কৃষ্ণপুরের দোতরা বাদক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৩/০৯/২০০৯ - ৯:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কৃষ্ণপুরের দোতরা বাদক
তাপু শিকদার

ভর বর্ষায় স্কুলের পাশের জলমগ্ন মাঠে এসে বিশালাকায় পণ্যবাহী নৌকাটি থামে। মাঝিরা মাস্তুল থেকে পাল গুটাতে শুরু করলে জালাল বেপারি-যে কিনা নৌকার প্রধান কান্ডারি, গলুই লাগোয়া পাটাতনের নিচ থেকে নোঙর টেনে বের করে। দড়িসমেত নোঙরটি পানিকে প্রবল আন্দোলিত করে তলানীতে গেঁথে থাকলে জালাল বেপারি তার সবুজ ফতোয়ার পকেট থেকে পাতার বিড়ি বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে।'কইরে ডিঙি রেডি কর, সৈয়জ্জী ভাইর বাড়িতে যাইতে অইব' বলতেই নৌকার অপর প্রান্তে ছইয়ের নিচ থেকে গলা বাড়ায় কাশেম 'আমি আপনেরে নিয়া বাউলের বাড়িত যামু। তার অনেক গপ শুনছি মহাজন সাব' বৈঠা হাতে বেরিয়ে আসে কাশেম।'ল তাইলে আমার লগে' বেপারি ডিঙির সামনের গুরাতে উঠে বসলে কাশেমও উঠে এবং বন্ধনমুক্ত করে ডিঙি ভাসায়। বৈঠা দিয়ে পানি কেটে কেটে গ্রামের দিকে এগোতে থাকলে বেপারি স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়।

'লোকটার লগে আমার পনর বছর ধইরা চিন-পরিচয়। ভৈরব ঘাট থাইক্যা মেঘনা-কুশিয়ারা উজান বাইয়া এত দূরের পথ কী আর শুধু ইট বেচার লাইগ্যা আসি? মনের একটা টান পইড়া গেছে ওর লাইগা আর এই এলাকাডার লাইগা। তর চাচীত এইবার আমারে আইতে দেয় নাই। জোর কইরা আইছি। কইছি, বয়সতো অনেক অইল, কহন মইরা যামুগা ঠিক নাই, এইবার আমারে নাও নিয়া শেষবারের মত যাইতে দেও কৃষ্ণপুরে। পোলাপাইনগুলাও বড় অইয়া গেছে, হেরাও চায় আমি যাতে দূরে না যাই। হেরা আমারে কয়, আপনের এত দূরে যাওনের কি দরকার? ভৈরব বাজারে আপনের যা আছে তা দিয়া আপনের পোলাপাইন সারা জীবন বইয়া খাইতে পারব। আমি কই, বিশ বছর ধইরা আমার এই কারবার। আর দশ বছর ধইরা প্রত্যেক বছর আমি কৃষ্ণপরে যাই। যাই ইট নিয়া আর আওনের সময় রাণীগঞ্জ থাইকা আমাদের খাওনের লাইগা ময়নাশাইল আর টুপা ধান লই, আজমিরিগঞ্জ, চানপুর আর আবদুল্লাহপুর থাইকা আমাদের দোকানের লাইগা সরিষা কিনি। তেলের ঘানি বসাইছি, মণে মণে সরিষা লাগেনা ? ওরা কয়, এইবার আর কিছুই আইনেন না। আমাদের যা সরিষা লাগে সাপ্লায়ার দিয়া যাইব। কাঠের ঘানিগুলা তুইলা দিয়া এইবার মেশিনের ঘানি লাগামু। তেলের মার্কা রেজিষ্টার কইরা নিছি। নাম দিছি- 'জালালের ফুল মার্কা ১ নং খাঁটি সরিষার তৈল'

বেপারি বিড়িতে শেষ টান দিয়ে পানিতে ফেলে দিলে ডিঙিটা শাপলা বনের ভেতরে প্রবেশ করে। শাপলা বনে বৈঠা ঠেলতে একটু কষ্ট হয় কাশেমের। কিছুটা মন্থর গতিতে ডিঙিটা এগুতে থাকলে বেপারি গুনগুনানি শুরু করে,'নাম জপিলে খোদা মিলে সৈয়জ্জীর আর কী দরকার? কাঠাল দেইখ্যা কী লাভ হইব গাছ লাগাইলে জাম্বুরার' বুজলা, এই গানটা হে বানছিল অনেক বছর আগে। আমার লগে তহনও পরিচয় হয় নাই। যে বছর এই গান বান্দে, সেই বছর শীতকালে তাদের পাশের চাউলধনী গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হইছিল । ঐখানে নাকি এক হুজুর এই এলাকার হুজুরদের চাল-চলন লইয়া খারাপ কতা কয়। হে তহন কওমি মাদ্রাসায় পড়ত। তাগড়া জোয়ান আছিল দেইখা তারে সবাই কয়, ঐ হুজুর যহন এই পথ দিয়া ফিরব তহন আমরা উচিত শিক্ষা দিমু। হে কয়, আমিত খারাপ কিছু কইতে হুনিনাই। উনিতো বড় হুজুর! পানজাবি লম্বা হইব না খাটো হইব এইটা নিয়া কিছু কইলে কী এমন ক্ষতি?ওরা কয়,আমরা যে তরিকা মাদ্রাসায় শিখতাছি হেইটা আসল তরিকা এর পরে আর কিছুই নাই। আমরা যা কই তুমারে তা মানতে হইব, এইটা ওস্তাদজীর নির্দেশ।

সন্ধার পরে যখন ঐ হুজুর এই পথে যাইতেছিল, তহন ওরা হুজুররে ধইরা মাইর দেয়। হুজুর মাইরের চোটে কাতরাইতাছিল আর কইতাছিল, খোদাগো! এদের কে তুমি ধৈর্য শক্তি দেও-তুমিত ধৈর্যশীলদের ভালবাস। এই কথা শুইনা সে তার সাথীদের কয়, অনেক হইছে! তোমরা চইলা যাও এখন। সে হুজুররে কান্ধে কইরা নদীঘাটে নিয়া যায়। মাঝিরে কয়, হুজুররে মেঘাখালি নিয়া সুন্দরমত বাসে তুইলা দিবা। যাওয়ার আগে হুজুর তারে জিগাইছিল, কিসের লাইগা আমার এই অবস্থা করলা? সে কইছিল, আফনে কইছেন আমরা নাকি লম্বা পাঞ্জাবি পইরা কাফড়ের দাম বাড়াইতাছি, এই কথা আমাদের ওস্তাদরা সহ্য করতে পারেনাই। হুজুর কইছিল, কাপড়ে কী আসে যায়, ইসলামের সৌন্দর্য্য মনের মধ্যে ধইরা রাখতে অইব। বাহিরের সৌন্দর্য্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্য্য গুরুত্বপূর্ন। মন আছে বইলাই আমরা মানুষ, নইলে জানোয়ারের সাথে আমাদের কী পার্থক্য? মাঝি নাও ভাসাইয়া দিলে, অনেকক্ষণ সে নদীর পারে বইসা আছিল। সেই রাইতেই সে বাড়ী ছাইড়া ছাতকের অনেক উত্তরে শারফিন টিলায় চইলা যায়।

শাপলাবন পেরিয়ে কাশেম একটি খালে প্রবেশ করলে জালাল বেপারি আবারো একটা বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।'শারফিন টিলায় ছয় মাস কাটাইয়া দোতরা বাজাইতে বাজাইতে যহন সে বাড়ি আইল। চুল-দাড়ি অনেক লম্বা দেইখা বাড়ির মাইনষে তারে কইল বাড়িতে থাকতে অইলে মাইনষের মত থাকতে অইব, আর দশ জনের মত সংসারি অইতে অইব। সে সবার কথা মাইনা নিল। তার এই পরিবর্তন দেইখা তার সমালোচনা শুরু করল তার মাদ্রাসার বন্ধুরা। সে এইগুলারে পাত্তা দেয় না, মায়ের আদেশ মত বিয়া করে দূরের এক গ্রামে। সংসার ধর্ম পালন কইরা যহনই সময় পায়, নদীর পাড়ে বইসা দোতরা বাজায়। অন্যের বান্দা গান গায়, মারেফতি গান-বৈষ্ণব সহজিয়া গান। এই রকম নদীর পাড়ে বইসা বইসা একদিন সে এই গান বান্দে।

সেইবার আমি কৃষ্ণপুরে পরথম আসি। ছোট নৌকা লইয়া আইছিলাম। ইট লইয়া না, মিষ্টি আলু আছিল আমাগো নৌকায়। বৈশাখ মাসের শেষ তহন। গাঙে নয়া পানি নামছে আমরাও চইলা আসছি। মিষ্টি আলু বেইচ্যা বোরো ধান কিনমু। আমগো লোকেরা বাড়িবাড়ি গিয়া মিষ্টি আলু বদলায়া ধান নিয়া আসত। আমি নৌকায় থাইক্কা হিসাব নিকাশ করতাম আর ময়নার বাপে রান্ধাবাড়া করত। ঐদিন সইন্ধা অইয়া গেছে দেইখা আমরা নদীঘাটে নৌকা লাগাইলাম। পারে উইঠা দেখি সৈয়দজী ভাই গান গাইতাছে, এই গানটা । বড়ই ভালা লাগল। আমি আরেকবার এই গানটা গাইতে কইলাম, সে গাইল। আমি কইলাম, আইজ আপনে আমাগো নৌকায় খাইবেনগো বাউল। সে কয়, আমারে বাউল কইয়েন না, ঐটা অনেক সাধনার বিষয়গো বেপারি। আমি বাউলও না আবার পুরা সংসারিও না। এই দোতরাটাই আমার সঙ্গী। যখন মনে টান মারে তখনই দোতরা বাজাই।

কাশেম তালে তালে বৈঠা ঠেলে এগুতে থাকলে বেপারি গলা খাকারি দেয়,' দুই বছর পর আবার আমি যাই কৃষ্ণপুরে। এইবার ইট নিয়া যাই। তার খবর লইতে গ্রামে গিয়া শুনতে পাই সে সিলেটে গেছে শাহজালালের ওরসে, আইজই আইসা পরব। পরের দিন বিয়ান বেলা আমাগো সাক্ষাত হয় নদীর পারে। আমারে জড়ায়ে ধইরা কয়, অনেক খুশি অইলামগো বেপারি, আফনে আমার খবর লইছেন। দেখলাম অনেক শুকাইয়া গেছে,কইলাম,আমি আফনেরে কাম দিতে চাই। সে কয়, আফনের কথা ফালাইতে পারুম না। কী করতে অইব বলেন? আমি কইলাম, আমার ইট আফনে বেইচ্যা দিবেন আর কমিশন পাইবেন। আমি জানছিলাম শীতকালে মাঠের কোণায় সে একটা চায়ের স্টল বসায়। এই আয় দিয়া সংসার চালায়। বর্ষা কালে তেমন আয় রোজগার নাই। ছোট ডিঙি লইয়া হাওরে চইলা যায় মাছ ধরতে। ঘরে খাওনের লাইগা মাছ ধরে বর্শী পাতায়া। ভাবের গান আর দোতারা তো আছেই।

আমার কথায় হে রাজী অইয়া কয়, আফনে নৌকায় থাকেন, আমি আইজই ইট বেচনের ব্যবস্থা করতাছি। সইন্ধা অওনের আগেই আমরা ইটগুলা বেইচা ফালাই। আমি তারে কই, এই সিজনে আরেকবার আমি মাল নিয়া আসমু ,আফনে খরিদদার জোগার কইরেন। সে রাজী হইলে আমি তারে তার পাওনা বুঝাইয়া দেই। দেখলাম সে খুবই খুশি হইছে। এইভাবে সে আমার কারবারের লগে জড়ায়া যায়। আমার লগে সুখ-দুঃখের কথা কয়, মারেফতি কথাও কয়। গত বছর কইছিল হের নাকি আলসার রোগ হইছে। লগে যোগ হইছে নতুন যন্ত্রণা। তার সেই পুরানা বন্ধুগুলা যাগো লগে হে পড়ত, হেরা এখনও তার পিছ ছাড়ে নাই-হেরা এহন গ্রামের মুরুব্বি। হেরা তার নামে কুৎসা রটাইতে থাকে আর হুমকি দেয় মরলে নাকি জানাযা দিবনা। হে লোকের নিন্দনরে পুস্পচন্দন ভাইবা জীবন কাটায়।

ডিঙিটা খালের শেষ প্রান্তে পৌছলে বেপারি কাশেমকে উত্তরের ঘাটে ডিঙি ভিড়াতে বলে। ডিঙি ভিড়লে বেপারি ডাকে, সৈয়জ্জী ভাই আছেন নাকি? কোন উত্তর আসেনা। বেপারি আবারো ডাকে দেয়। ভেতর বাড়ি থেকে দু-তিন জন লোক বের হয়। একজন বেপারি কে চিনতে পারে' আপনের ভাই আর নাইগো বেপারি। কথাটা শুনে মাথায় ঝিম ধরে উঠলে বেপারি দাড়ানো অবস্থা থেকে পরে যায়। লোকজন তাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়া যায়। শীতল পাটিতে বসিয়ে মাথায় পানি ঢাললে সে স্বাভাবিক হয়। বলে, লোকটা বড় ভালা আছিল! শেষবারের মত কৃষ্ণপুরে আইছিলাম শুধু তারে দেখার লাইগা। এই জনমে যহন দেখা অইলনা পরজনমে যেন তার লগে দেখা হয়।
বেপারি কবরটা জিয়ারত করতে চাইলে লোকগুলো বলে উঠে, এই বাড়িতে তারে মাটি দেওয়া হয় নাই। আমাদের পুরান বাড়ির কবরস্তানে তারে মাটি দিছে। বেপারি ধন্ধে পরে যায়, ডিঙিতে উঠে কাশেম দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে- লোকগুলা কি শেষ দিন পর্যন্তও তার পিছনে লাইগা আছিল?
-----------------------------


মন্তব্য

তাপু শিকদার [অতিথি] এর ছবি

আমি বোধহয় সচলে অচল মাল। ২৮ জন পাঠক পদধূলি দিলেন নাকি লাথি দিয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না। জানতে বড় ইচ্ছা হয়।

নিবিড় এর ছবি

সচলে কেউ অচল মাল না। এমনিতেই অতিথি লেখকরা একটু কম পাঠক পায় তার উপর রোজার সময় দেখবেন লেখা গুলোর গড় হিটের পরিমান কমে গেছে। লিখতে লিখতে আস্তে আস্তে একটা পাঠক গোষ্ঠী গড়ে উঠবে তখন দেখবেন গল্প লিখলে হিট ২৯ এর জায়গায় ২২৯ হবে হাসি আর একদিনেই আর এক লেখায় কি সব যাচাই করা যায়


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

রানা মেহের এর ছবি

পরেরবার সংলাপগুলো আলাদা করে দেবেন দয়া করে
পড়তে সুবিধা হয়
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

হঠাৎ মনে হলো এই গল্পটা খূঁজে বের করে পড়ি। কী এক কারণে পড়া হয়নি। গল্পটায় তাড়াহুড়ার ছাপ আছে বলে মনে হল। সেটা খুব খারাপ জিনিস তাও না । তবু . . .
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।