়নি। সজীবের পছন্দ হয়েছিল অন্য এক জোড়া এবং তার জিদ চাপলো এই জোড়া কানের দুল কিনবে। তখন হঠাৎ দোকানের এক কর্মচারী বলল -
"স্যার কিছুদিন আগেইতো এই রকম এক জোড়া আপনি কিনে নিয়ে গেলেন। আবার এই ডিজাইনেরই নিবেন?"।
শুনে সজীবতো বেকুব বনে গেল!!। তৃষ্ণা সেদিন খুব তড়িঘড়ি করে সেই দোকান থেকে চলে আসলো। সজীব ওই কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না সে কখন কিনেছিল এই কানের দুল জোড়া।
ডাক্তার ইমতিয়াজ উদ্দিন বসে আছেন তার জন্য হাসপাতালে নির্ধারিত কক্ষে। তৃষ্ণা ঢুকে একটা চেয়ারে বসল।
"সজীবের কি তার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে? আপনিতো বলেছিলেন ওর স্মৃতি ফিরে আসার কোন সম্ভাবনাই নেই!!"
"সম্ভাবনা নেই বলিনি বলেছিলাম সম্ভাবনা কম। তবে এই ধরনের রোগীদের স্মতি ফিরে আসার ঘটনা বিরল"।
স্বামীর স্মৃতি ফিরে আসবে এতে তৃষ্ণা'র খুশি হবার কথা কিন্তু ও খুশি হতে পারছে না।
"কিন্তু ওর স্মৃতি ফিরে আসলে যে আমি ওকে হারাবো। আমি ওকে হারাতে চাইনা ডাক্তার সাহেব। এই স্মৃতিহারা মানুষটাকে যে আমি অনেক ভালবাসি"
"ঘাবড়াবেন না প্লিজ। দেখি কি করা যায়। আপনি এখন সজীব সাহেবের পাশে থাকুন। আপনার সঙ্গ দেয়াটা জরুরী"।
হাসপাতালের কেবিনে এসে তৃষ্ণা দেখলো সজীব কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে ওর খুব মায়া হল। সাথে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো।
"তুমি আমার পাশে এস বসো" সজীব বলল
তৃষ্ণা সজীবের পাশে গিয়ে বসল। সজীব লক্ষ্য করল তৃষ্ণা'র চোখে-মুখে কেমন যেন বিষন্ন ভাব।
"তৃষ্ণা আমি ঠিক করেছি এইসব স্বপ্ন নিয়ে আর ভাববো না"।
"কেন?" তৃষ্ণা বলল
"কারণ স্বপ্ন শুধু দূরে নিয়ে যায়। নিজের কাছ থেকে, কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে, কখনও স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দেয় না"।
সজীব দেখলো তৃষ্ণা'র দু'চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পরল। সাথে সাথে ওর চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পরক্ষনেই ধপ করে আলো জ্বলে উঠলো। সজীব দেখলো একটা পরীর মত সুন্দর মেয়ে দু'চোখে মুক্তোর মত জ্বল জ্বলে অশ্রু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
"জুয়েল, এই জুয়েএএএএল। তুমি আমায় ভুলে গেলে। ভুলে গেল আমাদের পরীর মত নিষ্পাপ মেয়েটার কথা!!"
এইটুকু বলেই মেয়েটি মিলিয়ে গেল। সজীব তৃষ্ণা'র চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল- "চাইলেই কি এই স্বপ্ন থেকে দূরে থাকতে পারব? সজীব আর জুয়েলের মাঝে আমি কি আটকে থাকবো সারা জীবন? এসব কি আসলেই স্বপ্ন নাকি পুরানো স্মৃতি?"
মুখে বলল "এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? চোখের জল মুছে ফেলো"।
(সমাপ্ত)
মেঘলা জীবন
মন্তব্য
আপনার লেখার হাত বেশ! গল্পটায় দু'একটা জিনিষ অবশ্য স্পষ্ট নয়, তাও ভালোই লাগলো
আপনাকে ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।
পড়লাম। ভালো লাগছিল; হঠাৎ করে শেষ করে দিলেন। অবশ্য পাঠকদের অতৃপ্ত রাখার ভেতরেও মজা আছে।
আরো লিখবেন।
----------------------------------------------
আমার যত অগোছালো চিন্তাগুলি,
রয়ে যাবে এইখানে অযতনে ।।
এখানেইতো মজা। ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ
লেখার/ গল্পের থিমটা আমার কাছে অবোধ্যই রয়ে গেলো। ...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
তাই নাকি। ভাল লাগল জেনে।
ভালো লাগলো। "এটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড" মুভিটার কথা মনে পড়ে গ্যালো।
"Life happens while we are busy planning it"
তাই? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন