লেখকে আমার বড়ো বিশ্বাস। কালো হরফে [এখানেই বুঝে নেয়া যেতে পারে ডিসকোর্স কিভাবে কাজ করে, লেখা বলতে আমরা চিহ্নিত করেছি এই শব্দযুগলকে, এও লেখকদেরই অবদান, ধন্যি ধন্যি] তিনি পৃথিবী গড়তে পারেন, সেই পৃথিবী আপনার – আমার, কিন্তু অন্যরকম। দেখেও যা আমরা দেখিনা কিংবা আমাদের দেখতে দেয়া হয়না কিংবা দেখলে ভালো হয় তা তিনি আমাদের দেখানোর ক্ষমতা রাখেন।
পুজিবাদের অন্তপর্যায়ে আছি আমরা। আর এ পর্যায়ে পুঁজিবাদের সবচেয়ে চালু পণ্য, বাস্তবতা বহির্ভূত এক মিথ্যা বাস্তবতা - যা কেবল আপনারই সেবায় পেশ করছে বহুজাতিক ফেরিওয়ালারা। আর এই মিথ্যা বাস্তবতাই দখল করে নিচ্ছে আপনার বাস্তবতাকে। তাই প্রয়োজন একজন লেখক – যিনি ইতিহাস প্রবাহে আপনার অবস্থানটি দেখিয়ে দেবেন, আপনার স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার পটভূমি থেকে আপনার বিচ্যুতি নির্দেশ করবেন এবং সর্বোপরি আপনাকে দেবেন একটি অবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী হওয়ার অনুভূতি। আত্মপরিচয়বিহীন পণ্যভূতপূজক মতান্তরে আত্মাবিহীন সচল লাশ [ইংরেজিতে যাকে জম্বি বলে] হওয়া থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারেন অথবা রক্ষা পাওয়ার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন এমনই একজন লেখক।
সোমেন চন্দ – এমন এক ঢাকায় বাস করতেন যা আজকের পরিস্থিতিতে কেবল কল্পনাতেই সম্ভব বলে মনে হয়। দেশবিভাগের আগের সেই ঢাকা যার ছিল হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ছিল আলাদা করার মত সংস্কৃতি । ধর্মের ভিত্তিতে নির্ধারিত সীমানার একটি অবহেলিত অংশের কেন্দ্র নয়, যেখানে অতীতের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলার নিয়মতান্ত্রিক চেষ্টা চালানো হয়েছে।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সোমেন পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন, বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। রাজনীতির কলুষ বিবর্জিত পরম শিল্পের হঠকারিতা তার মধ্যে ছিলনা। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবেই রাজনীতি চলে আসে তার লেখায়। নিত্যদিনের ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে তিনি অবলীলায় দেখিয়ে দেন শাসনযন্ত্রের কুটিল চালপ্রয়োগ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার সুক্ষ্ম জাল। চেতনাকে এক ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয় তার সরল শব্দগুলো – ভাবতে বাধ্য করে। আত্মপরিচয় খোঁজার প্রয়াসে অনুপ্রাণিত করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা পতনের কিছু পরেই বিশ্বমঞ্চে তার আবির্ভাব। আনাঙ্খাকিত মৃত্যু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়ে অস্তপ্রায় ব্রিটিশ উপনিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটির বাসিন্দা সোমেন তাই আঞ্চলিক সমস্যা যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণের একটি উপাত্ত তা বলতে পারেন নির্দ্বিধায়। আর তাইতো একটি রাত গল্পের সনাতনী মা ছেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ বুঝে নিতে বই খুলে বসেন। দাঙ্গা গল্পে দুই ভাইয়ের আদর্শগত বিরোধের মধ্য দিয়ে রূপক আকারে বেরিয়ে আসে উপনিবেশবাদের শেষ ছোবল জাতিগত বিভেদের ভয়াবহ চেহারাটি। ইঁদুর গল্পের ইঁদুরগুলো যেন দারিদ্রেরই কিলবিলে রূপ যা একদন্ড শান্তিতে থাকতে দেয়না ক্রমাগত শ্রেণীস্বাতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে রত নিম্ন মধ্যবিত্তদের। নিরেট প্রেমের গল্প রাত্রিশেষ এও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে শ্রেণীসংঘাত যা থেকে মুক্ত নয় আপাত সংস্কারত্যাগী বৈষ্ণবরাও।
সোমেন শহুরে মানুষের কথা বলেন – যারা রাষ্ট্রদেবতার মন্দিরের কাছাকাছি থাকেন, যারা বিশ্ব মানচিত্রে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান সম্পর্কে বেশ সচেতনই বলা চলে, যারা দেখতে পায় কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে “আমাদের চারিদকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহারণ, খাদ্যের অভাবে, শিক্ষার অভাবে কুতসিত ব্যারামের ছড়াছড়ি, মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারিদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস, কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ, তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ”[গল্প - অকল্পিত]। তিনি গাঁয়ের কথা বলেন যেখানে “পঁচিশ বছর আগের পুরুষরা একদিন আকাশের দিকে চাহিয়া নিরুপায়ে কাঁদিয়াছে, তার বংশধরেরা আজও কাঁদিতেছে। তাহাদের চোখ-মুখ ফুলিয়া গেল”[গল্প – প্রত্যাবর্তন]। সোমেন মুক্তির কথা বলেন, আত্মউপলব্ধিতেই যার মন্ত্র সুপ্ত।
ফ্যাসিবাদী শক্তির অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ানোয় সোমেনের রক্তে লাল হয় ঢাকার রাজপথ। ১৯৪২ এর ৮ মার্চ ফ্যাসিবিরোধী মিছিলে নেতৃত্বদানকারী সোমেনকে ভোজালির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়। ২২ বছরের সোমেন চন্দ ইতিহাস হয়ে যান।
রালফ্ ফক্সের নাম শুনেছো?
