বাংলাদেশে আগে দীর্ঘ সময় ধরে সন্তানের ক্ষেত্রে একক অভিভাবকত্বের বিষয়টি চালু ছিলো। নিয়ম ছিলো অফিসিয়ালি সন্তান পরিচিত হবে পিতার নামে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি এমনই হয়ে গিয়েছিলো যে, মা সন্তানের ধাত্রী মাত্র, সন্তান শুধূই পিতার। সন্তানের আইনগত অভিভাবক হিসেবে মায়ের কোন স্বীকৃতি ছিলোনা। অন্যান্য উৎপাদন ক্ষেত্রের মতো এই ক্ষেত্রেও নারী বঞ্চিত ছিলো প্রত্যক্ষ উৎপাদকের উপর তার অধিকার থেকে। আওয়ামীলীগের শাসনের প্রথম আমলে( ১৯৯৬-২০০১) সরকার এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের পরিবর্তন করেন। সন্তানের উপর নারীর অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করার জন্য সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে অফিসিয়াল সমস্ত কাগজ পত্রে পিতার সঙ্গে মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করে। বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক ছিলো। এর মাধ্যমে অন্তত সন্তানের অভিভাবকত্বের প্রশ্নে নারী-পুরষের সমতার বিষয়টি জোরালো হয়।
গত মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারেননি। তাঁর ‘অপরাধ’ পিতৃপরিচয় না জানায় নবম শ্রেণীর নিবন্ধন ফর্মে সে তার বাবার নাম উব্লেখ করেনি। কিন্তু শিক্ষা বোর্ড মেয়েটিকে পরীক্ষার ফরম সঠিক ভাবে পূরণ না করার অপরাধে এস এস সি পরীক্ষা দিতে দেয়নি।
এ পরিপেক্ষিতে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় এই বিষয়ে ব্যরিষ্টার সারা হোসেন আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত শিক্ষা মন্ত্রনালযের সচিব, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ দেশের সব শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে এই বিষয়ে কারন দর্শাতে বলেছেন। এর সঙ্গে রুলে নবম ও একাদশ শ্রেণীর নিবন্ধন ও পরীক্ষা দেয়ার ফরম সংশোধন করে, মা ও বাবা উভয়ের নাম বাধ্যতামূলক না রেখে মা, বাবা অথবা আইনগত অভিভাবকের একজনের নাম লেখার সুযোগ রেথে ফর্ম তৈরি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কেন নেওয়া হবেনা তা জানতে চাওয়া হয়।
পিতৃপরিচয় যখন একজন সন্তান জানেনা তার মানে হলো সন্তানের জন্মের পর থেকে সেই সন্তানের বাবা সে সন্তানের কোন দায়িত্ব পালন করেনি, কিংবা করতে চাননি। এমনকি সন্তান হিসেবে তাকে সামাজিকভাবে স্বীকারও করতে চায়নি, কিংবা জন্মদাতা ‘বিশেষভাবে ক্ষমতাবান’ হওয়াতে এবং সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণ করতে অসীকৃত হওয়াতে তার মার পক্ষে সেই সন্তানের কাছে পিতৃপরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সেটি প্রকাশিত হলে হয়তো মা এবং সন্তান আরও বিপদে পড়তো। আমাদের সমাজে এই ধরনের ঘটনার কথাতো আমরা প্রায় সময়ই পত্রিকায় পড়ে থাকি। এইসব ক্ষেত্রে সন্তানের জন্মদাতা কিছুতেই বৈধ অভিভাবক হতে পারে না , পারা উচিতও নয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে চোখ বন্ধ করে বলাই যায় যে, ইচ্ছা করে কেউ পিতার নাম না লেখার কোনো কারন নেই। তাই সাদা চোখেই বলা যায় সঙ্গত কারনে পিতার নামের জায়গা খালি থাকেতে পারে। আমরা যদি ধরোই নিই পূরণ করা ফর্মটি মেশিনের মাধ্যমে পাঠ করা হয়. সেই খালি ঘরটি যদি মেশিনে পাঠের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, তাহলে সেই নিয়মটি কিংবা মেশিনে পাঠযোগ্য করার মতো ফর্ম তৈরি করবে, তাই বলেতো কারো পরীক্ষা দেওয়া কিংবা পড়াশোনা করার অধিকার কেড়ে নিতে পারেনা। বৈধ অভিভাবকের ঘরে দেয়ায় কিংবা পিতৃ পরিচয় না পাওয়ায় তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবেনা, এটি কেমন কথা! কোন আইনের মধ্য দিয়ে, কার পরামর্শে শিক্ষা বোর্ড এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিলো সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন ছিলো। এই বিষয়ে যদি সুনির্দিস্ট আইন না থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে এই পরীক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পরীক্ষা না নেয়ার মতো সিদ্ধান্ত হলো ? যে পরীক্ষার্থী এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার আগ পর্যন্ত পিতৃপরিচয় বাদেই পড়াশোনা করতে পেরেছে, যে সন্তান ১৬ বছর পর্যন্ত তার পিতা কে জানেনা, তাকে কখনও দেখেনি, হঠাৎ করে তার পিতৃপরিচয় পরিচয় কেন এতো জরুরী হয়ে উঠলো শিক্ষাবোর্ডের কাছে এবং সেটি না প্রকাশ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হলো। জবাবাদিহিতার পাশাপাশি শিক্ষা জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারার কারনে এই পরীক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয়েছে তার প্রতিদানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড কী ক্ষতিপূরণ দিবে সেই বিষয়ে আলাকেপাত করা উচিৎ্।
যে মা একাই সন্তানকে মানুষ করেছেন, তারই একমাত্র অধকার বৈধ অভিভাবক হবার। কারোই বুঝতে বাকী থাকবার কথা নয় যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এই মাকে কতোটা সামাজিক সংগ্রাম করে এই সন্তানকে বড়ো করতে হয়েছে। তার উপর এই রাষ্ট্রীয় হেনস্থা! তাহলে যে শিশু তার বাবা মায়েরই পরিচয় জানেনা, তাদেরকে অধিকার নেই এদেশে পড়বার? কিংবা যুদ্ধ শিশূদের কথাই যদি বলি, তারা কী পড়াশোনা কিংবা চাকুরী করতে পারবেনা? জৈবিক অভিভাবকের পরিবর্তেও অন্য কারো নামও বৈধ অভিভাবক হিসেবে থাকেত পারে। এর বাইরেও আরও বড় সত্য আছে। পিতা কিংবা মায়ের পরিচয়ের বাইরেও একজন মাুনষের পরিচয় হওয়া উচিৎ সে মানুষের সন্তান। সেই ভিত্তিতে, শুধূ সেই পরিচয়েই পৃথিবীর কাছে, দেশের কাছে একজন মানুষের সকল অধিকার রয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, গত সময়ের অনেকেটা বিশাল অংশ জুড়ে সন্তান শুধূ তার মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই যৌথ অভিভাবকত্বের পরিচয়ের বাইরে একক অভিভাবকত্বের প্রচলন রয়েচে। যেমন আয়ারল্যাণ্ডের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে বহির্তুত সন্তানের ক্ষেত্রে মা-ই একমাত্র আইনগত অভিভাবক। সেক্ষেত্রে শিশুর জন্মদাতা কোনোভাবেই সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবী করতে পারেননা।
এখানে একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন যে, শুধূ একক অভিভাবকত্বের বিষয় থাকলে বাংলাদেশের মতো মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশে সেটির পুরুতান্ত্রিক অনুবাদেই হবে। তাতে বাদ পড়বে মায়ের নাম। এর বাইরে নিয়মটি যদি এই রকম করা যায় যে, ‘বাবা মায়ের নাম বাধ্যতামূলক, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোন একজন কিংবা আইনগত অভিভাবকত্বের নামও চলবে’- তাহলে বোধ হয় অনেকাংশে দূর হবে বৈষম্যের জায়গাটি। আমরা আশা করি অচিরেই এই আইনটির সংশোধন আসবে এবং কোন ব্যক্তিকে আর এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হবে না।
-জোবাইদা নাসরীন
zobaidanasreen অ্যাট জিমেইল ডট কম
মন্তব্য
সচলে স্বাগতম।
লেখার বিষয় ভালো লাগলো - সচলায়তনে স্বাগতম
বাংলাদেশের মেয়েদের আইনগত অধিকার বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের লিগাল স্ট্যাটাস নিয়ে ইদানিংকালে কী হচ্ছে সে বিষয়ে আরো লিখলে খুব ভালো হয়!
ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো।
খুব দরকারি একটা বিষয় নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ
সচলে স্বাগত
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
সচলে স্বাগতম। এমন দরকারী বিষয় নিয়ে আরো লিখুন। ক্যাটেগরীতে "খেলাধুলা" কেন?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মাননীয় মডারেটার, দয়া করে আমার লেখাটি 'খেলাধূলা ' ক্যাটাগরী থেকে জেণ্ডার রাজনীতি বিভাগে পাঠিয়ে দিন।
স্বাগতম । ক্যাটাগরি থেকে 'খেলাধুলা' টা সরিয়ে দেয়ার জন্য মডারেটরকে অনুরোধ করতে পারেন ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
প্রয়োজনীয় পোস্ট...
