জাফলং এ একদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২০/০৯/২০০৯ - ১:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সিলেট শহর থেকে মাত্র ৫৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাফলং-তামাবিল সীমান্ত এলাকা। সিএনজি অটোরিকশায় মাত্র দেড় ঘন্টা সময় লাগে, ভাড়াও কম, সারাদিনে মাত্র আটশ টাকা। সিলেট শহর থেকে সকালে আমরা তিন বন্ধু রওনা হলাম জাফলংয়ের উদ্দেশে। জাফলং পৌঁছার আগেই চোখে পড়লসুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ঝর্ণা। পাহাড়ী ঝর্ণাগুলো সবই পড়েছে ভারতের মধ্যে। তাই কাছে যেতে পারিনি। দূর থেকেই ক্যামেরা বন্দি করলাম সেই পাহাড়ের কান্না। কি আর করা-সুদূরিকারে দূরেই মানায় ভালো।

পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাদা সাদা মেঘের খেলা। মনে পড়লো কবি গুরুও সেই গান ’ তোমার মুক্ত কেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি, তোমার আঁচল জ্বলে আকাশ তলে রৌদ্রবসনী।’ প্রকৃতির এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে যেন পুরো এলাকায়। মাঝেমধ্যে মেঘের কণা এসে ধাক্কা খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়ের গা থেকে বের হচ্ছে শ্বেতশুভ্র ধোঁয়া। পাহাড় আর মেঘের এই মিতালির দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা অসাধ্য। মেঘবালিকার এই অপরূপ দৃশ্যের কারণেই বুঝি এই অঞ্চলের নাম মেঘালয়-মেঘের আলয়।

জাফলং পৌঁছতেই চোখে পড়ল জাফলং নদী। অসংখ্য সিপি নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে নদীর বুকজুড়ে। নদীতে পানির গভীরতা বেশি নয়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে নদীর পানি খুবই শীতল। শীতল পানিতে মুখ ধুতেই দেড় ঘণ্টার ভ্রমণকান্তি দেড় সেকেন্ডেই দূর হয়ে গেল।

নদী থেকে সংগ্রহ করা পাথর খোদাই করে স্থানীয় শিল্পীরা বিক্রির জন্য সাঁজিয়ে রেখেছে বিভিন্ন শিল্পকর্ম। তার ওপরে লাগিয়েছে রং তুলির আঁচড়। তাদের কাঁচা হাতের কাজ দেখে মনে পড়লো প্রাম্য বালিকার সেই গান ’যাও পাখি বল তারে সে যেন ভুলেনা মোরে’। চাইলে পাথরের বুকে নিজের ইচ্ছেমত নাম লিখানো যাবে। প্রতিটা শিল্পকর্মের দাম গড়ে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা।

প্রচণ্ড রোদের মধ্যে নদীর পানিতে ডুব দিয়ে পাথর কুড়াচ্ছে একদল মানুষ। নদীর তলদেশ থেকে ছোট বালতি ভরে তুলে আনছে পাথর। পরে পানিতে ছাঁকনি দিয়ে পরিষ্কার করে পাথর জমা করা হচ্ছে নৌকার মধ্যে। সারা দিনে এভাবে চারজনের একটি দল নাকি দুই নৌকা পাথর কুড়াতে পারে। এখানে প্রতি নৌকা পাথর বিক্রি হয় এক হাজার থেকে এক হাজার দুই টাকায়। এই অঞ্চলের মানুষ এভাবে পাথর কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে যুগ যুগ ধরে। বছরের পর বছর আহরণের পরও পাথর কমেনি এতটুকুও। এ যেন এক আলাদিনের চেরাগ!

জাফলং নদীর প্রশস্ততা খুবই কম। মনে হয় যেন একটু জোরে লাফ দিলেই পার হওয়া সম্ভব। ইঞ্জিনের নৌকা প্রতিনিয়ত দুই পারের যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ভাড়া জনপ্রতি মাত্র তিন টাকা। কোলের বাচ্চা ফ্রি!

জাফলং নদীর কিনার ধরে কিছুটা হাঁটলেই চোখে পড়বে ভারতের মেঘালয় সীমান্তে নদীর ওপর নির্মিত ঝুলন্ত ব্রিজটি। পণ্য বোঝাই ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন পার হচ্ছে এই ব্রিজের ওপর দিয়ে। পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে পাকা রাস্তা।

পাহাড়ের গায়ে শোভা পাচ্ছে ঘরবাড়ি। দৃশ্যমান বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ইটের তৈরি। ফোনের টাওয়ার দেখে বোঝা যায় সেখানে রয়েছে মোবাইল ফোনসহ আধুনিক জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা। সবকিছু দেখে মনে হল ওপারের মানুষের জীবনয়াত্রার মান এপারের থেকে কিছুটা উন্নত।

জাফলং নদীর কিনার থেকে উপরে উঠতেই চোখে পড়ল আমাদের খাসি (খাসিয়া) পুঞ্জি। মাতৃতান্ত্রিক খাসি আদিবাসীরা এখানে বাস করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। খাসিদের ঘরবাড়িগুলো তাদের সনাতন রীতি অনুযায়ী মাটির কিছুটা ওপরে তৈরি, অনেকটা বাঁশের মাচার মতো।

