**
এখান থেকে আকাশের খুব ছোট্র একটা অংশ চোখে পড়ে। ফোকরটাকে সোজা সোজা তিনটা দাগ টানা একটা চৌদ্দ ইঞ্চি টিভির মতো মনে হয়। সেখানে দু তিনটা মেঘ দিব্যি এটে যায়। সোনালী আলো যখন দাগ টানা একটা চৌকো টানেল বানায় উল্টোদিকের দেয়ালে তখন সে টানেলের পাশে বসে সিগারেট খেতে বেশ লাগে, বিশেষ করে ধোঁয়াগুলো যখন কুন্ডলী পাকিয়ে ট্রেন ধরার ব্যাস্ততায় গল্গল করে টানেল এর এক মাথা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এক সময় মনে হতো ধোয়া হলে বেশ হয়!
সে অনেক আগের কথা। তার পর দীর্ঘ সময় স্বপ্ন দেখেছি “রাষ্ট্রপতির বিশেষ পরিদর্শনে কয়েদীর আচার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে সাধারন ক্ষমা” পর্বের। তারপর শেষ হয়েছে “ভুল করে রাস্তায় খিলখিল হাসি দেয়ার অপরাধে তন্বী অষ্টাদশীকে শত শত সেল পেরিয়ে এই সেলে ঢুকিয়ে দেয়া” পর্বের। এভাবে কেটে গেছে দিন, যা গড়িয়েছে মাসে, মাস, যা গড়িয়েছে বছরে। তারপর আস্তে আস্তে সব স্থবির হয়েছে।
সকাল বিকেল খাবার দিয়ে যায়। খাই, কেনো খাই সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই খাই এবং বেঁচে থাকি, এবং বেঁচে থাকি, এবং বেঁচে থাকি।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে হ্রতপিন্ডের শব্দ যখন “আফ্রিকার গভীর অরন্যে উন্মাদ ড্রামবাদকের লয়ের মতো ধীর থেকে আস্তে আস্তে গতি পেতে থাকে” তখন নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে সন্দেহ জেগে ওঠে। ধড়ফড় করে ওঠে শরীরে হাত দিয়ে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করি। নীরব নিস্তব্ধতা জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে বিশাল অজগরের শিকার ধরার ভঙ্গীতে। এ সময় বহুদূরে সেন্ট্রীর বুটের ঠক ঠক শব্দ বেশ আস্ব্যস্ত্ করে আমায়। সমস্যা হচ্ছে এর পরপর ক্লান্ত লাগে, মরুতে পথ হারানো পথিকের মতো প্রচন্ড ক্লান্ত লাগে ।
এমন এক রাতে আমার পরিচয় “নীল” এর সাথে। হঠাত করে চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি গলে ঢুকে পড়ে নীল। কিছুক্ষন উড়া উড়ি করে শান্ত হয়ে দাড়ায় সে ফোকরে। আমার খুব চমতকার লাগে, “সীমাহিন সমুদ্রে রাতের অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলে গর্বিত একচোখা জলদস্যুর মতো” তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটি। নিজের অজান্তে বলে উঠি, “বাহ বেশতো!!... কেমন আছো তুমি?”।
“ভালো” গম্ভীর গলায় বলে উঠে সে।
(আমার বেশ অবাক লাগে। সত্যি বলতে কী আমি নিজেও আশা করিনি যে একটা পাখি আমার সাথে কথা বলবে!কিন্তু ভালোও লাগে।)
“তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছো?”
“আমি নীল। এসেছি নীলগ্রাম থেকে। এসেছি আমার এক বন্ধুর পক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে”
“কে সে?”
“তার নাম নীলিমা। তোমায় বলতে বলেছে, সে তোমাকে ভালোবাসে”
আমি চমকে উঠি। আমতা আমতা করে বলি, “কিন্তু...”
“সে তাও তোমায় ভালোবাসে” গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় নীল।
“বেশ। তবে তুমি তাকে বোলো, আমিও তাকে খুব ভালোবাসি এবং বাসবো”
এরপর দীর্ঘ দিন অল্প অল্প বিরতিতে নীল আসে, ফোকরে দাঁড়ায়। আমাকে নীলিমার গল্প বলে। তার হেসে মুখ লুকানোর গল্প, বৃষ্টিতে দুহাত ছড়িয়ে ভেজার গল্প, ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে বাতাসে চুল উড়িয়ে খিলখিল করে হাসার গল্প, জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আমার দূঃখে কাঁদার গল্প, আমায় ভালোবাসার গল্প। আমাদের সময় কেটে যায় হাসি, কান্না, কপট রাগ, দূঃখ, অভিমান আর বহুবিধ অনুভূতির মৃদু স্রোতে। হঠাত একদিন আমার এ দীর্ঘ বন্দীদশা অসহ্য লাগে। প্রচন্ড রাগ লাগে নীলিমার উপর, ওর অনুপস্থিতির উপর। তারপর দীর্ঘদিন নীল আসেনা কোনো সংবাদ নিয়ে। যখন আসে তখন ওর মুখটা এতো শুকনো লাগে কেনো?!!! তবে কী সে আর আমায় ভালো বাসেনা?............