ক্যাটাগরীতে খেলাধুলা দেখে ভাবলাম 'সেমেনিয়া' টপিক নিয়ে কিছু একটা; তাই পড়তে দেরী হলো...
পিতামাতার উভয়ের নাম ফর্মে পূরণ করাটা ব্যক্তির ঐচ্ছিক বিষয় বলে নির্ধারণ করা উচিৎ ।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
আপনার নাম চেনা চেনা লাগছে, আপনি কি কোন স্কুলে শিক্ষিকা? যদি হয়ে থাকেন, হয়তো আমি আপনার ছাত্র
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। আর আমি মাঝে মাঝে প্রথম আলোতে সম্পাদকীয় পাতায় লিখি।
দরকারি লেখা।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য... আরো লিখুন, সচলে স্বাগতম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খুব ভাল একটা ইস্যু তুলে ধরেছেন।
সচলে স্বাগতম, নিয়মিত লিখুন।
ভীষণ জরুরি একটা বিষয়। খুলে যাক নতুন দ্বার, দূর হোক এই প্রতিবন্ধকতা।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
কেউ যদি বাবার নাম দিতে না চায়, পছন্দ নয় বলে? মা'কে "প্রেফারড গার্জিয়ান" ভাবতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটিকে সম্মান করার ব্যাপারে কি মত? দ্বিতীয়তঃ, অভিভাবকত্ব মূলতঃ অর্থনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা সংজ্ঞায়িত ও লালিত হয়। যেজন্যে বাবা সিংহভাগ পরিবারে শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও অধিকারপ্রাপ্ত হন। অ্যাবিউসের মাত্রাহীনতাও পিতৃত্বের স্বীকৃতি কেড়ে নেয়না, সেটা নেয়া উচিত। মায়েরা যেখানে উপার্জনক্ষম, পরিবারের কর্ত্রী হিসেবে "বাই ডিফল্ট প্যারেন্ট" মা'র হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আইদার অর হলে আপনি যেমনটা বলেছেন, পুরুষক্ষম সমাজে বাবার নাম আসাটা ঠেকানো যাবেনা। সবাই বিল ক্লিনটন নয় যে।
আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষের ব্যক্তি এবং ব্যক্কিত্ব নির্বাচনের যে স্বাধীনতা তাতে সন্মান দেখানো উচিত এবং অভিভাবকত্ব বিষয়টিও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত যার সঙ্গে যুক্ত আছে আর্থিক, মতাদর্শিক এবং আইনগত ক্ষমতা, যা পুরুষের দিকেই যায়।
একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য লাগে... পরিবার কেন পুরুষতান্ত্রিক হয়?
বাচ্চার আগে আমার অন্য একটা প্রশ্ন... বিয়ের পরেই কেন মেয়েদের নাম বদলাতে হবে? আমার নাম নজরুল ইসলাম... আমার বউয়ের নাম নাসমুস সাহার নূপুর...
আমি কোনোভাবে আমার বউয়ের এই নাজমুস সাহার নূপুর নামটার বদল চাই না। বা কেউ মিসেস নূপুর বললে খুবই মাইন্ড খাই...
আগে এই জায়গাটা ঠিক করা দরকার...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পরিবার পুরুষতান্ত্রিক হয়, কেননা পরিবারে পুরুষের পরিচয় আর্থিক আর নারীর পরিচয় নৈতিক। যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের সিদ্ধান্তকেই খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। আর নাম পাল্টানোর কথা বলছেন, সেটিতো একবারেই হওয়া উচিত নয়। বাবার কিংবা স্বামীর নামের অংশ আসলে একই অর্থই বহন করে। অর্থাঃ আমি অমুকের মেয়ে কিংবা স্ত্রী, এটিই আমার পরিচয়, এর বাইরে আমার কোন পরিচয় নেই। এর মধ্য দিয়ে বঞ্চিত হয় মায়ের দাবীও। কেননা তার নাম সন্তানের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকেনা। এভাবেই পুরুষতন্ত্র চর্চিত হয় আমাদের সমাজে।
সচলে স্বাগতম।
খুবই দরকারি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ভবিষ্যতে আর্ও লিখবেন আশা করি।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
নতুন মন্তব্য করুন