খাসি পরিবারের জীবনযাত্রায়ও বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। ঘরবাড়ি তৈরিতে ঐতিহ্যবাহী নির্মাণশৈলীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি আর ইট-পাথরের সমন্বয়। জাফলংয়ের খাসি পুঞ্জিগুলো অনেকটাই সমতলভূমিতে। জানা গেল, সিলেটের জাফলং ছাড়াও মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে খাসি জনগোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশের খাসিদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম পানচাষ। অনেকে পানের পাশাপাশি সুপারিও চাষ করে থাকে।

জাফলংয়ের সংগ্রাম পুঞ্জি, নকশিয়ার পুঞ্জি ঘুরে ঘুরে দেখলাম খাসি মেয়েরা পান সাজাচ্ছে বাজারে বিক্রির জন্য। ডানে-বাঁয়ে সব জায়গায়ই চোখে পড়ল লম্বা লম্বা গাছে ঝুলে আছে লতার মতো পানগাছ। হঠাৎ চোখে পড়লো অচেনা এক লতা জাতীয় গাছ। স্থানীয় একজন বললো এটা গোলমরিচের গাছ। নিজেরা অবশ্য টেষ্ট করে দেখিনি এটা সত্যিকারের গোলমরিচ কি না। ভয়টা বুঝতেই তো পারছেন- কামড় দেব ওখানে আর জ্বলবে সেখানে। রোদেও প্রখরতা তীব্র হওয়ায় ছবিটা ভালো হয়নি মোটেও।

খাসিপুঞ্জি ঘুরে উপস্থিত হলাম সংগ্রাম পুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) নিরোলা তংসংয়ের বাড়িতে। স্থানীয় বাঙালিদের কাছে যা ‘জমিদার বেটির বাড়ি’ নামে পরিচিত। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দোতলা এই বাড়িতে আধুনিক জীবনযাত্রার সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। দোতলার ড্রয়িংরুমের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে খাসিদের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, শিকার সরঞ্জাম ও অন্য জিনিসপত্রের নমুনা। নিরোলা তাংসাং ও তাঁর স্বামী দেলোয়ার লামি জানালেন খাসিসমাজের অনেক তথ্য। মুগ্ধ করলো তাদের আতিথিয়তা।

বেলা তখন মধ্যদুপুর। দুইটা ছুঁই ছুঁই করছে। দুপুরের খাবার শেষে ছুটলাম তামাবিল সীমান্তে। জাফলং থেকে তামাবিল সীমান্ত মাত্র তিন কিলোমিটার। তামাবিল সীমান্ত পার হলেই শিলং, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। নোম্যানসল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছবি ওঠানোর সময় বারবার মনে পড়ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার অমিত, লাবণ্য আর শিলং পাহাড়ের কথা। মনটা ব্যাকুল হচ্ছিল শিলং পাহাড় ঘুরে দেখার জন্য। কিন্তু এখানে এসেই শুরু হয়ে গেছে ‘সব বাধা ব্যবধান।’ দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারি। একই আলো, একই মাটি, একই বাতাস, একই ভাষা, কান্না হাসি সব একই রকম কিন্তু এরই নাম দেশ অথবা দেশ বিভাগ। যেখানে মানুষের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে পাসপোর্ট আর ভিসার খবরদারি। পথের দূরত্ব খুব সামান্য হলেও রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমানা তৈরি করেছে যোজন যোজন দূরত্ব। বেলা পড়ে এসেছে। ফিরতে হবে ঢাকায়, আবার সেই ইট পাথরের রাজ্যে, ব্যস্ত নাগরিক কোলাহলে। উঠলাম আবার অটোরিক্সায়। মনে মধ্যে বাজতে থাকলো কবি গুরুর গান-
’আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে’

রেনেসাঁ

tareq.mahamudএ্যাটইয়াহুডটকম


মন্তব্য

মৃত্তিকা এর ছবি

জাফলঙের ছবিগুলো ভালোই তুলেছেন।
৯৬ সালে গিয়েছিলাম শুধু জাফলং, অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা সেটা। তারপর ২০০১ এ তামাবিল পার হয়ে খাসিয়াদের বাসে চেপে মেঘালয়! পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার সময় মেঘের স্পর্শ পেয়েছিলাম! মেঘালয়কে আমার স্বর্গ মনে হয়েছিলো সেবার!

রেনেসাঁ [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ মৃত্তিকা। আমি মেঘালয় যাবার জন্য পাগল হয়ে আছি, সময়ের অভাবে যেতে পারছি না। ইচ্ছে আছে এই বছরের যে কোন সময় চলে যাব।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জাফলং আমার অপছন্দ... কয়দিন আগেই সচলে জাফলং বিষয়ে একটা ফটোব্লগ দিছিলাম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দুলাভাই। আর একবার যাবার ইচ্ছে আছে ।

রেনেসাঁ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।