**
কাশিমপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপার বেশ বিরক্তি বোধ করেন। সেন্ট্রী এবং আশেপাশের সেলের কয়েদীদের জবানবন্দী তাকে কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয় না। তিনি তার দীর্ঘ ২৩ বছরের কর্মজীবনে মুক্তির ১ মাস আগে কোনো কয়েদীকে আত্মহত্যা করতে দেখেননি অথবা এরকম কিছু শোনেনওনি। তিনি ভেবেই পান না একজন মানসিক রোগী কী করে সবার সাথে ভালো ব্যাবহার করে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে ৬ টি বছর! অসন্তুষ্ট চেহারায় তিনি লিখতে বসেন, “............ সকলের ভাষ্য মতে এই সিদ্ধান্ত্যে উপণীত হওয়া যায় যে......... দীর্ঘ সময় ধরেই কয়েদী মস্তিষ্কবিকৃতিতে ভুগছিলো। অনেকেই তাকে বিনা কারনে হাসতে অথবা কাঁদতে দেখেছে।............”
জেল সুপার নিজেও নিশ্চিত নন এ জিনিস উপরওয়ালারা খাবে কীনা।
****
ঃ তোমার গল্প শেষ?!!
ঃ ...
ঃ আমি মনে করলাম কোনো পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে!
ঃ ............
ঃ আচ্ছা, সত্যি কথা বলি। রাগ কোরো না। তুমি এরকম গল্পের একটা সমগ্র করো। “আধুনিক কালের রূপকথা”। (হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ে) তুমি এসব হেচোকি পেচোকি লিখে কেনো সময় নষ্ট করো তাই বুঝি না ।
ঃ.........
ঃ আমার অনেক সময় নষ্ট করলে। এখন এটা উসুল করবো। এতো সেজে গুজে এলাম তোমার জন্য আর তুমি আমায় এমন একটা রূপকথা পড়তে বসিয়ে দিলে!!! আদর করো (আদেশের সুরে)।
ঃ............(একটা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করে, এক চোখ একটু ছোট করে, বাঁকা হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে হয়। আস্তে আস্তে ব্লাউজের বোতামে হাত দেই, খুলতে থাকি।)
ঃ (গভীর গলায়) তোমার বোধহয় নীল রঙ খুব পছন্দ। সারা গল্প জুড়ে শুধু নীল আর নীল। আপুনা লন্ডন থেকে আমায় একটা নীল ব্রা পাঠিয়েছে। ওটা কাল পড়ে এলে তুমি আমায় আর বাসায় যেতেই দেবে না।
ঃ......... (আমাকে খুশীতে গদগদ হতে হয়!!)।
(রাকিব সুলতান)
মন্তব্য
গল্পের প্রথম অংশের সাথে দ্বিতীয় অংশের কোথায় যেন ব্লেন্ডিংয়ে একটু ঘাপলা আছে
থিমটা বেশ জমাট লাগলো
লীলেনদা'র কি বলতে চাইছিলেন প্রথম দুই অংশের সাথে শেষ অংশের ব্লেণ্ডিং না থাকার কথা? তাহলে আপনার সাথে একমত।
আমি প্রথমে বলতে চাচ্ছিলাম, গল্পটা প্রথম দুই অংশের পর শেষ হয়ে গেলেই ভালো হতো। পরে মনে হলো তাহলে তো গল্পটা একটা সাধারণ পরিচিত ভালো গল্প হয়ে যেত। তৃতীয় অংশ একটা হতে পারতো, গল্পটাকে বা লেখাটাকে নতুন মাত্রা দেবার জন্য। তবে এভাবে হবার তাৎপর্যটা বুঝিনি। কেমন হলে ভালো হতো তাও বলতে পারছি না, আমি তো আর গল্পকার না
আপনার লেখা আগে দেখিনি। সচলে স্বাগতম।
বেশ ভালো লাগলো... সচলে স্বাগতম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
স্বাগতম ।
**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
গল্পের প্রথম অংশটুকুই ভালো লাগলো শুধু, সুন্দর অলঙ্করণ।
শেষ পর্বের সাথে সংযোগ করতে পারিনাই বলে হয়তো বুঝলামনা গল্পটা পুরোপুরি।
পড়লাম। নূতন কিছু ছিল শুরুতে, শেষে এসে একটু হতাশ হলাম। বুঝতে পারিনি শেষটা।
তবে আপনার শব্দের অলংকরণ অসাধারণ। উপমাও খুব ভাল। চালিয়ে যান, ভালো করবেন ইনশাল্লাহ।
অগ্রীম ঈদ মোবারক।
দলছুট।
========
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।