শুনেছো কডওয়েল আর কনফোর্ডের নাম?
ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জান?
এই বীর শহিদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল,
সবুজ জলপাই বন হলো লাল,
মার – বুক হল খালি –
তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন।
চলো, আমরাও যাই ওদের রক্তের পরশ নিতে,
ওই রক্ত দিয়ে লিখে যাই
শুভদিনের সংগীত।
সোমেনের ছন্দোবদ্ধ আদর্শই হয়ে দাঁড়ায় তার ভবিষ্যত। তবে সেই শুভদিন আজও আসেনি। আজ কালো হরফগুলো ব্যাক্তিসর্বস্বতায় দুষ্ট। বহুর সম্মিলিত বোধ আজ আর অনিষ্টের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় না। বিচ্ছিন্ন বাস্তবতার বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিটি সত্ত্বা। সবার চোখেমুখে এক অদ্ভূত নিস্পৃহতার ঘোর। এমন সময় সোমেনের মত ঘুমভাঙানিয়ারই প্রয়োজন বোধ করি।
পরিশিষ্ট
সোমেন চন্দের জন্ম ১৯২০ সালের ২৪ মে। আদিবাস ঢাকার নরসিংদি জেলার বালিয়া গ্রামে। পিতা নরেন্দ্রকুমার চন্দ ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকাল স্কুল ও হাসপাতালের স্টোরস বিভাগে চাকুরিরত থাকার সুবাদে ঢাকায়ই সোমেনের বেড়ে ওঠা। ১৯৩৭ এ প্রত্যক্ষভাবে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কম্যুনিস্ট পাঠচক্রের সম্মুখ প্রতিষ্ঠান প্রগতি পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্বলাভ করেন। প্রগতি লেখক সংঘেরও প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। সংঘের সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক বৈঠকগুলোতে নিয়মিত লেখা উপস্থাপনের তাগিদ থেকেই তার সাহিত্যচর্চার বিস্তারলাভ। ১৯৪০ এর পর কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের কাজ শুরু করেন। প্রগতি লেখক সংঘের নেতৃত্বে ১৯৪১ এ ঢাকায় তৈরি হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন – সোভিয়েত সৃহৃদ সমিতি। এ সমিতি ১৯৪২ এর ৮ মার্চ ঢাকায় এক সর্বভারতীয় ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলন আহ্বান করে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কিছু দল এ সম্মেলন বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে। পরে রেল শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে সোমেন যখন সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তখন কিছু অস্ত্রধারী দুরাত্মা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ছত্রভঙ্গ মিছিলের মধ্য থেকে তাকে বের করে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
মন্তব্য
সোমেন চন্দের ছোটগল্প কয়েকটা পড়েছি। "ইঁদুর" তো ক্লাসিক।
সোমেন চন্দ নিয়ে লিখেছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ। মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম।একটু দৌড়ের উপরে আছি। আসছি একটু পরে।
ইদুর গল্পটি সত্যিই বাঙালি মধ্যবিত্তের সংকটের প্রাঞ্জল অভিব্যাক্তি
মনামী
ভালো লাগলো লেখাটা।
অফটপিক: বেশ কিছু লেখায় দেখলাম লেখকের নাম নেই। ভালো একটা লেখা পড়লে কে লিখেছে তা জানতে সাধ হয়। এটা ঠেকানোর উপায় কী?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পোস্টের শেষে লেখকের নিবন্ধিত নাম বা নিক উল্লেখ করে দিলে ভালো হয়।
বেখেয়ালে নামটা দিতে ভূলে গেছি। এখন আবার বেহায়ার মত জানিয়ে দিচ্ছি। অধমের নাম মনামী।
ভালো লেখা। পঞ্চতারকা দাগাইলাম।
ব্লগ পরিচিতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অতিথি লেখকরা একটু খেয়াল করে পোস্টের নিচে বা উপরে নিজের নামটাও কম্পোজ করে দিয়ে দিতে আর ভুল কইরেন কেউ । লেখকহীন লেখার কোন প্রমাণপত্র থাকে না।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
অনেক ধন্যবাদ।
মনামী
n.afrin[অ্যাট]live.com
গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। আরো বিস্তারিত হলে, আরো ভালো হত।
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ছবিটা পিকাসোর নাকি? আপনার বর্ণিত লেখকের সত্তাতো এতো খণ্ডিত নয়। (অফটপিক)
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
আপনার অনুমান সঠিক। ছবি পিকাসোর - পোয়েট। আজকের খন্ডিত চেতনার পাঠকদের কাছে লেখক এভাবেই ধরা দেন।
মনামী
n.afrin[অ্যাট]live.com
লেখকেরাও তো আজকাল খন্ডিত চেতনার ধারণ করেন । শুধু পাঠককে দোষ দিয়ে কি লাভ ?
