"একজন চিলেকোঠার সেপাইয়ের গল্প"

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৯/২০০৯ - ৯:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট বেলায় “তোমার জীবনের লক্ষ্য” রচনা যতবার-ই লিখেছি প্রতিবারেই লিখেছিলাম ডাক্তার হব। ব্যাকরন বইয়ে ও এই মহৎ পেশাটার অনেক গুন কির্তন পড়ে তখন ধারনা জন্মেছিল এটাই পৃথিবীতে সেরা কাজ। গরিব মানুষের সেবা যত্ন করা হবে। সময় গড়িয়ে যখন সত্যি সত্যি কোন একটা কিছু বেছে নিতে হল তখন কন্সট্রাকশন কোম্পানীর মালিকের ছেলে হয়ে জন্মানোর পাপের শাস্তি স্বরূপ আমাকে বুয়েটেই ভর্তি হতে হয়। উল্লেখ্য আমার বাবার কোম্পানী চালাতে গিয়ে আমার মোটামুটি টেন্ডারের হিসাব কিতাব সব এতটায় নাগালের ভেতর যে আমি মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ার পর ওসিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে ডিজাইন নিয়ে তর্ক জুড়ে দিতে পারি। তারা ও আমার কথা শুনে তাজ্জব। মাঝে মাঝে সন্দেহ করে , “বুয়েটের মেকানিকালে কি সিভিল ও পড়ায় নাকি”? চিরকাল ডাক্তারের কাছে দৌড়ানো থেকে মুক্তির জন্য মা চাচ্ছিলেন আমি যেন ডাক্তার হই , যেহেতু ডিক্টেটর স্বামীর সাথে তিনি পেড়ে উঠলেন না তাই এই বার তিনি কোমড় বেধেঁ লেগেছেন বাড়ির বউকে অবশ্যয় ডাক্তার হতে হবে।

আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দিয়ে কোচিং নামক স্কুলে ঝাঁকের কৈয়ের মতো এসে ঢাকায় ভর্তি হয়েছি। কিন্তু লেখা পড়া করতে ভাল লাগেনা, খালি আড্ডা দিতে মন চাইত। উপর আলাও দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। পরিবারের মানুষ শিক্ষিত না হওয়ায় বাইরের বই তখন পড়া হয় নাই খুব একটা, তাই তর্কে হারিয়ে দিতে পাড়তাম না, মাঝে মাঝেই ভুল কথা বলার জন্য গালি খাইতাম । মোহাম্মদ পুর থেকে হাজী মকবুলের পেটোয়া বাহিনীর হাতে দাবরানি খেয়ে উঠলাম ইস্কাটনে। এখানে আইসা দেখি পিচ্চি হান্নানের এলাকা। তাও আবার আমার ফ্ল্যাটের নিচেই তার ফ্ল্যাট। আগেই বলেছি আমি বড়লোকের পোলা, আমার বাপে আমারে ঐ কয় মাসে এতো টাকা দিছে যে আমি ঢাকায় একটা ফ্লাট নিয়ে থাকতে পারি, তাই বন্ধুদের আড্ডার প্রিয় জায়গা, বড় ভাইদের রুম ডেটিং এর স্বর্গ হয়ে উঠে আমার বাড়ি। আস্তে আস্তে আমাদের আড্ডা শামীল হলো তাপস (কলেজ বন্ধু), রুহুল তাপস(সাপ্তাহিক ২০০০ এর সাংবাদিক), ভারত ফেরত চট্টগ্রামের নিশাত ভাই, এবং ঢাকা ভার্সিটির বিবিএ এর অনেক গুলো বড় ভাই। তাদের তুলনাই আমার বাস্তব জ্ঞান তখন শুন্যের কোঠায়। আমার জ্ঞান বাড়তে লাগলো অনেক ভাবে, বিকেল হইলেই চলে যেতাম বাংলা মোটরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে , যেনো একটা অজানা জগতকে আবিস্কার করছি। দেশকে জানা হল, দেশের মানুষকে জানা হলো, স্বাধীনতার অর্থ বুঝলাম নতুন করে , স্বাধীনতার শত্রুদের চিনলাম নতুন করে। রুহুল তাপস ভাই সেই সময় ২৫ এ মার্চ এর কালো রাতের উপর বানানো বাংলা ডকুমেন্টারী “সেই রাতের কথা বলতে এসেছি” এর জন্য অনেক কাজ করছেন। কিন্তু কাউসার আহমেদ চৌধুরী তাকে খরচার টাকা দেয়না বলে গালাগালি করতোঃ)। কিন্তু কোনদিন দেখলাম না এই মানুষটা কাউসার আহমেদ চৌধুরী ডাকা মাত্র যায় নাই। আমরা বলতাম টাকা দেয়না যখন কাজে ইস্তেফা দিয়ে দেন, তিনি বলতেন কাজটা খুব ভালো হইতেছে, অনেক বড় কাজ হচ্ছে। দেশের অনেক উপকারে আসবে এই কাজ একদিন।

