ধূসর কাকতাড়ুয়াটা দাঁড়িয়ে ছিল অনেক দূরের মাঠে, মেঘগুলোর কাছাকাছি।
আমার বা তোমার সেখানটায় যেতে অনেক মাইল দৌড়াতে হবে, কিন্তু দেখো, সে চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, একপায়ে, ঠায়। যেন সে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, তোমার জন্য, কিংবা আমার জন্য, কিংবা কোন একজনের জন্য, কারো দৌড়ে যাবার জন্য। এবং ওর নিষ্পৃহ দাঁড়িয়ে থাকাটা বলে দেয়, তুমি ওর দিকে দৌড়ানো শুরু করলে ও পালিয়ে যাবে না। দু হাত দুপাশে মেলে ঠিক আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে।
ধূসর কাকতাড়ুয়াটার মুখভর্তি ছিল হাসি, আর পেটভর্তি ছিল খড়ের গাদা। ওর জামাটা ছিল একটা বস্তার কাপড় দিয়ে বানানো, আর সেটা ওকে খুব মানিয়েছিল। ওর মুখে ছিল একটা হাড়ি, কিন্তু সে মোটেও হাড়িমুখো ছিল না। ওর মুখে ছিল কালো কালি দিয়ে আঁকা একটা চওড়া একটা হাসি। আর ওর ছিল দুটো বিন্দু চোখ, দেখলে মনে হতো, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দূরে কোথাও, খুব মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করছে.. কিছু একটা ঘটার জন্য।
অনেক দূরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল। কিন্তু আর কিছু ঘটছিল না।
মেঘগুলো একটু একটু করে সরতে শুরু করলে, সব বাতাসগুলো ঢেউ নামিয়ে দিল ধানের ক্ষেতে। ঢেউগুলো যেন ধানের শীষগুলোকে নাচতে শেখালো, আর তারা উঠলো-নামলো সেই স্রোতে যেন তাদের নিজস্ব ইচ্ছা বলে কিছু ছিল না আর। তারপর বাতাসটা সরে গেলো দূরের মাঠে, আর ধানের শীষগুলো একটু স্থির হলো, কিন্তু চুপচাপ হয়ে ঠিক স্থির হয়ে থাকতেও পারলো না, একটু দুলে দুলে অপেক্ষা করতে থাকলো আরেকটা স্রোত বইয়ে যাওয়ার জন্য.. কিন্তু আর কোন বাতাসের স্রোত আসলোই না..
ধূসর কাকতাড়ুয়াটা মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকলো সোনালী শীষগুলোর দিকে.. ওর ফুটো জামার একপাশ দিয়ে বের হয়ে থাকা খড়গুলো একটু একটু নড়ছিল, তাই সে বিশ্বাস করে বসেছিল বাতাসগুলো আবার ফিরে আসবে, শীষগুলোকে ক্ষণিকের জন্য মাটিতে নুইয়ে ফেলার জন্য..
সে চেয়ে ছিল একদৃষ্টিতে, যদিও সেটা ঠিক ওর গল্প ছিল না।
ও দেখতো ঘাসফড়িংদের লাফিয়ে বেড়ানো, এবং সেটাও ঠিক ওর গল্প ছিল না। ওর ঘাসফড়িং শব্দটা খুব ভালো লাগতো, ঘাস-ফ-ড়িং।
হেমন্তের শুরুতে কৃষক এসে ওর সব ধানকে ঘরে তুলে নিয়ে গেলো।
কুকুরটা সেদিনও খুব ঘেউ ঘেউ করছিল দূরে কোথাও..
ঘাসফড়িংটা তখনো লাফাচ্ছিল একা একা খালি শূণ্য মাঠে।
আর ওর দিকে হাসিমুখে চেয়ে ছিল ধূসর কাকতাড়ুয়া.. যদিও সেখানে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকার মতো কিছুই ছিল না.. কারণ ওকে কেও ঘরে নিয়ে যেতে আসেনি। ও ঠিক সেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানটায় দাঁড়িয়ে সে পুরো বছর ধানগাছগুলোর হাওয়া দোলা দেখেছিল, যেখানটায় দাঁড়িয়ে মেঘদের সরে যাওয়া দেখছিল সীমান্ত পেরিয়ে, আর সূর্যটাকে বারবার বারবার ডুবে যেতে দেখছিল। ওর খুব ইচ্ছে করতো উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যের ওঠা দেখতে, কিন্তু কেউ ওর ইচ্ছেটা জানতো না।
ধূসর কাকতাড়ুয়া হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকলো, আর অনেকগুলো দিন, বাতাস এসে ওর পিঠ থেকে বের হয়ে থাকা খড়গুলো উড়িয়ে নিয়ে গেলো, আর সে শুকিয়ে যেতে থাকলো। ওর খুব মন খারাপ লাগতো, কারণ সে কোন কারণ ছাড়া একটা বিশাল প্রান্তরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল, একা একা। কোন কারণ ছাড়া দুপাশে দু হাত মেলে। এবং কেউ আসেনি কখনো ওকে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। মাঝে মাঝে শুধু বাতাসগুলো এসে ওর ছেঁড়া জামাটা ধরে একটু নাড়ানাড়ি করতো, কিন্তু ওর মন ভালো হত না। ওর খারাপ লাগতো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে, কারণ হাসিটা ওর নয় একদমই।
তারপর একদিন, খুব বৃষ্টি হলো সেখানে, আর কাকতাড়ুয়ার খড়গুলো ভিজে ভারী হয়ে খসে পড়লো। তারপর একটা বিশাল ঝড় আসলো সাগর পেরিয়ে, ওর বাঁশের কাঠামোটাও ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলো।
পরের মৌসুমে জমিতে লাঙল দেয়ার সময় কৃষক সেখানে একটা হাড়ি খুঁজে পেলো।
সেটার উপর কোন হাসিমুখ আঁকা ছিল না।
সে কিছুক্ষণ বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, হাতে হাড়িটা নিয়ে, কিন্তু কিছুতেই ঠাহর করতে পারলো না, হাড়িটা সেখানে কিভাবে আসলো।
( ঘাসপোকা )
মন্তব্য
উদ্ধৃতিঃ
"ওর খুব ইচ্ছে করতো উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যের ওঠা দেখতে, কিন্তু কেউ ওর ইচ্ছেটা জানতো না।"
আপনার গল্পটা খুব ভালো লাগলো।
উপমা দিয়ে সাজানো গল্পটা ধারুণ হয়েছে বস।
দলছুট।
===============
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।
ধন্যবাদ!
নতুন মন্তব্য করুন