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
গল্প পাঠ যখন শুরু করেছি সেই সময়েই পড়েছিলাম সোমেন চন্দ। এখনও পড়ি। সেই লেখককে নিয়ে লিখলেন আপনি। মনামী, আপনাকে ধন্যবাদ।
আমার প্রায়ই মনে হয়, নিজেদের নিয়ে আমরা বড় বেশি উদাসী। তাই সিলভিয়া প্লাথ কিংবা মায়কোভস্কির অকাল প্রয়ানে আমরা দুঃখবোধ করি। তাঁরা বেঁচে থাকলে কি করতে পারতেন সেটা আলোচনা করি। কিন্তু সেভাবে আলোচনা হয় না সোমেন চন্দকে নিয়ে। আলোচনা হয় আবুল হাসান কিঙবা রুদ্র কবিকে নিয়ে।
আমরা একবারো বলি না, যে ইদুর এর মতো গল্প লিখলো, পরিণত বয়েসে সে কি করতে পারতো, আমরা একবারও হুতাশা করি না, পরিণত হাসান চিবুকের লাবন্য নিয়ে আর কি বলতে পারতেন সেটা নিয়ে আমাদের কোন ভাবনা নেই।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
প্রথম যখন পড়াশোনা শুরু করলাম সে সময় অনেকটা বাছ বিচারহীন বই পড়েছি গোগ্রাসে।তার মধ্যে যে কটি ভালো বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার মধ্যে সোমেন চন্দের গল্প অন্যতম।তাঁর 'ইঁদুর" তো অসাধারণ এবং সাড়াজাগানো।সোমেন চন্দকে নিয়ে ভুদিন পর আপনার লেখা পড়লাম।খুব ভালো লাগলো।
আপনাকে শুভেচ্ছা।
তমিজ উদদীন লোদী
সোমেন চন্দের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয়। পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রকাশিত গল্পগুচ্ছটি [যেখানে সোমেনের ২৫ টি গল্প রয়েছে] হাতে আসার পর প্রথমেই যে বিষয়টি আমাকে আকৃষ্ট করে সেটি হলো তার আড়ম্বরহীণ, সাবলীল কথনভঙ্গি। সুগঠিত প্লট এর ধার ধারেননি তিনি। নিজের অভিব্যাক্তিটা জানিয়ে দেয়াই যেন মুখ্য। অর্ধ শতকেরও বেশ খানিকটা বেশি সময় আগে সোমেন মধ্যবিত্তের যে অন্তর্দন্দ ফুটিয়ে তুলেছেন অনুভব করেছি এ কথা আমিও বলতে চেয়েছি। ২২ বছরে তিনি যা রেখে গেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে সবসময়।
ইঁদুর গল্পটা পড়েছি প্রথমে, তারপর আর দু’একটা গল্প, কোনো সাহিত্য সাময়িকীতে, নামটা ঠিক মনে নেই। প্রথম গল্পটা পড়েই যে প্রবল আগ্রহ আর মুগ্ধতা বোধ করেছি, তা অনেক লেখকের গল্প/উপন্যাসে করিনি। কিন্তু এরপর আর পড়া হয়নি। এই লেখকের লেখা বইপত্রের দোকানে খুঁজবো ভেবেও ধীরে ধীরে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার লেখা আবার মনে করিয়ে দিলো। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
নতুন মন্তব্য করুন