আপনাদের সবাইকে অসংখ্য আপনাদের মন্তব্যের জন্য। আমি সমালোচনামূলক মন্তব্যই বেশী পছন্দ করবো তাই ভুল বুঝবেন না। আন্তরিক ভাবেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডজার লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনঃ
আসুন প্যাচাল পাড়ার স্বার্থে পুরো গল্পটিকে দু ভাগে ভাগ করে নেই।
স্বপ্নঃ প্রথম দুটি অংশ
বাস্তবঃ শেষ অংশ
প্রথম অংশে দেখানো হয় একজন মানুষের স্বপ্ন এবং তা পুরনের ব্যার্থতায় মৃত্যু। পুরো অংশটিকে বলা যায় "স্বপ্নের গূরূত্ব"। এ কারনেই এখানে প্রশ্নহীন আনুগত্য সম্ভব কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটি স্বপ্ন(অযৌক্তিক) তাই তার শেষ থাকতে হবে।
এবং এ কারনে পাঠক কে আসতে হবে বাস্তবে। যা যথেষ্ট সাদাকালো। আপনাকে চাহিদা পূরন করতে হবে। কামের সাথে নীল মেশানোর অপরাধ ক্ষমা করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটাকে বলা যায় স্বপ্নভংগ।
তাই আপনি যদি হঠাত করে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে এসে বিরক্ত হয়ে থাকেন তবে বলতে হবে আমি সফল। গল্প লেখা স্বার্থক। কারন ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি স্বপ্নভংগ একটি প্রচন্ড বিরক্তিকর ব্যাপার।
ডিসক্লেইমারঃ
* মানুষ সুখী হয় প্রশ্নহীন সমর্পনে।(এ কারনেই ধর্মের প্রবর্তন এবং এ কারনেই মানুষ প্রেমে পড়ে)।
* একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,
"Discovering something isn't FUN, Fun is the way/ process you go through to do it"
সুখী হওয়ার অন্য উপায়। যে কারনে মানুষ প্রেম করে।
মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে স্বপ্ন প্রয়োজন।
পৃথিবী যদি একটি অসীম দ্বিমাত্রিক উলম্ব তল হয়, তবে পেরেক ঠুকে ঠুকে উপরে উঠতে উঠতে নির্দিষ্ট সময় পর পর পেছন ফিরে দাত দেখিয়ে ছবি তুলে, আবার পেরেক ঠুকে ঠুকে উপরে ওঠাটাই যদি মানুষের নিয়তি হয়, তাহলে এ তথ্যটি জানা থাকায় কোনো ব্যাক্তির একটি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক বিকারে ভোগাটাই স্বাভাবিক একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পরে। যা মানুষের জন্য "নীটশে" এর পরিনতি ডেকে আনবে।
গল্প লেখা আমার জন্য একধরনের "Quest"। আমার লেখায় ঘুরেফিরে এ বিষয় আবারো আসবে। আমি হয়তো হাজার খানেক চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করবো। আমি নিয়মিত বিরতিতে লিখে যাবো। আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে কিছু বলে যাবার। যদি বলে যান "Bullshit গল্প"। সে জন্য আমি রাগ করবো না এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি। খুশীই হবো যদি নির্দিষ্ট করে বলে যান ঠিক কী কারনে তা তাই। এ লেখা দেয়ার পর অনেকক্ষন কোনো মন্তব্য পাইনি যা নিয়ে যথেষ্ট মর্মপীড়ায় ভুগেছি। এখন বুঝতে পারলাম ব্যাপারটি পাঠকরা বুঝে উঠতে পারেননি। তাই এই ডিসক্লেইমারের আগমন।
সরল স্বীকারোক্তিঃ
গল্পকে একটা "শুধু গল্প" হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সে হিসেবে আমার ধারনা প্রথম দু অংশের সাথে তৃতীয় অংশের সামঞ্জস্য ছিলোনা।এজ়ায়গাটুকু আমার জন্য বেশ সমস্যাসংকুল ছিলো। মেশানোটা আরো অনেক চতুর হওয়া উচিত ছিলো। সমস্যা হচ্ছে আমি এক বসায় লেখা শেষ করতে না পারলে তা আর কখনোই শেষ করতে পারি না। যে কারনে শেষের দিকে ধৈর্য্য থাকেনা। এছাড়াও আমার লেখা প্রকাশ করে অভ্যস্ত নই। আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। পরবর্তীতে আমি এ ব্যাপারে আরো কঠোর দৃষ্টি রাখবো। ধন্যবাদ সবাইকে।
নতুন মন্তব্য করুন