আমি তখন বুঝতাম না আসলে কি বানাচ্ছেন তারা, আমাদের দেশে এটা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ অশিক্ষিত, তাই তাদের সন্তানরা দেশের জন্মটার কোন ইতিহাস জানবে না এটা বোঝবার জন্য কেতাব পড়তে হয়না । আর শিক্ষিত বাবা মায়ের সময় কোথায় সন্তানদের এই দেশটার জন্মের ইতিহাস শিক্ষা দেবার। তারা স্কুলে দিয়েই খালাস।

“সেই রাতের কথা বলতে এসেছি” দেখবার জন্য গেলাম পাবলিক লাইব্রেরীতে। রুহুল ভাইয়ের কাছের মানুষ হওয়ার কল্যানে ফ্রী পাস, আমিতো মহা খুশি। দেখলাম কাঁদলাম, অভিভূত হলাম...গালাগালি করলাম পাকিস্তানীদের। বুঝলাম তাপস ভাইয়া কেন টাকা ছাড়া এ কাজ করেছেন। এটা কোন সাধারন ডকুমেন্টারী নয় এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। বুঝলাম কতটা দাম দিয়ে কেনা এই দেশ। বাহির হয়ে তাপস ভাইকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসল। বুঝলাম তিনি এখন একটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেলেন। সেদিনের পর থেকে আজ ও ২৫ মার্চের কালো রাতের মার্মান্তিক হত্যাকান্ডের কথা মনে হয়। যুদ্ধ দেখি নাই কিন্তু তার ভয়াবহতা দেখেছিলাম এই ডকুমেন্টারী্তে। অনেক কাছে চলে গেলাম যুদ্ধে নিহত মানুষগুলোর কাছে।

তার কিছুদিন পরই দেখলাম দেশের যুদ্ধ অপরাধীদের ক্ষমতায় চড়ে বসা তাদের, মন্ত্রী হওয়া, দেশের ইতিহাসকে বিকলাংগ করা। হতাশ, ভঙ্গুর আমি যুদ্ধ না করেই। একটা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস চোখের সামনে বদলানো হচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষ কিছুই বলেনা, তারা তাদের সন্তানদের সেই ভুল ইতিহাস শেখানোর জন্য স্কুলে পাঠায়, যেনো কিছুই হয় নাই। আমরা জানি আমাদের মাঝে বিভাজন অনেক, কিন্তু দেশটাতো আমাদের, এ দেশের ইতিহাস আমরা রক্ষা না করলে একদিন যে এ দেশের জন্মের কাহিনীটায় বদলে যাবে, ভুল প্রমানিত হবে অনেকের জীবন দান। দেশের যুদ্ধ অপরাধীদের শাস্তি না হয়ে পুরস্কৃত হতে দেখে আমার আর ইচ্ছে করছিলনা আমি ডাক্তার হব নাকি ইঞ্জিনিয়ার হব ...মনে হচ্ছিল...এত বড় বড় অপরাধ করে এই মানুষগুলো এত নির্ভাবনায় দিন কাটায় কিভাবে, তাদের কি ভয় করেনা? যুদ্ধে সব হারানো কোন মানুষ যেকোন সময় তাদের উপর ঝাপিয়ে পরতে পারে তাদের পাপের সাজা দেবার জন্য। কিন্তু না আজ ও কেউ ঝাপিয়ে পড়েনাই তাদের উপর ফিলিস্তিনীদের মত...তাই মাঝে মাঝে আমার মনে হতো আমি এক জন খুনি হব...খুবই শক্তিবান একজন খুনী...খুঁজে খুঁজে বের করবো সব পাপীদের আর সাজা দেব...দেখিয়ে দেব এই দেশটা শুধুই আমাদের , তারা এখানে আগাছা, তাদের সন্তারা এ দেশের মড়ক ...কিন্তু আজন্ম কাপুরুষ এই মন স্বপ্ন দেখলেও চিলেকোঠার সেপাই হয়ে বসে থাকে। আমি পুরুন করে চলেছি আমার বাবার স্বপ্ন...তার ফার্মের ইঞ্জিনিয়ার...

গরীব
সাউথ কোরিয়া


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

ভালো লেগেছে লেখাটি। অকপট সত্য!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মোস্তফা [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ।

গরীব
সাউথ কোরিয়া

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার জীবনের লক্ষ্য একটাই
এমন একটা চাকরি করা যে চাকরি ঘুমানোর জন্য বেতন দেয়

(এটা ইমানদার লক্ষ্য)

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘর জামাই থাকেন!চোখ টিপি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বস, আর্মি হইয়া যান- নিদেন পক্ষে বিডিয়ার !!
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

কয়েকটা জায়গা ছাড়া লেখাটা বেশ ভালো লেগেছে। চলুক

---------------------------------------------
আয়েশ করে আলসেমীতে ২৩ বছর পার, ভাল্লাগেনা আর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

স্পর্শ এর ছবি

গরীব ভাই আপনার এই লেখাটা খুব ভালো লেগেছে। এটা আমি আমার কয়েক বন্ধুকে পড়াবো। চলুক
আরো লিখুন।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনাকে।

গরীব
সাউথ কোরিয়া

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্য।

অগ্রীম ঈদ মোবারক।

দলছুট।
========
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

লেখাটি ভালো লেগেছে। শুধু বিষয়বস্তুর কারণে নয়, বর্ণনার কারণেও।
আপনার অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানাই। তবে 'চিলেকোঠার সেপাই' উপমাটি আপনার জন্য মানানসই নয়, অন্তত এই পোস্টের পরে তো নয়ই। সবাইকে গিয়ে রাস্তায় মিছিল করতে হবে না, গোলাম আযমদেরকে জুতাপেটা করতে হবে না, সবাইকে নিজের অবস্থানে থেকে এদের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করাও বিরাট একটা কাজ। বিভিন্ন ব্লগ সাইটে, ইয়াহু বা গুগোল গ্রুপে, ফোরামে ফোরামে, উইকিতে সর্বত্রই এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচরণ। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা থেকেই বোঝা যায় এরা ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়াতে বা মানুষকে বিভ্রাণ্ত করাকে কতোটা গুরুত্ব দেয়। আপনি লাইব্রেরিতে বই পড়ে জানছেন, সিরাত সচলে এসে জানছে, অছ্যুৎ বলাই ব্লগ লিখতে এসে এদের সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে - এই কাজগুলোও ফেলনা নয়। সুতরাং হতাশ হবেন না। নিজের সামর্থ্যকে ম্যাক্সিমাইজ করুন। নিজের আয়ত্বের মধ্যে ইতিহাসবিকৃতিকে প্রতিহত করুন।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

চেষ্টা করছি। আসা করছি পারব।

গরীব
সাউথ কোরিয়া

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখছেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।